সোনালী দিনের উপাখ্যান
দেবব্রত ঘোষ মলয়
পূর্বকথন
পুকুরপাড়ে ঢেউ রহস্যের কিনারা না হলেও রাজকুমার বোঝে এর পিছনে প্রাকৃতিক কারণ আছে কিছু। সন্ধ্যায় সূর্য ডাক্তারের চেম্বারে দেখা করে কিছু জরুরী ওষুধ নিয়ে নেয় সে। ওখানেই টিভির খবরে জানতে পারে আন্দামানে প্রবল ভূমিকম্প ও সুনামি হয়েছে। এরপর ...
পর্ব - ১১
ট্রেন বাঁকুড়া পৌছালো বিকেল চারটায়। রাজকুমার তার ব্যাগ পত্তর নিয়ে প্ল্যাটফর্মে নেমেই দেখল কৌস্তভ দাঁড়িয়ে, মুখে একগাল হাসি। কৌস্তভ রাজুর রুমমেট, দুজনেই থার্ড ইয়ার। তার থেকেও বড় পরিচয় দুজনে হরিহর আত্মা। কৌস্তভবের বাড়ি শিলিগুড়ি। ওর বাবা কেন্দ্রীয় সরকারের উঁচু পোস্টে চাকরি করেন।
রাজু নেমে হাতের লাগেজ নামিয়ে রাখল, কৌস্তভ এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরল ওকে।
হোস্টেলে পৌঁছতেই সব ছাত্ররা এসে সমবেদনা জানালো। এ সময়েই হোস্টেল সুপার দীনবন্ধু সরখেল এসে কৌস্তভের হাত ধরে বলল - সব কাজ ঠিকমত মিটেছে তো বাবা। আমাদের খবরটা শুনে খুব মন খারাপ হয়েছিল কদিন।
কৌস্তভ নিচু স্বরে বলে - হ্যাঁ স্যার, কথা দিয়ে যে কি হয়ে গেল। আমার বোনটা একদম একা হয়ে গেল।
- সে কি, ও তবে কার কাছে থাকবে?
- গ্রামে স্যার সবাই প্রতিবেশীর খোঁজ খবর রাখে। আর আমাদের ডাক্তার বাড়ি আমাদের আত্মীয়র থেকেও বেশি। আমি ফেরা পর্যন্ত ওদের কাছেই থাকবে বোন।
কথায় কথায় সন্ধ্যে হয়। অনেকদিন পর হোস্টেলের খাবার টেবিলে সবাই মিলে একসঙ্গে খাওয়া হল। রাজুর মনটাও বন্ধুদের সান্নিধ্যে অনেকটাই হালকা হল।
রাতে দুই বন্ধু মেতে উঠল গল্পে। পাশাপাশি দুটি সিঙ্গল বেড। দুজনের দুটি পড়ার টেবিল।
কৌস্তভ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে রাজুর কাছে সব শুনল। রাজু জিজ্ঞেস করল, হ্যাঁ রে, কাকু কাকিমা কেমন আছেন? আর দিদিভাই?
কৌস্তভ বলে - বাবা মা ভালোই আছেন। কিন্তু দিদিভাই মানে কৌস্তভের বড়দি আর জামাইবাবু একমাত্র মেয়ে তৃনাকে নিয়ে আন্দামানে গিয়েছিলেন। সেখানেই হল বিপদ।
রাজু চিন্তিত স্বরে প্রশ্ন করে - সে কিরে, কি হল দিদিভাইয়ের? ভালো আছেন তো ওঁরা সবাই?
আর বলিস না। যেদিন তোদের শ্যামসায়রে ঢেউ উঠল, সেই দিন ভোরে হোটেলের ঘরে প্রথম ঘুম ভাঙে দিদিভাইয়ের। মনে হয় অল্প অল্প ঘুরছে মাথাটা। তারপরই প্রচণ্ড জোরে দুলতে থাকে ঘরবাড়ি। জামাইবাবু ঘুম ভেঙেই দেখে এত জোরে দোতলার ঘরে দুলুনি হচ্ছে যে তৃনা একবার খাটের এপাশে আর একবার ওপাশে গড়িয়ে যাচ্ছে। দিদিভাই তো আতঙ্কে ঠক ঠক করে কাঁপছে। আর নীচে থেকে লোকজনের চিৎকার, কান্না, আর্তনাদ আর ভেঙে পড়ার আওয়াজ ভেসে আসছে। জামাইবাবু তৎক্ষণাৎ তৃনাকে কোলে তুলেই দিদিভাইকে বলে চল নীচে এক্ষুনি। তখন সিঁড়িতেও হুড়মুড়িয়ে নামছে লোকজন। তৃনাকে নিয়ে জামাইবাবু সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বেশ কয়েকবার মাথা ঠুকে গেল দেওয়ালে, এতই জোরে সে দুলুনি। শেষমেষ নীচে পৌঁছেই দেখেন হোটেলের সামনে পিচের রাস্তা চোখের সামনে চড় চড় করে ফেটে গেল। দিদিভাই ডুকরে কেঁদে উঠলেন - আমরা আর বাঁচব না গো, এ তো প্রলয় হচ্ছে। সমবেত লোকজন আতঙ্কে চিৎকার করতে করতে দৌড় লাগিয়েছে যে যেদিকে পারে।
একটানা কথাগুলো বলে একটু থেমে কৌস্তভ। উদগ্রীব রাজু প্রশ্ন করে - তারপর তারপর?
- তারপর দুলুনি থামে। কিন্তু গত শহর ততক্ষনে ধ্বংসস্তূপ। দুদিন খুব কষ্টে কাটল। খাবার নেই, জল নেই। এদিকে ফেরার বিমানের কোন ঠিক নেই। যাই হোক, দুদিন পর জামাইবাবু নানা সোর্স ধরে প্লেনের টিকিট জোগাড় করে বাড়ি ফেরেন। দিদিভাই আজও সে ট্রমা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। মাঝে মাঝেই মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়।
দুই বন্ধু অনেক সুখ দুঃখের গল্প করে নাঝরাত অবধি। তারপর একসময় তলিয়ে যায় গভীর ঘুমে।
ঘুমন্ত শহরের নিস্তব্ধতাকে মাঝে মাঝে খানখান করে দেয় পথকুকুরের চিৎকার। ইংরেজ আমলে তৈরি মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেলের মোটা দেওয়াল ভেদ করে সে আওয়াজ এদের ঘুমে কোন ব্যাঘাত ঘটায় না।
অমাবস্যার নিকষ কালো রাতের আকাশে একটা উল্কা তীব্র গতিতে দৌড়ে যায়।
( ক্রমশঃ)
-----------
খুব ভালো চলছে।
উত্তরমুছুন