গল্প।। রাজত্ব নয়তো রাজকন্যা ।। রণেশ রায়
রাজত্ব নয়তো রাজকন্যা
রণেশ রায়
আজ তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরেছে। সচরাচর তা হয় না। দেরী হওয়াটাই রেওয়াজ। রেওয়াজ ভাঙ্গায় সোমা একটু ব্যঙ্গর ছলেই প্রশ্ন করে :
---- আজ তাড়াতাড়ি ! অফিসে কাজের বুঝি চাপ কমেছে !
সৌরভ নির্লিপ্ত। খুব ঠান্ডা মাথার মানুষ। সে ব্যাগ থেকে একটা কাগজ বার করে বলে:
--- এই যে, যা চেয়েছিলে পেয়ে গেলে সোমা কাগজটা হাতে নিয়ে বোঝে সেটা তাদের বিবাহ বিচ্ছেদের রায় । তবে সে কি একাই এটা চেয়েছিল? এ নিয়ে আর কথা বাড়ায় না। একটু অন্য মনস্ক হয়ে ভাবতে থাকে। বলারতো কিছু নেই। দুজনেই চেয়েছিল।বিয়ের পর পাঁচ বছর হয়ে গেল। ফুল শয্যার কলি ফুল হয়ে ফুটল না আজও । একটা নির্লীপ্ত সম্পর্ক। যে যার বেঁধে দেওয়া কর্ত্তব্য করে যায় । তাতে না আছে মিলনের উষ্মতা না বিরহের বেদনা। তবে হ্যাঁ আছে আনুষ্ঠানিক কর্তব্যের নিত্য পর্ব। একটা নির্লিপ্ততার হিমাঙ্গ। অথচ আজ জন্মদিন কাল বিবাহ বার্ষিকী কিছুই বাদ যায় না। পরিচিতজনের উপস্থিতি। তাদের দেওয়া উপহার শোভা পায় শো কেসে। বিয়ের ছবিগুলো এলবামে উঁকি মারে। সোমা ভাবে, সেই বিয়ের দিন। ঘটা করে অনুষ্ঠান। বিচার না করেই প্রতিটি আচার অক্ষরে অক্ষরে পালন। সাত পাকের বাঁধন। যদিদং হৃদয়ং তব। সোমা সৌরভের যত্নের ত্রুটি রাখে না। সৌরভও সোনা গয়না কাপড় জামায় ভরিয়ে রাখে সোমাকে। কোন কিছুর অভাব বুঝতে দেয় না। তাও সোমার কিসের অভাব থাকতে পারে ! সেটা সৌরভ বোঝে না বা বুঝতে চায় না। ঝগড়া দূরের কথা, দুজনের মধ্যে কথা কাটাকাটিও তেমন হয় না।সোমার সঙ্গে শ্বশুর শাশুড়ির সম্পর্ক ভালো। মধ্যে মধ্যে তাঁরা খড়্গপুরে ছেলের কাছে আসেন। সোমার সে কদিন ভালো কাটে। শ্বশুর বিভিন্ন বিষয়ে পড়াশুনা করা মানুষ। সোমার সঙ্গে আলোচনা করেন। তার একাকীত্ব দূর হয়। তবে সোমা লক্ষ্য করে দুজনেরই ছেলের প্রতি একটা অদ্ভুত দুর্বলতা। অহংকারও বটে। কেনই বা সেটা হবে না। চলতি মতে ছেলে যথেষ্ট উপযুক্ত। আবার ছেলেকে কিছুটা ভয়ও করেন মনে হয়। তবে সোমা এআরো লক্ষ্য করেছে মেয়ের বাড়িতে তাঁরা যতটা স্বচ্ছন্দ এখানে ততটা নয়। সেখানে তাদের যাতায়াত বেশি। হয়তো নাতনীর টানে। সোমা ভাবে।
হিসেবী মতে সৌরভ ভালো ছেলে। সাফল্যের সঙ্গে পড়াশুানা শেষ করে ভালো চাকুরী। কিছুদিন পর পর প্রমোশনের হাতছানি। কোন বদ অভ্যেস নেই। দুজনের মধ্যে এক অদ্ভুত বোঝাপরা। কেউ কাউকে ছেড়ে তেমন থাকে নি। তাও এই বিচ্ছেদ। আবার সোমার সন্দেহ হয়, ভাবে এটা কি সত্যি বোঝাপড়া না একটা ঠান্ডা লড়াই। তারই ফলে এই বিচ্ছেদ। বিচ্ছেদের আবেদনের পর কেউ একদিনের জন্যও এ নিয়ে সংকোচ প্রকাশ করেনি। এ নিয়ে তাদের মধ্যে তর্ক বিতর্ক হয়নি। কেউ কাউকে দোষাবোপ করেনি। সোমা খোরপোস যা চেয়েছে তা দিতে রাজি সৌরভ। দুজনের সহযোগিতায় এত তাড়়াতাড়ি রায়টা পাওয়া গেল। খোরপোসটা সোমা চেয়েছিল নিজের প্রয়োজনে যতটা তার থেকে বেশি নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য। একমাত্র মেয়ে হিসেবে সে বাবার যে সম্পত্তি পাবে সেটা দিয়ে তার অনায়াসে চলে যাবে। অধিকার বোধ ছাড়া আরও দুটো বিষয় কাজ করেছে এই খোরপোস চাওয়ার পেছনে। সে নিজের অজান্তেই বোধহয় চেয়েছিল খরপোস নিয়ে সৌরভ কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত হোক। তাতে মামলা সমাধানে দেরী হবে। এর মধ্যে নিজেদের মধ্যে যদি বোঝাপড়ার রাস্তা তৈরী হয়। আবার সে বিয়ের আগে যে চাকরীটা পেয়েছিল সেটা বিয়ের শর্তে তাকে বাদ দিতে হয়েছে। তাকে কেন্দ্র করে তার অসোন্তোষটা বাড়ছিল। খোরপোস চাইতে কিছুটা প্রতিশোধস্পৃহাও হয়তো কাজ করেছে। নানা দ্বন্দ্ব সোমাকে ক্ষতবিক্ষত করছিল।
সৌরভের সঙ্গে সোমার সম্পর্কে ফাগুনেও মাঘের ঠান্ডার ফল্গুধারা। অফিস নিয়ে সৌরভ পড়ে থাকে। এরই মধ্যে একদিন রাতে ফাগুনের হাওয়া লাগিয়ে সোমা জিজ্ঞাসা করে :
---- তোমার এত সাবধানতা কেন ? তুমি কি সংসারে তৃতীয় কাউকে চাও না?
