Click the image to explore all Offers

গল্প ।। ঘ্রানেন অর্ধ ভোজন ।। রণেশ রায়



 


 

ঘ্রানেন অর্ধ ভোজন

 

রণেশ রায়


পরিচয়হীন নাম না জানা এক অখ্যাত মানুষ। কখনো ময়দানে ষ্টেডিয়ামের বাইরে থেকে রেম্পাডে দাঁড়িয়ে খেলা দেখে কখনো রেড রোড ধরে হেঁটে চলে বা তাকে দেখা যায় ভিক্টরিয়া মেমোরিয়াল হলের উঠোনে। সে চরকির মত ঘুরে বেড়ায়। তাকে যেমন কেউ চেনে না সেও কাউকে চেনে না। যেন এক মুসাফির। থাকা খাওয়া পোশাক কিছুরই ঠিক নেই। বিশেষ কেউ জানে না তার বাড়ী কোথায়, সে কেন এ ভাবে ঘুরে বেড়ায়। আর সবাই যারা রাস্তায় বের হয় তাদের কাজ আছে, আছে  বাড়ী ফেরার তাগাদা। প্রতিটি মুহূর্ত তাদের কাছে দামী। তবে এই চরকিবাবুর অবাধ সময় তাই তার কাছে সময়ের দাম শূন্য। নেই কিছুর জন্য ভাবনা তাই ব্যস্ততাও নেই। তাও তার তাড়া। কোন এক জায়গায় বেশিক্ষণ থাকা নয়। একজায়গায় পৌছেই অন্য কোথাও যাবার তাগিদ। তবে কোথায় কেন সে জানে না। 


একদিন তাকে দেখা যায় এসপ্লেনেডএ একটা নামকরা খাবারের দোকানের সামনে উবু হয়ে বসে থাকতে। যেন কোন কারণে সে কষ্ট পাচ্ছে। আজ তার এখান থেকে সরার লক্ষণ নেই। এখানেই যেন তার স্থায়ী আশ্রয় সে খুঁজে পেয়েছে। সারা জীবন ঘুরে ঘুরে একটা আশ্রয় পেয়েছে। রাস্তার ওপর ওরই মত কোন আশ্রয় ছাড়া নেহাৎ অবহেলায় বেড়ে উঠেছে বটগাছটা। সে এখানে গত একশো বছরের অসংখ্য ঘটনার সাক্ষী। সেই ইংরেজ আমল থেকে।দেশের স্বাধীনতার জন্য কত মানুষের কত ব্যস্ততা।কত মানুষের অআত্মত্যাগ।  তারপর পালাবদল। সাদা মানুষরা অঞ্চল ছেড়ে চলে গেছে। কালো মানুষের এখন চলাফেরা। তাদের সঙ্গেই এখন ভাব। আর ঘরছাড়া এই চরকি  বুড়োদের জন্য ছায়া বিছিয়ে দেওয়াই তার কাজ। তাদের আশ্রয় এই বুড়ো বটগাছ। তারাই যে  একান্ত আত্মীয়। আমি যে মানুষটার কথা বলছিলাম যে আমার আজের লক্ষ্যবস্তু সে এই বটতলায় উবু হয়ে বসে আছে। কোন দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই।


হন হন করে এক ভদ্রলোক হেটে যাচ্ছেন। মনে হচ্ছে পরিচিত। যেন ছবিতে দেখেছি। আপাত দৃষ্টিতে ভদ্রলোকের কোনদিকে দৃষ্টি নেই মনে হলেও তার প্রখর দৃষ্টি। চরকি বাবুকে আমি ছাড়া আর কেউ না হলেও উনি দেখেছেন। উনার বসে থাকা গোত্রহীন মানুষটার দিকে নজর পড়ে। কাছে গিয়ে বলেন কি হোল আপনি যে এ ভাবে বসে? কি ভাবছেন? চরকিবাবু বোবা চোখে তাকিয়ে। ভাবে তাকে দেখেন এমন মানুষ পৃথিবীতে আছে নাকি ! এত আন্তরিকতার সঙ্গে কেউ তো তাকে কেমন আছ বলে প্রশ্ন করে না। সে একটু অস্বস্তি বোধ করে। ভদ্রলোক কাছে এসে হাত বাড়িয়ে বলেন, " উঠে আসুন। চলুন"।  চরকিবাবু যেন নির্বাক, বাকশক্তি হারা। কোন কথা না বলে উনার হাত ধরে উঠে দাঁড়ান। ভদ্রলোক উনাকে ধরে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে যান। উনার কাঁধে ভর  করে হাঁটা শুরু করেন । কিসের ঘোরে যেন চরকিবাবু আচ্ছন্ন। বেশ কিছুক্ষণ হেঁটে উনি ভদ্রলোকের সঙ্গে একটা অফিসঘরে ঢোকেন। উনাকে সামনে বসিয়ে বেয়ারাকে জল আনতে বলেন ভদ্রলোক। তারপর দুজনের আলাপ পরিচয়। 


