ছোটগল্প।। খাঁচার পাখি।। সুপ্তা আঢ্য
খাঁচার পাখি
সুপ্তা আঢ্য
বড়ো রাস্তা ছাড়িয়ে গলি দিয়ে ঢুকে দু-তিনটে বাড়ির পরেই পুরোনো ঐতিহ্য বহন করে চলা বাগানওয়ালা পেল্লায় তিনতলা বাড়িটায় বংশানুক্রমিক ভাবে রাজা রানী রাজকন্যা থাকলেও সেই রাজ্যপাট এখন আর নেই। শহরের নামকরা সার্জেন ডাঃ মনোজিৎ বসু বিখ্যাত বসু পরিবারের বর্তমান বংশধর।কলেজ শিক্ষিকা স্ত্রী সুরঞ্জনা বসু আর বছর বারোর ফুটফুটে মেয়ে ঐন্দ্রিলাকে নিয়ে ওনার সাজানো সংসারে অবশ্য আরও অনেকে আছেন - - - মায়ের আমলের রান্নার লোক পান্নামাসি ছাড়াও কাজের লোক, মালী, দারোয়ান আর ঐন্দ্রিলার জন্য সবসময়ের মিনুদি।
এ বাড়িতে সকাল একটু তাড়াতাড়িই হয়। ডাক্তারবাবুর ভোরে উঠে মর্নিং ওয়াক আর প্রাণায়মের অভ্যেস বহুদিনের ।বিয়ের পর থেকে সুরঞ্জনা এই অভ্যেসের সঙ্গী থাকলেও ইদানীং মাঝে মধ্যেই ক্লান্তির দোহাই দিয়ে বিছানা ছাড়ে না। আর ঐন্দ্রিলা ভোরে উঠে বাগানে ঘাসের ওপর বেশ কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে সারারাত্রি জাগরণের পর নিশ্চিন্তে ঘাসের বিছানায় শুয়ে থাকা ফুলে কোঁচড় ভরে নিজের ঘরে গিয়ে গানের রেওয়াজে বসে।আজও তার অন্যথা হয় নি। সকালের রোদের আয়েশ গায়ে মেখে শহরটার যখন ঘুম ভাঙে, তখন মনোজিৎ আর সুরঞ্জনা দোতলার বারান্দায় বসে দিনের প্রথম চা নিয়ে সারাদিনের আলোচনা সেরে ফেলেন।
"রঞ্জু, কাল তুমি মেয়েটাকে ওভাবে বকে ঠিক করো নি। সারাদিন তো আমাদের ছাড়াই থাকে। একটু মাথায় রেখো এটা।"
"আমি জানি, কিন্তু একটু তো কড়া হতেই হবে। না হলে আজকালকার মেয়ে - - - রাশ টানতে পারবে না।"
"পরী আমাদের সেরকম মেয়েই নয়। যথেষ্ট বাধ্য আর তাছাড়া ও আমাদের মেয়ে - - - খারাপ হতেই পারে না। "
স্বামীর কথায় হাসতে হাসতে বলল "মেয়ে সোহাগী বাবা হলে এরকমই হয়। আমি নীচে গেলাম। "
নীচে ওদিকে পান্না মাসি কাজের লোক শান্তার মায়ের ওপর চোটপাট শুরু করে দিয়েছে।" তুমি তো জানো শান্তার মা, ছোটখোকা - বৌমণি নটার মধ্যে খেয়ে বেরোবে। একটু তো তাড়াতাড়ি আসতে হয়। নাও নাও, হাত চালিয়ে বাসনগুলো ধুয়ে ফেল দিকি। "
শান্তার মা রোগাসোগা শরীরের মতোই রোগা সরু গলায় বলল "আমার শান্তা এবার মাধ্যমিক পরীক্ষা দিচ্ছে তো। ফাইনাল পরীক্ষার আগে ইস্কুলে যে পরীক্ষা হয়, আজ থেকেই শুরু হল। "
" সে না হয় বুঝলুম। তা তোমার মেয়ে তো ইস্কুলে মিড ডে মিল খায়। তাহলে তোমার দেরী হলো কেন?''
