অনিন্দ্য পাল
================
জানালার বাইরে পরেশদের চালার উপর পায়রা দু'টোর রকম-সকম দেখছিল অসিত। একটা পায়রা, সম্ভবত ছেলে পায়রা অন্য পায়রা টাকে ইমপ্রেস করার চেষ্টা করছিল। ছেলে পায়রাটা মেয়ে পায়রাটার চারদিকে ঘুরে ঘুরে তার মাথায় ঠোঁটে দু-একবার হালকা ঠোকর মেরে বোঝার চেষ্টা করছিল বরফ গলছে কিনা। তারপর আবার পালক - গলা ফুলিয়ে নিয়ে ক'বার নিজের চারদিকে বেশ ভাল করে ঘুরে নিল। হাসি পেল অসিতের। ছেলেরা চিরকাল গলা বুক ফুলিয়ে মেয়েদের ইমপ্রেস করার চেষ্টা করে কিন্তু মেয়েদের এই সমস্যা নেই। ভগবান তাদের এমন করে গড়েছেন যে পুরুষরা জন্ম থেকেই ইম্প্রেসড। অসিতের চোখ আটকে ছিল পায়রা দুটোর উপর। ছেলে পায়রাটা হঠাৎ উঠে গেল মেয়ে পায়রাটার পিঠে। তারপর ঠোঁট দিয়ে মেয়েটার মাথার পালক ধরে বেশ জোরে জোরে ডাকতে লাগল পায়রা দু'টো।
গতরাতে পারমিতার ফ্ল্যাটে অসিতের জামাটা ছিঁড়েছে। গতকাল ভদকাটা একটু বেশিই নিয়েছিল অসিত। মাথাটা ঝিম মেরে থাকলেও বেহেড হয়নি।পারো আরো মাতাল করে দিয়েছিল তাকে।
পিঠে ওঠা পায়রাটা পিঠ থেকে নেমে গেছে। গলা ফুলিয়ে আর একটু বকবক কম করে সেটা উড়ে গেল। মেয়ে পায়রাটা আরো একটু সময় বসে রইলো, তারপর সেটাও উড়ে গেল।
পারোকে বিছানায় রেখে অসিত যখন বাড়ি ফেরে বেশিরভাগ দিনই কাকলি বুবুনকে নিয়ে ঘুমিয়ে থাকে। অসিত চাবি দিয়ে দরজাটা বাড়ি ঢুকে ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়ে। কাকলি জাগে না।
কাকলি বরাবরই একটু ঘুমকাতুরে তার ঘুম পেলে বাকি সবকিছু তুচ্ছ। গত দশ বছরে এমন অনেক রাত গেছে, যখন ঘুমন্ত কাকলিকে আদরে ভরিয়ে দিয়েছে অসিত কিন্তু কাকলি কোন রেসপন্স করেনি। না পরদিন যখন অসিত জিজ্ঞাসা করেছে অবাক হয়ে কাকলি বলেছে
--"কই আমার তো কিছুই মনে পড়ছে না? তুমিতো খুব অসভ্য!"
কাকলি রসিকতা করত।
অসিত কিছুটা অসভ্য তো বটেই।
বিয়ের পর প্রথম রাতে কাকলির সঙ্গে মিশে যেতে যেতে যখন কাকলিকে কামড়ে ধরে রক্তারক্তি কান্ড বাজিয়েছিল। একবার নয় তিন তিনবার। কাকলি ব্যথায় এত জোরে চেচিয়ে উঠেছিল যে অসিতের মা ছুটে এসেছিলেন, ভেবেছিলেন হয়তো ছেলে-বউয়ের মধ্যে কোনো অশান্তি হয়েছে। নিজের ছেলেকে তিনি ভালোই চেনেন।
কলেজে পড়ার সময় অসিত ক্লাসমেট মৌমিতার সালোয়ারের পিছনে ব্লেড চালিয়ে দিয়েছিল। তার সেই অসভ্যতার কথা এখনো কেউ জানেনা। মৌমিতাকে সে প্রপোজ করেছিল, কিন্তু মৌমিতার এক ধমকেই সেই প্রপোজ সুনামির জলে তলিয়ে গেছিল। রাখি বন্ধনের দিন মৌ তাকে রাখি বেঁধে টা টা করে চলে যাওয়ার পর মৌমিতা বুঝতেও পারেনি তার পিঠের দিকটা অসভ্য হয়ে গেছিল।
অসিত চিরকালই একটু অসভ্য প্রকৃতির। কাকলি তখন সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা। অসিত আর নিরামিষ জীবন সহ্য করতে পারছিল না। জোর করে কাকলিকে খুঁড়তে গিয়ে বাচ্চা আর মা দু'জনকেই মেরে ফেলেছিল প্রায়। যদিও সপ্তাহ খানিক হাসপাতালে থাকার পর কাকলি বাড়ি এসেছিল। সে যাত্রায় বুবুনও বেঁচে গেছিলো।
