Click the image to explore all Offers

গল্প।। একা।। অঞ্জনা দেব রায়



 

  একা

অঞ্জনা দেব রায় 


সূর্য ওঠার আগে অলোকবাবু রোজ সকালে মর্নিং ওয়াক করে বাড়ি চলে আসেন । এসেই ফ্রেস হয়ে চা
বসিয়ে দেন। চা খেয়ে বাজারে যান। বাজার থেকে আসার পর রান্নার মাসি এসে সকাল ,দুপুর ও রাতের খাবার বানিয়ে দিয়ে যায়। দোতালা একটা বাড়িতে অলোকবাবু একাই থাকেন । একসময় বউ , ছেলে সবাইমিলে বাড়িতে একসাথে থাকতেন । আজ অলকবাবু একদম একা । একা থাকতে অলোকবাবুর একদম ভাল লাগে না ।
বাংলাদেশ থেকে খুব ছোট বয়সে কলকাতায় এসে অনেক কষ্ট করে লেখাপড়া করে বড় হয়েছেন । লেখাপড়া শেষ করে ব্যঙ্কে চাকরিও পেলেন । ছোটবেলা থেকেই অলকবাবুর কবিতাও গল্প লেখার অভ্যেস ছিল । লেখাপড়া ও ব্যঙ্কে চাকরি করার সাথে সাথে অলোকবাবু তার সাহিত্যচর্চা মানে কবিতা,গল্প,প্রবন্ধ লিখতেন আর সেইসব লেখা বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হত । আবার নিজে পত্রিকা সম্পাদনাও করতেন । এছাড়া অনেক প্রতিভা অলোকবাবুর মধ্যে ছিল । বিয়ে করার খুব একটা ইচ্ছে ছিল না । বাড়ির সবার কথায় বিয়ে করেন । অলোকবাবুর বউ মলি বিয়ের সময় দশ ক্লাস পাশ করা ছিল। অলোকবাবু বউকে এগারো ক্লাস থেকে পড়িয়ে এম. এ পাশ করালেন এবং টিচার দিয়ে গান শিখিয়ে আকাশবাণীতে গান করার সুযোগ করে দিলেন। বিভিন্ন দিক দিয়ে বউকে শিক্ষিত করে বউ এর নামে বাড়িতে স্কুল তৈরি করে দিলেন । সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা হলেন মলি । অলোকবাবু মলিকে নিজের পরিচয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন । যথাসময়ে একটি ছেলেও হয়েছে ওনাদের । ছেলেকে দেখভাল করার জন্য অলকবাবু লোক রেখে দিয়েছিলেন যাতে মলির কোনো অসুবিধে না হয়।
অলোকবাবু মানুষটা খুব সরল ও সাদাসিদে এবং মানুষকে খুব বিশ্বাস করতেন । নিজের বউ মলিকে তো
অন্ধের মতো বিশবাস করতেন ও ভালবাসতেন । কিন্তু মলি অলোকবাবুর অন্ধ বিশ্বাসের অমর্যাদা করে
পাশের বাড়ির এক বিবাহিত পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন । অলোকবাবু বুঝতে পেরে মলিকে অনেক বুঝিয়ে ছিলেন কিন্তু কোন লাভ হয় নি । শুধু অশান্তিই হত । এইভাবে চলতে চলতে ছেলে যখন বারো ক্লাসে পড়ে তখন পাশের বাড়ির বিবাহিত পুরুষটির সাথে মলি চলে গেল একদিন । তখন অলোকবাবু মনে খুব কষ্ট পেলেন ও মহা সমস্যায় পড়লেন । একদিকে চাকরি আর একদিকে ছেলের দায়িত্ব সবকিছু একা সামলাতে হবে এই ভেবে খুব চিন্তায় পড়লেন । কিছুদিন বাদে রান্না করার জন্য ও অনান্য কাজের জন্য দুজন কাজের লোক রাখলেন । তবুও ছেলেকে কিভাবে মানুষ করবেন সেই চিন্তা সবসময় অলকবাবুর মনের মধ্যে ঘুরপাক খেত ।
মলি চলে যাওয়ার এক বছর বাদে আত্মীয়স্বজন ও পাড়া প্রতিবেশীরা অলোকবাবুকে আর একবার বিয়ে
করতে বলেছিলেন কিন্তু অলোকবাবু রাজি হন নি । অলোকবাবু বলেছিলেন আবার বিয়ে করলে ছেলের প্রতি অবহেলা করা হবে । তারপর ছেলে অবশ্য আস্তে আস্তে বারো ক্লাস পাশ করে ইংলিশে অনার্স কমপ্লিট করে । এরপর এম এ ও পিএইচ ডি করে বাঁকুড়ার একটি কলেজে পড়ায় । ছেলে চাকরি পাওয়ার পর অলোকবাবুকে বলেছিল “বাবা আমি এখন চাকরি করছি ,আমাকে নিয়ে তোমার আর কোন চিন্তা করতে হবে না এবার তুমি এমন একজনকে বিয়ে করো যে তোমার সঙ্গী হয়ে তোমাকে দেখভাল করবে এবং বুড়ো বয়সে তোমার পাশে পাশে থাকবে ফলে তোমার কোনো কষ্ট হবে না আর তোমার একা একা লাগবে না।“ কিন্তু অলোকবাবু ছেলেকে বলল “এখন আর এসবের দরকার নেই , তোকে বিয়ে দেবো । বউমা এসে আমার কাছে মেয়ে হয়ে থাকবে আর আমার সাথে গল্প করবে ও আমার দেখভাল করবে ।''

জীবনে অনেক সময় যা ভাবা যায় তা না হয়ে উল্টো হয়ে যায় । কিছুদিন বাদে ছেলের বিয়ে হল তার নিজের পচ্ছন্দের মেয়ের সাথে । বউমাও বাঁকুড়ায় ছেলের কলেজেই পড়ায় । ফলে চাকরির জন্য ছেলে ও বউমা বাঁকুড়ায় থাকে । অলোকবাবুর সাথে প্রতিদিন ফোনে কথা বলে আর কলেজের ছুটি পড়লে বাবার কাছে এসে কিছুদিন থেকে যায় । কিন্তু আস্তে আস্তে নানারকম কাজের অজুহাতে ছেলে বউমার বাড়িতে আসা কমে যায় আর ফোনেও কথা বলা কমে যায় । যে ছেলের জন্য অলোকবাবু দ্বিতীয় বার বিয়ে করেননি আজ সেই ছেলেও এখন বাবাকে ছেড়ে দূরে থাকে । বাড়ির ফাঁকা ঘরগুলো যেন অলোকবাবুর হৃদয়কে শূন্যতায় ভরে তোলে।
সাহিত্যচর্চা ও অন্যান্য কাজের মধ্যে নিজেকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করেন অলোকবাবু কিন্তু কাজের
শেষে ফাঁকা ঘড়গুলোর মধ্যে বিছানায় শুয়ে ভাবতে লাগলেন যে তিনি সবাইকে নিয়ে আনন্দে বাঁচতে
চেয়েছিলেন। ফলে অলোকবাবুর মনের মধ্যে নানান প্রশ্ন জেগে ওঠে। ভাবেন জীবনে সবার জন্য সবকিছু করে কি লাভ হল ? সেই তো তিনি একাই হয়ে গেলেন । অলোকবাবুর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে আর ভাবছেন তার পাশে থাকার কেউ নেই ।খালি ঘরগুলির মধ্যে তিনি এখন শুধু একা ।

------------- 

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.