সৌরভের উত্তর:
----- সেটা পরে ভাবা যাবে। আমাকে আর একটু উঠতে দাও।
আর ওঠা হয়নি। তবে অফিসে পরপর দুটো প্রমোশন হয়ে গেছে।
সোমা ভাবে উঠবে আর কত, কবে সময় হবে?
সোমার মনে পড়ে কলেজে দর্শনের ক্লাসে বক্সীবাবু বলতেন সবাইকে নিয়ে সমাজ। পারস্পরিক ইচ্ছের মিলে যে সৃষ্টি সেটাই সম্পুর্ণতা লাভ করে। সোমা ভাবে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে বোঝাপড়ায় নতুনের আগমন স্বাগত। সে কারও অনিচ্ছায় সন্তান চায় না। পুরনো ভাবনার মধ্যে নতুন ভাবনা উপস্থিত। এখন তাকে স্থির করতে হয় সে বিচ্ছেদোত্তর জীবন কেমন করে কাটাবে। বিয়ের আগে তার সত্তা জমা ছিল বাবার লকারে তারপর সেটা বাঁধা পরে সাত পাকে। এখন আর সে বাঁধা থাকতে চায় না। নিজের সত্তাটাকে চিনতে চায়। তার বাবা একজন সিংহ পুরুষ। তার কথাই শেষ কথা। তিনি পৃথিবী খুঁজে ভালো পাত্রের হাতে তাকে সমর্পণ করেন। সত্যিই তিনি মেয়ের ভালো চেয়েছিলেন। সব বাবা মাই যা চায়। মেয়ে যেন অভাবে না পরে। সমাজে যেন স্বীকৃতি পায়। সে অভাবে পরেনি ঠিকই । স্বামীর কল্যানে সমাজে যথেষ্ট কদর। তাও কিসের অভাব? যার জন্য এত `ভালো` সইল না। বিয়েতে মেয়ের যে মত থাকতে পারে সেটা বাবার সংস্কৃতিতে কোন দিন ছিল না। বাবা তাকে যে আদরে বড় করেছে সেটা সোমার জানা। তাও তার এই অভিমান। না তাকে নিজেরটা নিজে বুঝে নিতে হবে। বাবার কাছে যাবে না আর। কারণ এখন মা বেঁচে নেই। সেখানে তার কাটবে কি নিয়ে? আবার এক একাকিত্ব তাকে গ্রাস করে।
২
সোমা তার মাসতুতো বোন সীমাকে ফোন করে। ও থাকে মেদিনীপুরে । সে নিজে পছন্দ করে সহপাঠী দেবপ্রিয়কে বিয়ে করেছে। দেবপ্রিয় একটা অদ্ভুত ছেল়ে। অনেকে বলে বান্ডুলে । একটা ওষুধ কম্পানিতে চাকুরী করে। ওষুধ বিক্রি কাজ। নিজেকে ফেরিওয়ালা বলে পরিচয় দেয়। সম্পর্কে জামাইবাবু কারণ সীমা সোমার থেকে সামান্য হলেও বড়। সোমা দেবপ্রিয়র সঙ্গে কোথায় যেন একটা মানসিক বন্ধন অনুভব করে । দেবপ্রিয়ও সোমার মত বিশ্বাস করে প্রত্যেক মেয়েরই একটা নিজস্ব সত্তা আছে। পরিবারের বন্ধনে এই পিতৃতান্ত্রিক সমাজে সেটা চাপা পরে যায়। সীমার সঙ্গে দেবপ্রিয়র মারদাঙ্গা করে কাটে। সঙ্গে থাকে মেয়ে চুমকি। সবার সঙ্গে অবাধ মেলামেশা। সুযোগ পেলেই পুটলি বেঁধে বউ মেয়ে নিয়ে এখানে ওখানে দৌড়। সঙ্গে কেউ থাকে। এ হেন পুরুষের বন্ধুত্ব সোমা খুব উপভোগ করে। সীমাও সোমার খুব বন্ধু। সরল সহজ মেয়ে। বাবার আর্থিক অবস্থা তেমন নয়। সোমার মত এত স্বাচ্ছন্দে বড় হয়নি। তাও দুজনের খুব ভাব। মেয়ে চুমকি তো মাসি বলতে অজ্ঞান।
সোমা ভাবে তাকে বাড়ি ছাড়তে হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। একটা মেয়েদের হোষ্টেলে আপাতত উঠবে। পরে ভাবা যাবে কি করবে। তবে একটা কাজ জুটিয়ে নিতে হবে। টাকার জন্য সেটা যতটা না দরকার পায়ের তলার মাটি পাবার জন্য সেটা আরও দরকার। আজ সে বন্ধন মুক্ত। যে বন্ধন তার সত্তাটাকে অস্বীকার করে এসেছে। মেয়েদের নিজস্ব সত্তা ফিরে পাবার তাগিদটা কয়েক ঘন্টার মধ্যে তীব্র হয়ে ওঠে। একটা যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার আনন্দের স্পর্শ সে পায়। কারো মুখাপেক্ষী হয়ে থাকলে চলবে না। আবার কি যেন ভেবে মোবাইলটা হাতে নেয়। সীমাকে ফোন করে। বোধহয় ভাবে সীমার মাধ্যমে দেবপ্রিয়কে জানিয়ে দেওয়া দরকার। ওই এখন সবচেয়ে কাছের মানুষ যার সাহায্য তার দরকার। একটা সম্পর্কের টান যেন অনাত্মীয়কেও আত্মীয় করে তোলে।একটা বন্ধন টপকে আরেকটা বন্ধন যেন হাতছানি দেয়। আর এ বন্ধন মুক্ত আকাশের নিচে স্বেচ্ছা স্বীকৃত বন্ধন। একই সঙ্গে সে বন্ধন মুক্তির কারিগর। এক নতুন সম্পর্কের দিশারী।
খবর পেয়ে পরের দিন সীমা আসে। দুজনে মুখোমুখি বসে। সীমা বোঝে না কিভাবে কথা শুরু করবে। নিজে যেচে সান্ত্বনা দিতে গেলে এই মুহূর্তে সোমা ভুল বুঝতে পারে, সে ভাবে। কেমন আছিসের মতো একটা নিরীহ কথাও সোমাকে আঘাত দিতে পারে। ওর অস্বস্তি বুঝে সোমাই কথা শুরু করে :
----- চুমকি কেমন আছে ?
