সারবারাসের ছবি
অনিন্দ্য পাল
১
বৈশাখ দেওয়াল ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে বিরক্ত হল। মনে মনে পঙ্কুকে দু-একটা বাজে কথা বলে আবার ভূগোল বইটা খুলে বসলো। পঙ্কুদাটা যেন একটা কী! ঘড়িটাতে ব্যাটারিও দেয়নি। এগারোটা কুড়ি বেজে সেই যে থেমে গেছে, গত সোমবার এসেও যেমন দেখেছে, আজও একদম সেখানেই আটকে আছে। কতক্ষণ এভাবে হাঁ করে বসে থাকা যায়? তিনি এখন গেছেন চা খেতে, মোড়ের মাথায় বাবলুর দোকানে। আর একবার যদি কিছু নিয়ে তর্কে মেতে ওঠে তা হলে তো হয়েই গেল, পাক্কা একঘন্টার আগে আর আসছে না। ঘড়ি বন্ধ থাকলেও, বৈশাখ মোটামুটি বুঝলো সে দশ মিনিটের বেশি বসে আছে।
পঙ্কুদা, মানে পঙ্কজ বৈদ্য। বাবুদাদের এই বাড়িতে ভাড়া থাকে। নিচের তলার দু'টো ছোট ছোট ঘর। ব্যাচেলর। রান্নার বালাই নেই। পাইস হোটেলে খাওয়া।
কমার্সের ছাত্র। একটা ছোটখাটো প্রাইভেট কোম্পানিতে কাজ করে। চাকরির পরীক্ষার জন্য পড়াশুনা করছে। বৈশাখের ছোটকা রন্টু বিজ্ঞানের ছাত্র, বৈশাখের অঙ্ক বিজ্ঞান সেই দেখে। ভূগোলটা একটু দেখে দেবার জন্য রন্টুই পঙ্কুদার কাছে পাঠিয়েছে। বৈশাখ একাই আসে, পঙ্কুদা টিউশন করতে পছন্দ করে না। পঙ্কুর সঙ্গে রন্টুর পরিচয় ওই বাবলুর চায়ের দোকানে। দুজনেই তর্কে মহাবলী একেবারে!
কি করে, কি করে ভাবতে ভাবতে বৈশাখের মাথায় একটা দুষ্টুবুদ্ধি খেলে গেল। পঙ্কুদা তাকে সবসময় এই ঘরটায় বসায়। কিন্তু পাশের ঘরটায় কখনও নিয়ে যায় না। সব সময় বাইরে থেকে হ্যাশবোল্ট টানা থাকে। কি আছে ওই ঘরে? হঠাৎ খুব কৌতুহল হল বৈশাখের। এ যেন একটা রহস্য আর বৈশাখ এখন ক্লাস এইটের ছাত্র নয়, রহস্য ভেদী গোয়েন্দা।
পায়ে পায়ে উঠে এল বৈশাখ। দরজার বাইরেটা একবার ভালো করে দেখে নিল। নাহ পঙ্কুদার আসার কোন চান্স নেই। বাইরে উঠোনে তমাদি কাপড় মেলছে। বাড়িওলার মেয়ে। সে দৈবাৎ এই ঘরে ঢোকে।
মাঝে মধ্যে শশা, পেয়ারা দিয়ে যায়।
হ্যাশবোল্ট খুলে দরজাটায় ধাক্কা দিতেই খুলে গেল দরজাটা। বৈশাখ ভেবেছিল হয়ত ভূতের সিনেমায় যেমন দেখায় তেমন কিছু একটা হবে, অথবা একটা ক্যাঁ-এ-এ-এ-চ করে আওয়াজ অন্তত হবে। কিন্তু নাহ!
দরজাটা একদম নিশব্দে খুলে গেল। কিন্তু এবার বৈশাখের অবাক হবার পালা। ঘরের ভিতরটা এত অন্ধকার কেন? একটা জানালাও খোলা নেই। একটা ভ্যাপসা গন্ধ নাকে এল তার, অনেকটা যেন সেই তাদের বাড়ির চিলেকোঠার পুরোনো জিনিসে ঠাসা স্টোররুমটার মত। হাতড়ে হাতড়ে সুইচ অন করে আলো জ্বালালো বৈশাখ। ওহ, এটা ঘর না ভ্যাট বোঝাই মুশকিল! যে ঘরে বৈশাখ পড়তে বসে, সেটাও খুবই অগোছালো। তবু মাঝে মধ্যে ঝাঁটপাট পড়ে হয়তো, কিন্তু এই ঘরের মেঝে যেটুকু দেখা যাচ্ছে, তার উপর অন্ততঃ এক ইঞ্চি পুরু ধুলো জমে আছে। চারদিকে কোথাও বই, কোথাও খবরের কাগজ কোথাও দোমড়ানো মোচড়ানো আর্টপেপার ভর্তি হয়ে রয়েছে। ঘরের এক কোণে একটা বড় বোর্ডের মত কিছু রয়েছে। কাপড় চাপা দেওয়া। তার পাশের প্লাস্টিকের তাকে গোটানো অনেক গুলো আর্ট পেপার। ছবি আঁকে নাকি পঙ্কুদা? দেখতে হচ্ছে তো।
কয়েক পা এগিয়েছে সবে, হঠাৎ গেটের কাছ থেকে পঙ্কুদার গলা ভেসে এল, কাকে যেন বলছে " না জয়েনিং লেটারটা আসেনি এখনও, এই সপ্তাহে আসার কথা আছে "। দুদ্দাড় করে পিছন ঘুরে দরজার কাছে আসতে গিয়ে একটা নরম কিছুর উপর পা পড়ে পিছলে যাচ্ছিল বৈশাখ। কোন রকমে সামলে নিয়ে বেরিয়ে এসে দরজা দিতে গিয়ে মনে পড়লো সুইচটা অফ করে নি। কিন্তু ততক্ষণে পঙ্কুদা উঠোন পেরিয়ে ঘরের দিকে আসছে। তাড়াতাড়ি করে দরজাটা বন্ধ করে আবার নিজের জায়গায় বসে পড়লো বৈশাখ। ---কি রে বৈশাখ, ভূগোল পড়লি একটুও! নাকি শুধু পাতা উলটে গেলি?
