গানের মায়াজাল 
জয়িতা দত্ত
   
  এ শুধু অলস মায়া....
  এক অলস দুপুরে রাস্তা দিয়ে ভেসে আসা পুরনো বাংলা গান রিংকীর মনে অদূর অতীতের মায়াজাল বিছিয়ে বসল।
  
  জ্ঞান হওয়া ইস্তক রাস্তামুখী দোতলার বারান্দাটি রিংকীর অত্যন্ত প্রিয় জায়গা।  সেই রাস্তার ওপারে পুজোর প্য্যন্ডেল। সেই প্য্যন্ডেলে পুজোর বেশ কিছুদিন আগে থেকেই মাইকে গান হত- বাংলা-হিন্দী, ফুল ভল্যুমে; সারারাত সারাদিন, নানা গান ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। দশমীর পরেও দু-তিনদিন চলত।কান পাতা দায়,কথা শোনা দায়।  তখন তো শব্দদূষণ শব্দটার চল হয়নি। 
ডেসিবেল? সে আবার কি? পুজোতে ওইভাবেই মাইক বাজবে সেটাই দস্তুর। নাহলে আর পুজো কিসের? তা যাক গে,কার কিরকম লাগত সে জেনে রিংকীর কি কাজ! তার ভীষণ ভালো লাগত।
  গান অন্ত প্রাণ ছিল রিংকীর। একলাটি তাই  বারান্দায় বসে তন্ময় হয়ে গান শুনত। গান তত সে নিশ্চয়ই বুঝত না, কিন্তু সুরের জালে বুঁদ হয়ে থাকত।  রিংকীর এই নিজস্ব জগতের কথা সবার কাছেই ছিল অজানা।
  
  
  এইরকম ভাবেই পুজো আসে,পুজো যায়।গান হয়,গান থামে।  রিংকীর মনে কোনো গান  রেখাপাত করে কিনা জানা যায় না। সময়ের সাথে রিংকী একটু একটু করে বড় হয়, মুখে কথা ফোটে। এরকমই একদিন এক পাড়াতুতো পিসী মাকে কোন এক জায়গায় যাবে কিনা জিজ্ঞেস করতে এলে আগ বাড়িয়ে রিংকী পিসীকে সুর করে  জানিয়ে দিল, ' নানানা, আজ রাতে আল যাত্তা শুনতে যাব না,আমিও না, মাও না, বাপিও না'। হাসির ঝড় বয়ে গেল। এরপর রিংকীর গানের খ্যাতি (?) ছড়িয়ে পড়ল।বাড়িতে যেই আসত সেই-ই ওর কাছে গান শুনতে চাইত আর ও ওই লাইনটাই নেচে নেচে হাত নাড়িয়ে আধোআধো গেয়ে শোনাত।অত গানের মধ্যে এই  লাইনটাই যে তার শিশুমনে কেন জায়গা করে নিয়েছিল তা তো সে বলতে পারবে না ! আরো একটু বড় হয়ে পুজোর পর যখন যাত্রা দেখা শুরু হল, তখন  মায়ের মুখে রিংকী এই গল্পটা শুনেছিল। তখন থেকে ই সে অপেক্ষায় ছিল এই গানের সিনেমাটা দেখার জন্য। দেখেওছিল টিভিতে, নিশিপদ্ম। মান্না দে-র গলায় গানটা ছিল 'নানানা, আজ রাতে আর যাত্রা শুনতে যাব না,বুঝলে নটবর '।
  
  
  রিংকী আরো বড় হতে লাগল। আরও গান শুনতে থাকল প্রতি পুজোতে। কোন এক পুজোয় শুনল মেরে সপ্নো কি রাণী কব আয়েগী তু.... গানের মানে নয়, সুর তাকে টানে। এইসময় বড়দের আড্ডায় তার কানে এল... ওহ্ কি দৃশ্য! পাহাড়ের রাস্তায়, মানুষের ঘরের পাশ দিয়ে টয় ট্রেন যাচ্ছে !! কেউ কেউ তো বলল শুধু ওই  দৃশ্য দেখবার জন্য নাকি আবার সিনেমাটা দেখবে!  কিন্তু  রিংকীর হয়েছে মহা মুশকিল ! এক সিনেমা কি তা তার জানা নেই। রেল সে তখন চড়েছে।কিন্তু টয় ট্রেন ! মানে খেলনা রেল ! তার ভিতর মানুষ? পাহাড়? এগুলো নিশ্চয়ই রূপকথার গল্প! কোথায় দেখা যায়? আমি দেখব - বলতেই বাপির চোখরাঙানিতে থমকে গেছিল। একজন সান্ত্বনা দিয়ে বলল কখনও দার্জিলিঙে গেলে দেখতে পাবি। এতদিন ছিল সুরের টান;এবার তার সাথে  খেলনা রেল দেখার টান জুড়ে গানটা তার মনে একেবারে গেঁথে গেল। বড় হয়ে সে দার্জিলিঙ যাবেই যাবে খেলনা রেল দেখতে। দিন গড়ায়। কলেজে পড়ার সময় বন্ধুরা মিলে একদিন একটা সিনেমা দেখতে গেল - আরাধনা ! ও বাবা! গানটা যে এখানে ! কিশোর কুমারের গাওয়া।  আর সত্যিই কি অপরূপ দৃশ্য!! খেলনা রেলে চড়ার ইচ্ছেটা রিংকীর মনে আরো চেপে বসল।সেই খেলনা রেল রিংকী দেখেছিল বৈকি ! আরো প্রায় পঁচিশ বছর পর। চড়েওছিল। শিশুবেলায় শোনা সেই গান থেকে তৈরি কাঙ্ক্ষিত ইচ্ছেটা মধ্যবয়সে এসে তার পূর্ণ হল।
  
  এইভাবে বহুর মাঝে একটা দুটো গান কার জীবনে কি দাগ যে রেখে যায় তা কে বলতে পারে !!
 --------------- 
ছবি ঋণ- ইন্টারনেট 
==========================
  