" আসলে দিদি, আজ থেকে পরীক্ষা বলে কাল ওর বাপ কটা মাছ এনেছিল। একটু ভাত আর বেগুন দিয়ে মাছের ঝোল করে দে এলাম। অন্যদিন তো পান্তাভাত খেয়েই যায়! তাই---
" তা অবশ্য ভালোই করেছ। এখন তাড়াতাড়ি বাসন কটা মেজে আমাকে দাও দিকি। অনেক দেরী হয়ে গেল। "
" তুমি এখানে বারান্দায় দাঁড়িয়ে কি করছ পরী? পড়তে বসবে না? "
" হ্যাঁ মা - - "বলতে বলতে দুধের গ্লাসটা টেবিলে রেখে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াতেই সুরঞ্জনা নীচে কাজের তদারকিতে চলে গেল।" আজ কি রান্না করছ মাসী? শোনো---পরীর জন্য টিফিনে আজ নুডলস্ না দিয়ে চিঁড়ের পোলাও দিও। আর আমাদের জন্য রুটি তরকারি আর ফ্রুটস্ দিয়ে দিও। "
" হ্যাঁ বৌমণি, তাই করছি। তুমি রেডি হয়ে নাও - - - আমার রান্না প্রায় শেষের দিকে।"
"শোনো শান্তার মা, শান্তা তো এবার মাধ্যমিক দেবে, তো এরপর পড়াবে তো নাকি কলোনীর অন্য মেয়েদের মতো বিয়ে দিয়ে দেবে। "
" না গো বৌদি, ইস্কুলের দিদিমণিরা বলে, ওর নাকি পড়াশোনার মাতা খুব ভালো - - - তাই ওর বাবা ওকে পড়াতে চায়। ওই মানুষটা স্বপ্ন দেখে - - - - মেয়ে অনেক নেকাপড়া করে চাকরি করবে। "
" এতো খুব ভালো কথা! ওর পরীক্ষা শেষ হলে একবার নিয়ে এসো। "কথাগুলো বলেই ওপরে নিজের ঘরে রেডি হতে চলে যায় সুরঞ্জনা।
সাড়ে নটা নাগাদ মনোজিৎ সুরঞ্জনাকে নিয়ে বেরিয়ে যেতেই এতক্ষণের সবটুকু ব্যস্ততা হঠাৎ হাওয়ার একটা ফুঁয়ে নিভে গেল। ঐন্দ্রিলার স্কুল না থাকায় পুরো বাড়িতে এখন চারটি প্রাণী। আমাদের রাজকন্যা নিজের ঘরে নিজের ছোট্ট জগতে ব্যস্ত। আর নীচের তলায় এখন অবসরের জমাটি আসর। ওদের হাসির আওয়াজ কানে আসতেই ব্রেকফাস্টের প্লেটটা নিয়ে দোতলার বারান্দার চেয়ারে বসে মনোযোগ দিয়ে ওদের কথা শুনতে লাগল।
"হ্যাঁ গো শান্তার মা - - - মেয়েকে তো খুব পড়ানোর ইচ্ছে ওর বাপের। কিন্তু তোমাদের পাড়ার যা অবস্থা!"
" সে তো জানি মাসি---কিন্তু মেয়ে আমার সেরকম নয় গো, বই ছাড়া কিচ্ছুটি বোঝে না। ও মিনুদি তুমি তো জানো বলো না গো - - - "
ওর কথায় সায় দিয়ে মিনুদি বলল" হ্যাঁ গো মাসি, শান্তা বড়ো লক্ষ্মী মেয়ে। এ বয়সের অন্য মেয়েদের মতো কোনো বেচাল নেই ওর। পড়াশোনা ছাড়া বাকি সময়টুকু ঘরের কাজকর্ম নিয়েই থাকে।
" হ্যাঁ গো মিনুদি - - - আজ সকালে কলের ওখানে কি হয়েছিল গো? "
" ও মা, তুই জানিস না - - - রোজকার মতোই কালুর বৌ আর সবিতার মায়ের মধ্যে কলে লাইন দেওয়া নিয়ে ঝামেলা শুরু---তারপর যা হয়। "
" এ তো নিত্যদিনের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন। সবার তাড়া থাকে আর কল মাত্র একটা।"
" সেই তো রে শান্তার মা - - - মাঝে মাঝে তো এই নিয়ে রক্তারক্তিও বেঁধে যায়। অবশ্য পান্নামাসি, তোমার ব্যাপার আলাদা - - - তোমাকে তো আর ভোর থেকে লাইনে দাঁড়াতে হয় না! "
" সেটা অবশ্য ঠিক। এই বাড়িতে তো আর কম দিন হোলো না - - - এখানেই জীবনটা কেটে গেল। সেই কবে দেশ থেকে মায়ের সঙ্গে এয়েছিলুম, আর মা মরে যাওয়ার পর থেকেই কত্তাবাবা আর কত্তামায়ের আশ্রয়ে থাকতে থাকতে কখন এবাড়ির একজন হয়ে গেছি। "
" আরে, পরীমা----তুমি ওখানে দাঁড়িয়ে কি করছ?টিফিনটা খেয়েছ তো? "
" হ্যাঁ - - - আমি প্লেটটা রাখতে এসেছিলাম। আচ্ছা মাসি, তোমাদের পাড়ায় বুঝি সবার বাড়িতে কল নেই? জল নিতে গেলে লাইন দিতে হয়? "
" হ্যাঁ গো পরীমা - - - আমাদের কলোনীতে সবাই এভাবেই জল নেয়।"।
" তোমাদের ভীষণ কষ্ট হয় তো বলো? "
" না গো পরীরানী - - - ওসব আমাদের অভ্যেস হয়ে গেছে। আর কি বলো তো----সারাদিন তো কাজেই কেটে যায়, তাই কলের লাইনে দাঁড়াতে খুব একটা খারাপও লাগে না। সকলের সাথে একটু গল্পও হয়ে যায়। "
" পরীমা----এসব কলোনীর কূটকচালী তোমাকে শুনতে হবে না। তোমার এখন ড্রয়িং করার সময়, যাও - - - - না হলে কিন্তু মা শুনলে রাগ করবে। "
মিনুমাসির কথায় পরী অর্থাৎ ঐন্দ্রিলা চুপচাপ নিজের ঘরের দিকে চলে যায়।
বেশ কয়েকমাস পর এক সকালে শান্তার মা" বৌদি - - - বৌদি "বলে বাড়িতে ঢুকতেই পান্নামাসি বলে উঠল" এত সকালে ষাঁড়ের গলায় চেঁচামেচি করছিস কেন? "
চেঁচামেচি কানে যেতেই মনোজিৎ ছাদের আলসে থেকে ঝুঁকে পড়ে বলল"কি হয়েছে পান্নামাসি - - - শান্তার মা কি বলছে?"