ভূগোল বইটা হাতে তুলে নিয়ে বসে পড়লো পঙ্কুদা।
বৈশাখের মন তখন পঙ্কুদার গোপন ঘরের দিকে। একটা চাপা টেনশন ও কাজ করছে। লাইটটা নেভানো হয় নি।
২.
আজ অনেক তাড়াতাড়ি বেরিয়েছে বৈশাখ। এই কদিন পঙ্কুদার গোপন ঘরের কথা এক মুহূর্তের জন্য ভুলতে পারেনি সে, এমনকি গতরাতে স্বপ্নের মধ্যে বৈশাখ পঙ্কুদার ঘরে ঢুকে কিছু একটা খুঁজছিল। কি খুঁজছিল, সেটা আর তার মনে নেই। তবে ঘরটার মধ্যে সেদিন একটা গভীর রহস্যের গন্ধ পেয়েছিল, আর সেই রহস্যের সমাধান করতে আজ অন্য দিনের চেয়ে অন্তত কুড়ি মিনিট আগে বেরিয়েছে। কি আছে ওই ঘরে? না কি সে বেফালতু এসব রহস্য-ফহস্য ভেবে বসে আছে। ব্যাচেলর লোক, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কোন ব্যাপার নেই। পড়তে গিয়ে দেখেছে, চৌকির উপরে এককোণে আগের দিনের মোজা খোলা, আর গন্ধরাজ সেই মোজার ঠিক পাশেই রাতের খাবার থালাটা এঁটোকাঁটা সমেত ঘুমিয়ে আছে। তাকে দেখে হয়তো খেয়াল হয় পঙ্কুদার, থালাটা চৌকি থেকে নামিয়ে রেখে দেয় টিভির উপর, কখনও বা মেঝেতে ডাঁই করে রাখা ছাড়া জামাকাপড়ের উপর। রবিবার, সপ্তাহে একদিন বাড়িওলার তোলা কাজ করে যে মল্লিকাদি সে ঘরদোর মুছে, জামাকাপড় কেচে দেয়। কিন্তু তাতে পরিবর্তন কিছু হয় না। সোমবার পড়তে গিয়ে ঘরদোর আর পঙ্কুদাকে একই রকম দেখে বৈশাখ। এই অপরিচ্ছন্ন আর অগোছালো মানুষটার একটা জিনিস কিন্তু বৈশাখের ভালো লাগে। স্বাধীনতা। যা ইচ্ছা করার, যেমন ইচ্ছা থাকার স্বাধীনতা। কেউ বলবার নেই, কেউ বকবার নেই।
চাকরি পেয়ে গেছে পঙ্কুদা। ছোটকা খবরটা দিয়েছে। যদিও বৈশাখ সেটা আগেই জানতো। আর দিন দশেকের মধ্যেই হয়তো চলে যাবে পঙ্কুদা। শিলিগুড়ির দিকে পোস্টিং হতে পারে। এই খবরে বৈশাখের যতটা না মন খারাপ হয়েছে, তারচেয়ে বেশী উৎকণ্ঠা হয়েছে। পঙ্কুদার গোপন ঘরটা কি দেখা হবে না? আর সেই জন্যই আজ এত আগেভাগে বেরিয়েছে।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে খানিকটা ঢালাইরাস্তা, সেটা পেরোলেই বড় রাস্তা। রাস্তার ওপাশের মোড় দিয়ে ঢুকে আবার ঢালাই রাস্তা, সেটা কিছুটা গিয়েই ঠিক যেখানে গোঁত্তা খেয়ে বামদিকে ঢুকেছে, সেখানেই দেখা হয়ে গেল পঙ্কুদার সঙ্গে। কেমন যেন একটু উদভ্রান্তের মত লাগছে। হনহন করে এগিয়ে এসে একটু চাপা গলায় বললো, " পড়াতে পারবো কি না জানি না। যাইহোক এসে যখন পড়েছিস, গিয়ে বোস, আমি আসছি এখুনি।" কথাগুলো বলে, কেমন সন্দিগ্ধ চোখে একবার পিছনে দেখে নিল পঙ্কুদা। তারপর আবার হনহন করে এগিয়ে গেল। বৈশাখ, একটু অবাক চোখে সেই দিকে তাকিয়ে থেকে আবার পঙ্কুদার বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগলো। পঙ্কুদার ব্যবহারটা কেমন একটা আজব মনে হল বৈশাখের।
********* *********** ************
আজকে আর সময় নষ্ট করলো না বৈশাখ।
পঙ্কুদার ঘরে ঢুকে ব্যাগটা কোনমতে বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে খুলে ফেললো সেই দরজাটা। ভিতরে ঠিক তেমনি অন্ধকার। আজও কোন জানালা খোলা নেই।
তবে একটা অদ্ভুত অনুভূতি হল তার। দরজার ওপাশের পরিবেশ আর ঘরের ভিতরের পরিবেশের মধ্যে কেমন যেন একটা ফারাক মনে হল বৈশাখের। সুইচটা অন করলো, বাল্বটার হলুদ আলোয় ঘরের যে রূপ সে দেখলো, তাতে হতভম্ব হওয়া ছাড়া তার আর কোন গতি ছিল না। আগের দিন ঘরের মধ্যে সব কিছু অগোছালো ছিল, কিন্তু এরকম লণ্ডভণ্ড অবস্থায় ছিল না। যেন একটা তাণ্ডব চালিয়েছে কেউ। জামাকাপড়, বইপত্র, খবরের কাগজ এমনকি অজস্র আর্ট পেপার চারদিকে এমন ভাবে ছড়িয়ে পড়ে আছে, যেন এখুনি এখানে একটা ভয়ানক ঝড় বয়ে গেছে।
