বুমেরাং
পারমিতা রাহা হালদার(বিজয়া)
"ফ্যান দেবে মা খুব খিদে পেয়েছে?"! বাসন্তী তাড়াতাড়ি করে গ্লাসে এক চিমটি নুন মিশিয়ে কাজের বাসা থেকে আনা ফ্যান খেতে দিল মেয়েকে। তিন্নি খেয়ে বললো,জানো মা আজ ফ্যানের সাথে অনেক গুলি ভাত পেলাম। কত্ত দিন পর একমুঠো ভাত খেলাম।
ভাতের হাঁড়ি উপুড় দিয়ে হাঁড়ির ঢাকনাটা একটু ইচ্ছা করেই আজ আলগা করেছিল বাসন্তী। মাসের শেষ, মুড়ি বাতাসা কেনার পয়সা টুকুও নাই। একমুঠো ভাত ফ্যানের মধ্যে মিশলে বড়লোক গিন্নিদের বাসায় ভাতে অভাব পড়বে না। কিন্তু ঐ ভাত টুকুতে তিন্নির পেট না ভরলেও ভীষণ খুশি হবে। ভাতের স্বাদ যে আলাদা। অবশ্য বাসি ভাত বাঁচলে দেয় বড়গিন্নি, সে খেলে নাকি তাদের পেটে সহ্য হয়না।
আজ পৌষ সংক্রান্তি তাই পড়ন্ত বেলায় পিঠে পুলির ফরমাইশ হয়েছে। কিলো কিলো চাল ডাল ভিজিয়ে বাসায় এসেছে মেয়েকে ফ্যান খাওয়াতে। বড়গিন্নি বলেছে বাসন্তীর হাতে যাদু আছে না হলে প্রতি বছর এতো সুন্দর করে পিঠে পুলি বানাতে পারে?! মুগপুলি, পাটিসাপটার তো জবাব নেই । প্রশংসা শুনে বাসন্তীর মন মেয়েটার জন্য হু হু করে, ইসসস যদি একটা পিঠেও ওকে বানিয়ে খাওয়াতে পারতাম। ভাত খাওয়ার টাকা নেই পিঠে খাওয়ার বিলাসিতা !!! ভাবাও দুঃস্বপ্ন।
তাড়াতাড়ি বাসার কাজ সেরে গিন্নিদের বাসার দিকে যেতেই রামচাঁদ কাকার সাথে পথে দেখা। ঢেঁকিতে চাল গুঁড়োর কাজ আছে করবি রে বাসন্তী?! পিঠে বানাবার কাজও আছে মিষ্টির দোকানে,বানাতে পারলে অনেক টাকা মাইনে।
কি করে করি কাকু, বড়গিন্নির বাসায় রান্না করতেই সারাদিন কেটে যায়। বাসায় একরত্তি মেয়েটা একাই....
বড়গিন্নি ভীষণ হিসাবি, বাসন্তী এসে পিঠে তৈরি করছে আর বড়গিন্নি সবার জন্য গুনে গুনে ভাগ করে আলাদা পাত্রে সেগুলো রাখছে।
এদিকে তিন্নি সবার বাসা থেকে পিঠে পুলির গন্ধ পাচ্ছে । আজ বড্ড লোভ হচ্ছে, পাঁচ বছর বয়সী তিন্নির পিঠে খেতে। মা বলেছিল বড়গিন্নির বাসায় আজ অনেক পিঠে পুলি, পায়েস হবে সবাই মজা করে খাবে ! আমি ও মায়ের কাছে যাই তাহলে মা আমাকেও বানিয়ে দেবে। মা খুব পচা শুধু ওদের ভালো ভালো রান্না করে খাওয়ায় আর আমাকে ফ্যানে নুন মিশিয়ে....
