"নন্দিনী - - - - এই নন্দিনী - - - - "
"কী হয়েছে - - - এত চিৎকার করছ কেন?"
"জানো না কেন ডাকছি?"
"সেই - - - -! দরকার ছাড়া তো আমি অস্তিত্বহীন। যাকগে, ডাকছিলে কেন বলো।"
"নন্দিনী প্লিজ, অফিসে যাওয়ার সময় বিরক্ত কোরো না। আমার ওয়ালেট, ঘড়ি এগুলো কোথায় রেখেছ? "
" নিজের কাজ নিজে করে নিলে না তো আমাকে তোমার কাছে আসতে হয়, না তোমাকে আমায় সহ্য করতে হয়। আর, তাছাড়া আমাকেও তো বেরোতে হবে" আলমারী খুলে ওর জিনিসগুলো হাতে দিয়ে রাগে গজগজ করতে করতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায় নন্দিনী। রাগে, বিরক্তিতে মনটা তেতো হয়ে আসে ওর----।
কোনওরকমে তৈরী হয়ে নীচে এসে দেখল - - - - অভি চলে গেছে ওকে ছেড়ে একাই। প্রচন্ড অভিমানে বুকটা ভারী হয়ে গেল নন্দিনীর। তিতাসকে স্কুলে পাঠিয়ে, সংসারের সবটুকু সামলে নিজেকে তৈরী করতে যেটুকু সময়ের প্রয়োজন - - - - সেটুকুও পায় না ও। একটা দীর্ঘশ্বাস বুকে চেপে ট্যাক্সি নিয়ে অফিসে রওনা হল নন্দিনী।
গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে নন্দিনীকে না নিয়ে একাই অফিসে রওনা দেয় অভি। প্রায় ছ'বছরের ভালোবাসার সম্পর্কের পরিনতিতে আজ ওরা স্বামী - স্ত্রী। কিন্তু বিয়ের আট বছরের মধ্যেই' ভালোবাসার 'একটা অক্ষরও অবশিষ্ট নেই আর। তিতাস না থাকলে কবেই ও আলাদা থাকত! যতদিন যাচ্ছে নন্দিনী জাস্ট ইনটলারেবল হয়ে যাচ্ছে। সোজা কথার বাঁকা মানে খুঁজে চেঁচামেচিতে পারদর্শী হয়ে উঠছে ও। অথচ ইউনিভার্সিটিতে এই মেয়েটার কোমর ছাড়ানো শ্রাবনের মেঘের মতো ঘন কালো চুল আর অতল সমুদ্রের গোপন রহস্যে ঘেরা চোখের জাদুতে মোহিত হয়ে গিয়েছিল অভি।
অফিসে আজও পাঁচ মিনিট লেট হয়ে গেল নন্দিনীর। তিতাসের জন্মের পর ওকে চাকরীটা ছেড়ে দিতে বলেছিল অভি। কিন্তু নিজের যোগ্যতায় পাওয়া চাকরীটার সাথে কোনো আপোসে যায়নি বলেই হয়ত মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে অভি ওর দিক থেকে। ভালোবাসার সুতোয় বাঁধা সম্পর্কের বাঁধনটা আজ শুধুই একটা সুতোয় ঝুলছে - - - তিতাস। ওর জন্যই একপা এগোতে গিয়ে হাজার পা পিছিয়ে আসে নন্দিনী।
"আজও লেট করলি নন্দিনী। স্যার কিন্তু এবার সত্যিই রেগে যাবেন রে।"
"কী করি বলতো, বন্যা - - - - রোজ শত চেষ্টাতেও পেরে উঠি না রে। স্যারের আর কী - - - - ওনাকে তো আর সংসার সামলাতে হয় না।"