সেই ধংসস্তুপ ঠেলে এগোতে গিয়েই পায়ের নিচে একটা নরম কিছু পড়ে প্রায় পিছলে যাচ্ছিল বৈশাখ। কোনমতে সামলে নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। মনে পড়লো, আগেরদিন ছুটে বেরোতে গিয়েও এরকম একটা নরম কিছুর উপর পা পড়ে পিছলে যাচ্ছিল। কৌতুহল হতে পায়ের কাছে জমে থাকা কাগজের স্তুপ ঠেলে দেখতে চাইলো জিনিসটা ঠিক কী? নিচু হয়ে হাতড়ে হাতড়ে যে জিনিসটা তার হাতে উঠে এল, সেরকম কোন জিনিস এই ঘরে থাকতে পারে, বৈশাখ ভাবতেই পারেনি। একটা ব্লাড ব্যাগ। কিছুদিন আগে তাদের পাড়ার ক্লাবে ব্লাড ডোনেশান ক্যাম্প হয়েছিল। সেখানেই দেখেছে। কিন্তু পঙ্কুদা এই ব্লাড ব্যাগ নিয়ে কি করে? ব্যাগের ভিতরে তখনও কয়েক ফোঁটা রক্ত রয়েছে। বৈশাখের গাটা হঠাৎ কেমন ঘিনঘিন করে উঠলো। একটা কাঁপুনি লাগলো সমস্ত শরীরে। ব্লাড ব্যাগ টা হাত থেকে ফেলে দিয়ে একলাফে ঘরের কিছুটা ভিতরে ঢুকে পড়লো সে।
কয়েক মুহূর্ত লাগলো বৈশাখের ধাতস্থ হতে। একবার পিছন ফিরে দেখলো, নাহ, পঙ্কুদা আসেনি এখনও। এবার বৈশাখ কতগুলো গোটানো আর্টপেপার তুলে নিল। খুলে খুলে দেখে বেশ অবাক হয়ে গেল। সবগুলো আর্টপেপারেই একটা বিভৎস কুকুরের ছবি আঁকা। কিন্তু প্রতিটা ছবির উপর আবার গাঢ় লাল রঙে একটা করে গোল গর্তের মত আঁকা। তবে একটা অদ্ভুত একটা ব্যাপার ছিল প্রতিটা কুকুরের ছবিতে। ছবিতে আঁকা কুকুর গুলোর মাথা একটা নয়, কারো দুটো আর কারো তিনটে। আরও একটা আশ্চর্যের বিষয় হল, মাথা গুলো ঘাড়ে জুড়ে থাকলেও, ঘাড়টা কিন্তু কুকুরের বডিতে জোড়েনি। এরকম অদ্ভুত দর্শন ছবি আঁকার কারণ বৈশাখের মাথায় এল না। এদিক ওদিক হাতড়ে আরো অনেক ছবি খুলে খুলে দেখতে লাগলো বৈশাখ, কিন্তু না, অন্য কোন ছবি আঁকেনি পঙ্কুদা। শুধু কুকুরের ছবি? তাও এরকম বিভৎস, যেন কুকুর গুলো সদ্য নরক থেকে উঠে এসেছে ! কিন্তু কেন? বৈশাখের মনের ভিতর একটা ভয়ানক তোলপাড় শুরু হয়ে গেল। সে এটাও ভেবে পেল না, ছবি গুলো বা নিজের ছবি আঁকার কথা পঙ্কুদা লুকিয়ে রেখেছে কেন? আরও দু-একটা ছবি খুলে দেখছিল বৈশাখ। হঠাৎ তার মনে হল, ঘরের মধ্যে কিছু একটা চলে ফিরে বেড়াচ্ছে। খুব আস্তে হলেও একটা শ্বাস প্রশ্বাস এর শব্দ যেন শোনা যাচ্ছে! চকিতে চারদিকে তাকিয়ে কিছুই দেখতে পেলনা বৈশাখ। দরজার দিকে খেয়াল করে দেখলো, না পঙ্কুদাও আসে নি এখনও। ঘরটার যা অবস্থা, ইঁদুর ছুঁচোর উপদ্রব থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। সেরকম কিছু একটা ভেবে বৈশাখ এদিক ওদিক ঘাঁটতে ঘাঁটতে হঠাৎই একটা অদ্ভুত ছবি দেখতে পেল। ছবিটা একটা ক্লিয়ার ফাইলের মধ্যে রাখা ছিল। একটা ভয়ালদর্শন তিনমাথা বিশিষ্ট কুকুরের ছবি। অনেক পুরোনো। মোটা কাপড়ের মত কিছুতে আঁকা। বিভৎস সেই ছবিটা দেখে যেকোন মানুষেরই ভয়ে হাতপা ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। ভয়ঙ্কর তিন মাথার চোখগুলো যেন একেবারে জীবন্ত, জ্বলজ্বল করছে, আর হাঁ করা তিনটে মুখের মধ্যে আগুনের গনগনে রঙ, আর সাজানো ভয়ঙ্কর দাঁতগুলো থেকে যেন রক্ত চুঁইয়ে পড়ছে! ঘাড়ের কাছ থেকে কালো রঙের কতগুলো সাপ উদ্যত হয়ে আছে ভয়ানক আক্রোশে। কুকুরটার লেজটাও যেন এক ভয়ঙ্কর ক্রুদ্ধ সাপের লেজের মত এখুনি আছড়ে পড়তে চাইছে। বৈশাখের সমস্ত শরীর যেন অবশ হয়ে এল। ছবিটা যেন ভয়ানক একটা পাশবিকতার জীবন্ত প্রতীক। চারপায়ের ভয়ঙ্কর নখের একটা আঁচড়ে সে যেন ছিঁড়ে ফেলতে চাইছে পৃথিবীর বুক। ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ যেন তার শরীরটা কাঁটা দিয়ে উঠলো। কেমন একটা ভয় আর শিরশিরানি তার সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়লো। হঠাৎ আরও একটা আশ্চর্য বিষয়ের দিকে নজর পড়লো বৈশাখের। ভালো করে না দেখলে বোঝা যায় না, এই তিন মাথাআলা কুকুরটার ঠিক পিছনে যেন একটা অন্ধকার গোল গর্তের মত হয়ে অনন্ত গভীর কোন অজানা অচেনা জগতে মিশে গেছে। সে কোন জগৎ, কেনই বা তাকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছে এই ভয়াল দর্শন কুকুর? কেনই বা পঙ্কুদা এই ছবির মতো করে কুকুর আঁকতে চাইছে? এতগুলো "কেন" ভিতরে ভিতরে ব্যতিব্যস্ত করে তুললো বৈশাখ কে। ঘর থেকে বেরিয়ে যাবে কি না ভাবছে, ঠিক তখনই পিছনে কারও পায়ের শব্দ পেয়ে একটু চমকে উঠে পিছন ফিরে দেখলো, দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে পঙ্কুদা। উস্কো খুস্কো চুল, কয়েক দিনের না কাটা দাড়িতে কেমন একটা রুগ্ন আর সন্ত্রস্ত লাগছে পঙ্কুদাকে। মুখটা যেন অসম্ভব ফ্যাকাসে লাগছে পঙ্কুদার, শুধু চোখদুটো যেন অসম্ভব উজ্জ্বল, একটা অদ্ভুত দ্যুতি যেন পঙ্কুদার চোখদুটোকে কেমন ভয়াল করে তুলেছে। একটু ভয় পেয়ে আমতা আমতা করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো বৈশাখ। তাকে কিছু বলতে না দিয়ে পঙ্কুদা বললো, " চুপচাপ বসে পড় "। তারপর ঘরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে, এগিয়ে এল তার দিকে। পঙ্কুদার চোখে চোখ পড়তেই অপরাধীর মত চোখদুটো মেঝের দিকে নামিয়ে নিল বৈশাখ।
৩.
"আমি, আমি নই।" পঙ্কুদার এই কথাটা কিছুতেই মাথায় ঢুকছে না বৈশাখের। যেমন সে বুঝতে পারছে না, কেন পঙ্কুদা তাকে দিয়ে ঘরের বাইরে থেকে তালা বন্ধ করে দিল! তবে সেদিন পঙ্কুদার থেকে হাড় হিম করা যে সব কথা বৈশাখ শুনেছে, সেগুলো তাকে সব সময় একটা ভয়ঙ্কর উৎকণ্ঠার মধ্যে রেখেছে। এই তিন দিন বৈশাখ না পারছে ঠিক করে ঘুমাতে, না পারছে পড়তে, না পারছে খেতে এমনকি বিকেলে ফুটবল খেলতেও যাচ্ছে না। যেতে ইচ্ছাই করছে না তার। এদিকে পঙ্কুদার মোবাইলটাও সুইচ অফ।
এদিকে ছোটকা রন্টু কি একটা প্রজেক্টের কাজে সাতদিনের জন্য গেছে পুরুলিয়া। ফলে বৈশাখ এই ব্যাপারটা আলোচনাও করতে পারছে না কারো সঙ্গে।
যদিও পঙ্কুদা বারবার নিষেধ করে দিয়েছে, সে যেন একেবারেই অন্য কাউকে কিছু না জানায়। আর সেটাতেই বৈশাখের মনটা খুঁত খুঁত করে উঠছে সবসময়। একটা ছবি এত ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটাতে পারে একথা বৈশাখ বিশ্বাসই করতো না, যদি পঙ্কুদা তাকে পারমিতাদির পাঠানো ভিডিওটা না দেখাতো। পঙ্কুদার বান্ধবী পারমিতাদি আর্ট কলেজের ছাত্রী ছিল। সেখান থেকে পাশ করে এক বিখ্যাত আর্টিস্টের কাছে
অ্যাপ্রেন্টিস ছিল। পঙ্কুদারও ছবি আঁকার শখ ছিল, যদিও প্রথাগত ভাবে কখনো কোথাও শেখেনি। মাঝে মধ্যে পারমিতাদির কাছে যেত এই সব ব্যাপারে। দুজনে বেশ কিছু ছবিও এঁকেছে একসঙ্গে। কিন্তু হঠাৎ করেই একদিন পারমিতাদির সেই আর্টিস্ট স্যারের ক্যান্সার ধরা পড়ে, একেবারে শেষ পর্যায়ে। মাত্র একমাস বেঁচেছিলেন রোগটা ধরা পড়ার পর। মারা যাবার আগে তিনি পারমিতাদিকে বলে যান, একটা মূল্যবান ছবি আসবে ইতালি থেকে, পাঠাচ্ছেন তার এক বন্ধু। পারমিতাদিকে সেই ছবিটা নিয়ে মিউজিয়মে দিয়ে দিতে বলেন সেই আর্টিস্ট স্যার। তিনি মারা যাবার ঠিক পরের দিন এসে পৌঁছায় ছবিটা। স্যারের ছেলে মেয়ে তখন বাবার শেষকৃত্য করতে ব্যস্ত, তাই পারমিতাদি নিজের কাছেই নিয়ে আসে ছবিটা। উদ্দেশ্য ছিল, সেই মহামূল্যবান ছবিটা মিউজিয়মে দান করার আগে একবার চাক্ষুষ করা।
