ঘুম ভেঙে গেছে সে কোন ভােরে। কিন্তু শীতের এই ভােরে চোখ মেলতে কার মন চায়। লেপের তলায় মুখ গুঁজে জেগে ঘুমানাের ভান করার সুখ শীতকালেই মেলে। কত খেয়াল.. কত পুরােনাে স্মৃতি ঢেউ তুলে মনের গভীরে। আবার কখনাে শান্তমনে শুধুমাত্র শরীরের উষ্ণতা অনুভব করে কনকনে শীতকে জব্দ করার সুখেও খুশি উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। বিছানায় শুয়ে সেই খুশিকে আঁকড়ে পড়ে আছি অনেকক্ষণ। শরীরের ওমে তেতে উঠেছে লেপের অন্দরমহল। মনে হল কারও পিঠে পিঠ ঠেকে আছে। পাশে কে শুয়ে? কে আবার মা! এই তাে টের পাচ্ছি। মায়ের শরীরের স্পর্শ। একদম গায়ে গা ঠেকিয়ে শুয়ে আছে আমার মা। তাই বুঝি শরীরটা আয়েসে সতেজ হয়ে যাচ্ছে। মনটাও বেশ উদ্বেগহীন। হঠাৎ-মগজের সুইচ অন্—মা!
কিন্তু। মা তাে নেই? গতবছর শীতেই মা হঠাৎ করে একদিন চিরবিদায় নিয়েছেন। তার আগের রাতে ঠিক এরকমভাবেই মায়ের পাশে শুয়েছিলাম, শেষবারের মতাে। তাহলে? আমি কি স্বপ্ন দেখছি? ঘুমের ঘােরে আছি? ঘুমের হুঁশগুলােকে ধাক্কা মেরে সজাগ করে তুললাম। কই নাতাে! ঘুমতাে চোখে নেই। চোখ বুজে আছি মাত্র। কিন্তু তবুও স্পষ্ট টের পাচ্ছি যে পিঠে পিঠ ঠেকিয়ে কেউ শুয়ে আর সেটা যে মায়ের স্পর্শ, তা বুঝতেও ভুল হচ্ছে না কারণ একটা শিশুও তার মায়ের স্পর্শ টের পেয়ে যায়। না.. মুহূর্তে মনটা ডুকরে উঠল। অশরীরী মায়ের শরীরের অনুভব! মা কী সত্যিই পাশে শুয়ে? আমার কি ভয় পাওয়া উচিত? মাকে আবার ভয় কী? পাশ ফিরে দেখব? না, না.. পাশ ফিরলেই যদি মা চলে যায়। মা সারাজীবন ভাের পাঁচটা থেকে রাত বারােটা অবধি খেটে গেছে এ সংসারের প্রতিটি মানুষের জন্য। আজ একটু জিরােক। আর ভয়? মায়ের কাছে তাে ভয় দূর হয়ে যায়, ভয় পাব কেন?
যাতে মায়ের কোনাে অসুবিধা না হয় বা মা টের পেয়ে না যায় এমনি ভান করে পড়ে আছি লেপের তলায় মুখ ঢেকে। হঠাৎ মনে হল সামনের লেপটা নড়ল। কেউ যেন উসখুস করল। তবে কি.. মা এবার সামনে ! কিছুটা উত্তেজনা নিয়ে চোখের পাতা খুলতেই অবাক। একী! কে মুচকী হাসছে। মুখ ফসকে কথাটা আপনেই বেরিয়ে এল..
--- তারামাসি তুমি-ই-ই? আমি ভাবলাম মা।
---হ্যাঁরে, তাের মাও আছে তাের ওপাশে। আমরা দুই বােনেই আছি তাের দুইপাশে। কতদিন আরাম করে ঘুমাইনি বলতো !
--- আজ হঠাৎ?