বাচ্চাটা হবার পর থেকে কাকলি যেন কেমন মিইয়ে গেল। সর্বক্ষণ বাচ্চার দেখভাল আর সংসারের কাজে একদম জড়িয়ে নিল নিজেকে। অসিতের তখন মাঠের পাশের এক্সট্রা খেলোয়াড়ের মত হাপিত্যেশ অবস্থা। যদি বা কখনো একটু ঘন হবার সুযোগ হত তখনই যেন কাকলি মিয়ানো মুড়ির মতো বিছানায় পড়ে থাকত। অসিত ক্ষুধার্ত কুকুরের মতো খুবলে খেতে খেতে হঠাৎ কখনো বুঝতে পারত কাকলি অসাড় পুতুলের মত পড়ে আছে। অসিতের সব আগুন নিভে যেত। এভাবে বেশি দিন চলে না। অসিতের পক্ষে এই জীবন মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। তাই কখন যে আরও অসভ্য হয়ে উঠেছে সে নিজেই বুঝতে পারেনি। শরীরের মধ্যে জমাট খিদেটা রাক্ষস হয়ে উঠেছিল।
পায়রা দুটো উড়ে গেছে। চোখ কচলে বিছানা থেকে নেমে এলো অসিত। আজ ঘুমটা একটু তাড়াতাড়িই ভেঙেছে। ঘুম চোখে পায়রার মিলন দৃশ্য দেখে বাসর রাতের কথা মনে পড়ে গেল অসিতের। সেদিন নববধূ কাকলি আর তাকে বৌদিরা ঠেলে বাসর ঘরে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। আড়ষ্ট মেয়েটার সঙ্গে কথায় কথায় মাত্র মিনিট দশেক নষ্ট করেছিল অসিত।
তারপর ঝাপিয়ে পড়েছিল যেন মন্বন্তরের পরে হঠাৎ খাবারের গুদামে এসে পড়েছে।
অসিত বাথরুমে ঢুকলো। বাথরুমে আউটলেটের কাছে কয়েক ফোঁটা রক্ত। অসিত মুখটাকে মেঝের কাছে নামিয়ে এনে ভালো করে খুঁটিয়ে দেখে নিশ্চিন্ত হল রক্তই! চিন্তায় পড়ল অসিত? এ কার রক্ত? তার নয়, এ ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হবার পর ভাবল তাহলে কাকলির হতে পারে! বুবুন তো এই বাথরুমে আসেনা। কাকলির কি তবে ...
কয়েক বছর আগে এই দিনগুলোর হিসাব সেও রাখত। ওষুধের দোকান থেকে ন্যাপকিন সেই কিনে এনে দিয়েছে। এখন কাকলির ঘুমন্ত মুখটা শুধু দেখে। তাও যে রাতে বাড়ি থাকে। সমস্ত দিন অফিসে ফাইল পেষা, তারপর বিকেলে কখনো ময়দান না হলে গঙ্গার পাড়। তারপর সন্ধ্যায় পারমিতা ফ্ল্যাটে। গভীর রাত পর্যন্ত সেখানেই জীবনের পাওনা-দেনা মিটিয়ে নেয়। সবাই চলে গেলেও সে থেকে যায় পারমিতার কাছেই।
রক্তটা চটচট করছে। চটি দিয়ে ঘষে, জল ছিটিয়ে ধুয়ে দিল। একটু ফিনাইল ছড়িয়ে দিয়ে আবার ঘষে দিল পা দিয়ে। রক্ত ধুয়ে গেলে অসিতের মনে হলো আরো অনেক কিছুই এরকম ধুয়ে দিতে পারলে বোধহয় ভাল হত। বুবুনের জন্য মাঝে মাঝে খুব চিন্তা হয়। কষ্ট্ও হয়।
ব্রাশে মাজন লাগাতে লাগাতে অসিতের আবার পায়রা দুটোর কথা মনে হলো। মৈথুনের পর পাখি দুটো দুদিকে উড়ে গেছে। সেও তো পারো কে ছেড়ে চলে আসে। কতদিন বাড়ি এসে চুপিচুপি বুবুনের পাশে শুয়ে পড়ে। তার আর কাকলির মাঝে এখন প্রচুর ব্যবধান। বুবুনই এই দুটো মানুষকে এক ছাদের তলায় এখনো আটকে রেখেছে।
ব্রাশ করতে করতে বেসিনের সামনের আয়নাতে চোখ পড়ে গেল অসিতের। আরে আয়নাটা তো বেশ পরিষ্কার লাগছে। সাবানের ফেনা জল ইত্যাদি ছিটকে কেমন ঝাপসা হয়ে গেছিল। দেখা যেত না। কাকলি হয়তো পরিষ্কার করেছে।
সেই আয়নার চোখে হঠাৎ নিজেকে দেখে ফেলল অসিত। দেখে ফেলল কারণ সে সচরাচর আয়নার সামনে দাঁড়ায় না। তার চুল সব সময় ছোট করে ছাঁটা। হাতটা বুলিয়ে নিলেই ঠিকঠাক হয়ে যায়, আয়না-চিরুনি লাগে না। কিন্তু এখন দেখে ফেলল। আর চমকে উঠল নিজেকে দেখে!
-- এ কাকে দেখছি আয়নায়?
চোখ মুখ ফোলা ফোলা, মাতালদের মত ঠোঁট, আর যেটা তাকে সবচেয়ে অবাক করল,! তার পেট। সেখানে একটা বিশাল আকারের মাংস-চর্বির স্তুপ আস্তানা গেড়েছে। কিশোর বেলা থেকেই নিজের সৌন্দর্য আর চেহারার প্রশংসা শুনে বড় হওয়া বছর পঁয়তাল্লিশের এর অসিত নিজেকে ঠিক চিনতে পারছিল না! ব্রাশটা হাত থেকে খসে নিচে পড়তেই শব্দে তার চেতনা হল, মনে মনে বিড় বিড় করলো --"কবে এমন হলাম আমি?"
