সৌরভ পুরকাইত
রমাপদবাবু আর হাঁটতে বেড়োন না।রিটায়ার করেছেন দু বছর হল।স্কুলের কাজের সঙ্গে যতদিন যুক্ত ছিলেন বেশ শান্তিতেই ছিলেন।এক মেয়ে।তারও বিয়ে হয়ে গেছে।বাড়িতে আছে বলতে একমাত্র স্ত্রী।রমাপদবাবুর কোন ব্যারাম ট্যারাম নেই।কোনকালে ছিলও না।সেই তিরিশ বছর বয়স থেকে ভোরবেলায় ওঠা তার অভ্যাস আর তার সাথে একটু মর্নিং ওয়াক। তাঁর থেকে বয়সে পাঁচ বছরের ছোট স্ত্রী অর্চনাদেবী।এখনতো দিব্যি শক্তপোক্ত।পেনশনের টাকায় অভাবও তেমন নেই।তবু রমাপদবাবুর মনটা ভালো নেই।
বেশ কয়েকমাস হল তিনি হাঁটতে যাচ্ছেন না।খোশমেজাজি রমাপদবাবু চিরকালই কাজের মানুষ।প্রথম প্রথম স্কুল ছাড়ার পর তিনি বাগান নিয়ে মেতে উঠেছিলেন।এখন সেই সব টবগুলি বাগানে অনাদরে পড়ে আছে।নতুন করে এই শীতে আর চারা লাগানো হয়নি।সকালে এখন তিনি বেশ বেলা করেই ঘুম থেকে উঠছেন।বেলা সাড়ে সাতটা মানে ভালোই বেলা।
ফোনটা চার্জে বসিয়ে স্ত্রীকে হাঁক দিলেন।'কিগো আজ কি চা-টা পাবো না নাকি?'
'রোজ রোজ দেরি করে উঠলে আমি দুবার চা করতে পারব না বলে দিলুম'।অর্চনাদেবী ঝেঁঝেঁ উঠে উত্তরটি দিলেন।
আসলে হয়েছে কি রমাপদবাবু একটি স্মার্ট ফোন কিনেছেন।তাঁর কেনার ইচ্ছা ছিল না।রিটায়ার করার দুমাস আগে সহকর্মী প্রকাশবাবু উঠে পড়ে লাগলেন।'স্যার আর কদিন পরেই তো চলে যাবেন।যোগাযোগ বলতে কিছুই থাকবে না। আজকাল ফেসবুকের যুগ।অনলাইনে কিনুন।কমের মধ্যে হবে।আমি অর্ডার করে দেব'।ইত্যাদি ইত্যাদি।সেই থেকে ফেসবুকের নেশা তাঁর দৈনন্দিন কাজে গোলযোগ ঘটাচ্ছে।অনেক রাত অবধি তিনি এখন অনলাইনে থাকেন।
প্রতি মিনিটেই নতুন নতুন পোস্ট।একটা দেখে শেষ হবার আগেই আরেকটা চলে আসছে।মন অভিনবত্বের কাছে বারেবারে জমে যায়।বিশ্রামের মধ্য দিয়ে বিশ্লেষণে যেতে নারাজ।তাই বন্ধ করি করি করেও আর বন্ধ করা হয় না।রাত বেড়ে যায়।ফ্রেন্ডলিস্টের সংখ্যাটা আটশো অতিক্রম করেছে। প্রথম প্রথম বেশ মজা লাগতো। নিজে থেকে কিছু পোস্ট করলে অনেক লাইক আর কমেন্টস্ পড়ত। পুরানো ছাত্রছাত্রীরা খবর নিত।মনে হত সেই পুরানো সম্মান, সুখ্যাতি আবার ফিরে ফিরে আসছে। রমাপদবাবু ধরে নিয়ে ছিলেন বয়সটা যেন অনেক কমে গেছে। সেই পুরাতন রমাপদ বসু, সেই দৃঢ়,স্বাধীনচেতা,জনপ্রিয় ছাত্রদরদী রমাপদ মাস্টার।
গত কয়েক মাস ধরে তেমন করে লাইক পড়ছে না তার পোস্টগুলিতে। কমেন্ট বক্সটাও ফাঁকা থেকে যাচ্ছে।কি ব্যাপার হল?তবে কি তাঁকে আর কেউ পছন্দ করছে না।এই কয়েকদিনে বেশ কয়েকবার প্রফাইল ছবিটা বদলে বদলে দিলেন।কিন্তু কই?আগের মতো দু-আড়াইশো লাইক তো পড়ছে না।তবে কি মানুষ তাকে ভুলে গেল?
স্ত্রীর কথায় একটু আঘাতই পেলেন তিনি।তবু মুখে কিছু বললেন না। টুথব্রাশে মাজনটা লাগিয়ে বাথরুমে ঢুকলেন।হঠাৎ একটা আর্তনাদ।অর্চনাদেবী দৌড়ে এলেন।
হসপিটলে শুয়ে আছেন রমাপদবাবু।জ্ঞান ফেরার পর থেকেই তিনি বাড়ি যেতে চাইছিলেন। ডাক্তার বলেছে এখনো আটচল্লিশ ঘন্টা অবজারভেশনে রাখতে হবে।একটু আগে ঘুম ভেঙেছে তাঁর।বাথরুমে পড়ে যাবার পর এই প্রথম উঠে বসলেন। হাতে আর মাথায় চোট পেয়েছেন তিনি। মাথার কাছটা এখনো বেশ ব্যথা।
জানালার শার্সি দিয়ে নীচে তাকালেন।একটা ছোট রাস্তা চলে গেছে দূরে দিগন্তের কাছে। যেখান থেকে সকালের আলো ফুটে বেড়োবে। আকাশটা তাই নতুন দিনের উৎসবে সেজে উঠেছে। অনেক দিন তিনি সকাল দেখেন নি। জানলার ফাঁকটুকু দিয়ে প্রাণ ভরে নিশ্বাস নিলেন।
বাড়ি ফিরে এসেছেন রমাপদবাবু।প্রয়োজনটুকু ছাড়া এখন তিনি মোবাইল নিয়ে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করেন না।হাতে তাঁর প্রচুর কাজ।বাজার থেকে নতুন গাছের চারা কিনে এনেছেন। হাঁটতেও বেড়োচ্ছেন প্রতিদিন। টকটকে কমলা রঙের সূর্যদেবকে প্রাণভরে দেখলেন।যার কাছে ম্লান হয়ে যায় ঔদ্ধত্য অহংকার আর মিথ্যাচার। নির্মল সূর্যদেবকে রমাপদবাবু একটা লাইক দিলেন,কমেন্টও করলেন। মনে মনে,আন্তরিকতার সাথে।।
------------
সৌরভ পুরকাইত
ধনিয়াখালি,হুগলি
৯৫৬৪৮৭৩৪১৮
Sent from my Samsung smartphone.