--- আজ যে তুই আমার লেপটা গায়ে দিয়েছিস। তাই ভাবলাম, যাই একবার লেপের তলার সুখ অনুভব করি। বেঁচে থাকতে তাে আর লেপ গায়ে শােয়া হল না । কাঁথা গায়েই গাঁয়ের পুরানাে বাড়িতে কেটে গেল জীবন। আরাম আর পেলাম কই?
হঠাৎ ধরা পড়ে গেছি, আমতা আমতা ভাব করে কৈফিয়ত দিচ্ছি যেন..
--- হয়েছে কী জানাে তারামাসি, আমি আমার লেপ ভেবেই লেপটা নামিয়েছিলাম বাঙ্ক থেকে, কিন্তু পরে খেয়াল করলাম এটা আমার লেপ নয়, এটা তােমার লেপ। বেশ নরম-গরম...একেবারেই নতুন হয়ে আছে। ভাবলাম, এবছর এটাই গায়ে দিয়ে নিই।
— বেশ করেছিস। গায়ে তাে দিবিই। তুই দিবি নাতাে কে দেবে? আমার তাে ছেলেপুলে নেই। সেই এতটুকু বয়সে বিয়ে হয়ে গেলাম শ্বশুর ঘর, তারপর কিছুদিনের মধ্যে বর গেল মরে। ইঞ্চিপাড় সাদা শাড়িতেই জীবন কাটল। রঙের ছোঁয়া আর পেলাম কই? সে বছর আমার দূর-সম্পর্কের আত্মীয়রা তীর্থ যাচ্ছিল .. কাশী, কেদারনাথ, বদ্রীনাথ দর্শনে | আমাকেও সাধলাে .. তাইতাে এই লেপটা তৈরী করেছিলাম। লাল টুকটুকে লেপ.. প্রথমবার লেপ গায়ে শােয়ার আমেজ, সে কী কম সুখের ! তীর্থ থেকে ফিরে লেপটা তাের মায়ের কাছে গচ্ছিত রেখে গেলাম। ভাবলাম, তাের মায়ের কাছেই সুরক্ষিত থাকবে। আবার যদি কখনাে তীর্থভ্রমণে যাই, তখন কাজে লাগবে। কিন্তু কপালে কী আর সুখ ছিল, একেবারে শেষ তীর্থের ডাক এল। সেখানে যেতে হলে লেপ কাঁথার প্রয়ােজন পড়ে না।
একে একে সব মনে পড়তে লাগল। ছােটবেলার রূপকথা যেন। তারামাসির সাথে আমাদের কোন রক্তের সম্পর্ক ছিল না। তবু, একটা আত্মীয়তার বন্ধন ছিল। তারামাসির দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতে ইচ্ছে করত। তার কথাবার্তা, আচরণ, পরিধেয়.. কোনটাই গ্রাম্য মহিলার মতাে ছিল না, অথচ তিনি প্রত্যন্ত গ্রামেই বাস করতেন। শহরে তাঁর এক অবস্থাপন্ন আত্মীয় ছিল। তাদের বাড়িতে তিনি মাঝে-মধ্যেই এসে থাকতেন। তাই তাঁর চালচলনে আধুনিকতার ছাপ।তারামাসির অবস্থাও মন্দ নয়। একার জীবন। বিষয়সম্পত্তির দেখাশোনা তাঁর ভাশুরপাে করত।
তারামাসি বলতেন-- শােন্ সাবান মাখবি না। মশুরডালের বেসন মুখে মাখবি তাহলে দেখবি, মুখে কোনো ব্রন বেরােবেনা। গায়ের চামড়া মসৃণ হবে, ঝকঝক করবে। মা, কৌটো ভরে ভরে বেসন তৈরী করে রাখতেন আর আমরা আরামসে ব্যবহার করতাম সারা বছর ধরে।
কৌটোর কথা মনে হতেই মনে পড়ল, তারামাসি সেবার তার আত্মীয়ের বাড়ী থেকে কয়েকটা খালি কৌটা, বিস্কুটের টিন নিয়ে এসে আমাদের বাড়িতে রেখে দিয়ে গেলেন। বললেন, রাখ.. পরে বাড়ি নিয়ে যাব। কৌটোগুলাে ভারী সুন্দর দেখতে। কোনােটা চৌকো,কোনটা গােল, কোনােটা লম্বাটে ! এরকম অদ্ভুত ডিজাইনের কৌটো সচরাচর কারাে বাড়িতে দেখা যেত না | অবাক হয়ে ভাবতাম, এইসব অদ্ভুত জিনিস তারামাসি কোথায় পান। সেবার দু-দুটো বড়সড় অ্যালুমিনিয়ামের ঢালাই করা বালতি কিনে আমাদের বাড়িতে রেখে দিয়ে গেলেন। তারপর আর ফেরৎ নিয়ে গেলেন না। হঠাৎই একদিন পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে গেলেন। কিন্তু সত্যিই কী মায়া কাটানাে যায়?