যাই হোক স্যারের কাজকর্ম মিটে গেলে সেদিনই রাতে বাড়ি ফিরে পারমিতাদি সেই ছবিটা দেখার জন্য পার্সেলটা খোলে। সেই সঙ্গে পঙ্কুদাকেও ভিডিও কলিং করে, যাতে পঙ্কুদাও দেখতে পায়। পঙ্কুদার চোখের সামনেই ঘটে যায় সেদিন একটা ভয়ানক ঘটনা। স্ক্রিনের উপর চোখ রেখে বসে ছিল পঙ্কুদা, ওপাশে মোড়কটা খুলছিল পারমিতাদি। একটা গাঢ় নীল রঙের চামড়ার মোড়কের ভিতরে ছিল ছবিটা। সেই মোড়কটা দেখে পারমিতাদির মনে হয়েছিল সেটা বহুদিন, হতে পারে বহু বছর খোলা হয় নি। মোড়কটা বাঁধা হয়েছিল একটা গাঢ় কালো রঙের পাকানো পাকানো দড়ি দিয়ে। সম্ভবত সেই দড়িটা তৈরি হয়েছিল কোন জন্তুর নাড়ি থেকে। চামড়ার মোড়কটা যখন খুলছিল পারমিতাদি, ঠিক তখনই পঙ্কুদা স্ক্রিনে মাত্র কয়েক মুহুর্তের জন্য একটা অন্ধকার ছায়ার মত কিছুকে পারমিতার ঠিক পিছনে দেখতে পেয়েছিল। সেটাকে তেমন একটা গুরুত্ব দেয়নি পঙ্কুদা। তারপর যখন পারমিতাদি একটানে মোড়ক খুলে ফেললো, তখনি হঠাৎ করে একটা চাপা কিন্তু ভয়ঙ্কর জান্তব স্বরে গর্জন করে উঠল কোন জন্তু। পারমিতাদির আড়ালে তখনও ছবিটা দেখতে পায়নি পঙ্কুদা। পারমিতাদি মোবাইলের দিকে পিছন করে বসে ছিল তখন, ফলে এই গর্জন তার কানে গিয়েছে কিনা সেটাও বোঝা যাচ্ছিল না। কিন্তু সে যে স্তব্ধ হয়ে বসে ছবিটা দেখছিল, সেটা দেখেছে পঙ্কুদা। মাত্র কয়েকটা মুহূর্ত। তারপরেই দপ করে নিভে যায় ঘরের আলো আর পঙ্কুদার কানে ভেসে আসে পারমিতাদির চিৎকারের আওয়াজ। যেন কেউ জোর করে তাকে কোথাও টেনে নিয়ে চলে যাচ্ছে, এমনটাই মনে হয়েছিল পঙ্কুদার। তারপর সব বন্ধ। একটাও আলো জ্বললো না, একটুও শব্দ হলনা, শুধু কয়েক মিনিট পর কানেকশনটা কেটে গেলো। কি হল পারমিতার? খুব উৎকণ্ঠা আর একটা ভয়, আশঙ্কা নিয়ে রাতটা কোনমতে কাটিয়ে পঙ্কুদা পরদিন সকালে যখন পারমিতাদির বাড়ি পৌঁছালো, তখন সেখানে অনেক মানুষ। পুলিশ। পারমিতাদিকে তারপর থেকে আর খুঁজে পাওয়া যায় নি। তন্নতন্ন করে সমস্ত জায়গায়, এমনকি পঙ্কুদার বাড়িতেও খুঁজেছে পুলিশ কিন্তু পাওয়া যায় নি। শেষ ফোনটা যেহেতু পঙ্কুদাকেই করেছিল, তাই পুলিশ তাকেও সন্দেহের তালিকায় রেখেছে। এখনও পারমিতাদির বাড়ির লোকেরা ভাবে পঙ্কুদা জানে পারমিতাদি কোথায় আছে।
সেদিন ফেরার সময় পঙ্কুদা পারমিতাদির ঘর থেকে
সেই ছবিটা মোড়ক সমেত নিয়ে আসে। প্যাকেটের ভিতরে একটা গোটানো কাগজে, অনেক পুরানো কোন ভাষায় কিছু লেখা ছিল। পঙ্কুদা তার পাঠোদ্ধার করতে পারে নি। ছবিটা নিয়ে গেছিল এক বিশেষজ্ঞের কাছে। তিনি বলেন, এটা খৃষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকে আঁকা সারবারাসের ছবি। গ্রীক পুরাণ অনুযায়ী সারবারাস তিন মাথা যুক্ত ভয়ালদর্শন কুকুর। মৃত্যুপুরীর সিংহদরজায় পাহারায় থাকে, যাতে মৃত আর জীবিতের জগৎ কখনও না এক হয়ে যায়। তার জ্বলন্ত দৃষ্টি এড়িয়ে কোন মৃত ব্যক্তির আত্মাও যেমন সেই মৃত্যুপুরীর বাইরে বার হতে পারে না, তেমনি জীবিত কেউ ঢুকতেও পারে না সেখানে। আর সেই ভয়ঙ্কর দানবাকৃতি তিনমাথাওলা কুকুরের প্রহরায় নিশ্চিন্ত হয়ে মৃত্যুপুরীর রাজা প্লুটো এবং তার পরমাসুন্দরী রাণী পারসিফোনে সযত্নে মৃত্যুর পরের জগতের প্রতিপালন করেন। ছবিটা কে এঁকেছে তেমন কিছু জানা না গেলেও ছবির পিছনের লিপির পাঠোদ্ধার করে সেই গবেষক একটা কোন ভয়ঙ্কর কথা বলেছিলেন, সেটা আর সেদিন শোনা হয় নি বৈশাখের। কারন, এই কথা গুলো বলার পর কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে পঙ্কুদা তাকে বলেছিল, "এবার তুই চলে যা, ওর আসার সময় হয়ে গেছে। আমাকে ওর খাবার ব্যবস্থা করতে হবে, তবেই আমি পারমিতাকে ফিরিয়ে আনতে পারবো। বেশী দেরী হলে হয়তো পারমিতাকে আর পাবো না।"