----- ভালো , কি হয়েছে। ডেকেছিস কেন ? সীমা বলে।
----- রায় বেরিয়েছে। আদালত ডিভোর্স দিয়েছে। তুই তো সবটাই জানিস। এত ভালো থাকা কি সহ্য হয়? কি বলিস ?
---- এভাবে বলিস না। যা হবার হয়েছে। এখন কি করবি ভাবছিস?
---- একটা মেয়েদের হোষ্টেল দেখে নেব ভাবছি।
---- কেন ? মেসোর ওখানে যাবি না কেন? এখন মাসিমা নেই মেসো একা। তুই গেলে একটা সঙ্গ পাবে।
---- মা থাকলে ওখানে যাবার কথা ভাবতাম। আর কাউকে সঙ্গ দেওয়াটাইতো সব নয়। বাবার পৌরুষের ছায়ায় আবার হারিয়ে যাব। নির্ভরশীলতার বন্ধন থেকেই যেখানে মুক্তি চাইছি। আর জানিস তো ওখানে গেলে আবার অতীতটা তাড়া করে বেড়াবে।ইঙ্গিতের ছোঁয়াটা সীমাকে স্পর্শ করে। সীমা জানে কোন অতীত সোমাকে ঘিরে থাকে ও বাড়িতে। সীমা এ নিয়ে আর কথা বাড়ায় না।
খবর পেয়ে দেবপ্রিয় আসে। দেবপ্রিয় সীমার স্বামী। মেদিনীপুরে মা মেয়ে আর স্ত্রী সোমাকে নিয়ে থাকে। সোমাদের খড়্গপুরের বাড়ি থেকে খুব দূরে নয়। দেবপ্রিয় সোমার বন্ধুর মত। খোলামেলা ছেলে। মেয়েদের অধিকার নিয়ে সোচ্চার। ওই সীমাকে বিয়ের আগে যে চাকুরীটা পেয়েছিলো সেটা নিতে বলেছিল। কিন্তু কলকাতা থেকে মেদিনীপুরে বিয়ের সূত্রে চলে আসতে হবে ভেবে ও চাকরিটা নেয় না। সৌরভের ইচ্ছেটাকে মর্যাদা দেয়। আজ বোঝে দেবপ্রিয় মেয়েদের আত্মনির্ভর থাকতে বলে কেন। ওর সেদিনের পরামর্শটা কতটা সঠিক ছিল। তবে সেটা আজ আর ভেবে লাভ নেই। এখন একটা মেয়েদের হোষ্টেলে থেকে কাজ জুটিয়ে নিতে হবে। সোমা ভাবে। সে সবটা দেবপ্রিয়কে বলে। ও জানায় কেন সে বাবা সদাশয় মুখার্জির বাড়ি যেতে ইচ্ছুক নয়। দেবপ্রিয় ওকে ওদের বাড়িতে এসে কিছুদিন থাকতে অনুরোধ করে। আর মেয়ে চুমকিতো ওরও মেয়ে। ওতো মাসি বলতে অজ্ঞান। সুতরাং আর কোন কথা নয়। সীমা দেবপ্রিয়র কথা সমর্থন করে সোমাকে খড়গপুরে যেতে রাজি করায়। সোমা খুব একটা আপত্তি করতে পারে না। সেওতো জানে এই সময় দেবপ্রিয়ই ওকে সবথেকে বেশি নির্ভরতা দিতে পারে। আর চিমটি হবে ওর সবচেয়ে কাছের সঙ্গী। ওখান থেকে চাকুরীর চেষ্টা করতে অসুবিধে হবে না। সীমার শাশুড়িও যে বড় সহায়ক হবে তাতে সন্দেহ নেই।
পরের রবিবার দেবপ্রিয়র সাহায্যে সৌরভের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সম্পর্কটা শেষ করে সোমা নিজের মালপত্র গুছিয়ে মেদিনীপুরে সীমাদের বাড়িতে ওঠে। সৌরভ কোর্টের রায় অদ্ভুত নির্লিপ্ততার সঙ্গে অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। যে খরপোশ দেওয়ার কথা তা একবারে দিয়ে দেয়। নগদের পরিমাণটা মোটা হলেও তার বিন্দুমাত্র আপত্তি থাকে না। অন্তর্মুখী নির্লিপ্ত সৌরভের কাছে এর থেকে বেশি কিছু অবশ্য সোমা আশা করেনি। কেরিয়ার সর্বস্ব একজনের পক্ষে এটাই স্বাভাবিক। দেবপ্রিয় হলে একটু অন্যরকম ব্যবহার আশা করা যেত। সোমা ভাবে।
সোমার বাবা সদাশয় মুখার্জি প্রসাধনী পণ্যের কারবারি। দেশভাগের পর পূর্ববঙ্গ থেকে এসে যাদবপুরে বাসা বেঁধেছেন। কিছু টাকা সেখান থেকে নিয়ে এসে এখানে ছোট একটা ব্যবসা শুরু করেন। বুদ্ধিমান পরিশ্রমী মানুষ। যোগাযোগকে কাজে লাগিয়ে কিভাবে বাড়তে হয় জানেন। কালক্রমে ব্যবসা বড় হয়েছে। একটা কারখানা করেছেন। আজ ব্যবসা রমরমা। সোমা সদাশয় বাবুর একমাত্র কন্যা। সুশ্রী, ফর্সা। শান্ত প্রকৃতির। অনেকটা মায়ের মত। বাবা মেজাজি মানুষ আর ব্যবসা নিয়ে পড়ে থাকেন বলে বাবা নয় মায়ের সঙ্গেই বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করে। তবে তার প্রয়োজন মেটাতে বাবা কার্পণ্য করেন না। মায়ের ছত্রছায়ায় বাবার নিয়ন্ত্রণে সে বড় হয়ে ওঠে। বাবার নিয়ন্ত্রণটা অনেকটা প্রকাশ্য। মা বাবা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তাই মায়ের নিয়ন্ত্রণটা বাবার নিয়ন্ত্রণেরই নামান্তর। সংসারে কর্তা ইচ্ছা কর্ম। মেয়ের ভালো চান বলে নিয়ন্ত্রণটা একটু কঠোর। বাবার অধিনস্তে দুজনেই অভ্যস্ত হয়ে গেছে।
পূর্ববঙ্গে সদাশয়বাবুদের কিছু জমি জমা ছিল। তবে জমিদারি ছিল কিনা জানা নেই। অবশ্য সদাশয়বাবু তাদের জমিদারির কথা বলতে কখনো ভোলেন না। জমিদারি আভিজাত্যটা তিনি রক্ষা করে চলেন তাঁর চাল চলনে । এটাই মা-মেয়ের সঙ্গে তাঁর একটা দূরত্ব গড়ে তুলেছে।মা-মেয়ের মধ্যে বন্ধনের কারন বোধহয় এটাই। দুজনেই অধীনস্ত। সোমার কোন সমস্যায় মা-ই ভরসা।
