ছোটগল্প।। গোপন বনভোজন।। জয়িতা দত্ত
গোপন বনভোজন
জয়িতা দত্ত
শিবানীদেবীর ফ্ল্যাটবাড়ির সবাই ছাদে পিকনিক করছে। কিছুদিন আগেই ওঁর পেটে গলব্লাডার অপারেশন হয়েছে,তাই তিনি সেখানে অংশগ্রহণ করতে পারছেন না। বারান্দায় শীতের রোদে পিঠ দিয়ে বসে কাগজ পড়ছিলেন তিনি। কখন যে চোখ লেগে গিয়েছিল,কে জানে ! আধো ঘুমে তিনি পৌঁছে গেলেন কোন এক অবচেতনপুরে !
ছোট ছোট ছেলেমেয়ে আঠারো - কুড়ি - বাইশ জন। মামাতো মাসতুতো পাড়াতুতো সবাই - যদিও সেই ভেদাভেদ জ্ঞান তাদের তখনও হয়নি। তখনকার দিনে এমনই ছিল কিনা ! ডিসেম্বরের বার্ষিক পরীক্ষা শেষে স্কুলে অফুরান ছুটি আর অঢেল ফূর্তির সময় সেটা। মাসির বাড়ি সব ভাইবোনেরা এল। চু-কিতকিত,ডাংগুলি, স্কিপিং,গাছের ফল চুরি, সাঁতার, এদিক -ওদিক ঘোরাঘুরি, ঝগড়া মারপিট,ইত্যাদি করেও বাড়িতে ফিরে ক্যারাম,লুডো ! কোথা দিয়ে যে স্রেফ বয়ে যেত সময়টা !
এরকমই কোন একসময় এদের মাথায় পিকনিক করার ভূত চাপল । এঃ, ভুল হল! পিকনিক নয়, 'বনভোজন'। পিকনিক তখনকার চালু শব্দ নয়। তা বনভোজন তো হবে, কিভাবে? সর্বজ্যেষ্ঠটি দ্বাদশবর্ষীয় আর সর্বকনিষ্ঠাটি পঞ্চমবর্ষীয়া! বড় দাদার কড়া হুকুমজারি হল যে বড়দের নেওয়াও যাবে না আর বলাও যাবে না। তাহলে অ্যাডভেঞ্চার মাটি, বড়োরা সবেতেই খবরদারি করবে! অবশ্যই পুঁচকেটা যেন শুনতে না পায় সেভাবেই আলোচনাটা হল, যা নালিশকুট্টি, ঠিক বলে দেবে! হুকুম তো জারি হল,কিন্তু রান্না করবে কে?! সব বড় বড় রাঁধুনী কিনা ! কিন্তু ওই যে বলে না, ইচ্ছে থাকলেই উপায় হয় ! পুঁচকে বোনকে টিকটিকি লজেন্সের লোভ দেখিয়ে দু-তিন ভাইবোন সরিয়ে নিয়ে গেল আর অন্যরা বসল শলা-পরামর্শ করতে।
তখনকার দিনে সব বাড়িতেই ইয়াব্বড় রান্নাঘরে (এখনকার মত কয়েকফুটি কিচেন নয়) নানারকম পদ রান্না হত, শুক্তো থেকে চাটনি। লোকজন খেতে খুব ভালোবাসত, 'কব্জি ডুবিয়ে খাওয়া' কথাটা প্রচলিত ছিল। হাঁড়িকুড়ি,ডেকচি নানারকম বাসনকোসন প্রায় সব বাড়িতেই প্রয়োজনের অতিরিক্ত থাকত। রান্না না পারুক কেউ ,খাবার দাবার নিয়ে একসঙ্গে বসে অন্য কোথাও তো খাওয়াই যায়! 'বনভোজন'-এ তো রান্না করার কথা কোথাও বলা নেই ! ঠিক হল প্রত্যেকে নিজের বাড়ি থেকে নিজের থালা নিয়ে আসবে, অবশ্যই লুকিয়ে। আর যার বাড়িতে যা যা রান্না হবে এক এক বাটি করে নিয়ে আসবে, যেমনভাবেই হোক। আক্ষরিক অর্থে চুরি করে !!