দুই
কেমন একটা অস্বস্তিতে কাকলির ঘুমটা ভেঙে গেল। সারাদিনের পরিশ্রমের পর রাত্রে বুবুনকে নিয়ে শোবার পর আর তার জ্ঞান থাকে না। গাঢ় ঘুম তার। ঘুমন্ত অবস্থায় সে অন্য জগতের মানুষ।
এদিক-ওদিক করতে গিয়ে বুঝতে পারলো ভারী কিছুর নীচে সে আটকে পড়েছে।
ঠাহর হতে বুঝল, অসিত তার ওপর পড়ে আছে। কাকলি ভয়ে সিঁটিয়ে যায়! বুবুন কি কিছু দেখল? এই মানুষটা বেহেড মাতাল হয়ে আসবে আর এইরকম সব অদ্ভুত কাণ্ড করবে! বাচ্চাটার কথা কি ভুলেই যায়? এই মুহূর্তে অসিতকে একটা বিতিকিচ্ছিরি দেহসর্বস্ব মানুষ ছাড়া তার আর কিছু মনে হলো না।
কোনমতে নিজে নাইটিটা গায়ে গলিয়ে দ্রুত একটা বিছানার চাদর নিয়ে অসিত কে ঢেকে দেয় কাকলি, তারপর ছোটে বাথরুমের দিকে। বুবুনকে দেখে নিয়েছে তার মধ্যে, ঘুমোচ্ছে বলেই মনে হলো।
বুবুন হবার পর কাকলির নিজের শরীরের চাহিদা তেমন ছিলনা, তখন বাচ্চাটাই তার ধ্যান-জ্ঞান। তবু তার মধ্যেও অসিতকে কাছে আসতে দিয়েছে, কিন্তু দিনের পর দিন অসিত যেন কেমন পাল্টে গেছে। সে অন্তঃসত্ত্বা থাকাকালীনই অসিত অনেক রাত করে মদ খেয়ে বাড়ি ফেরা শুরু করল। প্রশ্ন করেছিলো কয়েকবার। কিন্তু অসিতের কাছ থেকে কোনো সঠিক উত্তর কখনও সে পায়নি। কখনো শুনেছে পানশালায় গেছিল, কখনো বাইপাস।
ধীরে ধীরে কাকলি বুঝে গেছে। আর জিজ্ঞাসা করেনি, বাধাও দেয়নি। তবে নিজেকে যতটা বুঝেছে অসিতের সঙ্গে আর কোন আনন্দ সে পায় না বরং অসিত কে ভয় পায়। অসিতের শারীরিক নৃশংসতা কাকলির মনে এই ভয়ের বীজ বপন করেছে।
ইদানিং কাকলি বুঝতে পারে, অসিত অন্য কোথাও রাতের খোরাক খুঁজে পেয়েছে। অসিতের জামাপ্যান্ট হাতড়ে তেমন কিছু না পেলেও সেলফোনে "পারো" নামের কাউকে পেয়েছিল। এই পারো প্রায়ই অসিত কে ফোন করে, ফোনের কললিস্ট থেকে কাকলি জেনেছিল।
কাকলি এর বেশি কিছু জানতে চেষ্টা করেনি তারপর। সে জানে, অসিত যেখানে শরীরের সুখ পাবে সেখানেই যাবে, তাকে আটকানোর চেষ্টাও করেনি। এমনকি কাকলির কখনো খুব কষ্ট হলে বাথরুমে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়েছে, তারপর চোখ মুখ ধুয়ে আবার আগের মতোই ঘরকন্না করেছে। প্রথম প্রথম মনে হতো জীবন থেকে কিছু একটা যেন হারিয়ে যাচ্ছে। ছেলের খেলনার বাক্স পরিষ্কার করার সময় ভাঙ্গা খেলনা গুলো ফেলে দিতে গিয়ে মনে হয়েছিল অসিতের কাছে সেও ঐরকম ভাঙা খেলনা ছাড়া কিছুই নয়।
অসিত পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়েছে। শরীরের খিদে মিটে গেছে, এবার ঢেকুর তুলে ঘুম! এইতো রুটিন। কাকলির শরীরটা জ্বালা করে ওঠে। এত রাত্রে শাওয়ারটা নেওয়ার পরও জ্বালাটা কমেনি, কমবে না কখনও।
তিন
বুবুনকে গতকাল ক্লিনিকে নিয়ে গেছিল কাকলি। ডাক্তারবাবু বলেছেন ভাইরাল ফিভার। বাড়ি বাড়ি হচ্ছে এই সময়টায়। দিন তিনেকের ওষুধ দিয়েছে, ঠিক হয়ে যাবে।
সংসারের সমস্ত কাজ, ছেলের স্কুল, আঁকা, ডাক্তার, ওষুধ এসব করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেছে কাকলি। দুপুরে ঠিক করে খেতেও পারেনি। গা বমি বমি করেছিল। রুপমকে দুবার ফোনে ধরার চেষ্টা করল "নট রিচেবল। ট্রাই এগেইন আফটার সাম টাইম।" বিরক্তিকর!
