গল্প।। সম্পর্ক ।। অঞ্জনা দেব রায়
সম্পর্ক
অঞ্জনা দেব রায়
অমিতবাবু ও মানসবাবু দুজনেই প্রতিবেশী । দুজনের বাড়ির সীমানা একটা পাঁচিল দিয়ে আলাদা করা ঠিকই কিন্তু দুটো বাড়ির মধ্যে একটা সুসম্পর্ক আছে । দুজনেই প্রতিদিন একসাথে মর্নিংওয়াক করেন ও
একসাথে বাজারে যান এবং বিকেল হলেই বাড়ির সামনে মাঠে গিয়ে গল্প করেন । দুই বাড়ির গিন্নীদের সাথেও ভালই মিলমিশ ছিল । অমিতবাবুর একমাত্র ছেলে বনি কলেজে বিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র । আর মানসবাবুর এক মেয়ে জলি শহরের এক নামী স্কুলের বারো ক্লাসের ছাত্রী । ছেলেটি ও মেয়েটির মধ্যে খুব একটা কথা নেই তবে মাঝেমধ্যে চোখাচোখি হয় । অমিতবাবুর গিন্নীর একটু ফুলগাছ লাগানোর সখ বলে দু বাড়ির পাঁচিলের গা ঘেঁষে অনেকরকমের ফুল গাছ লাগিয়েছে । কিছুদিন পরে গাছগুলি বড় হয়ে ফুল ফুটেছে তবে কিছু কিছু গাছ একটু বেশি লম্বা হয়ে পাঁচিলের ওপর দিয়ে গিয়ে মানসবাবুদের বাড়ির সীমানায় পড়েছে ।
তার মধ্যে শিউলি, পদ্ম , মাধবিলতা, জবা কিছু গাছ বড় ও ঝাঁকড়া হয়ে পাঁচিলের দুদিকে ছড়িয়ে পড়েছে ।যখন ফুল ফোটে তখন দু বাড়ির মানুষ পুঁজোর জন্য ফুল তুলে নেয় । এই পর্যন্ত সব ঠিকঠাক ছিল , কোন ঝামেলা ছিল না । কিন্তু সমস্যা বাধে বসন্তকালে । এই সময় গাছের পুরনো পাতা ঝরে নতুন পাতা বের হয় । বেশীরভাগ ঝরাপাতা মানসবাবুর বাড়িতে পরে অপরিষ্কার তো হচ্ছেই এছাড়া শিউলি গাছের শুয়োপোকাগুলো সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে । ফলে মানসবাবুর গিন্নী গাছের ডালগুলি নিয়ে একটু আপত্তিকর মন্তব্য করেন । তাতে অমিতবাবুর গিন্নী অসন্তুষ্ট হয় । এইভাবে একটু একটু করে দুই বাড়ির মধ্যে মনোমালিন্য তৈরি হয় ।
একদিন তো মানসবাবুর গিন্নী অমিতবাবুর গিন্নীকে যথেষ্ট চড়া স্বরে বলেই ফেলল গাছের ডাল কাটার
কথা । মানসবাবু গিন্নীকে খুব ভাল করেই চেনে , রাগের মাথায় যদি সত্যিই সে নিজেই গাছের ডাল কাটতে যায় , তা হলে তো বড় রকমের গোলমাল বাঁধার আশঙ্কা । মনে মনে ভাবলেন অমিতবাবু লোকটি খুব ভাল মানুষ, বুঝিয়ে বললে বুঝবেন। আর মানসবাবু মানুষটি সবরকম গোলমাল ও ঝামেলা থেকে দূরে থাকতে পচ্ছন্দ করে । মানসবাবুর রাগ যে হয় না তা নয় ,মাঝেমাঝে খুব রাগ হয় । নানারকম যুক্তি খাড়া করে মনকে ঠাণ্ডা রাখার চেষ্টা করেন । আর ভাবেন রাগারাগি করার চেয়ে ঠাণ্ডা মাথায় সমস্যার মীমাংসা করে নেওয়াই ভাল , তাতে ঝামেলা হওয়ার সমস্যা থাকবে না । সবসময় কম্প্রমাইজ করে চলা ভাল । মানসবাবু তার গিন্নীকে শান্ত ভাবে বোঝাতে গেলে গিন্নির রাগ আর বেড়ে গেল । সে দ্বিগুণ উচ্চ স্বরে চেঁচিয়ে উঠল আর বলতে লাগল “প্রতিবছর ধরে বসন্তকালে পাতা পড়ে নোংরা হয় বাড়ি আর শুঁয়োপোকা ঘরে ঢোকে । তোমার সাহসে না হয় আমিই যাচ্ছি ওদের বাড়ি । “ মানসবাবু গিন্নিকে বলল “তোমার যেতে হবে না । আমি সকালে যখন হাটতে যাব তখন অমিতবাবুকে বুঝিয়ে বলব ।''
পরদিন সকালে মানসবাবু অমিতবাবুকে ফুলগাছের যে ডালগুলো ওনাদের বাড়ির দিকে পড়েছে সেগুলিকে কাটিয়ে দিতে বললেন । অমিতবাবু কণ্ঠস্বর গম্ভীর করে সামান্য উষ্মার সঙ্গে বললেন, “ফুলগাছের কোন ডাল আমি কাটতে পারব না । ওতে সংসারে অশান্তি হবে । খুব অসুবিধা হলে আপনি নিজে কাটিয়ে নিন ।
মানসবাবু একটু রেগে গিয়ে বললেন “ গাছ যখন আপনারা লাগিয়েছেন , গাছের ডাল আপনাদের কাটা উচিত ।
আমি কেন কাটতে যাব ? আমার ঘরে গাছের পাতা পড়া নিয়ে অশান্তি হচ্ছে তাই বললাম । “
এইভাবে দুই প্রতিবেশীর মধ্যে সামান্য জিনিস নিয়ে সুসম্পর্ক নষ্ট হল । অমিতবাবু ও মানসবাবু দুজনেই
মনে মনে খুব কষ্ট পেলেন । এদিকে অমিতবাবুর ছেলের সাথে মানসবাবুর মেয়ের যে একটা প্রেমের সম্পর্ক হয়েছে সেটা দুই পরিবারের কেউ জানে না । একদিন জ্যোৎস্না রাতে অমিতবাবু দেখলেন পাঁচিলের গা ঘেঁষে ওনার ছেলে বনি ও মানসবাবুর মেয়ে জলি দুইজনে গল্প করছে আর বনি গাছ থেকে গোলাপ ফুল তুলে জলিকে দিচ্ছে । বনি ঘরে আসলে অমিতবাবু জিজ্ঞাসা করতে গেলেই বনি বলল “বাবা আমি জলিকে ভালবাসি , আর আমি জলিকে বিয়ে করতে চাই । “ অমিতবাবু বললেন মানসবাবুদের সাথে আমাদের আগের মত সম্পর্ক নেই এছারা মানসবাবুর গিন্নির যা মেজাজ তোমাদের এই সম্পর্ক মেনে নেবেন কিনা জানি না । বনি বাবাকে
বলল” তুমি চিন্তা কোরো না , আমি বলে সব ঠিক করে নেব দেখবে ।“
পরদিন বনি মানসবাবুর বাড়িতে গিয়ে সব কথা বলার পর দেখল মানসবাবু ও তার গিন্নী রাগ না করে
খুশিমনে মেনে নিলেন । বনি তখন মানসবাবু ও অমিতবাবুকে বলল “ তোমরা সামান্য ফুলগাছের ডাল ও শুঁয়োপোকা নিয়ে নিজেদের মধ্যে যে সুসম্পর্কের বিচ্ছেদ ঘটিয়েছেলে আমরা দুজনে সেই ভাঙা সম্পর্কটা যাতে সুস্থ সম্পর্ক হয় তার ব্যবস্থা করলাম । একটা ভাল সম্পর্ক গড়তে অনেক সময় লাগে কিন্তু ভাঙতে সময় লাগে না । “
কিছুদিন বাদে ভাল দিন দেখে বনি ও জলির বিয়ে হয়ে গেল আর দু বাড়ির মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে উঠল।
-----------
লেখিকা – অঞ্জনা দেব রায়
ঠিকানা – ৫৫৩ পি মজুমদার রোড
কলকাতা – ৭৮