সোমার মনে পড়ে তাঁর বয়েস যখন চোদ্দ বা পনেরো তখন একবার রক্ত স্বল্পতার সমস্যা নিয়ে সে নার্সিংহোমে। রাতে অল্পসময়ে রক্ত পেতে অসুবিধে হওয়ায় নীলু রক্ত দেয় সদাশয়বাবুর অনুরোধে। সোমা ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠে। সোমার স্মৃতিতে ভেসে ওঠে নতুন দিগন্ত। অনেকদিন হয়ে গেলেও এই সেদিন। সোমার স্মৃতির দরজা খুলতে থাকে। সে এখন একা হলেও স্মৃতিতে তারা দুজন। নীলু ফিরে আসে। শুধু স্মৃতির দরজা নয় হৃদয়ের দরজা দিয়েও নীলুর অনুপ্রবেশ। যেন এক সুখস্মৃতি। বিচ্ছেদের বেদনা বিদায় নেয়। স্মৃতিতে তার সুখানুভূতি। এক অদ্ভুত আমেজ দোলা দেয়।
নীলকান্ত ওরফে নীলু সোমার বাবার কারবারে চাকুরীজীবি। বাবার মালপত্র বিক্রি করে কমিশন আর তার সঙ্গে সামান্য কিছু মাইনে তার রোজগার। অনেকদিন ধরে নীলু এই কাজ করে। সেই দৌলতে বাড়িতে নীলুর যাতায়াত থাকলেও সোমার সঙ্গে নীলুর আনুষ্ঠানিক পরিচয় হয়নি, কেউ করিয়ে দেয়নি। সুস্থ হয়ে ফেরার পর সোমা নিজেই একদিন পরিচয়টা সেরে নেয়। সে নীলুকে রক্ত দেওয়ার জন্য কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতে গেলে নীলু কিছুটা বিড়ম্বনা বোধ করে। সে আপত্তি করে। বলতে চায়, কৃতজ্ঞতার নাগপাশে তার কর্তব্যবোধকে বেঁধে দেওয়াটা অসম্মানজনক। সোমাকে কি একটা অনুভূতি যেন স্পর্শ করে। সে বোঝে সে ভুল করেছে। সোমার মনে পড়ে সে যেন বলেছিলো -------- সেদিন রক্ত না দিলে আমি বাঁচতাম না।
অপ্রস্তুত নীলু বিরক্তি প্রকাশ করে বলে ;
-------- কাউকে অনুগ্রহ করা আমার পোষায় না। মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক অনুগ্রহের ভিত্তিতে হয় না। কর্তব্য মনে করে যা করার করেছি।
লজ্জায় সোমার মাথা নত হয়ে যায়। একইসঙ্গে নীলুর প্রতি আগ্রহ বাড়ে। ওর মন নীলুর সংসর্গ কামনা করে ওর নিজের অজান্তেই।
নীলু থাকে টালিগঞ্জের এক বস্তি অঞ্চলে। বাবা একটা ছোট কারখানায় কাজ করতেন। নীলু যখন উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেয় তখন তার বাবা মারা যায়। দাদা গাড়ি চালায়। এক বোন আছে। সংসার চলতে চায় না। তখন নীলু কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে সদাশয় বাবুর অফিসে চাকুরীর জন্য আবেদন করে। কাজটা পেতে অসুবিধে হয় না। সাক্ষাৎকার নিয়ে সদাশয়বাবু বুঝেছিলেন তাঁর কাজে নীলু সম্পদ হবে। ছেলেটি বিনয়ী অথচ কথাবার্তায় তুখড়। সদাশয়বাবুর বুঝতে ভুল হয় না। সেই থেকে মাল বিক্রিতে নীলু তার ডান হাত।
প্রাথমিক পরিচয়ের পর সোমার নীলুর সঙ্গে নানা আছিলায় কথাবার্তা হয়। এখন সে কলেজে যাতায়াত করে। এ বাড়িতে আসা যাওয়ার পথে সকালে বা বিকেলে হঠাৎ দুজনের দেখা। নিভৃতে দুচারটে কথা। সেটা হয়তো কাকতালীয়। কি জানি ! তবে দেখাটা হয়। আর এটা হয় সদাশয় বাবুর নজর এড়িয়ে। তবে মায়ের নজর এড়ায় না। নীলুর প্রতিও মায়ের স্নেহ বর্ষিত হয় না যে তা নয়। তবে কখনো কখনো বাবার কাঠিন্য মায়ের মুখে। সেটাকে সোমা তেমন পাত্তা দেয় না। সে জানে মা প্রক্সি মাত্র। বাবাকে নিয়েই চিন্তা। সেই জন্যই লুকোচুরি। আর্থিক ও সামাজিক অসাম্য ওদের পথে বাঁধা। সেটা টপকানো মুশকিল। বাবা মেনে নেবেন না। সোমা জানে। তাও সে বুক বাঁধে। আর সে ভাবছেই বা কেন এত ! ব্যাপারটাতো এখনো পরিচিতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
সোমা একদিন বিকেলে বারান্দায় দাঁড়িয়ে সামনের বড় মাঠটায় ফুটবল খেলা দেখছে। বিকেলে প্রায়ই সে সেটা দেখে। বাবা ফুটবল পাগল। ইস্টবেঙ্গলের সদস্য সমর্থক। বাবার থেকেই ওর মধ্যে ফুটবলের প্রতি আকর্ষণটা সঞ্চালিত হয়েছে সোমার মধ্যে। সোমা হঠাৎ দেখে আজ এই টুর্নামেন্টের খেলায় নীলু একটা টিমের হয়ে খেলতে এসেছে। শিহরন বয়ে যায় সোমার সর্বাঙ্গে। খেলা শুরুর সঙ্গে সঙ্গে ওর অপলক দৃষ্টি নীলুর ওপর। নিলুতো বেশ খেলে। স্বাস্থবান ক্ষিপ্র নীলু দ্রুতপায়ে বল নিয়ে এগোলেই মনে হয় এই বুঝি গোল হয়। উত্তেজিত হয়ে ওঠে সোমা। আবার নীলুর সট বাইরে গেলে বা গোলকিপার আটকালে সে নিরাশ হয়। কোথা দিয়ে দেড়ঘন্টা কেটে যায়। সোমার এই অনুভূতি উত্তেজনা নীলু ভালো ফুটবল খেলে তারজন্যই না আরো কিছু। সোমা ভেবে লজ্জা পায়।