রুপম বুবুনের প্রাইভেট টিউটর। সন্ধ্যার দিকে এসে ঘন্টা দুই পড়িয়ে চলে যায়, সপ্তাহে চারদিন। আজ বারণ করবে ভেবে ফোনটা করেছিল কিন্তু হলে তো! যাকগে, এলে বলে দেবে। গড়িয়া থেকে আসে, বাস-অটো করে বেকার ছেলে, পয়সাটা নষ্ট হবে! কি আর করা যাবে? চেষ্টাতো করেছে কাকলি।
মাথাটা দপদপ করছে তার।এই এক সমস্যা হয়েছে ইদানিং কোন বিষয় নিয়ে একটু ভাবলেই মাথাটা দপদপ করে। বলেছিল একবার অসিতকে। গা করেনি। কাকলিও আর বলেনি।
ঘুমের চটকাটা ভেঙে গেল কলিংবেলের তীব্র আওয়াজে। অসিতকে বারবার ডোরবেলে নরম সুরের কিছু সেট করতে বললেও গা করেনি। ওই কান মাথা জ্বলানো বিদেশি আওয়াজ আবার বেজে উঠলো। বুবুনকে পাস ফিরিয়ে দিয়ে, কপালে হাত দিয়ে দেখল জ্বর রয়েছে। থার্মোমিটারে মাপতে হবে। আগে রুপমকে বসিয়ে একটু চা টা করে দিয়ে তারপর জ্বরটা মাপবে।
মশারির বাইরে বেরিয়ে বুঝতে পারল বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। ভাদ্র মাস প্রায় শেষ। ছোটবেলা থেকেই মাসটাকে পছন্দ করেনা কাকলি। বাবা বলতো "পচা ভাদর"। গ্রামের ভাদ্রমাসের সঙ্গে অবশ্য দক্ষিণ কলকাতার এই ভাদ্র মাস মেলে না। যাইহোক জানালাটা বন্ধ করে ঘরের বাইরে এল। ঘর থেকে বেরিয়ে লম্বা ডাইনিং কাম স্টাডিটা পেরিয়ে দরজাটা খুলতে হয়। কিন্ত মাঝপথে কাকলির মাথাটা ঘুরে গেল। তার মনে হলো মাথাটা উপর থেকে নিচের দিকে পাক খাচ্ছে! কয়েক সেকেন্ড! ধাতস্থ হয়ে কাকলি থমকে দাঁড়ালো। একটা চেয়ার ধরে দাঁড়িয়েছিল। টেবিলের উপর থেকে জলটা নিয়ে খেতে গিয়েও রেখে দিল। কেমন একটা অস্বস্তি অনুভব করতে লাগলো সে। যাকগে ঠিক হয়ে যাবে, ছেলেটা এতক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে, দরজাটা খুলে দিই আগে। এরকমটা ভেবে কাকলি টলতে টলতে দরজাটা খুলতে গেল, খুলল কিন্তু তারপর সামনে কে দাঁড়িয়ে আছে দেখার আগেই তার সব ব্ল্যাক আউট হয়ে গেল। শুধু কানে এলো দুবার- "বৌদি বৌদি?"
চার
আজকাল অনেক রাতেই অসিত বাড়ি ফেরে না। অনেক সময় ফেরে রাত ভোর করে, বেহেড মাতাল হয়ে। ফিরে কোনক্রমে বুবুনের পাশে এসে শুয়ে পড়ে।
কাকলি এখন রাত্রে স্নান করে সমস্ত শরীর সুগন্ধি দিয়ে সাজিয়ে অপেক্ষা করে। রুপম আসে।
মাথার মধ্যে কি সব কিলবিল করছিল সে দিন। কতক্ষণ পর জ্ঞান ফিরেছিল সেদিন কাকলি জানেনা কিন্তু জ্ঞান ফিরে দেখল সে দরজার কাছেই রুপমের কোলের উপর পড়ে আছে। রূপমের মাথাটা তার মুখের ঠিক উপরে ঝুকে আছে। ধড়মড় করে উঠতে গেল কাকলি! কিন্তু রুপম তাকে ধরে ফেলল। বলিষ্ঠ হাতের খাঁচায় বন্দী হয়ে গেল সে "আস্তে উঠুন বৌদি। কি হয়েছিল? দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গেই পড়ে যাচ্ছিলেন!"
কাকলি বুকের উপর শাড়িটা গুছিয়ে নিতে নিতে বলে,
--মাথাটা ঘুরছিল। দেখতো কি হলো! এমা তুমি তো একদম ভিজে গেছ?