"জানি না ছোটখোকা - - - জিজ্ঞেস করছি কিন্তু এ মেয়ে কিছু বললে তো! বৌদিকেই দরকার - - -"
"ঠিক আছে মাসি----বলো শান্তার মা - - -! বাই দ্য ওয়ে, কাল শান্তার রেজাল্ট বেরিয়েছে না?"
"হ্যাঁ গো বৌদি, ও চারটে লেটার আর একটা ইস্টার পেয়েছে। হেডদিদিমণি বলেছেন, ওদের ইস্কুলে ওইই নাকি সবচাইতে ভালো নম্বর পেয়েছে।"
ওদের কথার মাঝখানে মনোজিৎ নীচে নেমে এসে বলল" বাঃ! এতো দারুণ ব্যাপার। তো যার রেজাল্ট সে কোথায়?"
"ও তো আজ ইস্কুলে যাবে রেজাল্ট আনতে। তাই একটু ঘরের কাজগুলো সেরে রাখছে।"
"আচ্ছা শোনো - - - কাল কাজে আসার সময় ওকে নিয়ে আসবে। আর এটা রাখ - - বাড়ি যাওয়ার পথে মাংস আর মিষ্টি নিয়ে যাবে।"
"দাদাবাবু - - - - এর কোনো প্রয়োজন নেই!আজ তো ও ইস্কুলেই মিড ডে মিল খাবে। বড় দিদিমনি বলে দিয়েছে। "
" এটা তোমার জন্য না - - - শান্তার জন্য - - - বুঝলে!রাতের বেলায় ওকে ভালো করে খাইয়ে দিও।" মনোজিৎ টাকাটা শান্তার মায়ের হাতে দিয়ে ওপরে চলে যায় আর পরী বাগানের দরজায় দাঁড়িয়ে ওদের কথোপকথন শুনে একটা কৌতুহল মনের মধ্যে চেপে বাগানে চলে যায়।
ওদিকে শান্তা স্কুল থেকে ফিরে রান্নাঘরে ওত আয়োজন দেখে মাকে বলল" এসবের কোনো প্রয়োজন ছিল না। সামনে এখন অনেক খরচ, আমি কিন্তু আরও পড়াশোনা করতে চাই - - - - অনেক বড়ো হতে চাই।"
"জানি রে মা, আর মাসের মাঝামাঝি এসব কেনার পয়সা কোথায় বলতো? এটা মামাবাবু দিয়েছেন - - -" "মামাবাবু - - -! মা, মামাবাবু খুশী হয়েছেন?" " সে আর বলতে! তোকে যে ওনারা ভীষণ ভালোবাসেন, কাল তোকে নিয়ে যেতে বলেছেন। যাবি তো? "
" কি যে বলো না মা? উনি না বললেও আমি যেতাম। "
পরের দিন সকালে মনোজিৎ আর সুরঞ্জনা দোতলার বদলে একতলার বসার ঘরেই চা নিয়ে অপেক্ষায় থাকেন - - - যতই হোক মেয়েটাকে কত ছোট থেকে দেখছেন! শান্তা ওর মায়ের সঙ্গে এসে ডাক্তার মামাবাবু আর মামীমাকে প্রণাম করতেই সুরঞ্জনা ওকে জড়িয়ে ধরে অনেক আদর করেন আর মনোজিৎ খোলা মনে আশীর্বাদ করে ওর হায়ার স্টাডি নিয়ে কথা বলতে শুরু করে দেন।
"আমি আসব?"
"ওমা, এটা জিজ্ঞেস করছ কেন মা?"
"না, বাইরের ঘরে কেউ থাকলে জিজ্ঞেস করেই তো তুমি আসতে বলো। তাই - - -"
"আচ্ছা বেশ, এই দিদিকে তুমি চিনতে পারছ পরীমা?".
"চিনি - - - এটা তো শান্তাদিদি ।মা, আমি একটু শান্তাদিদির সঙ্গে বাগানে যাব?"
মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে সুরঞ্জনা বললেন" বেশ তো - - - যাও না! শান্তা ----যা তো মা, পরীর সাথে বাগানে!''