শুধু যে ভালো ফুটবল খেলে বলে তার এই আকর্ষণ নয় সেটা সোমা ভালোই বোঝে। যেদিন সোমা রক্ত দিয়েছিলো সেদিনই সোমার হৃদয়ে রক্তকরবীর প্রস্ফুটন। সে জানে যে এই রক্তকরবীর চাড়া প্রথিত হয়েছিল তার আগে। সোমার স্মৃতি সোমাকে নিয়ে যায় সেই অনুসন্ধানে। সোমার মনে পড়ে বাবা প্রায়ই নীলুকে অযথাই বকতেন। কিছুটা রূঢ় ব্যবহার করতেন মাল বিক্রিতে টান পড়লেই। নীলু বিশেষ কিছু বলত না। বোধহয় ভাবতো অধ:স্তন কর্মচারী হিসেবে এটা তার উপরি পাওনা। সোমা বাবার ব্যবহার যেমন পছন্দ করতো না তেমনি নীলুর চুপ করে থাকাটাও তার ভালো লাগতো না। একদিন বাবার দুর্ব্যবহার যেন মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। সে পাশের ঘর থেকে শোনে বাবা বলছেন :
------ এইতো তোদের কোন উৎসাহই নেই। কোথায় বিক্রি বাড়িয়ে নিজের আয় বাড়াবি তা নয়। এই জন্যই বলি ছোটোলোক তোরা ছোটলোকই থাকবি। কোনোদিন মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবি না।
বাবার আচরণটা সোমার অসহ্য লাগে। যেন বিক্রি বাড়লে ওদেরই লাভ। বাবার কিছু না। তাছাড়া তুই বলে সম্বোধন বা ছোটলোক বলা। কেন নীলু চুপ করে থাকে ! আত্মসম্মানবোধ নেই! সোমারই যেন আত্মসম্মানে বাধে। নীলুর নয়। সোমা অধৈর্য বোধ করে।
সেদিন নীলু চুপ করে থাকে না। প্রথমে বোঝাবার চেষ্টা করে। বলে:
------ দেখুন পূজোর পর বাজার প্রতিবারই পড়ে যায়। মেয়েরা প্রসাধনী জিনিস পূজোর সময় বেশি কেনে। ঠান্ডা পড়লে আবার বাজার উঠবে
মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে ধমকের সুরে সদাশয়বাবু বলেন:
-------- চুপ! আমাকে বাজার নিয়ে জ্ঞান দিতে এসো না। আমি জানি কখন নামে কখন ওঠে। নিজের অপদার্থতা ঢাকার চেষ্টা কোর না।
সোমার কাছে নীলুর কথাটা যুক্তিসঙ্গত মনে হয়। সে শোনে এবারে নীলু উত্তেজিত হয়ে বলে :
-------- তবে ছোটলোকদের বাদ দিন। যদি বড়লোকের ছেলে দিয়ে ভালো কাজ হয় তাই দেখুন। আমি আর কাল থেকে আসব না।
নীলুর প্রতিক্রিয়া সোমার ধমনীতে রক্তের সঞ্চালন ঘটায়। নীলুর এই সম্মানবোধ তাকে অদ্ভুত আনন্দ দেয়। বাবাকে মুখের ওপর জবাব তারা কোনদিন দেয়নি। আজ নীলু দিয়েছে। তার মধ্যে এতদিন যে সুপ্ত অভিমান ছিল সেটা মুহূর্তে মিলিয়ে যায়। সে দেখে তার মাও তার পাশে। তাকে দেখে সোমা বোঝে সেও মনে মনে যেন খুশি হয়েছে। কিন্তু মুখে বলেন:
-------- বাবাকেতো জানিস। একটু বদরাগী। ওর ছোটোলোক কথাটা বলা ঠিক হয়নি বটে। তবে নিলুও এভাবে না বললেই ভালো ছিল।
সোমা উৎসাহ নিয়ে বাবার প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করে। তিনি যেন চুপসে গেছেন। গলা নামিয়ে বলেন:
------ তুমি শুধু শুধু রাগ করছ। তোমার ভালোর জন্যই বলছিলাম। ব্যবসা রাখতে পারলে আমার যেমন লাভ তোমাদেরওতো। হয়তো একটু কড়া কথা বলেছি। আমারতো বয়েস হয়েছে প্রেসারটাও বেশি।
সোমা জানে বাবার আচরণটা। তবে জানতো না পাল্টা ধাক্কায় এভাবে সিংহ মুশিকে পরিণত হয়। সোমা বোঝে বাবার নীলুকে দরকার। অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে সে নীলুকে শান্ত করে। কাজ ছাড়তে বারণ করে। সেদিনই সোমার হৃদয়ে রক্তকরবীর বীজের বপন হয়।
৩
সোমা এখন কলেজে দ্বিতীয় বর্ষে উঠে আরও বেপরোয়া হয়ে গেছে। নীলুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। কলেজের বন্ধুর মাধ্যমে তার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখে। কলেজের পর নীলুর সঙ্গে দেখা করে। কলি ফুল হয়ে ফোটে। আর নীলুও যেন কেমন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তার চিন্তা ভাবনায় পরিবর্তন আসতে থাকে। সে নতুন নতুন সুন্দর কথা বলে। কিন্তু একই সঙ্গে এক ভয়ংকর পরিবর্তনের কথা বলে। সবসময় যেন এক দোটানার মধ্যে থাকে । কি যেন ভাবে। তবে সোমার প্রতি দুর্বলতা তাকে দুর্বল করে তোলে। নীলু যে ধরনের কথা বলে কলেজে রাজনীতি করা কিছু ছেলে মেয়ে এই ধরনের কথা বলে। সোমা বোঝে সে চূড়ান্তপন্থী রাজনীতির সমর্থক হয়ে উঠছে। সে ভীত হয়ে ওঠে। স্থির করে ওকে আরও সঙ্গ দিয়ে ওকে ভালোবাসা দিয়ে ও টেনে আনবে। সোমা ভয়ে ভয়ে থাকে। কিন্তু একই সংগে