--ও কিছু না আসলে আপনার চোখেমুখে জল দেব, কিন্তু আপনি পড়ে গেছেন এমন ভাবে, আমি উঠতে পারছিলাম না। হাত বাড়িয়ে রুমালটা বৃষ্টির জলে ভিজিয়ে আপনার চোখেমুখে জল দিচ্ছিলাম।
কাকলি এবার লজ্জা পেয়ে উঠে বসল। রুপম ওকে ধরে ধরে সোফার উপর এনে বসালো। এই মুহূর্তে কাকলির কোনরকম অস্বস্তি বোধ নেই। রুপমের হাতের তালু ওর পিঠ স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত শরীর টানটান হয়ে উঠতে চাইল।
রুপমের উষ্ণতা অনুভব করছিল এতক্ষণ, এবার তার মনে হলো কোন গহীন গভীর সমুদ্র হঠাৎ জেগে উঠেছে। ভয়ানক সব ঢেউ সমস্ত শরীরে আছড়ে পড়ছে। ভিজে যাচ্ছে এযাবৎ শুকিয়ে যাওয়া সমস্ত গুহা গহ্বর বালিয়াড়ি। বৃষ্টি আরও বৃষ্টি হোক, চেয়েছিল কাকলি। চরম বৃষ্টিতে ভেসে যাক ঘরবাড়ি, আর সমস্ত বাস্তবতা। কাকুলি চাইছিল, খুব করেই চাইছিল। আর একবার জোয়ারের নদী হয়ে বাঁচতে।
রুপম ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়েছিল সেদিন কাকলির সর্বত্র। এক পরম সুখে কাকলি সর্বস্ব ছেড়ে দিয়েছিল রুপমের আধভেজা স্বেদ-গন্ধমাখা অস্তিত্বের কাছে।
আজও কাকলি বুবুনকে ঘুম পাড়িয়ে, নিজেকে সম্পূর্ণভাবে প্রতীক্ষার মানুষটার কাছে সঁপে দেওয়ার অপেক্ষায় সোফায় এসে বসলো। টিভিটা মিউট করে চালিয়ে গা এলিয়ে দিল। রূপমের আসতে এখনো কিছুটা সময় বাকি।
পাঁচ
পারোর ফ্ল্যাটের দরজায় বেশ কয়েকবার টোকা দিল অসিত।
আজ একটু দেরি হয়ে গেছে তার। পার্কস্ট্রিটের হেড অফিসে একটু কাজ ছিল। ব্যাংকের এই ব্রাঞ্চটায় তিন জন কর্মী নেই, একটা কন্ট্রাকচুয়াল পোস্ট এর তদ্বির করতে গিয়েছিল। ম্যানেজার হিসেবে তার চাপটাই বেশি।
বিরক্ত অসিত বেশ কয়েকবার দরজায় ধাক্কা দিয়ে ব্যর্থ হয় একটা দুই অক্ষরের খিস্তি দিয়ে সরকার আর মিত্রকে পরপর কল করল। দুজনেই রিসিভ করল, কিন্তু মদ জড়ানো গলায় কি যে বললো, তার কিছুই মাথামুণ্ডু বোঝা যায় না। শেষবারের মতো ধাক্কা দেয় অসিত। কোন সাড়া নেই। একটু থমকে দাঁড়িয়ে ভালো করে দরজাটা একবার লক্ষ্য করে। নাহ, সেকেন্ড ফ্লোর ফ্ল্যাট নাম্বার টু এ। কোনো ভুল হয়নি।
এবার অন্য একটা চিন্তা তাকে গ্রাস করে। পারোকে ফোন করে, সেটাও "সুইচ অফ"। অদ্ভুত ব্যাপার! হলো টা কি? অসিত টেনশনে লিফট না ব্যবহার করে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামে নেমে আসে। রাস্তায় প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একটা ট্যাক্সি পেয়ে যায়, আবার কল করার চেষ্টা করে। কিন্তু সুইচ অফ!
পারোর জন্য বেশ চিন্তা হচ্ছে তার। তেমন কিছু গরম না থাকলেও সে বেশ ঘামছে। হঠাৎ তার অদ্ভুত লাগে। পারোর জন্য তার এত চিন্তা হচ্ছে কেন ?
পারমিতা খাসনবিসের সঙ্গে তার ফ্যালো কড়ি মাখো তেল ছাড়াও কি তবে অন্য কোনো বাঁধন তৈরি হয়েছে? অলক মিত্রের দুরসম্পর্কের বোন পারো।মিত্রের ছেলের জন্মদিনে পরিচয়। মিত্রই তাকে নিয়ে যায় ওর ফ্ল্যাটে। বিবাহ বিচ্ছিন্ন এবং নিঃসন্তান পারোর কাছে সরকারের যাতায়াত অসিতের আগে থেকেই। সরকার বহুজাতিক সংস্থার কর্মী। তার নাড়া বহু জায়গায় বাধা। অসিতের মত সে রেগুলার নয়।
অসিত বুঝতে পারেনা পারোর জন্য তার চিন্তাটা ঠিক কেন? সে কি তাহলে পারোকে ভালোবাসে? নাকি খিদে মেটানোর অভ্যেসে ছেদ পড়ল তাই এই চিন্তা! তবে এটুকু বুঝতে পারে কাকলির জন্য কখনো এত চিন্তা সে করেনি। করতে পারেনি।
বাড়ি থেকে মিনিটখানেক হাঁটা দূরত্বে ট্যাক্সিটা ছেড়ে দেয় অসিত। একটা সিগারেট ধরিয়ে টানতে থাকে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে। বাড়িতে স্মোক করলেই কিচকিচ করে কাকলি। এখনতো বুবুনও বলে "বাবা গন্ধে কষ্ট হচ্ছে তুমি বাইরে যাও।"
সাড়ে ন'টা বাজে। এত তাড়াতাড়ি শেষ কবে বাড়ি ফিরেছে মনে করতে পারল না অসিত। বন্ধ দোকানপাট এর পাশ দিয়ে টলতে-টলতে বাড়ির দরজা পর্যন্ত এল। তার চেতনা খানিকটা হলেও ফিরেছে। পকেট হাতড়ে চাবি খুঁজে দরজা খোলার জন্য যেটুকু দরকার সেটুকুই, তারপরতো আবার সব স্বপ্ন! অসিতের আর স্বপ্ন দেখতে ভাল লাগে না।
খালটার পাশে ক'টা কংক্রিটের বেঞ্চ। এখন ফাঁকা। একটাতে অসিত একটু ঝেড়ে ঝুড়ে বসল। এখনই বাড়িতে ঢুকতে বিশেষ করে কাকলির মুখোমুখি হতে ইচ্ছা করছিল না তার। পারোকে বিড়বিড় করে একটা খিস্তি দিয়ে সেল ফোনটা ঘাঁটতে বসলো। এটা সেটা করতে করতে ভাবল, পারোকে আরেকবার কল করবে কি না?
