সোনালী দিনের উপাখ্যান
দেবব্রত ঘোষ মলয়
পূর্ব কথন
আমবাগানে মনন আর ঝিনটির ভালবাসা গভীর হয়। কিন্তু তাল কাটে এক অভাবনীয় ঘটনায়। ওদের চোখে পড়ে আমবাগানে ঝুলন্ত লাশ। গ্রামের লোক জড় হয়, আসে পুলিশ। জানা যায় ঝুলন্ত লাশ বিমার এজেন্ট রুইদাস সরকারের মেধাবী কিশোর ছেলে জয়-এর। এরপর ...
পর্ব - ১৫
মনন ঝিনটিকে নিয়ে মামার বাড়ি ফিরতেই সবাই ঘিরে ধরে ওদের। জানতে চায় আমবাগানের ঘটনা। মনন বলে সব। ঝিনটি চুপটি করে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে শোনে সব, কোন কথা বলে না। রাজালক্ষী দেবী বসে ছিলেন আরামকেদারায়। তিনি জন্ম থেকেই ঝিনটিকে কোলে পিঠে বড় করেছেন। জানেন এই মেয়েটির মন বড় নরম , তুলতুলে। তার উপর ওরকমভাবে বাবাকে হারানোর শোক, হাসিখুশি মেয়েটাকে চুপ করিয়ে দিয়েছে। এর উপর আজ এইরকম একটা মর্মান্তিক ঘটনা চোখের সামনে দেখল ও। মিষ্টি কিশোর জয়কে ও ছোট ভাইয়ের মতোই ভালবাসত, দেখিয়ে দিত পড়া, খাওয়াত কুলের আচার।
রাজলক্ষী দেবী উঠে আসেন ঝিনটির কাছে। কোলের কাছে টেনে নিতেই মেয়ের সে কি কান্না, গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে তাকে ঘরে নিয়ে যান তিনি।
রাতে খাওয়া দাওয়ার পর অন্য দিনের মতোই রাজ লক্ষীদেবীর বিশাল খাটের একপাশে শুয়ে পড়ে ঝিনটি। সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে কাদা ক্লান্ত মেয়েটি। রাজলক্ষী দেবীও ঠাকুর নমস্কার করে শুয়ে পড়েন।
পরের দিন সকাল থেকেই আকাশের মুখ ভার। অল্প অল্প বৃষ্টিও হচ্ছে অসময়ে। এর মধ্যেই গ্রামে গুঞ্জন ওঠে। জয়ের লাশ পোস্ট মর্টেম এর পর গ্রামে এসেছে। থেকে থেকেই অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে জয়ের মা কল্পনা। গ্রামের বউরা তাকে সামলাবার চেষ্টা করে। পাড়ার ছেলেরা সৎকারের আয়োজন করে। মননও যায় তাদের সাথে আকাশী নদীর তীরে গ্রামের শ্মশানে। আজ গোটা গ্রামেই প্রায় অরন্ধন। গ্রামের শ্মশানে কোন ডোম নেই। বেকার নদে মল্লিক অন্যবারের মতোই পাড়ার ছেলেদের নিয়ে চিতা সাজায়। বিড়বিড় করে বলে গ্রামে কু নজর পড়েছে, না হলে একটার পর একটা এই রকম ঘটনা ঘটে।
দাউ দাউ করে চিত জ্বলছে। নদীর চড়ায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে বিষণ্ণ শবযাত্রীরা। তারা আগেও এসেছে এখানে, কিন্তু এইরকম একটি হাসিখুশি প্রাণবন্ত কিশোরের অকাল মৃত্যু তাদের স্তব্ধ করেছে।
মনন চুপ করে বসে আছে নদীর দিকে তাকিয়ে। আনমনে ভাবে সে, কত দুঃখ কষ্ট মানুষের জীবনে। তার বাবা, ঝিনটির বাবা হারিয়ে গেল। আর ফিরে আসবে না হাজার ডাকলেও, কাঁদলেও। ছোট্ট জয় চলে গেল কোন অভিমানে কে জানে। বড় বিষণ্ণ হয়ে যায় তার মন। নদী বয়ে যায় আপন মনে। তার কোন হেলদোল নেই। একটা পালতোলা নৌকা যাচ্ছে স্রোতের সাথে ভেসে। নৌকাটার পিছনেই ভেসে যাচ্ছে একটা মৃত পশু, গরু সম্ভবতঃ। চলমান সেই মৃত পশুকে ঠুকরে খাচ্ছে একটা চিল, তারই দেহের উপর বসে। জ্বলন্ত চিতার কুণ্ডলী পাকানো ধোঁয়া পাক খেয়ে উঠে যাচ্ছে আকাশে।
ক্রমশঃ