" হ্যাঁ মামীমা - - - যাচ্ছি।"
শান্তাকে দোনামোনা করতে দেখে মনোজিৎ বলল "তুই কিচ্ছু ভাবিস না---আমি সব ব্যবস্থা করে তোকে বলব। তুই নিশ্চিন্তে থাক্।"
"হ্যাঁ শান্তা , তোর মামাবাবু ঠিকই বলছেন। তোর এর পরের পড়াশোনার সব দায়িত্ব আমাদের। "
শান্তাকে সাথে পেয়ে খুশিতে ডগমগ হয়ে বাগানে চলে যায় পরী। শান্তার মা কাজের শেষে শান্তাকে ডাকতে গেলে পরী বায়না ধরে" ও পিসি, শান্তাদিদি আজ থাকুক না আমার সাথে! প্লিজ পিসি---"
" কিন্তু পরীমা, আমার যে দেরী হয়ে যাবে! "
" থাক্ না রে শান্তা এখানে! আমাদের পরীমা স্কুল না থাকলে বাড়িতে একলাটি নিজের মনে মনকথা কয়। তোর কোনো চিন্তা নেই রে - - - আমরা আছি তো। আর তাছাড়া এখানে দুটো ডাল ভাতের জোগাড় ওর হয়ে যাবে। কি বলো পান্নামাসি? "
"সে আর বলতে - - - -! সেই কত্তাবাবার আমল থেকেই দেখে আসছি---এ বাড়ি থেকে অভুক্ত কেউ যায় না। তুই নিশ্চিন্তে বাড়ি যা। "
সকলের কথায় নিশ্চিন্ত মনে শান্তার মা বাড়ি ফিরে যায় আর পরী ওকে পেয়ে মনের আগল খুলে গল্পে আড্ডায় মেতে ওঠে। ওর এই বাঁধন ছাড়া রূপ দেখে মিনুদি আর পান্নামাসি আনন্দে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে বলে ওঠে" শান্তা না এলে মেয়েটা যে হাসতে জানে - - সেটা সবাই ভুলেই গেছিলাম।" সারাটাদিন কাটিয়ে প্রায় সন্ধ্যের আগে বাড়ি চলে যায় শান্তা । এরপরের স্কুল ছুটির দিনগুলো খুব আনন্দেই কাটে ঐন্দ্রিলার।
এর সপ্তাহখানেক পর এক বিকেলে প্রথম সারির টিভি চ্যানেল, খবরের কাগজের রিপোর্টার, লালবাজারের উঁচু মহলে হুলুস্হুলু পড়ে যায়। কিন্তু শেষ মুহূর্তে মন্ত্রীমহলের অনুরোধে খবরটা যথাসম্ভব গোপন রেখে গোয়েন্দা দফতর তৎপরতার সাথে নিজেদের সোর্স নিয়ে কাজে লেগে পড়ে। সন্ধ্যের একটু আগে একটা দুধসাদা ইণ্ডিকা ডাক্তার মনোজিৎ বসুর বাড়ির পুরনো আমলের গেট, সুদৃশ্য বাগান পেরিয়ে দরজার সামনে দাঁড়ালে গাড়ি থেকে নেমে আসা ব্যক্তিটিকে সাদরে অভ্যর্থনা জানাতে কেউ এগিয়ে না এলেও নিজেই কলিং বেলটা বাজিয়ে "ডাক্তারবাবু - - - - ডাক্তারবাবু" বলে ডাকতেই একটু বিরক্ত হয়ে মনোজিৎ বেরিয়ে এসে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে দেখে চমকে বললেন "আসুন স্যার, কিছু মনে করবেন না। আসলে - - -"
"আপনার মনে করার কিছু নেই । আমি সব শুনেই এসেছি। আমাদের গোয়েন্দা বিভাগের বেস্ট অফিসাররা দায়িত্ব নিয়েছেন। খুব শিগগির খবর পাওয়া যাবে।"
"স্যার - - খবরটা জানাজানি হলে মুস্কিল হবে না তো?"
"সেটা নিয়েও ভেবেছি। আর তাই খবরটা গোপন রাখার আদেশ দেওয়া হয়েছে মিডিয়াকে। আচ্ছা একটা কথা বলুন তো - - - কোনো ফোন এসেছিল? "
" নাঃ--কোনো ফোন কি চিঠি - - - কিচ্ছু না। কি হলো কিছুই বুঝতে পারছি না আমরা। আমার স্ত্রী তো বারবার সেন্সলেস হয়ে যাচ্ছে। "
শহরের মেয়র তথা মন্ত্রী কল্যাণ খাসনবিশ মশাই বললেন" সেটাই স্বাভাবিক। শুধুমাত্র সান্ত্বনায় যদিও কোনো কাজ হয় না তবু আপনার মতো একজন স্বনামধন্য মানুষের এরকম বিপদে আমরা সবাই আপনার পাশে আছি। বিশেষত মুখ্যমন্ত্রী নিজে বিষয়টি নিয়ে উদ্যোগী হয়েছেন। একটু সময় দিন - - - অপরাধীরা ছাড়া পাবে না।"
এইসব কথাবার্তার মধ্যে লালবাজারের অফিসাররাও এসে পড়ায় বেশ কিছুক্ষণের জেরা সেরে মন্ত্রী ও অফিসাররা বেরিয়ে যেতে কান্নায় ভেঙে পড়া সুরঞ্জনাকে কাঁদার সুযোগ করে দিয়ে মাথানীচু করে বসে রইল মনোজিৎ।
তিনদিন পরেও কোনও খবর না পাওয়ায় বিধ্বস্ত মনোজিৎ আর সুরঞ্জনা বসার ঘরে তৃষ্ণার্ত চাতকের মতো ফোনের দিকে বাকরুদ্ধ নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে বসেছিল।এমন সময় হঠাৎই ক্রিং--রিং--ক্রি---রিং--- আওয়াজে চমক ভেঙে তাড়াতাড়ি রিসিভারটা তুলে সুরঞ্জনার ইশারায় স্পিকারটা অন্ করে উদ্বেগের সাথে "হ্যালো" বলতেই ফোনের অপর প্রান্ত থেকে জলদ গম্ভীর স্বরে কেউ বলে উঠল "এটা কি ডাক্তার মনোজিৎ বসুর বাড়ি? ওনার সঙ্গে একটু কথা বলা যাবে?"