ওদের কথার মাঝেই ব্যাগের ভিতর থেকেই কেঁপে উঠে ফোনটা। কোনও কিছুর আগমনের জানান দিতেই মনটা ছটফট করে উঠে ওর। এই একটা ব্যাপারে বড্ড মিল চিঠি আর ফোনের - - - -দুটোই বন্ধ অবস্থায় মনের মধ্যে এক অদ্ভূত কৌতুহলের উদ্রেক করে, যা প্রকাশে আনে লজ্জা আর অপ্রকাশে মনের অস্থিরতা বাড়ায়।বন্যা চলে যেতে ইনবক্স চেক করতেই দেখে রবিঠাকুরের গানের দুটো লাইন" বঁধু মিছে রাগ কোরো না - - - "মেসেজটা পড়ে শেষ করার আগেই আবার একটা মেসেজ" খালি পেটে রাগ কমে না ম্যাডাম---কিছু খেয়ে নাও।"
কী অদ্ভূত! ও কী করে জানল নন্দিনীর রাগ করে না খেয়ে থাকার কথা। মনখারাপের সময়গুলোতে একঝলক ঠান্ডা বাতাসের সাথে বার্তাবহের বার্তা এসে ওর সব মনখারাপকে এক ফুঁয়ে কোথায় উড়িয়ে নিয়ে চলে যায়।
নন্দিনী এই অপরিচিত নতুন বন্ধুর নাম দিয়েছে 'খোলা হাওয়া' - - - - যা ওর হৃদয়ের বন্ধ জানালার ফাঁক ফোকর দিয়ে প্রবেশ করে দমকা হাওয়ায় মনের গুমোট পরিবেশকে উড়িয়ে সমস্ত মেঘ কাটিয়ে নীল আকাশের প্রশান্তি এনে দেয়।
নিজের কেবিনে বেশ কিছুটা সময় একলা মনের সঙ্গী হয়ে সব খারাপ লাগাগুলোকে গোপন কুঠুরিতে বন্ধ রেখে স্বাভাবিক ভাবে বাড়িতে ফোন করতেই তিতাসের গলা শুনল"আমি এসে গিয়েছি - - - - মামনি ।লক্ষ্মী মেয়ে হয়ে থাকব, ঠিক করে খেয়ে নেব আর মিঠু মাসির সব কথা শুনব - - - - তুমি একটুও ভেবো না। আচ্ছা মামনি, তুমি তো রোজ ফোন করো। বাবাই কোথায় বলতো? একটুও ফোন করেনা - - - - বাবাইয়ের সাথে কথাই বলব না।"
"বাবাই তো ব্যস্ত থাকে, ঠিক আছে আমি বলে দেব তোমাকে ফোন করতে। তুমি লক্ষ্মী মেয়ে হয়ে থেকো কিন্তু । মিঠুমাসিকে ফোনটা দাও তো বাবু।
মিঠু দিকে ফোনে সবটা বুঝিয়ে দিয়ে অভ্যাসবশেই ফোন করল অভিকে "তোমার লাঞ্চ হয়ে গেছে? তিতাস রাগ করেছে, ওকে একবার ফোন করে নিও।" ফোনের ওপ্রান্তে থাকা অভির উত্তরেই ওর কাজের চাপ বুঝতে পেরে কথা না বাড়িয়ে ফোনটাকে রেখে দিল নন্দিনী।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের ম্যানেজার অভি ওরফে অভিমন্যু বসুর কাজের চাপে অন্য কথা মনেই থাকে না। কোনওরকমে নন্দিনীর ফোনটা রেখেই ফাইলে মুখ ডোবালো অভি। নন্দিনীর সব কথা কানে এলেও মন পর্যন্ত পৌঁছল না ওর। বিকেল পাঁচটা নাগাদ সব কাজ শেষ করে মাথাটা ফাঁকা হতেই হঠাৎ মনে পড়লো নন্দিনীর ফোনটার কথা "কী একটা বলছিল যেন, তিতাসের কথা-----কী হল মেয়েটার?" বাড়িতে ফোন করতে ফোনটা বেজে গেল একা একাই। বাধ্য হয়ে নন্দিনীকে ফোন করে জিজ্ঞেস করতেই ফোনের ওপ্রান্ত থেকেই ওকে দায়িত্বজ্ঞানহীন প্রমান করে ফোনটা রেখে দিল ও। "নন্দিনী দিন দিন নেক্সট টু ইমপসিবল হয়ে যাচ্ছে।"