চরকি বাবু অবাক হয়ে বলেন, " আচ্ছা আপনি কি আমাকে চেনেন? আমি ঠিক ঠাওর করতে পাচ্ছি না। তবে মনে হচ্ছে কোথায় যেন আমিও আপনাকে দেখেছি?"


''আরে এই অঞ্চলে যাতায়াত করে এমন লোক কে আছে  যে আপনাকে চেনে না? মনে করে দেখুন বেশ কয়েক বছর আগে খেলার মাঠে একটা গোলমাল হয়।মাউন্টেন পুলিশের তাড়া খেয়ে আপনি দৌড়াতে শুরু করেন। আমিও। এই ময়দান মার্কেটের সামনে এসে আপনি পড়ে যান। ওখানে দোকানদাররা যাদের সঙ্গে আপনার রংগরসিকতা গল্প বলা তারা  আপনাকে তুলে সেবা যত্ন করে । আমি আপনাকে নিয়ে গিয়ে মানিকতলার বাড়ীতে পৌঁছে দিই। কি মনে পড়ে?''


আলাপ পরিচয়ের মধ্যে আগন্তুক ভদ্রলোক বলেন: " আপনি কি অসুস্থ? আমি ঘণ্টা চারেক

আগে অফিসে আসার সময় আপনাকে ওখানে দেখি। এখনও  একই ভাবে বসে। 


চরকি বাবু অবাক হন।বলেন, " অসুস্থ হব কেন? বরং আমি তো ভাবছিলাম আপনিই অসুস্থ। তা নইলে আমার খবর নেবেন কেন। আমার খবর নেওয়া তো কোন সুস্থ মানুষের কাজ না।" বলে চরকি বাবুর হাসি। ভদ্রলোক তখন বলেন " আচ্ছা চক্রবর্তী বাবু আপনি ওভাবে উপুড় হয়ে বসেছিলেন কেন? আমি তো জানি আপনি হেঁটে বেড়ান, ঘুরে বেড়াতেই পছন্দ করেন।" চক্রবর্তী বাবু বোঝেন ধরা পড়ে গেছেন । উনি বলেন " গাঙ্গুলি শোন তবে তোমাকে বলি। ওই খাবার দোকানের খাবারের গন্ধ আমাকে মাতাল করে দিয়েছিল। সে গন্ধের আবেশে আমি বসে পড়ি।উঠতে পাচ্ছিলাম না। দোকানের ভেতরে গিয়ে আশা মেটাব তার মুরোদ নেই। তাই প্রাণ ভরে ঘ্রাণ নিচ্ছিলাম। জানেন তো ঘ্রাণেন অর্ধ ভোজনও। আর অর্ধ ভোজন বলে পেট ভরাতে সময় লাগছিল। এই যা।" গাঙ্গুলি বাবুর এবার হাসির পালা। উনি চরকিবাবু তথা চক্রবর্তিবাবুর হাত ধরে বাইরে এসে বলেন, "  আপনার কাছে যা পাবার পাওয়া হয়ে গেছে। কাল কাগজটা পাঠিয়ে দেব। কলকাতা করচার কলমে দেখে নেবেন। আর আপনার প্রাপ্য সামান্য কিছু থাকবে যাতে ঘ্রাণে  ভোজন না করতে হয় কালকে।

-------------------------

 ছবি ঋণ- ইন্টারনেট 
    ----------------

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.