বৈশাখ চলে এসেছিল। পঙ্কুদাকে তারই ঘরে বন্দি করে। চাবিটা জানালা দিয়ে ভিতরে ফেলতে গিয়ে দেখেছিল পঙ্কুদা ততক্ষণে ভিতরের ঘরের দরজা আটকে দিয়েছে। অনেক প্রশ্ন সঙ্গে এসেছে বৈশাখের। পঙ্কুদার শেষ কথা গুলোর কোন অর্থই সে বুঝতে পারেনি, এখনও। কার আসার সময় হয়ে গেছিল? কার খাবার ব্যবস্থা করতে হয়েছিল পঙ্কুদাকে? ঘরে ওই ব্লাড ব্যাগটা কি জন্য পড়ে ছিল? কেনই বা পঙ্কুদা ঘরে ঢুকে আগে ব্লাড ব্যাগটা কে নিয়ে লুকিয়ে ফেলার চেষ্টা করছিল? নাহ, এত ক্যানোর উত্তর বৈশাখ এখনও পায় নি! আদৌ পাবে কি না, সেটাও বুঝতে পারছে না। পঙ্কুদা বলেছিল, তিনদিন পর সে নিজেই পারমিতাকে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসবে। আজ রাত শেষ হলেই তৃতীয় দিন শেষ হয়ে যাবে। আসবে কি পঙ্কুদা, পারমিতাকে নিয়ে? জানে না বৈশাখ।
৪.
কখন ঘুমিয়ে পড়েছে, বুঝতে পারেনি বৈশাখ। ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো, রাত বারোটা কুড়ি। এখুনি বেরোতে হবে তাকে। বারোটা বেজে গেছে, মানে তিন দিন পূরণ হয়ে গেছে। নাহ, বৈশাখ আগামী কাল সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারবে না। ড্রয়ার থেকে টর্চটা নিয়ে খুব পা টিপে টিপে নীচে নামলো। একতলায় জিমি শুয়ে আছে। ওকে দেখে খানিকটা লেজ নেড়ে, একটু গরগর করে উঠলো। তারপর যেন কেমন ভয় পেয়েছে এরকম একটা ভাব করে আবার শুয়ে পড়লো। সাইকেলের ক্যারিয়ারে একটা লোহার শক্ত রড আর কালী পুজোর সময় বাড়তি হওয়া বড় রঙমশাল চাপিয়ে বেরিয়ে এলো বাড়ি থেকে। রাস্তায় পা দিয়ে বুকটা ভয়ে ছ্যাঁৎ করে উঠলো। এত রাতে কোনদিন কারো সঙ্গেও রাস্তায় বের হয়নি, আর একা তো নয়ই। খুব অন্ধকার চারদিকে। মফস্বলের রাস্তায় টিমটিমে আলোগুলো যাও বা জ্বলতো আগে, এখন কভার দেওয়া তার দেওয়ার পর সেগুলোও নেই। গা ছমছম করে উঠলো বৈশাখের। কিন্তু পরক্ষণেই দাঁতে দাঁত চেপে মনে শক্তি নিয়ে এল, নিজেই। যেতেই হবে। সত্যিই কোন আশ্চর্য ব্যাপার, না কি পঙ্কুদার মনের ভুল, সেটা তাকে দেখতেই হবে। এমন ও হতে পারে, পঙ্কুদা ওই ঘরে নেই। বৈশাখ বেরিয়ে আসার পর সে হয়ত কাউকে দিয়ে চাবি খুলিয়ে চলে গেছে। এই তিনদিন সবাই ভেবেছে, পঙ্কুদা হয়ত গেছে কোথাও, ওরকম তো সে মাঝে মধ্যেই যায়, ফলে কেউ তেমন খোঁজ ও করেনি।
একটু চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিয়ে সাইকেলে চেপে বসলো বৈশাখ। তারপর প্রাণপণে প্যাডেল করে ঢুকে পড়লো পঙ্কুদার বাড়ির গলিতে। সে যখন পঙ্কুদার বাড়ির গেটের সামনে এসে দাঁড়ালো, হাতের ঘড়িতে তখন বারোটা পঞ্চাশ। পঙ্কুদার বাড়িওলা থাকে তিন তলায়। বয়স্ক বাবা মা, আর তমাদি। তমাদি বিয়ে করেনি। প্রাথমিক ইস্কুলে পড়ায়।
দোতলায় একটা আলো জ্বলছে। চারদিকটা ভালো করে দেখে নিল বৈশাখ। না, কেউ কোথাও নেই। সাইকেলটা পাঁচিলের গায়ে হেলান দিয়ে লক করে দিল। তারপর ক্যারিয়ার থেকে লোহার রড আর রঙমশাল গুলো নিয়ে এগিয়ে গেল গেটের দিকে। লোহার গ্রিলের গেটটা এমনি লাগানো ছিল। ল্যাচটা ঘুরিয়ে খুলে ঢুকে পড়লো বৈশাখ। এখন আর তার ভয় করছে না। একটা রোমাঞ্চকর অনুভূতি তাকে উত্তেজিত করে তুলেছে। বৈশাখের নিজেকে মনে হচ্ছে
সে যেন গোয়েন্দা, রহস্য উদ্ঘাটন করতে এসেছে। পঙ্কুদার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দেখলো ভালো করে, তালাটা যথাস্থানে আছে। লোহার একটা ছোট তালা। রডটা তালার আংটার ভিতরে ঢুকিয়ে বেঁকিয়ে একটু চাপ দিতেই সেটা ঘ্যাট করে একটা শব্দ করে খুলে গেল। কোন শব্দ যাতে না হয় তেমন আস্তে আস্তে দরজাটা ঠেলে ভিতরে ঢুকলো বৈশাখ। টর্চের আলোয় দেখলো সেদিন জানালা দিয়ে চাবিটা ঠিক যেখানে ছুঁড়ে দিয়েছিল, সেটা সেখানেই পড়ে আছে। এই কদিনে সমস্ত ঘরে ধুলোর পরত পড়েছে। বাকি সব কিছু ঠিক আগের মতোই অগোছালো হয়ে আছে। টিভির উপরে খাওয়ার এঁটো বাসন, টেবিলের উপর জামা, চেয়ারের উপর প্যান্ট সবই একরকম আছে। এই ঘরটা পেরিয়ে বৈশাখ এবার এগিয়ে গেল সেই ঘরটার দিকে। টর্চের আলোটা হঠাৎ একদম কমে এল। হাতড়ে হাতড়ে সুইচ বোর্ডটা খুঁজে সুইচটা অন করলো। কিন্তু আলো জ্বললো না। টর্চের মিনমিনে আলোতে ঘরটা খুঁজতে গিয়ে অবাক হয়ে গেল বৈশাখ। ঘরটা যেখানে ছিল, সেখানটাতে দেওয়াল ছাড়া আর কিছুই নেই। সেই দেওয়ালের উপর একটা ছবির ফ্রেম উল্টে আছে। এ কি করে সম্ভব? গত দু সপ্তাহে সে এই খানে ঘরটাতে অন্তত দু'বার ঢুকেছে। এই ঘরেই সে দেখেছে ভয়ঙ্কর সারবারাসের ছবি।