ভেতরে কি ছিল পারো? দরজাটা খুলল না কেন ? শাঁসালো মাল কেউ এসেছে নাকি? কয়েক সেকেন্ড পর আবার নম্বরটাতে কল করার জন্য টাচ করতে যাবে, তখনই একটা অচেনা নম্বর থেকে ফোন এলো। রিং হতে লাগল। অসিতের ধরতে ইচ্ছে করলো না। অনেক কাস্টমারের কাছে তার নম্বর আছে, এখন আর ব্যাংকের চাপ নিতে পারবে না। কিন্তু দ্বিতীয়বার যখন ফোনটা আবার বাজলো বাজেই থাকলো অসিত কাটলো না। পুরো রিং হল না। তৃতীয়বার বিরক্ত হয়ে ফোনটা রিসিভ করল। কর্কশ ভাবে হ্যালো বলার পর বেশ কিছুটা সময় কেটে গেলেও ওপ্রান্ত নিশ্চুপ। অসিতের মনে এবার অন্য কিছু ধাক্কা মারলো। ঠিক তখনই ওপ্রান্তে পারোর গলা, "আমি পারো।"
রাগে মাথাটা জ্বলে গেল অসিতের।
--হারা... ! এতক্ষণ কোথায় ছিলে? দরজাটা খুললে না কেন? বড় খদ্দের?
পারোর দীর্ঘশ্বাসটা অসিতের কানে পৌঁছায় না। সে অসিতের প্রশ্নের উত্তরটাও সরাসরি দিল না। একটু ভাঙ্গা অথচ তীব্র গলায় বলল,
--তুমি আর এসো না অসিত। ধরে নাও আমার দরজাটা এবার বন্ধ হয়ে গেল।
প্রায় চিৎকার করে উঠল অসিত,
---কিন্তু কেন?
রেগে গেলে অসিতের শরীর এবং ঠোঁট দু'টো কাঁপতে থাকে। এখনো কাঁপতে লাগল।
--- দেখো এমনও তো হতে পারে আমার আর ভাল লাগছে না এই বেচাকেনার জীবন! অথবা আমি সুস্থ নই ! যাইহোক তুমি আর এসো না।
পারোর গলায় যে বিষাদ ছিল, অসিতকে সেটা ছুঁতে পারল কি না বোঝা গেল না। কিন্তু অসিত যে রাগে জ্বলছিল তা বোঝা যাচ্ছিল। অসিত পাওনাদারদের মত করে বলল
--"এই মেয়ে ছেলে আমি কি মাগনা যাই? পকেট খরচের জন্য প্রতি মাসে টাকা গুনে নিস অ্যাডভান্স! এখন অন্য কোন মালদার জুটেছে তাই না?"
সেলফোনের অন্য প্রান্তে কয়েক সেকেন্ড পারো চুপ করে থেকে বলল
--"অসিত এই শব্দগুলো তোমার কাছ থেকে শুনবো আশা করিনি। আর টাকা তো আমি নিয়েছি, না হলে বাঁচতাম না। পেট তো কিছু বোঝে না! কিন্তু আমি, তোমার কাছে অন্তত শরীরটা বিক্রি করিনি। তোমাকে ভালোবাসতাম বললে কথাটা হয়তো খুব ক্লিশে শোনাবে, বেশ্যার আবার প্রেম! তাইনা!
তবু ব্যাপারটা অনেকটা সে রকমই ছিল। আমার দূর্ভাগ্য সেটা তুমি বুঝতে পারোনি, আমি বোঝাতেও পারিনি। যাইহোক আর এসোনা তুমি।"
একটুখানি চুপ করে পারো আবার বলতে শুরু করল-
"প্রথমে ভেবেছিলাম সব যোগাযোগ নষ্ট করে দেব। আগের সিমটা নষ্ট করে দিয়েও মনে হলো তোমাকে শেষবারের মতো একবার ফোন করি, তাই এই নম্বরটা নিলাম।"
অসিতের এবার একটু অন্যরকম মনে হচ্ছিল। সেটা কষ্ট না অন্য কিছু তা অসিত জানে না। রোদ এবং বৃষ্টি একসঙ্গে হলে মানুষের যেমন হতচকিত দশা হয় তেমনি খানিকটা। দুঃখ-কষ্ট বোধহয় তার এত তাড়াতাড়ি আসে না। খুব ধারালো কিছুতে কেটে গেলে যন্ত্রণাটা যেমন একটু পরে শুরু হয়, তেমনি অসিতের সময় লাগছিল। সে একটু বিধ্বস্ত গলায় আবার জিজ্ঞাসা করল
--"কিন্তু কেন পারো? আমার অন্যায়টা কোথায়?"
