সোনালী দিনের উপাখ্যান
দেবব্রত ঘোষ মলয়
পূর্বকথন
মনন অনেকদিন পর আসে মামারবাড়ি। সূর্য ডাক্তারের চেম্বারে খানিক আড্ডা দিয়ে বেরিয়ে পড়ে মামারবাড়ির উদ্যেশ্যে। পথে দেখতে পায় ক্রন্দনরত ঝিনটিকে। ভালোবাসায় আর সমবেদনায় আদ্র হয় সে, আদরে আবেগে জড়িয়ে ধরে প্রিয় মানুষটিকে। তারপর ...
পর্ব ১৪
পাতাগুলি এসে পড়ে ঝিনটির গায়ে মাথায়। মনন চকিতে মাথা উঁচু করে তাকায় গাছের উপর দিকে। ঘন পাতায় ঢেকে গেছে উপরের ডালগুলি। আর বেশ উপরে ডালপালার ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে কিছু একটা যা অল্প অল্প করে দুলছে।
"ঝিনটি, দেখ তো, উপরে কিছু একটা দেখা যাচ্ছে ডালপালার ফাঁকে" - বলে মনন।
ঝিনটি অন্যমনস্ক ভাবে বলে - "হবে ওই চিল শকুন জাতীয় কিছু।" তারপর কি মনে হতে ভালো করে তাকায় উপরের দিকে। আর তারপরই তীব্র চিৎকার করে জড়িয়ে ধরে মননকে, ঠক ঠক করে কাঁপছে সে।
ঝিনটিকে জড়িয়ে ধরে মনন এবার খুব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখে উপরে। আর তারপরই ভীষণ চমকে ওঠে সে। চিল বা শকুন নয়, ঘন ডাল পাতার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে দুটি ফ্যাকাসে পায়ের পাতা, অল্প অল্প দুলছে সেটা।
একটু ধাতস্থ হয়ে মননকে ছাড়ে ঝিনটি। কান্না থামিয়ে বলে - "মনদা, কি হবে এবার?"
এরপরের ঘটনায় যথারীতি গ্রামে আলোড়ন পড়ে যায়। ধীরে ধীরে লোক জড় হয় অকুস্থলে। আসে পুলিশ। গাছের উপর থেকে নামানো হয় ঝুলন্ত লাশ। দেখার ইচ্ছে না থাকলেও প্রথম প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে থাকতেই হয় মনন ও ঝিনটিকে। নামানোর পর দেখা যায় একটি ১৬-১৭ বছরের কিশোর। পাতলা ছিপছিপে চেহারা, পরনে ফুলপ্যান্ট আর গোল গলা গেঞ্জী। এখনো কচি মুখের আদল। হাই পাওয়ারের চশমা।
গ্রামের ব্যাপার। মুহূর্তের মধ্যেই শনাক্ত হয় ছেলেটি রুইদাস সরকারের ছোট ছেলে অভিজয়, সবাই ডাকে জয়। রুইদাস সরকার বিমার এজেন্ট। এই গ্রামে অবস্থাপন্ন প্রায় সবাইকে বীমা করিয়েছে সে। উচ্চমাধ্যমিক পাশ রুইদাসের বউ কল্পনা অঙ্গনওয়ারি কাজ করে। বাবা মা দুজনেই সারাদিন নিজের নিজের পেশায় ব্যস্ত থাকে। ছেলেদের দিকে নজর দিতে পারে না সেভাবে। বড় ছেলে বিজয় স্কুলের পর পড়াশোনা ছেড়ে দেয়, নেশা ভাঙ করে। তাকে নিয়ে সরকার দম্পতি বিড়ম্বনার মধ্যেই থাকে। কিন্তু ছোট ছেলে জয় খুবই মেধাবী, স্কুলে ফার্স্ট হয়। এবার গ্রামের স্কুলে তাকে নিয়ে খুব আশা, বোর্ড পরীক্ষায় গ্রামের মুখ উজ্জ্বল করবে সে।
এখন গাছতলায় তার লাশ একটি ভ্যান রিকশায় শায়িত। দুজন পুলিশ লাশ নিয়ে যাবে মর্গে। একজন অফিসার এতক্ষন কথা বলছিলেন সূর্য ডাক্তারের সঙ্গে। তিনি বলেন - ডাক্তার বাবু আপনি মনন আর ঝিনটিকে বাড়ি নিয়ে যান। হয়ত তদন্ত এগোলে ওদের একবার জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে।
গাছতলায় গোটা গ্রাম। গুঞ্জন চলছে ঘটনা নিয়ে। ইতিমধ্যেই খবর পেয়ে দৌড়ে এসেছেন রুইদাস আর কল্পনা। ছেলের মৃতদেহ দেখেই জ্ঞান হারিয়েছেন জয়ের মা কল্পনা। সূর্য ডাক্তারের প্রাথমিক চিকিৎসায় জ্ঞান ফেরে তাঁর। সূর্য ডাক্তারের সঙ্গে তাঁর সাদা এম্বাসাডার গাড়িটি আছে, তিনি যাচ্ছিলেন সদর হাসপাতালে বিশেষ কাজে। রুইদাসকে বলেন - "যা হবার হয়েছে। তুমি এখন কল্পনা বৌদিকে নিয়ে বাড়ি যাও। আর মনন, তুইও বাড়ি যা, ঝিনটিকেও আমাদের বাড়ি নিয়ে যা। আমি চট করে ঘুরে আসি সদরে।"
পুলিশ চলে যেত লাশ নিয়ে। ধীরে ধীরে ফাঁকা হয়ে যায় গাছতলা। কিন্তু আকাশী নদী একভাবে বয়ে চললেও নিস্তরঙ্গ গ্রাম ধানসিঁড়িতে জটলার আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে অভিজয়ের মৃত্যু - আত্মহত্যা না খুন এটি? কেন অকালে চলে যেতে হল গ্রামের সবার প্রিয় এই শান্ত শিষ্ট মিষ্টি ছেলেটিকে? কেন?
ক্রমশঃ
বেশ ভালো এগোচ্ছে ..
উত্তরমুছুন