অনেকদিন পর আচমকা অভির ফোন পেয়ে মনটা আনন্দে নেচে উঠেছিল নন্দিনীর। পরমুহুর্তে ভুলটা ভাঙতেই ভাবল "ওর কাছে আমার অস্তিত্ব না থাকলেও মেয়েটাকে ও বড্ড ভালোবাসে। এই শান্তিটুকু নিয়ে অন্তত মরতে পারব"। এসব ভাবতে ভাবতে ভিজে চোখের কোলটা মুছে সুখী মুখের মুখোশটা পরে অফিস থেকে বেরোনোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল নন্দিনী। এমন সময় স্ক্রিনে ফুটে উঠল"মন ভালো করার অব্যর্থ ওষুধ কিন্তু ফুচকা। ওর তেঁতুল জলের সাথে চোখের নোনতা জল মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় । "
এখন মেসেজ দেখে আর অপ্রত্যাশিত বিরক্তি, কৌতুহল না হলেও চারপাশটা দেখে নিল নন্দিনী "কেউ ওর অসুখী চেহারাটা কী দেখল?" এই অজানা বন্ধুর অনামা মেসেজ আসার শুরুর দিনগুলোতে সবাইকে সন্দেহের চোখে দেখত নন্দিনী। ওর সন্দেহের তালিকায় পাড়ার দোকানদার, অফিসের সহকর্মী, পিওন, দারোয়ান এমনকি ট্র্যাফিক সিগনালে দাঁড়িয়ে থাকা গোমড়ামুখো পুলিশটাও বাদ যেত না। আর এখন এই হঠাৎ পাওয়া নাম না জানা মানুষটাকে কখন যেন নিজের অজান্তেই বন্ধুর স্বীকৃতি দিয়ে দিয়েছে। কাজের ফাঁকে মাঝে মাঝেই সাদা স্ক্রিনে কালো অক্ষরে ফুটে ওঠা কয়েকটা লাইন পড়ার জন্য ভীষন উদগ্রীব হয়ে থাকে মনটা "বড়ো অদ্ভূত মানুষ! আমার ভালোলাগা, খারাপলাগা সবকিছু নখদর্পনে।
অন্তর্যামী হয়ে সব মনখারাপের দায়িত্ব নিয়ে আমাকে ভারমুক্ত করার দায়িত্ব নেওয়া মানুষটাকে জানতেই হবে আমাকে।" এসব ভাবতে ভাবতে অফিস থেকে ফিরে কী মনে করে তিতাসকে সঙ্গে নিয়ে পাড়ার মোড়ে ফুচকা খেতে চলে এল নন্দিনী।
" মামনি, আজ আমরা ফুচকা খাব? "
" হ্যাঁ, আমার বুড়িমা - - - - আজ আমরা ফুচকা খাব - - - আর আমার সোনার পছন্দের আইসক্রিম খাবো - - তারপর ফিরব।"
" বাবাই থাকলে আরও মজা হতো - - - -!"
"কী করা যাবে বলো - - - - - জানোই তো বাবাই কতো ব্যস্ত।"
বাবাই না থাকার মনখারাপটা আজ ফুচকাই ভুলিয়ে দিল তিতাসকে।
তিতাসকে ফোনে না পাওয়ায় বারবার ওর আদুরে আওয়াজ কানে ভাসছিল অভির। নতুন কোনো কাজে হাত না দিয়ে বাড়ির পথে পা বাড়ালো ও। হঠাৎ দূর থেকে মা-মেয়েকে ফুচকা খেতে দেখে গাড়িটা কিছুটা দূরে রেখে চুপিচুপি নন্দিনীর কানের কাছে মুখ এনে বলল"আমি কী একটা পেতে পারি?"
চমকে তাকিয়ে অভিকে দেখে অপ্রত্যাশিত আনন্দে, বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল ওরা।
"কী মজা, কী মজা - - - - বাবাই এসে গেছে।তুমি ফুচকা খাবে তো বাবাই?কতগুলো খাবে - - - 1---2---3---?"