এই ঘরে বসেই বৈশাখ পঙ্কুদার মুখে শুনেছে সারবারাসের কথা, পারমিতার কথা। দেখেছে পঙ্কুদার আঁকা সারবারাসের অসংখ্য ব্যর্থ ছবি। সেই ছবির উপর রক্তের গোল গণ্ডী, যা নাকি সারবারাস কে জীবিতের জগতে ঢুকতে দেয় নি। সেই ব্লাড ব্যাগ। আর চব্বিশ শ বছরের পুরোনো সারবারাসের ছবি। এসব তো সে নিজে চোখে দেখেছে। হাত দিয়ে ছুঁয়েছে। তাহলে? গেল কোথায় সে সব? কোথায় গেল সেই দরজা, সেই ঘর? কেমন একটা অদ্ভুত লাগলো বৈশাখের। নিজের চোখকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছে না সে। হঠাৎ কি মনে হতে, দেওয়ালের গায়ে উল্টে লটকানো ছবিটা সোজা করে তার উপর টর্চের আলো ফেললো। সেই মৃদু আলোতে যা দেখলো, তাতে বৈশাখের বুকের রক্ত জমে যেন বরফ হয়ে গেল। এটাতো সেই সারবারাসের ছবিটা। এখানে এল কোথা থেকে? কে টাঙালো? সেই মুহূর্তে নিজেকে কেমন যেন অসহায় মনে হল বৈশাখের। ঠিক তখনই তার চোখ পড়লো ছবিটার দিকে। সারবারাসের চোখদুটো যেন জীবন্ত আগুনের গোলা হয়ে উঠেছে। ঘাড়ের কাছ থেকে কালো রঙের অসংখ্য সাপেরা কিলবিল করে উঠছে। সেই তিনমাথাওলা ভয়ঙ্কর কুকুরের মুখ থেকে আগুনরক্ত মাখা লালা ঝরছে বৃষ্টির মত। সামনের দু'টো পা এর থাবায় বেরিয়ে থাকা তীক্ষ্ণ নখ গুলো যেন মৃত্যুর চাবি। তার সাপের লেজের মত লেজটা আছড়ে পড়ছে দেওয়ালের উপর। ভয়ঙ্কর এক ভয় আর শিরশিরানি বৈশাখকে হতচকিত করে তুললো। টর্চের আলোটা যেন হঠাৎ আরও কমে গেল। বৈশাখ রঙমশালটা জ্বালাতে যেতেই একটা ভীষন শক্তিশালী কিছুর ধাক্কায় ছিটকে পড়লো সেগুলো। আর সেই প্রায় অন্ধকারে বৈশাখ স্পষ্ট দেখলো, ছবির সেই ভয়ঙ্কর দানবাকৃতি তিনমাথাওলা কুকুর সারবারাস ছবি ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে, যেন এখুনি তাকে নিয়ে যেতে চাইছে সেই ভয়ানক মৃত্যুপুরীর অন্ধকার জগতে। চোখ থেকে ঠিকরে বেরিয়ে আসছে ভয়ঙ্কর হিংস্র আগুন। এক পা এক পা করে পিছিয়ে আসছিল বৈশাখ, দরজার দিকে। হঠাৎ কেউ তাকে একটানে সেখান থেকে সরিয়ে নিল। ভীত সন্ত্রস্ত বৈশাখ পিছনে তাকিয়ে দেখলো তাকে ধরে আছে পঙ্কুদা। কিন্তু এ কি করে সম্ভব? এঘরে ঢুকে তো সে চারিদিক টর্চের আলোয় দেখে নিয়েছিল, কোথ্থাও কেউ ছিল না। তাহলে? পঙ্কুদা কি বাইরে থেকে এল? দরজা খোলা ছিল।
আর একবার ভালো করে দেখলো বৈশাখ। হ্যাঁ পঙ্কুদা।
কিন্তু এ কি অবস্থা শরীরের? সমস্ত শরীর কঙ্কালসার। মুখটা ভয়ানক রকম ফ্যাকাসে, একেবারে যেন রক্তশূন্য হয়ে গেছে পঙ্কুদার শরীরটা। ভীষন রকমের ভয়ার্ত স্বরে তখনই পঙ্কুদা বললো, আর সময় নেই, ও এবার নিয়ে যাবেই। আমি শুধু তোর অপেক্ষায় ছিলাম। এই কথা গুলো তোকে না জানালে আমি ওর হাত থেকে মুক্তি পাচ্ছি না। আর আমি সারবারাসের থেকে মুক্তি না পেলে পারমিতাকেও ছাড়াতে পারবো না।
বৈশাখ বুঝতে পারলো না, কি বলতে চাইছে পঙ্কুদা। কিন্তু এটুকু বুঝতে পারলো, খুব কষ্টে আছে পঙ্কুদা।
তার চোখের সামনে কেমন যেন অসহায় হয়ে পড়ছে বারবার। একটা আবছা অবয়বের মত বাতাসে মিশে যেতে চাইছে কিন্তু খুব কষ্ট করে নিজেকে ধরে রাখছে।
- রক্ত, রক্ত আরো রক্ত চায় ও। কয়েক হাজার বছর পর ওই অভিশপ্ত ছবিটা খুলে ওকে জাগিয়ে তুলেছে পারমিতা। ওর খিদে না মেটা পর্যন্ত ওকে রক্ত যুগিয়ে যেতে হবে। আমার শরীর থেকে আর নেবার মত কিছু ছিল না। তাই ...