এবার চিন্তা বনভোজন হবে কোথায়? বনভোজন যখন,বনেই তো ভোজন হবে! শিবানীর মাসির বাড়ি থেকে কোণাকুণি একটা মাঠ পার করে একটা রাস্তা, সেটা পেরিয়ে গেলে গাছপালা আগাছা ভর্তি প্রায় জঙ্গুলে জায়গা, প্রায় বন-ই। তা ঠিক হল সেখানেই সবাই মিলে খাওয়াদাওয়া হবে। শিবানীর উপর খালি দায়িত্ব ছিল পুঁচকেকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবার।
যেমন ভাবা তেমন কাজ। থালা-গ্লাস তো আগেই পাচার হয়ে গেল। দাদা-ভাইরা মিলে সেগুলো চটের ব্যাগে মুড়ে ওখানে রেখে এল। যত দিন এগোতে লাগল, ওদের উত্তেজনাও বাড়তে লাগল। বাড়িতেও ফিসফিস ফিসফাস শুরু হল। শিবানীর ছোটমামা তখন এখানে, তার চোখে তা ধরা পড়ল, তিনি মিলিটারীম্যান কিনা! কিন্তু মামা ওদের কিচ্ছুটি বুঝতে দিলেন না। উল্টে চোখকান খোলা রেখে, দরজার আড়াল থেকে ওদের ফিসফিসানি শুনতে থাকলেন।
যাই-ই হোক, সেইদিন তো এসেই পড়ল একদিন। সবাই ভীষণ উত্তেজিত,উৎকন্ঠিত। শান্তশিষ্ট হয়ে সবাই যে যার রান্নাঘরে তীক্ষ্ম নজর রেখে চলেছে কি কি রান্না হচ্ছে তার উপর। শিবানীর মাসির একবার সন্দেহ হল - 'কি ব্যাপার? তোরা হঠাৎ সব ভালো মানুষের মত মুখ করে বাড়িতে কেন?' ছোটমামা বললেন- ' দেখ গে, কোথায় কার সঙ্গে মারপিট ঝগড়া করে বাড়িতে ঘাপটি মেরে রয়েছে সব !' তখন ভাগ্যিস মুঠোফোনের যুগ নয়, কারোর পক্ষে যাচাই করা সম্ভব নয়; তাহলে জানা যেত যে অন্যান্য বাড়িতেও একই অবস্থা ! যাই হোক, রান্না শেষ হতেই শিবানীরা ভাইবোন সবাই আব্দার জুড়ল,এক এক বাটি করে সব দিতে হবে আর এক জামবাটি করে ভাত।সবাই তারা ছাদে বসে খাবে, রান্নাঘরে মাটিতে পাত পেড়ে নয়।মাসি এবার ওদের ভালোমানুষ সাজার কারণটা যেন বুঝতে পারলেন (একদম নয়)!যাইহোক, সবাই খাবার নিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে চুপিচুপি এপাশ-ওপাশ দেখে, ছাদে না গিয়ে সব ভোঁ-ভাক্কা। সেই বনে গিয়ে সবাই একত্রিত হল।
তারপর হৈহৈ রৈরৈ করে থালা সাজিয়ে সবার আনা খাবার সবার পাতে ভাগ করে দিয়ে খেতে বসবার মুখে সবার খেয়াল হল পুঁচকেকে আনা হয়নি ! উৎসাহ উদ্দীপনায় শিবানী ওর কথা ভুলেই গেছে। সবাই ওকে একপ্রস্হ বকাবকি। এখন ওকে আনতে গেলে ধরা পড়ে যাবার সম্ভাবনা আছে। তাহলে সব আয়োজনই মাটি ! খুব মন খারাপ নিয়ে সবাই খেতে বসতে যাবে সবে,এমন সময় আবির্ভাব শিবানীর ছোটমামার ! তাঁর একহাতে রসগোল্লা আর একহাতে দইয়ের বিরাট হাঁড়ি আর......আর সামনে পুঁচকে !! ওদের সব ফিসফিসানি ছোটমামা শুনে ফেলেছিলেন যে ! দই রসগোল্লা ছাড়া কি বনভোজন সম্পূর্ণ হয়! নিজেও বসে গেলেন ছোটদের সঙ্গে বনভোজনে। খাওয়ার পর গানের লড়াই, এক্কা-দোক্কা,চু-কিতকিত আর উপরি পাওনা সন্ধ্যার মুখে মামার বলা ভূতের গল্প। শেষে ভয়ে গা জড়াজড়ি করে মামার পায়ে পায়ে ঘরে ফেরা।
ভূতের ভয়ের রেশ নিয়েই শিবানীদেবীর দিবানিদ্রা সাঙ্গ হল। সম্বিত ফিরতে তাঁর ঠোঁটের কোণে একটুকরো হাসি খেলে গেল। কি মজাই না হয়ে ছিল সেদিন ! এখন এরা যে কিসব ছাদে প্ল্যানপ্রোগ্রাম করে বনভোজন করে!থুড়ি,এরা তো বনভোজন করে না,পিকনিক করে!! কোন থ্রীলই নেই এতে !
আর সেদিন? থালা-বাটি আনতেই ভুলে গেছিল সবাই,ভূতের ভয়ে। পরের দিন সকাল হতেই দু-তিন জন মিলে আবার চুপিচুপি ওখান থেকে ওগুলো নিয়ে এসেছিল । ততক্ষণে কোন বাড়িতেই ওদের এই বনভোজনের গল্প আর গোপন থাকেনি।
----------------------------------
ছবি ঋণ- ইন্টারনেট
--------------------------