"আমিই ডাক্তার মনোজিৎ বসু। বলুন কি বলার আছে?"
"আপনার মেয়ে ঐন্দ্রিলার ব্যাপারে কিছু কথা বলার ছিল।"
"পরী - - -ও কেমন আছে? ওর কোনো ক্ষতি হয় নি তো? কোথায় আছে ও এখন? আপনি কে বলছেন?"
গম্ভীর স্বরটি একটু সময় নিয়ে বলে উঠল" আপনার মেয়ে আমার আশ্রয়ে সুরক্ষিতই আছে। ওকে না জানিয়েই আপনাকে ফোন করছি। "
" আচ্ছা - - - ও আপনার কাছে কি ভাবে পৌঁছল? মুক্তিপণ কত দিতে হবে ওর জন্য? দেখুন আপনি যা চাইবেন তাই দেবো - - - শুধু আমার মেয়েটার কোনো ক্ষতি করবেন না প্লিজ।"
স্পিকার ছাড়িয়ে গম্ভীর কণ্ঠের গমগমে হাসিতে পুরো ঘর কাঁপিয়ে অজানা মানুষটি বলে উঠল" ও আমার কাছে আপন সন্তানবৎ যত্নেই আছে। সন্তানের মূল্য কি মুক্তিপণে নির্ধারণ করা যায় ডাক্তারবাবু? আপনি আসুন - - - - আপনার অপেক্ষায় রইলাম। আর হ্যাঁ, আমার অ্যাড্রেসটা একটু লিখে নিন।" অজানা ভদ্রলোকটির সাথে কথা শেষ হবার সাথে সাথেই দরজায় কলিং বেলের আওয়াজ শোনা গেল। মিনুদি দরজাটা খুলতেই লালবাজারের অফিসাররা এবং পুলিশমন্ত্রী স্বয়ং ঘরে প্রবেশ করে মনোজিতের লেখা অ্যাড্রেস আর ওনাদের কল ট্র্যাক করে পাওয়া অ্যাড্রেস মিলিয়ে দেখতেই হাসি ফুটে উঠল ওনাদের মুখে।
"ডাঃ বসু আমরা গাড়িতে ওয়েট করছি। আপনারা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রেডি হয়ে আসুন।"
কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনটি গাড়ি ঝড়ের গতিতে বেরিয়ে গেল গন্তব্যের দিকে।হঠাৎ আসা ফোনটায় এতদিনের ভাবনাগুলো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল। "লোকটা ঐন্দ্রিলাকে সুস্থই রাখবে বলো? ওর কোনো ক্ষতি করবে না - - - তাই না? "
" ওর কথা শুনে তো তাই মনে হচ্ছে। আগে তো পৌঁছই - - - ।"
"ও তো মুক্তিপণও চাইল না। কি ব্যাপার বলো তো - - - তুমি কিছু বুঝলে?"
"আঃ রঞ্জু! একটু থামবে - -!"
আচম্বিতে স্বামীর এরকম ব্যবহারে চুপ করে জানালার বাইরে তাকিয়ে রইল সুরঞ্জনা। নিজের ব্যবহারে নিজেই লজ্জিত হয়ে স্ত্রীর হাতে চাপ দিয়ে বললেন" স্যরি রঞ্জু, আসলে পরীকে না দেখা পর্যন্ত মাথায় কিছু ঢুকছে না। কি হচ্ছে কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। "
স্বামীর হাতে হাত রেখে বলল "আমি বুঝতে পারছি। আমি ওর মা হতে পারি - - - কিন্তু ও তো আসলে পাপাস্ পরী। পুলিশ তো যাচ্ছে আমাদের সাথে। তুমি চিন্তা কোরো না, সেরকম কিছু হলে ওনারা ঠিক সামলে নেবেন। "
প্রায় ঘণ্টাখানেক পর হাইওয়ের পাশের ফলকে লেখা 'পলাশপুর' গ্রামের সরু পিচের রাস্তা দিয়ে ঢুকে পুলিশ ভ্যানটাকে অনুগমন করে মনোজিতের গাড়ি গিয়ে দাঁড়াল গাছপালায় ঘেরা 'স্নেহচ্ছায়া' নামে বাড়িটার সামনে। ভিতর থেকে বাচ্চাদের কলকাকলির আওয়াজে গমগম করছিল চারপাশটা ।পুলিশের গাড়ি দেখে ইতিমধ্যেই বেশ কিছু লোকজন অদূরে ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে একরাশ উৎকণ্ঠা নিয়ে। ওনারা ভিতরে ঢুকতেই একজন লম্বা সৌম্য দর্শন ধুতি পাঞ্জাবি পরিহিত ভদ্রলোক এগিয়ে এসে গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন "যদি ভুল না করি - - আপনি ডাঃ মনোজিৎ বসু এবং উনি ঐন্দ্রিলার মা সুরঞ্জনা বসু?"