পঙ্কুদার হাতে কয়েকটা ফাঁকা ব্লাড ব্যাগ।
একটা যন্ত্রণায় যেন কুঁকড়ে গেল পঙ্কুদা, নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,
-- সেদিন আমি খুব স্বার্থপর হয়ে উঠেছিলাম। আবার একটা ছবি আঁকলাম, কিন্তু আমার শরীরে রক্ত ছিল না, ওকে খাওয়াবার মত। আর প্রতিবার আঁকার পরেই যখন ও ছবি থেকে বেরিয়ে আসতো, তখনি ওর প্রচুর প্রচুর রক্ত দরকার হত। এভাবেই ওকে ডেকে আনতাম আমাদের পৃথিবীতে। একবার রক্ত খাওয়া হয়ে গেলে সেই ছবির চারদিকে রক্তের গোল গণ্ডী দিয়ে দিতাম। আমার ভয় হত, যদি রক্ত না পেয়ে ভয়ানক নখ দিয়ে আমাকেও নিয়ে যায় তবে পারমিতাকে ফিরিয়ে আনতে পারবো না, আর তাই সেদিন তোকে তুলে দিয়েছিলাম ওর ভয়ঙ্কর খিদের মুখে। বুঝতে পারি নি ...
থেমে গেল পঙ্কুদা। হঠাৎ তখনি একটা বিদ্যুৎ ঝলকের মত বৈশাখের চোখের সামনে ভেসে উঠলো কাটা কাটা কয়েকটা দৃশ্য। সেদিন ঘরে ঢুকে পঙ্কুদা তাকে সারবারাসের ছবিটা সম্পর্কে বলে বাইরে গেছিল। তখনি, হ্যাঁ মনে পড়ছে, মনে পড়ছে বৈশাখের! ভয়ঙ্কর দানবাকৃতি তিনমাথাওলা কুকুরের লকলকে জিভ নেমে এসেছিল তার মুখের উপর, শরীরের উপর। তারপর আর মনে নেই। শুধু মনে পড়ছে অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে সেদিন বাড়ি ফিরেছিল। তারপর ...
কয়েকটা দৃশ্য ভাসা ভাসা ফুটে উঠলো চোখের সামনে। বাড়িতে প্রচণ্ড কান্না কাটি, প্রচুর লোক। বৈশাখ শুয়ে আছে। তার মাথার কাছে মা আছড়ে পড়ে কাঁদছে ... নাহ, আর কিছু মনে করতে পারছে না বৈশাখ। হঠাৎ সে দেখলো পঙ্কুদার শরীরটাকে এক হ্যাচকা টানে নিজের কাছে নিয়ে গেল ভয়ঙ্কর সেই মৃত্যুর পাহারাদার। প্রচণ্ড যন্ত্রণার চিৎকারে খানখান হয়ে গেল রাতের নিস্তব্ধতা। আর তখনই বৈশাখের চারদিকের সব কিছু ভেঙেচুরে পড়তে লাগলো, পাল্টে যেতে লাগলো সব কিছু। একটা অসম্ভব হিমশীতল বাতাস তাকে ভাসিয়ে নিয়ে চললো। তার সামনে একটা ভয়ঙ্কর গাঢ় অন্ধকার যেন গভীর সুড়ঙ্গের মত গিলে নিচ্ছে তার সমস্ত অস্তিত্বকে। হঠাৎ একটা অসম্ভব উজ্জ্বল আলোর ঝলকানিতে চোখ ধাঁধিয়ে গেল বৈশাখের। দেখলো, তার ঠিক সামনেই দাঁড়িয়ে আছে সেই ভয়ঙ্কর দানবাকৃতি তিনমাথাওলা কুকুর সারবারাস। আর তার অনেকটা পিছনে তার দিকে হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে পঙ্কুদা আর পারমিতাদি।
================================
ঠিকানা*
======
অনিন্দ্য পাল
প্রজত্নে -- বিশ্বনাথ পাল
গ্রাম -- জাফরপুর
পোঃ-- চম্পাহাটিি
পিন - ৭৪৩৩৩০
থানা -- সোনারপুর
জেলা -- দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত
Mob: 9163812351
ধন্যবাদ।