নীলুর প্রতি আকর্ষণ বাড়তে থাকে। সে রাজনীতির বিরোধিতা করলেও ওদের যুক্তি অস্বীকার করতে পারে না। এইভাবে সোমা আর নীলুর চলতে থাকে। দুজনেই বোঝে সোমার বাবা মেনে নেবে না। নীলুর অবস্থা এমন নয় যে সে সোমার দায়িত্ব নেবে। সোমা ঠিক করে পাশ করে একটা চাকুরী জুটিয়ে নেবে। তারপর বাবাকে উপেক্ষা করে হলেও নীলুর সঙ্গে জুটি বাঁধবে। এর জন্য দরকার কিছু সময়। সোমার মা ওদের সম্পর্কটা টের পান। তবে সোমা নিশ্চিন্ত মা বাবাকে কিছু বলবে না। যদিও সোমাকে মধ্যে মধ্যে সাবধান করেন। আর এই অসম সম্পর্ক টিকবে কিনা তা নিয়ে তিনিও সংশয়ে। মনে মনে মেয়ের ভালো থাকার তাগিদে এই সম্পর্ককে পুরো স্বীকৃতি দিতে পারেন না। সোমা বোঝে
সামনে যুদ্ধটা সহজ নয়। কিন্তু তাকে জিততেই হবে। নীলুর কিন্তু সংশয় দূর হয় না। সে ভাবে সোমা শেষ পর্যন্ত
বাবাকে অস্বীকার করে সম্পর্কটা টেনে নিয়ে যেতে পারবে তো ? না এটা ওর সাময়িক আবেগ। একদিন সে সোমাকে বলে :
---------- তোমার বাবা সম্পর্কটা মেনে নেবেন ? হাজার হলেও এটাতো সমানে সমানে সম্পর্ক নয়। সোমার চটজলদি উত্তর : ধরে নিও মেনে নেবেন না। আমারতো সেটাই ধারণা। মেনে নিলে অবাক হব। তবে তোমার সম্পৰ্কতো আমার সঙ্গে। বাবার সঙ্গে নয়। বিয়ে যদি করতে হয় আমাকে করবে বাবাকে নয়। এ নিয়ে এত ভাবছ কেন ? আমার ওপর আস্থা রাখো। ------- না বাবাকে নয়, সেটাতো ঠিকই। আর আমিতো সহকামী নই । নীলু ঠাট্টার সঙ্গে বলে। সোমার আত্মবিশ্বাস দেখে ওর ভালো লাগে। কয়েকদিন হল নীলুর দেখা নেই। সে নাকি অফিসেও আসছে না। সোমা চিন্তায় পড়ে। কি হতে পাড়ে! আশ্চর্য ! তাকে কিছু বলেও যায় নি। সোমা খবর করে। কিন্তু নীলুর কোন খবর পায় না। সে নীলুর বাড়ি গিয়ে জানে দিন কতক আগে সে অফিস বেরিয়েছে আর ফেরে নি। বাড়ি থেকে পুলিশে খবর দিয়েছে। কিন্তু লাভ হয়নি। বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করে সোমাও হতাশ। তবে কি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে কোথাও চলে গেলো। বছর খানেক অনিশ্চয়তার মধ্যে থেকে সোমাও হতাশ। কি হল! সোমার বাড়িতেও এই নিয়ে গবেষণা। সদাশয়বাবু চিন্তিত, কোথায় গেলো ! সে তার পুলিশ বন্ধু সোমার ব্যানার্জী কাকুর শরণাপন্ন হয়। সোমাও কাকুর কাছে জানতে চায়। কিন্তু কিছুই জানতে পারে না। কাকুর অনুমান রাজনীতির কারনেই নীলু আত্মগোপন করেছে।
সোমার পরীক্ষা হয়ে গেছে। সে এম এ পড়ছে। মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছে। নীলুর দেখা নেই। আর নীলুওতো ওর কথা ভাবলো না ! তারই বা কি দায়। অভিমান হয়। আবার ভাবে যদি রাজনীতি করতে যায় তবে অপরাধটা কোথায়! নিশ্চয় বিপদের মধ্যে আছে। কিন্তু সোমা কি করবে ? ভেবে পায় না। সদাশয়বাবু একদিন সোমাকে ঘরে ডাকে। সোমা ঘরে এসেছে। দুজনে মুখোমুখি। সদাশয়বাবুই কথাটা তোলে। বলেন:
------- দেখ মা, আমি নীলু আর তোমার সম্পর্কটা জানতাম। মায়ের কাছে শুনেছি। আমার আপত্তি তেমন ছিল না। ভেবেছিলাম তুমি যদি সম্পর্কটা ধরে রাখতে জোর কর তবে ওকে কোম্পাণীতে অংশীদার করে নেব। আর কাজটাতো ও ভালই জানে। সামাজিকভাবে সমস্যা থাকে না। আর্থিক সমস্যার প্রশ্নটাও মিটে যেত । কিন্তু আমি সুযোগটা পেলাম কই ! তুমিও ওকে ধরে রাখতে পারলে না। ও তোমার কথাটা ভাবছে কি না জানি না। এখনতো দেখছি ও আর ফিরবে কি না সন্দেহ। সত্যি যদি রাজনীতিতে জড়িয়ে যায়, গা ঢাকা দেয় তবেতো আর ফেরার তেমন সম্ভাবনা নেই। তোমার ব্যানার্জি কাকুরও সেটাই ভয়। রোজ ই তো কাগজে দেখছো। এখন তোমাকে শক্ত হতে হবে। ওর জন্য বসে থাকলেতো নিজের সর্বনাশ। আমাকে ভুল বুঝ না। আস্তে ধীরে নিজে সিদ্ধান্ত নাও। সময় নিয়ে জানাও।
সোমা সময় নিয়ে উঠে আসে। কোন কথা বলে না। ভাবে বাবাতো কোন ভুল বলছেন না। উনি আর করবেন কি। তাদের সম্পর্কটাতো মেনে নিয়েছিলেন। সেটাই ভাবা যায় না। তবে ও আর বিয়ে করবে না। বাবাকে সেটা জানিয়ে দেবে। এর মধ্যে সোমার মা অসুস্থ হয়ে পড়েন। মারাত্বক অসুখ। সোমার বাবা ব্যস্ত হয়ে পড়েন। মা বেঁচে থাকতে থাকতে সোমার বিয়ে দেবার জন্য অস্থির হয়ে পড়েন। সোমা বাবাকে জানায় সে বিয়ে করবে না। বাবা তাতে রাগ করেন। মা এদিকে সোমাকে রাজি হতে বলে। তিনিও চান সোমার বিয়ে দেখে যেতে। নীলুর ফেরার সম্ভাবনা তেমন সোমা দেখে না। সব দেখে শেষ পর্যন্ত অসুস্থ মায়ের কথা ভেবে বিয়েতে মত দেয়। সে পাত্রস্থ হয়। আর সে পাত্র হল সৌরভ।