"হ্যাঁ আপনি ঠিকই বলেছেন।" মনোজিতের কথা শেষ হবার আগেই সুরঞ্জনা বলে উঠল "পরী কোথায়? ওকে আপনি কোথায় পেলেন?"
"আপনার প্রশ্নের উত্তর অবশ্যই দেব।কিন্তু আমার কথায় ভরসা করতে পারলেন না তো - - -! অবশ্য সেটাই স্বাভাবিক।
ইতিমধ্যে পুলিশ অফিসার চারিদিক ঘুরে এসে জানতে চাইলেন "এই আশ্রমের সব পেপার্স ঠিক আছে তো? কতজন বাচ্চা আছে এখানে? "
"আপনারা অফিসে আসুন। সব পেপার্স ওখানেই দেখাব।" এরপর মনোজিতের দিকে ঘুরে বললেন "আসুন সবাই। আর ঐ যে ঐন্দ্রিলা - - - - বাচ্চাদের সাথে বাগানের গাছগুলোয় জল দিচ্ছে। বড়ো লক্ষ্মী মেয়ে আপনার। আজকালকার যুগে এত শান্ত মেয়ে দেখাই যায় না। "
ওনার কথা অনুসরণ করে ডানদিকে তাকাতেই ওরা দেখতে পেল একঝাঁক ছেলেমেয়ের সাথে কী অবলীলায় মিশিয়ে নিয়েছে পরী নিজেকে। বাগানে একঝাঁক রঙবেরঙের প্রজাপতির মাঝখানে ওদের ছোট্ট ফুলপরীটা কি সুন্দরভাবে ঘুরছে - - - এই সবুজে ঘেরা প্রকৃতির মাঝে সদ্য প্রস্ফুটিত ভোরের শিশির ভেজা ফুলের মত পবিত্র উচ্ছল প্রাণবন্ত নতুন পরীর রূপে মনটা বড়ো ভালো হয়ে গেল মনোজিতের।
"আসুন - - - অফিসে বসেই আপনাদের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দি ।" অফিসে বসে সকলের জন্য চায়ের অর্ডার দিয়ে অফিসিয়াল কাগজপত্র অফিসারদের হাতে দিয়ে বলতে শুরু করলেন "দিন তিনেক আগে আশ্রমের কিছু অফিসিয়াল কাজে কোর্টে যেতে হয়েছিল। ফেরার পথে যদিও ওকে ট্রেনের কামরায় দেখিনি, কিন্তু ওকে দেখলাম ট্রেন থেকে নেমে - - - রবাহুতের মতো এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল। একটু অস্বাভাবিক মনে হতে ওর নামধাম জানতে চাইলে ও আমার আশ্রমের খোঁজ করছিল। এদিকে সন্ধ্যেও হয়ে আসছিল - - - বাচ্চা মেয়ে - - -তাই সবদিক ভেবে ওকে এখানে নিয়ে এসেছি। "
" ও এখানে কেন এল? আর এই আশ্রমের কথা জানল কি করে? "
সুরঞ্জনার প্রশ্নের উত্তরে ভদ্রলোক বললেন" আপনাদের হয়ত মনে নেই - - - বেশ কয়েকমাস আগে আমাদের আশ্রম রাজ্যপালের কাছে পুরস্কৃত হয়েছে, আর সেটা খবরের কাগজের প্রথম পাতার খবরে জায়গা পেয়েছিল। ওখান থেকেই ঐন্দ্রিলা আশ্রমের ঠিকানা পেয়েছে। কিন্তু ও বড্ড চাপাস্বভাবের - - - তাই ওর আসার কারণটা আমি এখনও জানতে পারিনি। "
" ফোন নম্বর কি করে পেলেন? "
অফিসার জানতে চাইলে উনি বলেন" বলতে পারেন একটু মিথ্যের আশ্রয় নিতে হয়েছিল এটা জানতে। আসলে আমার ছেলেমেয়েরা অনাথ হলেও ও যে অনাথ নয় সেটা ওর চেহারা বলে দিচ্ছিল।" একটু চুপ থেকে উনি কথার রেশ টেনে বলতে শুরু করলেন" তাই ওকে হারিয়ে ওর বাবা-মার অবস্থা কল্পনা করে বড়ো দুশ্চিন্তা হচ্ছিল। অথচ খবরের কাগজ বা টিভিতে কোনো নিরুদ্দেশের খবর ছিল না যা থেকে আপনাদের কাছে পৌঁছতে পারতাম। তাই অনেক কষ্টে একটু অভিনয় করেই আপনার ফোন নম্বর জানতে হয়েছে ওর কাছ থেকে।সবটাই তো শুনলেন - - - আর যদি কিছু জিজ্ঞাস্য থাকে তো বলুন। সাধ্যমত উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করব। "
পুলিশ অফিসারটির আরও কিছু প্রশ্নোত্তর পর্বের শেষে সুরঞ্জনা বলল" আমার মেয়েটাকে ডাকবেন? "
ওনাদের অপেক্ষা করতে বলে 'স্নেহচ্ছায়া' র কাণ্ডারী ওই মানুষটি ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই মনোজিৎ বলল" পরী হঠাৎ বাড়ি ছাড়তে গেল কেন? আমাকে বললেই তো নিয়ে আসতাম এখানে ওকে?"
