গুনগুনকে কে যেন পেছন থেকে ডাকল । গুনগুনের সাথে ওর বন্ধু অভিনন্দন ছিল । ওরা মাস্টারমশাই অমরপালের কাছ থেকে গান শিখে টালিগঞ্জ মেট্রো স্টেশনে টিকিট কেটে ট্রেন ধরার জন্য স্টেশনে ঢুকছিল। অভিনন্দন গুনগুনকে বলল মনে হয় তোর নাম ধরে কেউ ডাকছে । গুনগুন পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখল রজত । রজতকে দেখে গুনগুন একটু অবাক হল । রজত হচ্ছে কবি, গল্পকার, তবে ওর লেখা দুটো উপন্যাস খুব জনপ্রিয় হয়েছিল । রজতকে দেখে গুনগুন দাঁড়িয়ে পড়ল। আসলে রজত ও গুনগুন কলেজে একসাথে পড়ত । প্রায় দশবছর বাদে দেখা হল । রজত গুনগুনের থেকে দুবছরের বড় । একসময় দুজনের মধ্যে খুব বন্ধুত্ব ছিল । গুনগুনের গান শুনতে রজত খুব ভালভাসত আর রজতের লেখা কবিতার থেকেও গল্প পড়তে গুনগুন বেশি ভালবাসত । গুনগুন তাকিয়ে অবাক হয়ে দেখল, যে রজত কেমন আছিস বলে, মুচকি হেসে দ্রুত পায়ে হেঁটে এগিয়ে যাচ্ছে । অভিনন্দন গুনগুনকে বলল তোর সাথে হয়ত কথা ছিল আমাকে দেখে দাঁড়াল না । গুনগুন বলল হয়তো কিছু বলবে ভেবেই ডেকেছিল কিন্তু পরে সিদ্ধান্ত বদলায় ।
অভিনন্দন বলল তুই তো বললি উনি লেখালেখি করেন , আসলে যারা লেখক জানিসতো ওরা কখন যে কী ভাবে ,কী করে তার ঠিক নেই । তবে যাই বলিস না কেন , ছেলেটা একটু অস্বাভাবিক ও খামখেয়ালী মনে হয় । এসব বন্ধুদের সাথে চলা খুব মুশকিল । যাই হোক, আসছি বলে অভিনন্দন ওর বাড়িতে যাওয়ার জন্য ট্রেনে উঠে পড়ল । কিন্তু গুনগুন যাবে উল্টোদিকে ফলে ও যে ট্রেনে উঠবে সেই ট্রেনটা আসতে দেরী করছিল । গুনগুন তাই মেট্রো স্টেশনের চেয়ারে বসে ভাবতে লাগল রজত এরকম ব্যবহার করল কেন ।
কলেজে পড়ার সময় গুনগুনদের বাড়িতে রজত খুব আসত । আবার রজতদের বাড়িতে গুনগুনও যেত। গুনগুন ছিল সহজ সরল । কিন্তু রজত খুব চালাক আর নিজের প্রয়োজনে যে কোন কারোর সাথে বন্ধু করে নিত আবার প্রয়োজন মিটে গেলে অনেক সময় তাকে চিনত না । গুনগুনের মা বাবা রজতকে ছেলের মত ভালবাসত । গ্রামের বাড়িতে যখন গুনগুনরা যেত রজত তখন ওদের সাথে যেত । রজতের গ্রামে যেতে খুব ভাল লাগত কারণ গ্রামের পরিবেশ ও গ্রামের মানুষদের জীবনধারা নিয়ে গল্প লেখার খুব ইচ্ছে ছিল মনে মনে । এছাড়া রজত একসময় গুনগুনকে বলেছিল যে ওদের গ্রামের বাড়ি এবং ওদের বাড়ির সবাইকে নিয়ে একটা গল্প লিখবে । কিন্তু রজত সেই গ্রামের গল্প লিখে উঠতে পারে নি । তবে রজতের লেখা গল্প , উপন্যাস, কবিতা মাঝে মধ্যেই দেশ পত্রিকা ও খবরের কাগজে ছাপা হয় । সাহিত্য জগতে রজতের বেশ নামডাক হয়েছিল ।
হঠাৎ করে রজত গুনগুনদের বাড়ি আসা বন্ধ করে দিল । বেশ কিছুদিন পরে একদিন গুনগুনের সাথে রাস্তায় দেখা হলে রজতকে ডাকলে কথা না বলে পাশ কাটিয়ে চলে গেল । গুনগুনের খুব খারাপ লাগল । এরপর একমাস বাদে গুনগুন মা বাবার সাথে কলেজস্ট্রিটে কিছু দরকারি বই কিনতে গিয়ে রজতের সাথে দেখা হয়ে গেল । রজত পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়ার চেষ্টা করছিল কিন্তু গুনগুনের বাবা রজতের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল আমাদের গ্রামের বাড়ি নিয়ে কি গল্প লিখেছ ? রজত মাথাটা নিচু করে লিখব বলে চলে গেল। গুনগুন যেই দোকান থেকে বই কিনছিল সেই দোকানদার বলল ও তো রজত দাস । ওর কয়েকটা গল্প ও দুটো উপন্যাসের বই আমার দোকানে আছে । কিছুদিন আগে পর্যন্ত নামডাক ছিল ছেলেটির ভালোই । প্রকাশকদের কাছে ও বেশ কদর ছিল। কিন্তু শোনা যায় আজকাল লেখালেখির বদলে কফিহাউসে মেয়েদের সাথে আড্ডা দেয় বেশী । কোন পত্রিকার অনুষ্ঠানে গিয়ে একটা কবিতা বলেই মেয়েদের সাথে আড্ডা দিতে চলে যায় । আগে ওর লেখার মান ছিল খুব উন্নত । এখন সেরকম ভাল লিখতে পারে না । খুব অহংকারী ও স্বার্থপর ছেলে ।
গুনগুন হাসল আর বাবাকে বলল শুনেছ রজত এখন আগের মত আর ভাল ছেলে নেই । দেখনা কেমন পালিয়ে বেরাচ্ছে । কিন্তু যতই আমাদের কাছ থেকে পালিয়ে যাক রজত নিজেই জানে সবাই ওর মুখোশে ঢাকা মুখটাকে চিনতে পেরে গেছে ।
-----------------------
ছবি ঋণ- ইন্টারনেট
লেখিকা – অঞ্জনা দেব রায়
ঠিকানা – ৫৫৩ পি মজুমদার রোড
কলকাতা – ৭৮