কি রে তিন্নি তুই এখানে? আমাকে একটা পিঠে দেবে মা?! তুমি তো এত্তো বানাচ্ছ। মেয়ের কথায় ছ্যৎ করে উঠলো বাসন্তীর বুকটা।
" কি হ্যাংলা দেখো! এখানে এসে চুরি করে পিঠে খেয়েছে, এক রত্তি মেয়ের এতো সাহস"-বলেই ঠাস করে তিন্নির গালে চড় কষালো বড়গিন্নি।
"আমি খাইনি পিঠে গিন্নি মা", বেশ জোর দিয়ে বললো তিন্নি। তুই না তো কে খেল ?! দুটো পিঠে কম এই থালায়। কলহ শুনে বাসার সবাই ছুটে এলো। তিন্নির উপর দোষারোপ দেখে বড়গিন্নির ছেলে আর চুপ করে না থেকে বললো আমি খেয়েছি মা ওকে বকোনা। লজ্জায় চুপ বড়গিন্নি। বাসন্তী বললো," আমরা গরিব কিন্তু চোর নই গিন্নি মা। এবার থেকে আর আমি রান্না করতে আসব না"। বড়গিন্নির অনেক অনুরোধেও রাজী হলোনা বাসন্তী। গরিবের আত্ম সন্মানটাই তাদের সম্বল।
রাতে মরদকে খুব মিস করে বাসন্তী। জুটমিলটা যদি বন্ধ না হতো ওদের সুখের সংসারে আগুন কি লাগতো ?! মরদটা দেনার দায়ে কায়ারের মতো গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে বাঁচলো। আর এই হিংস্র পৃথিবীতে একা করে রেখে গেল বৌ মেয়েকে। মেয়েটাকে এবার স্কুলে পড়াতেই হবে ,আমার মতো পোড়া কপাল যেন ওর না হয়। অক্ষর জ্ঞান থাকলে অন্তত মার খেতে হবেনা সবার কাছে। চোখের জল মুছে শক্ত হলো বাসন্তী।
" রামচাদঁ কাকা চলো কোথায় একটা কাজ করতে হবে"। সেকি রে! গতকাল বললি সময় নেই। আজ তো বলছি চলো, যত্ত কাজ আছে করবো কিন্তু মোটা বেতন চাই আমার।
সবাই গান গাইছে টুসুর, চাল পিসছে ঢেঁকিতে !!! (আজ থেকে বাসন্তী নতুন সদস্য।) সারাদিন রাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে বাসন্তী। রাতে মিষ্টির দোকানে পিঠে পুলি বানায়। আস্তে আস্তে মিষ্টি বানানোতে পটু হয়ে গেল বাসন্তী। তিন্নিকেও স্কুলে ভর্তি করেছে। রোজগার বেড়েছে আজকাল ফ্যানের বদলে দুমুঠো গরম ভাত খায় মা মেয়ে মিলে।
আঠারো বছর পর.....
আজ তিন্নি ফিরছে ইঞ্জিনিয়ারিং কমপ্লিট করে। শহরের বড়ো কম্পানি জয়েন করবে। রামচাঁদ কাকা তোমার কাছে আমি আজীবন ঋণী! একি কাঁদছিস কেন?! এইটা আনন্দশ্রু কাকা।
"তুই আসবি বলে আমি তোর পছন্দের সব রান্না করেছি তিন্নি।" এবার তোমাকে নিয়ে শহরে চলে যাবো মা। এখন থেকে তোমাকে আর কষ্ট করে টাকা উপার্জন করতে হবে না।
তুমি আমার সাথে শহরে থাকবে।
এইসব কি বলছিস! আমি এই বাসা ছেড়ে কোথাও যাবোনা, "এখানে জড়ানো সব স্মৃতি "...! জানিস আমার স্বপ্ন, আমার একটা নিজের মিষ্টির দোকান। সেখানে আমাদের মতো অসহায় কয়েকটা নারী কাজ করে উপার্জন করবে।
এক বছর পর শহর থেকে তিন্নি এসে বললো, কাল আমরা পুজো দিতে যাবো তুমি ভোরে রেডি থেকো মা। পরের দিন একটা নতুন দোকানে নিয়ে গিয়ে বললো আজ থেকে তুমি এই দোকানের মালিক মা। এই নাও দোকানের দলিল! খুশি হয়ে মেয়েকে বাসন্তী আশীর্বাদ করে বললো আরো একটা বড়ো কাজ আমাদের করতে হবে তিন্নি!
"একি বাসন্তী, তিন্নি তোরা আমার বাসায়?এতোদিনে মনে পড়লো বড়গিন্নিকে?!"
" আজ যে আসতেই হতো গিন্নিমা। সেদিন তুমি তিন্নিকে চোর ভেবে থাপ্পড় না মারলে আমার জেদ হতোনা আর তিন্নিকে হয়তো বড়ো মানুষ করে তুলতেই পারতাম না । তোমার সেইদিনের অবদান অস্বীকার করি কি করে গিন্নি মা। আজ আমি অসহায় দশটা মেয়ের খাবারের সংস্থা করে দিতে পারলাম, তিন্নির জন্যই সম্ভব হলো। যেন কখনো আর কেউ কোন এক তিন্নিকে দুটো পিঠে পুলি চুরির দায়ে তাদের গায়ে অন্ততঃ চোরের কলঙ্ক লাগাতে না পারে।"
--------------
ছবি ঋণ- ইন্টারনেট
===================
Paromita Raha Halder
C/O Bimal Kumar Halder
Noapara, Ogg Rd. Bye lane,
Land Mark : Near Taltala Math,
PO: Garulia,
Dist: 24 Pagns(N),
743133