মধ্যবয়স্ক অফিসারটি হঠাৎই বলে উঠলেন "কি জানেন ডাঃ বসু, ছেলেমেয়েদের বয়ঃসন্ধির মনের খবর বোঝা বড়ো মুশকিল।"
"সেই - - - - ঠিকই বলেছেন।"
"ওকে কিন্তু বকাবকি করবেন না ম্যাডাম। এতে হিতে বিপরীত হয়ে যাবে। "
" আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন। তবে - - - এবার বোধহয় পরীর বন্ধু হওয়ার সময় এসে গেছে আমাদের। "
ওদের কথার মাঝেই " মা - - - বাবা---তোমরা?" - - পরীর গলার আওয়াজে সকলে একসাথে হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল ওর দিকে। সুরঞ্জনার চোখের জল আজ আর বাঁধ মানছিল না। বহু অদর্শনের পর সবচেয়ে প্রিয় নিজের সন্তানকে দেখার আকুলতায় ভরা দৃষ্টিতে পরীর দিকে তাকিয়ে ছিল মনোজিৎ।
বাবা মাকে ওই অবস্থায় দেখে পরী দৌড়ে বাবার কাছে এসে জিজ্ঞেস করল "আমি তো ভালোই আছি এখানে। তুমি ওভাবে তাকিয়ে আছ কেন?"
মেয়ের কথার কোনো উত্তর না দিয়ে ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে শান্তির নিশ্বাস ফেললেন মনোজিৎ "যা মা - - - তোর মায়ের কাছে যা। তোকে না দেখে তোর মা প্রায় বিছানা নিয়েছিল।"
মায়ের এই অবস্থার কথা শুনে দৌড়ে মাকে জড়িয়ে ধরে মায়ের সাথেই কাঁদতে লাগল ও। সুরঞ্জনা মেয়েকে আদরে সোহাগে ভরিয়ে দিয়ে জানতে চাইল "তুই হঠাৎ কাউকে কিছু না জানিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলি কেন মা? "
মায়ের প্রশ্নের উত্তরে ঐন্দ্রিলা মুখ নীচু করে দাঁড়িয়ে রইল। মেয়েকে নিরুত্তর দেখে সুরঞ্জনা জিজ্ঞেস করল "কি রে - - - বল্? আমরা তোর উত্তরের অপেক্ষায় রয়েছি।"
"হ্যাঁ, ঐন্দ্রিলা----চুপ করে থাকলে হবে না! তোমার উত্তরের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। "
এত প্রশ্নের উত্তরে ঐন্দ্রিলাকে নীরব দেখে স্নেহপরায়ণ মানুষটি ওর মাথায় হাত রেখে বললেন "ওনাদের কথার জবাব দাও ঐন্দ্রিলা। ওনারা তোমার বাবা মা - - -। এভাবে চুপ করে থাকলে তো হবে না মা---।"
" আর তাছাড়া ঐন্দ্রিলা - - - ওভাবে একা বেরিয়ে তুমি ঠিক করো নি। ওনার বদলে কোনো দুষ্টু লোকের খপ্পরে পড়লে কী হতে পারতো - - - জানো?"