৪
কিছুদিন হল মা মারা গেছেন। সোমাও বাস্তুচ্যুত। তার এখন বাবার ওপর রাগ হয়। এখনও সে জানে না নীলু কোথায় আছে। তবে শুনেছে সে নাকি বাড়ি ফিরেছে। কিন্তু কোন মুখে তার সামনে দাঁড়াবে। বাবা জোর করে বিয়ে দিয়েই এই সর্বনাশ করেছে। নইলে নীলুর সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারতো। তাই সে বাবার ওখানে না গিয়ে দেবপ্রিয় সীমার হাত ধরে খড়্গপুরে পাড়ি দেয়। খড়গপুরে চুমকিকে নিয়ে বেশ কাটে। আর সীমা দেবপ্রিয়ের মত সঙ্গী। সীমার শাশুড়িও ওর বন্ধুর মত। খুবই আপনজন। বাড়িতে একটা খোলা মেলা পরিবেশ। চুমকিকে পড়ানো, ওকে গান শেখানো সবেতেই সোমার উৎসাহ। সোমা নিজেও এরকম একটা সংসার চেয়েছিল। হয়তো নীলুর সঙ্গে সম্পর্কটা টিকে থাকলে সেটা সম্ভব হতো। ওর নীলুর জন্য আরও কিছুদিন অপেক্ষা করা উচিত ছিল। বাবার তাগিদে সেটা হলো না। তার বাবার ওপর রাগ হয়। আবার ভাবে বাবা যেটা করেছেন সেটা যে কোন বাবার পক্ষে স্বাভাবিক। অহেতুক সে বাবার ওপর রাগ করছে। বাবাকে ও প্রায়ই ফোন করে। মধ্যে মধ্যে কলকাতায় বাবার কাছে যায়। বাবা ওকে ওখানে গিয়ে থাকতে বলেন। কিন্তু সেটা সে পারে না। আবার একজনকে ছেড়ে আরেকজনের ছত্র ছায়ায় জীবন। সে ভাবতেও পারে না। আর এখানেতো ও মুক্ত মানুষ। এরই মধ্যে চাকুরির জন্য দরখাস্ত করতে থাকে।
হঠাৎ একদিন খবর আসে বাবা অসুস্থ। হাসপাতালে ভর্তি। সে বাবার বাড়িতে যায়। নার্সিং হোম বাবার তদারকি সবই করতে হয়। তার সঙ্গে সোমা। এরই মধ্যে হাসপাতালে সেই বিধ্বংসী অগ্নিকাণ্ড। বাবা বেঁচে যান। তাঁকে কাছেই আর একটা নার্সিং হোমে নিয়ে যাওয়া হয়। সেদিন ওই বস্তিবাসীরা উদ্ধার না করলে উপায় ছিল না। কি যে হ`ত । সোমা ভাবতে পারে না। সোমা আর সীমাকে রোজই নার্সিং হোম যেতে হয়। সেদিন সোমা একাই এসেছে। সীমা আসেনি। নার্সিং হোমে সোমা একটু আগেই এসেছে। সময় হলে ভেতরে ঢুকবে। বাইরে হলে বসে। হঠাৎ চোখে পরে কয়েকজনের একটা জটলা। মনে হচ্ছে ওখানে নিলুও একজন। সবাই যেন অপেক্ষা করছে ভেতরে ঢুকবে। সোমা নিজেকে আড়াল করে। তার আবার চিন্তার সমুদ্রে ঝড়। ফিরে যায় পূরোণ দিনগুলোতে। চোখ থাকে নীলুর ওপর। যেন একটু রোগা হয়েছে। আগের মত ক্ষিপ্রতা চেহারায় প্রকাশ পায় না। তবে সবার মধ্যে ও যেন আলাদা। সবার মাথায় যেন দুঃচিন্তা। আকাশকুসুম ভাবতে থাকে সোমা। এরই মধ্যে ভিসিটের সময় হয়ে গেছে তার হুস নেই। হঠাৎ নীলুকে দেখতে না পেয়ে তার হুস ফেরে। সময় হয়ে গেছে। তাকে ঢুকতে হয়। সে ঘরে ঢুকে বাবার বিছানার পাশে যায়। কিন্তু কেমন যেন অন্যমনস্ক। কাকে খোঁজে। রোজ এসে বাবার হাত ধরে জিজ্ঞেস করে :
------- কেমন আছো ? আজ সেটাও ভুলে গেছে। মেয়ের এই অন্যমনস্ক ভাব দেখে বাবা ব্যস্ত হন। জানতে চান কি হল। শরীর খারাপ কি না। সোমা উত্তর না দিয়ে চেয়ারটা টেনে বাবার পশে বসে। চারদিক দেখতে দেখতে এক জায়গায় এসে চোখ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। দেখে নীলু সঙ্গে একজনকে নিয়ে এক রোগীর তত্ত্বাবধানে। সে জানতে পারে এই ঘরে সেদিন আগুনে পোড়া সব রুগী। বাবার সঙ্গেই সবাইকে এখানে আনা হয়েছে। তবে নীলু এখানে কেন? সোমার মনে প্রশ্ন। সে প্রশ্নের উত্তর সে পেয়ে যায় বাবার কাছেই।
সোমাকে অনুসরণ করে সদাশয়বাবুর চোখ পড়ে ওই বিছানায়। সে নীলুকে দেখে। তার মনে পড়ে সেদিন সেই উদ্ধার কাজে এরাই ছিল। সেদিন সেই ধোঁয়া আর বিপর্যয়ের মধ্যে নীলুকে সে চিনতে পারেনি। আর নিজের শারীরিক অবস্থা তাকে চিনতে দেয় নি। আজ চিনেছে। আর বিছানায় শুয়েতো সেই বৃদ্ধ যে তার সঙ্গে ওই হাসপাতালে ভর্তি ছিল। সদাশয়বাবু বোঝেন নীলু সেদিন উদ্ধার কাজে ছিল। তার কেমন ভাবান্তর হয়। এই সেই নীলু! তার পরিত্রাতা। লজ্জায় আত্মশোচনায় অস্থির হয়ে ওঠে। এরই মধ্যে মনে হয় আজ সোমার এই অবস্থার জন্য সেই দায়ী। নীলুকে সে যদি জামাই করে নিত তবে সোমার এই অবস্থা হ`ত না। সে সোমাকে টেনে পাশে বসায়। বলে:
--------- ওটা নীলু নয় ! সোমা একটু কঠিন হয়ে ওঠে। বলে
-------- হ্যাঁ। কেন?