বিষন্ন এবং ক্লান্ত গলায় পারো আলতো করে হাসলো।
--ন্যায়-অন্যায়ের হিসেবটা এখানে নাইবা করলে! তাতে মেলার সম্ভাবনা কম। ও কথা থাক, আমার সব দরজা গুলো এবার এমনিই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আমি কিছুদিন আগে তোমাকে বলেছিলাম। প্রায়ই আমার তলপেটে ব্যথা হয়। বেশ বেশি ব্লিডিং হয়। তুমি বোধহয় গুরুত্ব দাওনি। ভাড়ার শরীরকে কে আর গুরুত্ব দেয় বল? আজ অসহ্য যন্ত্রণা আর ব্লিডিং নিয়ে ডাক্তার বোসের নার্সিংহোমে গেছিলাম। প্রথমে ভেবেছিলাম হয়তো মেনোপজের সময় হয়ে গেছে। পঁয়তাল্লিশ তো হল। কিন্তু বিভিন্ন চেক আপের পর উনি বললেন সার্ভাইক্যাল ক্যান্সার ।যদিও মূল রিপোর্টটা পেতে সময় লাগবে।
তার গলাটা গভীর খাদে নেমে গেছে। অসিত কিছু একটা বলতে চাইছিল, কিন্তু পারো তাকে থামিয়ে দিল।
"নাহ, অসিত, তুমি আর এসো না। আমি রতনকে খবর দিয়েছি। ডিভোর্স হলেও সে এখনো আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখে। তুমি বরং কাকলি আর ছেলেকে সময় দাও।
পরিবারটাকে বঞ্চিত করো না। আমি দরজাটা বন্ধই করে দিলাম। ভুলে যেও কোনদিন আমার দরজা দিয়ে ভিতরে এসেছিলে। ভালো থেকো। "
অসিতকে কিছু বলতে না দিয়েই কলটা কেটে দিলো পারো। অসিতের স্নায়ুগুলো সব জমাট বেঁধে গেছে। গলাটা খুস খুস করছে । মাথার দপদপানিটা থেমে গিয়ে এখন যেন একটা শীতল স্রোত বয়ে যাচ্ছে। একটু শীত শীত করছে তার।
অফিসের হাতব্যাগটাতে দুটো মদের বোতল ছিল। আজ মজলিসে সেগুলোর সদ্ব্যবহার হয়নি বলে বাড়িতেই কয়েক ঢোক দেবে ভেবেছিল। কাকলি আর বুবুন ঘুমালে এর আগেও কয়েকবার এমনটা করেছে সে।
বেশ কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থাকল অসিত। একটা চরম হতাশা আর অসহায়তা তাকে অবশ করে ফেলেছিল। কি ভেবে ব্যাগ থেকে মদের বোতল দুটো বার করে কয়েক চুমুক দিয়ে খালের মধ্যে ফেলে দিল। তারপর মাথার চুলগুলো খামচে ধরে বসে থাকল। ততক্ষনে দোকানগুলোর শাটার বন্ধ হতে শুরু করেছে।
ছয়
বেশ কিছুটা সময় কেটে গেছে। নিজের দিকে তাকিয়ে সেদিন আয়নায় নিজেকে দেখে যতটা কদাকার লেগেছিল এখন আরো কুৎসিত মনে হচ্ছে অসিতের। নিজের খিদে মেটাতে গিয়ে, নিজের চাওয়া পাওয়ার হিসেব ঠিক রাখতে গিয়ে কবে যে সব হিসেবে ভুল হয়ে গেছে ঘুনাক্ষরেও ধরতে পারেনি। একজন স্বামী হিসেবে সে ব্যর্থ, কিন্তু একজন বাবা হিসেবে তার চেয়েও বেশি ব্যর্থ। বুবুনের জন্মদিনটাও ঠিক করে মনে করতে পারে না। মাথার ভিতর আগুন জ্বলছিল অথচ শরীরটা ঠান্ডা হয়ে আসছিল অসিতের। দোকানপাট সব বন্ধ হয়ে গেছে। রাস্তায় দু-একটা গাড়ি ছাড়া লোক চলাচল প্রায় নেই। তিন মুখো ল্যাম্পপোস্টের একটা আলো তার বাড়ির দরজায় পড়েছে, দরজাটা বন্ধ। দরজাটা বন্ধই থাকে।
অসিত মনে করতে পারেনা, শেষ কবে কাকলি তাকে দরজা খুলে দিয়েছে! বা শেষ কবে এসে কাকলি আর বুবুনকে নিয়ে ডিনার টেবিলে বসেছে? সে এটাও মনে করতে পারে না, শেষ কবে কাকলিকে ভালো করে দেখেছে!