সকলের কথার উত্তরে ছলছল চোখে ঐন্দ্রিলা বলল"মা---আমার রুটিন মাফিক চলতে আর ভালো লাগছিল না। "
" কিন্তু - - - আমাদের সবাইকে তো রুটিন মেনেই চলতে হয়। তুমি জিজ্ঞেস করে দেখো - - -। "
" দাঁড়ান ম্যাডাম - - - আমি কথা বলছি।তোমার ইচ্ছেগুলো আমাকে বলবে মা? তোমার কি ভাল লাগে---? "
ওনার স্নেহ স্পর্শে সাহস সঞ্চয় করে ঐন্দ্রিলা বলল" শান্তাদিদিরা স্কুলে একসাথে বসে লাঞ্চ করে, কত মজা করে ওরা। সকাল বেলায় রাস্তার কল থেকে লাইন দিয়ে জল নিয়ে আসে একসাথে। বিকেলে পাড়ায় কত্ত কি খেলে ওরা - - - যেগুলো আমার ভিডিও গেমের থেকে অনেক ভালো। কি মজা করে একসাথে স্কুলে যায়। শান্তাদিদি , মিনুমাসি - - - ওদের কত বন্ধু আছে পাড়ায়। কি মজা করে একসাথে থাকে ওরা। "
" কিন্তু এই আশ্রমের খোঁজ পেলে কী ভাবে? "
অফিসারের প্রশ্নের উত্তরে ও বলে" নিউজ পেপারে - - - স্যারের একটা ইন্টারভিউ ছিল, সাথে এখানকার সবার ছবি। "
" আর তাই তুমি চলে এলে? আমাদের বলতে পারতে তো? "সুরঞ্জনা একটু রাগতস্বরে জানতে চাইলে ও বলে" আমার ডেইলি রুটিনে তো এটা নেই মা - - - তাই আসাটাও হত না। "
হতবাক সুরঞ্জনা কিছু বলার আগেই মনোজিৎ মেয়েকে কাছে টেনে নিয়ে বললেন" আমাদের ভুল হয়ে গেছে রে মা। ছক ভাঙা জীবনটাও যে তোর প্রাপ্য - - - ছকে বাঁধা থাকতে থাকতে কখন যেন সেকথা ভুলেই গিয়েছিলাম রে মা। এবার বাড়ি ফিরে চল আমাদের সাথে। "
" এখানে আমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না বাবা।"
"জানি রে মা, এখানে তো অফুরান ভালোবাসা - - - অসুবিধারও সুবিধা হবে না। কিন্তু তোকে ছাড়া আমরা থাকব কি করে বলতো? "
" কিন্তু বাবা----"
" ঐন্দ্রিলা, তুমি তো বুদ্ধিমতি মেয়ে - - - তোমাকে ছাড়া ওনারা ভালো থাকবেন না। তুমি কি সেটা চাও?"
দুদিকে মাথা নাড়িয়ে না বলতেই মাস্টারমশাই বলে উঠলেন" ডাক্তারবাবু আপনার মেয়ে একটি রত্ন। একে হেলায় হারাবেন না,প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে গিয়ে নিজেকে খুঁজে পেতে চায় ও। ওকে সেটুকু সুযোগ করে দিন ডাক্তারবাবু। "
মাস্টারমশাইয়ের কথায় সায় দিয়ে মনোজিৎ বললেন "একটা বিষয়ে আপনার অনুমতির প্রয়োজন ছিল মাস্টারমশাই?"
" হ্যাঁ বলুন না - - - - নির্দ্বিধায় বলুন। " " পরী যদি প্রতি শনি- রবিবার এখানে এসে কাটায় অসুবিধা হবে না তো? "
" একথা কেন বলছেন ডাক্তারবাবু? ঐন্দ্রিলাকে আশ্রমের সকলে ভীষণ ভালোবাসে - - - ও এখানে এলে আমাদেরও ভালো লাগবে। আসবে তো মা? "
" তাহলে তো খুব মজা হবে, তাই না মাস্টারমশাই? আচ্ছা বাবা - - - আমি তাহলে এখন বন্ধুদের কাছে যাই? "উত্তরের অপেক্ষা না করে ঐন্দ্রিলা চলে যেতেই মাস্টারমশাই বললেন"একটা কথা বলি ডাক্তারবাবু---অনেক বেলা হয়ে গেছে, আমার সাধ্যমত দুপুরের খাবারের আয়োজন করেছি। দুটি ডাল ভাত মুখে দিয়ে আপনারা রওনা দেবেন। আজ ঘরের মেয়েকে ঘরে ফিরিয়ে দিতে পারছি----এর থেকে বড়ো আনন্দ আর কিছুই নেই।"
" সে না হয় হবে। এখন আপনি এটা রাখুন। "
" এটা কি ডাক্তারবাবু - - - ঐন্দ্রিলার মুক্তিপণ?"
"একথা বলে আর লজ্জা দেবেন না প্লিজ। আপনি ঐন্দ্রিলার জন্য যা করেছেন সেটার মূল্য নির্ধারণ কোনো মূল্যেই সম্ভব নয়। আসলে - - - আমার মেয়ে তো আপনার পরিবারের সদস্য হয়েই গেছে। আর বাকী রইলাম আমি আর আমার স্ত্রী। তাই মনে করুন, এটা আমাদের প্রবেশ মূল্য। "
" কী বলছেন আপনি - - -! "
" একেবারে ঠিক বলছি। এটা গ্রহণ করে আপনার এই বিরাট কর্মকাণ্ডের অংশীদার করবেন আমাদের?"
" কী যে বলেন ডাক্তারবাবু? আপনাদের পাশে পাওয়া তো আমার ছেলেমেয়েদের ভাগ্যের ব্যাপার। "
" এক মিনিট, শুধু ওনারা না - - - আজ থেকে আমিও আছি আপনাদের সাথে। গোয়েন্দা বলে দূরে সরিয়ে দেবেন না তো? "
ওনার কথায় সকলে হাতে হাত রেখে একসাথে হেসে উঠলেন আর বাইরে থেকে ঘরে ঢোকার মুহূর্তে এই দৃশ্য দেখে ঐন্দ্রিলা হাততালি দিয়ে নেচে উঠলো।
------------------