হঠাৎ মনে হল, ঘরে কে ঘােরাঘুরি করছে। কে.. মা? ভাের পাঁচটা হতেই মা ঠিক আগের মতােই উঠে পড়েছে। ঘরময় পায়চারি করে কী যেন খুঁজছে।
--- কী খুঁজছাে মা?
--- আমার দাঁত কোথায় রেখেছিস বলতাে?
--- দাঁত?
--- সেই যে হাসপাতালে, শুতে অসুবিধা হচ্ছিল বলে বাঁধানাে দাঁতের একপাটি মুখ থেকে খুলে রাখলাম। সেটা তাে তুই বাড়ি নিয়ে এলি। কিন্তু আমার তাে আর বাড়ি ফেরা হল না। বলি, সেটা কোথায় রেখেছিস? একটু যে ভালমন্দ খাব তার উপায় নেই। তাছাড়া, দাঁত না থাকলে কী চেহারা মানায় ?
ও তাইতাে। মাকে হঠাৎ হাসপাতালে ভর্তি করা হল। সেবছর শীত বিশেষ পড়েনি।কিন্তু সেদিনটা যেন হাড়কাঁপুনি দিয়ে শীত কামড়ে খাচ্ছিল। সারারাত মাকে কোলে শুইয়ে রেখেছিলাম। মা শুয়ে থাকতে পারছিলেন না। হঠাৎ বাঁধানাে দাঁতের একপাটি খুলে পাশের টেবিলে রাখলেন, কী জানি বােধ হয় খুলে খুলে আসছিল। সকালে আমি সেটা বাড়িতে নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু মা আর সজ্ঞানে ফেরেননি। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন সেদিনই দুপুরে।
--- কীরে, কোথায় রেখেছিস বল? এসেছি যখন, তখন সঙ্গে নিয়েই যাই।
--- ধ্যুত! আমার মনে নেই। তুমি খুঁজে নাও। আমার ঘুম.... পাচ্ছে।
সকালে ঘুম থেকে উঠে কাউকে দেখতে পেলাম না। তবে শরীরে লেগে থাকা মায়ের স্পর্শটা অমলিন। চায়ের কাপ হাতে বিস্কুটের টিন খুললাম, তারামাসির রেখে যাওয়া আয়তাকার ছােট টিন। বাথরুমে জলভরা তারামাসির দুটো বালতি। স্নানের আমেজে তারামাসির শেখানাে বেসনের প্রলেপ।
রাতে গায়ে জড়ানাে তারামাসির লেপ। লেগে আছে মা-মাসির শরীরের গন্ধ। এইভাবেই বুঝি মা-মাসিরা সঙ্গে থাকেন চিরকাল.. চির আলিঙ্গনে।
---------------------------------------------------------------
লেখিকা- রীতা রায়
মহেশমাটি রোড, মালদা
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত
পিন. 732101
মোঃ 7602482082