অন্যদিনের মতো অসিতের মাথাটা অ্যালকোহলের থাবায় ক্ষতবিক্ষত হয়নি আজ। ফলে রাত্রির নিস্তব্ধ উপেক্ষা তাকে ছুঁয়ে যাচ্ছিল, নিজের বাড়ীর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে তার মনে হলো যদি সে নাই আসতো তবে কি কারো কিছু এসে যেতো?
একবার পিছন ফিরে দেখল অসিত, পিছনে তাকে ডাকার কেউ নেই। ছিল না কখনো। অন্যসব বাড়ি গুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে একটু। সবাই দায়-দায়িত্ব ভালোবাসার সুখের বাঁধনে জড়িয়ে দুঃখ-কষ্ট ক্ষোভের মরা গিঁট খুলে একটা শান্ত রুটিন রাত কাটিয়ে দিচ্ছে সেই সময়।
সেই শুধু সমস্ত কিছুর বাইরে। সব দরজার বাইরে একা দাঁড়িয়ে আছে।
চাবিটা পকেট থেকে বের করে দরজার লকটা খুলে ভিতরে ঢোকে একজন ধসে পড়া মানুষ নিজের চোখেই কুৎসিততম হয়ে ওঠা একজন মানুষ।
নিস্তব্ধ হলটা পেরিয়ে বেডরুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে তার ইচ্ছা করছিল ঘুমন্ত কাকলি আর বুবুনকে একবার অন্য চোখে দেখতে। যে চোখে সে কখনও দেখেনি। একজন স্বামী হিসেবে, একজন বাবা হিসেবে। এলোমেলো চিন্তা ভাবনা তাকে আরো বিধ্বস্ত করে দিচ্ছিল। দরজাটা ঠেলে ঢুকতে গিয়ে ধাক্কা খেলো অসিত। বাইরে থেকে বন্ধ। দরজাটা খুলে ভিতরে তাকিয়ে ঘুমন্ত বুবুনকে দেখতে পেল। নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে ছেলেটা। কয়েক মুহুর্ত তাকিয়ে থাকে অসিত। শেষ কবে বুবুনের মুখে বাবা ডাক শুনেছে মনে পড়ে না। সকালে ঘুম ভাঙার আগেই চলে যায় স্কুলে রাতে অসিত যখন ফেরে-তখন বুবুন ঘুমায়। কিন্তু কাকলি কোথায়? টয়লেটে? টয়লেটে গিয়ে বুঝলো না সেখানে কেউ নেই। তবে কোথায় গেল কাকলি ? বাইরের বাথরুমে? তবে কি কাকলির এখনো...
সেদিন বাথরুমের মেঝেতে রক্ত দেখেছিল অসিত। ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরের বাথরুমের দিকে যেতে যেতেই পাশের ঘরটার সামনে থমকে দাঁড়ায়। দরজাটা সামান্য খোলা। ভেতর থেকে হালকা নীল আলোর রেখা তার চোখে এসে পড়ে। চোখটা ভিতরে চলে যায় তার। অবচেতনে এগিয়ে যায় কয়েক পা।
ভিতর থেকে যে শব্দ শুনতে পায় সে শব্দই তো সে শুনতে চেয়েছিল কাকলির গলায়। কাকলির গলায় ভালোবাসার, ভালোলাগার সুর তাকে পাথর করে দেয়। কয়েক মুহুর্ত পরেই অসিতের চোখে ভিতরের আলো-আঁধারি কিছুটা স্পষ্ট হয়। দুই আদিম মানব-মানবী পরম আদরে সোহাগে আষ্টেপৃষ্ঠে পড়ে আছে। রতিসুখে বাহ্য জ্ঞান শূন্য হয়ে পরস্পরকে জড়িয়ে ফেলছে। অসংখ্য চুমকুড়ির শব্দ যেন প্রকৃতির সমস্ত জগৎ থেকে কাকলিকে এখন অনেক দূরে ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে।
অসিতের চোখ জ্বালা করে উঠলো। মাথায় কেমন ঘোর লেগে আছে বুকটা যেন হাল্কা হয়ে গেছে। তার শরীরটা অবশ। দেওয়ালটা ধরে নিজেকে সামলে নিল। রুপমকে সেই বুবুনের প্রাইভেট টিউটর করে এ বাড়িতে এনেছিল।
বাইরে বেরিয়ে এল অসিত। একদম বাইরে মূল দরজাটা ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে বন্ধ করে চাবিটাকে জানালা দিয়ে ঘরের মধ্যে ছুঁড়ে দিলো। অসিতের সামনে এখন শুধুই রাত, রাস্তা আর বাদবাকি পৃথিবী। সেখানে আর কোনো দরজা তার চোখে পড়ছে না। বাড়ির এবং চেনা সব দরজা তার জন্য এখন বন্ধ হয়ে গেছে।
অসিত আবার রাস্তায় নেমে এলো। কেউ তাকে ডাকলো না, কেউ জানতে চাইল না, সে এখন কোথায় যাবে?
------------------------
ছবি ঋণ- ইন্টারনেট----
================================
ঠিকানা*
======
অনিন্দ্য পাল
প্রজত্নে -- বিশ্বনাথ পাল
গ্রাম -- জাফরপুর
পোঃ-- চম্পাহাটিি
পিন - ৭৪৩৩৩০
থানা -- সোনারপুর
জেলা -- দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত
Mob: 9163812351
ধন্যবাদ।