ছোটগল্প ।। অব্যক্ত ভালবাসা।। চন্দন চক্রবর্তী
অব্যক্ত ভালবাসা
চন্দন চক্রবর্তী
"যদিদং হৃদয়ং মম তদিদং হৃদয়ং তব"- কথা কটা কদিন ধরে মাথায় ঘুরছে আর জ্বালা ধরাচ্ছে !
এখন বিকেল । পার্লার থেকে ভদ্র মহিলা এসে আমাকে সাজাচ্ছেন ৷ এতদিন নির্বিচারে অত্যাচার সহ্য করে এসেছি,আজও করছি ৷ কিন্তু ভেতরে ভেতরে জ্বলছি ! একটা লোককে চিনিনা,জানিনা তাকে হৃদয় দেব কি করে ! এই প্রহসনের কোন মানে হয় !
নীলদা আমার দাদার বন্ধু বছর কয়েক ওকে দেখছি ৷ আর প্রথম দেখা থেকেই ওর প্রেমে পড়েছি । কিন্তু কিছু একটা বলতে গেলেই গলাটা বুজে আসে । দূর ছাই ! কেন এমন হয় কে জানে । রোজই ভাবি কিছু একটা বলবো । ফাঁকা পেয়ে বলতে গিয়েও কেন যে বলতে পারিনা । শরীরটা ভার ভার ঠেকে । জ্বিভটা কেমন ভারী হয়ে যায় । গলা শুকিয়ে যায় !
আর নীলদাটাই বা কেমন ! ওর হাব ভাবেওতো কত পরিবর্তন এসেছে । ওর তাকানো কেমন বদলে গ্যাছে ! ব্যাটা ছেলে হয়ে ওরইতো এগিয়ে আসা উচিত ছিল ! আমি নিশ্চিত ও আমাকে ভালবাসে ! কিন্তু এরপরেও না আমি, না নীলদা,মনের কথাটা বলতে পারলাম !
মাস ছয়েক আগে একদিন দাদা বাড়ি ছিল না । নীলদা এলো,আমরা দুজন গল্প করছি । ওর নাম্বারটা আমাকে দিল । সেভ করে রাখছি । হঠাৎ ও কাছে এসে আমার হাতটা ধরে কিছু একটা বলতে গেল,আর সেই মুহূর্তে মা ঘরে ঢুকলো চা নিয়ে ।
ব্যাস ওই পর্যন্তই । এতেই আমরা দুজনেই অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম । ঘামে আমার ভেতরটা ভিজে গেল । একটা ভালো লাগা আমার দেহে ছড়িয়ে পড়ল। এই প্রথম পুরুষের ছোঁয়া আমাকে দিশেহারা করলো ।
কিন্তু ঐদিনের পর থেকে ছমাস কেটে গেল,না নীলদা আমাদের বাড়ি এলো,না কোন ফোন করলো । যে মানুষটা সপ্তাহে একদিন হলেও আমাদের বাড়ি আসতো তার কোন সাড়া শব্দ নেই ! বড় মুখ করে ফোন নাম্বারটা দিল অথচ ! মেসেঞ্জারে লিখেতো জানাতে পারতো !
এদিকে আমিও চেষ্টা করিনি তা নয়,একদিন লজ্জার মাথা খেয়ে ফোনে চেষ্টা করলাম । সুইচ অফ ! ম্যাসেজ করলাম ! কোন উত্তর নেই !
দাদাকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম নীলদা বিশেষ কারণে খুব ব্যস্ত,কাজেই আর আসবে না । কিন্তু দাদার কথাগুলো যখন বলছিল মনে হল কিছু লুকোচ্ছে ! দাদা কি আর আমাদের সম্পর্কের ব্যাপারটা আঁচ করে নি ! তবে এড়িয়ে গেল কেন !
আমার বাবা নেই । আমাদের সংসারে দাদাই সব । সেই দাদাই আমার সম্বন্ধ দেখা শুরু করল । ছটফট করতে লাগলাম । আবার নীলদাকে ফোন করলাম,মেসেজ করলাম । না কোন সুবিধা হল না । এখন মনে হচ্ছে ওর বাড়ির ঠিকানাটা যদি নিয়ে রাখতাম !
বাড়ির চাপে বাধ্য মেয়ে হয়ে বিয়েতে মত দিলাম । এক বুক অভিমান নিয়ে রাজি হয়ে গেলাম । কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি তারপর থেকে এত দিন একটা করে দিন গুনে যাচ্ছি আর একটা কষ্ট বুকে চেপে মুখে কপট হাসি রেখে সামলে চলেছি ৷ একটা অবসাদ আমাকে চেপে ধরেছে !
আজ আমার বিয়ে । আজও যন্ত্র চালিতের মত যে যা বলছে করে যাচ্ছি !
হঠাৎ মেসেজটা এলো !
আমাকে ক্ষমা কর । ধরে নাও তোমার মঙ্গল চেয়েই সরে এলাম । তোমার আগামী সুখের হোক । যেতে পারলাম না । তার জন্য আর একবার ক্ষমা চেয়ে নিলাম ।
মেসেজটা পড়ে আমার শরীরে মাথা থেকে পা পর্যন্ত রাগের তরঙ্গ ছুটছে । কাপুরুষ না হলে সামনে আসার হিম্মত নেই ! এতদিন একটা খবর পর্যন্ত দিল না ! আর এখন !
আমার সারা শরীর কাঁপছে ।
পার্লারের ভদ্রমহিলা আমাকে দেখে চোখটা কুঁচকালেন ৷ ওর কাজ করতে অসুবিধা হচ্ছে । জিজ্ঞেস করলেন আমার শরীর খারাপ লাগছে কি না !
মাথা নেড়ে না জানিয়ে বাথরুমে যাবার নাম করে একটু সময় নিলাম স্বাভাবিক হতে ।
ফিরে এসে আবার মেকআপে বসলাম । মনের ভিতরে খচ খচ করছে । কোন কারন খুঁজে পেলাম না কেন নীলদা এমন করল !
নিতান্ত বিরক্তি নিয়ে সমস্ত অনুষ্ঠান মেনে উৎরে গেলাম ঠিকই,কিন্তু রাগটা রয়েই গেল ।
দ্বিরাগমনে এলাম । এতদিন একটার পর একটা ব্যস্ততার মধ্যে দিনগুলো কেটেছে গেছে । কিন্তু বাপের বাড়ি আসায় আজকে মনে হচ্ছে দৌড়ে গিয়ে নীলদার সামনে প্রশ্নটা রাখি ।
আমাদের আসার কারনে বাপের বাড়িতে দুচার জন এসেছে । কথাবার্তা হচ্ছে । মাকে দুজনে প্রনাম করলাম। কিন্তু দাদাকে দেখছি না ! আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে আমার বর কথাটা পাড়ল ।
মার মুখে কথা কটা শুনে আমার ভেতরটা হুহু করে উঠল । তাড়াতাড়ি নিজেকে আড়াল করতে সেখান থেকে সরে চোখদুটো চাপা দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম ।
নীলের লাঙ ক্যানসার হয়েছিল । আজ সকালেই মারা গেছে !