------- ওরাই সেদিন আমাকে আগুন থেকে উদ্ধার করেছে, বাঁচিয়েছে। তুই আমাকে ক্ষমা কর।
-------- তোমাকে ক্ষমা করার কি আছে ? কি বাজে বকছ ?
-------- তোকে সব বলব। তুই ওকে ডেকে দে।
সোমা অবাক হয়। ভেবে পায় না বাবার কি বলার আছে। কি রহস্য সে কিছু বোঝে না। তাও সে জানতে চায়। আর এই সূত্র ধরে নীলুকেতো একবার কাছে পাওয়া যেতে পারে। সে উঠে গিয়ে নীলুকে ডাকে।নীলু অবাক। এখানে সোমা এলো কেন ? সোমা ওকে বলে বাবা তাকে একবার ডাকছে। কি বলবে। সোমার ইশারায় নীলু দেখে সদাশয়বাবু দূরে বিছানায় শুয়ে। একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে। সোমার অনুরোধ নীলু ফেলতে পারে না। তার আজকের অবস্থার জন্যতো সোমা দায়ী নয়।
নীলু সদাশয়বাবুর কাছে আসে। সঙ্গে সোমা। নীলু আসতেই সদাশয় বাবু ওকে বলেন :
------ আমায় ক্ষমা করে দাও। নীলু বোঝে না সদাশয় বাবু এরকম করছেন কেন? তিনি কি দোষ করলেন যে এভাবে ক্ষমা চাইছেন। ওতো রাজনৈতিক কারনে ধরা পড়ে। জেলে যায় বলে আর কাজে যেতে পারেনি। সদাশয়বাবুর দোষ কোথায়। সদাশয়বাবু বলেন :
------- আমি সোমাকে সব বলছি। তুমি ওর থেকে জেনে নিও। সে লজ্জার ব্যাপার তোমাকে বলতে পারবো না।
সোমা নীলুকে বাইরে অপেক্ষা করতে বলে। নীলু চলে গেলে বাবার কাছে জানতে চায় কি হয়েছে, সে এত উতলা কেন। বাবা ওকে কাছে টেনে নিয়ে যা বলে তাতে সোমা হতভম্ভ। যেন এক অপরাধীর জমানবন্দী।
সোমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। কি অঘটনই না তার বাবা ঘটিয়েছে। আর নিঁখুত চক্রান্ত। কি করে সে এটা নীলুকে বলবে ! আর আজ নিলুই তার বাবার একজন পরিত্রাতা। সেই ছোটোলোক বস্তির ছেলে ! সোমার মনে এক ঘৃণার সঞ্চার হয়। কিন্তু নীলুকে তার জানাতেই হবে। তার প্রতি এই অবিচার, সে জানবে না ! আর সবটা সোমাকে ঘিরে। রাগে ঘৃণায় সে শিউরে ওঠে। সোমা বাইরে এসে নীলুর সঙ্গে দেখা করে। দুজনে রাস্তার ওপারে একটা চায়ের দোকানে ঢোকে। সোমা মাথা হেট করে বসে। কিভাবে কথাটা তুলবে ভেবে পায় না। নিলুই কথা শুরু করে হালকা মেজাজে যাতে সোমার চাপটা কমে। বলে :
-------- এতদিন পর দেখা। কোথায় খুশি হবে, সোহাগে মুখ উপচে পড়বে, তা না। মুখ বেজার করে এ কি ! তবে ডাকলে কেন ?
সোমার সম্বিৎ ফেরে। বলে :
-------- না:, মানে
------- মানে ! তোমার বাবা কি বললেন ! কে কাকে ক্ষমা করবে। আমিইতো উনাকে না জানিয়ে উধাও হয়েছি। আমারইতো ক্ষমা চাওয়া উচিত
----- উধাও হওনি। তোমাকে উধাও করা হয়েছে। তুমি এমন কিছু যুক্ত ছিলে না যাতে তোমায় পুলিশ ধরে। চক্রান্ত করে তোমায় ধরানো হয়েছে। আমার জীবন থেকে তোমাকে সরিয়ে নিতে। আর এই চক্রান্তের কারিগর আমার বাবা শ্রী সদাশয় মুখার্জী। সোমা প্রায় ফেটে পড়ে। একটা অব্যক্ত যন্ত্রণার ব্যাথা মুখে ভেসে ওঠে।
------ হয়েছে কি ? সবটা না বললে বুঝব কি করে। শান্ত হও
-------- এর পরেও শান্ত হতে বল ! তবে শোন। সবটা শুনে তুমিও শান্ত থাকতে পারবে না।
এরপর সোমা সবটা বলে। জানায় যে পুলিশকাকুর সাহায্যে সদাশয়বাবু অহেতুক রাজনীতির দোহাই দিয়ে নীলুকে ধরিয়ে দেয়। নীলু সেভাবে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিল না। সোমার জীবন থেকে নীলুকে সরিয়ে নেওয়ার জন্য তার এই চক্রান্ত। অত্যন্ত নৈপুণ্যের সঙ্গে এটা করা হয় যার আঁচ কেউ পায় না। সদাশয়বাবু আরও জানান যে আজ নীলুকে বিয়ে করে সংসার পাতলে সদাশয়বাবুর আপত্তি নেই। সে অবসর নেবে। নীলুর হাতে তুলে দেবে ব্যবসা।
সব শুনে নীলু বলে :
এতে অবাক হবার কিছু নেই। সেদিন কাগজে পড়লে না একটা গরিব মুসলমান ছেলে ধনী পিয়া নামে হিন্দু পরিবারের এক মেয়ের প্রেমে পড়ায় তার কি পরিণতি। ধর্ম আর বিত্ত নিয়ে অহং মানুষকে কত নীচে নামাতে পারে সে ধারণা আমাদের নেই। এ নিয়ে ভেব না ! এর বিরুদ্ধে লড়াইটা বৃহত্তর লড়াইয়ের অংশ।
এরপর সোমা একটু ধাতস্ত হয়। সে তার বাবার প্রস্তাবটা সম্পর্কে নীলুর মত জানতে চায়। শুনে নীলু হো: হো: করে হেসে ওঠে। বলে :
--------- রাজত্ব শুদ্ধ রাজকন্যা ! দুটো একসঙ্গে সইবে না। যে কোন একটা। কোনটা তুমিই বল। দুজনেই মুচকি হাসে।
---------------------------------------------
১৯/১২/২০২০
----------------------
ছবি ঋণ- ইন্টারনেট