"আমার প্রিন্সেস যতগুলো দেবে। আমার কাছে কিন্তু পয়সা নেই। তোমার মামনি কী আমাকে খাওয়াবে? "
আজ আর একটুও রাগ হোলো না নন্দিনীর। বরং কপট রাগে চোখ পাকিয়ে বলল"বড্ড বাজে কথা বলো তুমি। আমি বুঝি এরকম! তবে বেশি খেয়ো না - - - অ্যাসিড হয়ে যাবে। "
" যো হুকুম, মহারানী। "
অনেকদিন পর এভাবে একসাথে বাড়ি ফিরল ওরা। আজ সব মেঘ কেটে গিয়ে অস্তরাগের রবির কমলা আভায় নন্দিনীর মনের আকাশ রঙিন হয়ে উঠেছে।
বাড়ি ফিরে তিতাসকে কোলে নিয়ে নিজের ঘরে চলে যায় অভি ।ইউনিভার্সিটির দিনগুলো পেরিয়ে আসার পর আজ নন্দিনীকে তিতাসের মা নয় - - - -ওর কল্পনায় বেঁচে থাকা চিরনতুন রহস্যে ঘেরা নন্দিনী মনে হচ্ছিল। অফিসে দায়িত্ব বেড়ে যাওয়ায় আলাদা করে নন্দিনীকে সময় দিতে পারে না বলে অভিমানে বুক ভরে উঠলেও এখন আর কোনো অনুযোগ করে না ও। সেদিনের সেই মিষ্টি, হাসিখুশি নন্দিনীর এখন শুধুই অভির স্বপ্নে আগমন। আর অভির স্ত্রী - - - - তিতাসের মা নন্দিনী এখন বড্ড বদমেজাজি, খিটখিটে। এসব ভাবতে ভাবতে ক্লান্ত অভি একসময় ঘুমিয়ে পড়ে।
সংসারের সব কাজ শেষ করে অভির ঘরে গিয়ে দেখল - - - - তিতাস ওর বাবাই-এর বুকে নিশ্চিন্তে ছোট্ট পাখির মতো ঘুমিয়ে আছে। অভিও গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। আবারো একটা কষ্ট আস্তে আস্তে বুকের মধ্যে চেপে বসছে। তিতাস একটু বড়ো হবার পর থেকেই ওদের বিছানা আলাদা হয়ে গেছে। তবুও আজ মনের কোনো এক কোনে একটুকরো আশা নিয়ে এসেছিল নন্দিনী। পুরোনো অভিমান নতুন করে চেপে রেখে তিতাসকে নিয়ে নিজের ঘরে চলে যায় ও।আজকাল অভির বদলে অভিমান, দীর্ঘশ্বাস - - - এরাই সর্বক্ষণের সঙ্গী হয়ে উঠে ধীরে ধীরে নন্দিনীকে একরাশ কালো হতাশার অন্ধকারে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। সব জেনেও ইচ্ছে করেই নিজেকে ওদের হাতে সঁপে দিয়েছে নন্দিনী।
রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুমপরীদের জাদুকাঠির ছোঁয়ায় বিশ্বচরাচর স্বপ্নমাখা চোখে ঘুমের কোলে ঠাঁই নিলেও নন্দিনীর চোখে ঘুম ছিল না। আজ ভীষন ভাবে অভিকে চাইছিল ওর মন ।অভির ছোঁয়ায়, ওর ভালোবাসায় নিজেকে পূর্ণ করতে চাইছিল ওর সমস্ত সত্ত্বা। কিন্তু ঘুমন্ত অভিকে জাগিয়ে নিজেকে সঁপে দিতেও ইচ্ছে করল না নন্দিনীর। বদলে এক দুরন্ত অভিমান গ্রাস করল ওকে।"আমি কী এতটাই মূল্যহীন যে আমার ছোট ছোট ইচ্ছে অনিচ্ছে আজ আর স্পর্শ করে না অভিকে। এখন আমার পরিচয় বকলমে এবাড়ির কেয়ারটেকার। "ঘুমন্ত তিতাসের কপালে আলতো করে হাত ছুঁইয়ে পায়ে পায়ে ঘরের লাগোয়া ছাদে এসে দাঁড়াল নন্দিনী। অনেকদিন পর অন্ধকার রাতের খোলা আকাশের নীচে এসে দাঁড়ালো ও। সারাদিনের এটাই একটা সময় যখন এই বিরাট সীমানাহীন আকাশের সীমার মধ্যে নিজেকে সঁপে দেওয়া যায়। মনে পড়ে গেল - - - বিয়ের পর পর প্রায়ই চাঁদ - তারাদের সাক্ষী রেখে প্রেমের জোয়ারে ভেসে যেত দুটি প্রেমিক হৃদয়। "এমন কিছু বেশী দিনের কথা তো নয় - - - - তবু দুটো রাতের কত পার্থক্য।" হঠাৎ তিতাস কেঁদে উঠতেই নিজের মনে বুনতে থাকা ভাবনার জালটা খেই হারিয়ে ফেলে। দৌড়ে এসে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে নতুন ভাবনার সুতোয় ফেলে রাখা মালাটা গাঁথতে গাঁথতে ঘুমিয়ে পড়ে নন্দিনী।
ক্রমশঃ ----------------
ছবি ঋণ- ইন্টারনেট
-----------------------------------
Address and phone number :-
Supta Auddy
Flat 1, U7A Block H, Tarabag Campus, Burdwan University, Post Rajbati, Dist Purba Bardhamann, PIN 713104, WB
Ph No.. 7679517894