ভাপা ইলিশ
সমাজ বসু
সন্ধ্যের মুখে স্টেশনের বাজারে সস্তায় ইলিশ পেলেন সুবোধবাবু। ঝুপ ঝুপ বৃষ্টি পড়ছে সেই দুপুর থেকে। একজোড়া হাতে ঝুলিয়ে আসছেন পুকুরপাড় দিয়ে,পেছন থেকে মেয়েলি গলায় কে যেন জিজ্ঞেস করল,"ইলিশ কত করে নিল?"
গলার স্বর শুনে চমকে উঠলেন সুবোধবাবু-- একি অনুপমা তুমি? ভরসন্ধ্যেয় তুমি এখানে কি করছ?
---- শরীর খারাপ নিয়ে আজ অফিসে গেলে। এত দেরি ত হয় না! তার ওপর দুপুর থেকে বৃষ্টি শুরু হয়েছে,তাই ভাবলাম একটু ছাতাটা নিয়ে.....
--- কি দরকার ছিল! এই বৃষ্টি তেমন গায়ে লাগে না।
--- তা বললে না,কত দাম নিল?
--- বেশ কম দামেই পেলাম। বাজারের তুলনায় প্রায় শ দেড়েক টাকার তফাৎ। তাছাড়া টাটকাই মনে হচ্ছে। সুবোধবাবু তাঁর স্ত্রীকে আস্বস্ত করলেন।
বৃষ্টিটা একটু জোরেই এল। একটা ছাতায় স্বামী স্ত্রী দুজনে কোনরকমে মাথা বাঁচিয়ে এগিয়ে চললেন।
নিজের অজান্তেই মনে মনে স্ত্রী অনুপমার সঙ্গে কথা বলতে বলতে সুবোধ বাবু একসময় বাড়ি পৌঁছে গেলেন। তাঁর মনে হল, এতটা পথ তিনি বেশ একটা ঘোরের মধ্যে ছিলেন। অনুপমা যেন সত্যিই পাশে ছিলেন। কিন্তু আজ সে তো ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাহলে এমনটা কেন হল? এ কথা বাড়িতে বলাও যাবে না।
বৃষ্টি ধরে আসতেই আকাশটা পরিষ্কার হয়ে গেল। আকাশ জুড়ে তারাগুলোও যে যার মত ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল।
মাছদুটো কেটেকুটে নুন হলুদ মাখিয়ে ফ্রিজে ঢুকিয়ে রেখে,দু কাপ চা নিয়ে সুবোধবাবুর পাশে এসে বসল রিমি, সুবোধবাবুর পুত্রবধূ।
--- বাবা, একটা কথা বলে তোমাকে বলা হয়নি।
--- কি কথা রিমি মা?
---- বাবা,কাল আমি তোমাকে ভাঁপা ইলিশ রেঁধে খাওয়াব। তুমি একদম না করবে না।ভাঁপা ইলিশ তো তোমার খুব প্রিয়। সেইদিনের দুর্ঘটনার পর থেকে সেই যে ছেড়েছো,আজ চার বছর হল তুমি মুখে তোলনি।
--- নারে মা, এই অনুরোধটুকু আমায় করিস না। আমি রাখতে পারব না। সেই দিনটা কি ভুলতে পারি? সকাল থেকে ইলিশ মাছের সব আইটেম ছেড়ে শুধু ভাঁপা ইলিশই সেদিন রেঁধেছিল তোর মা। রান্না শেষ হওয়া মাত্রই তাঁর বুকের ব্যথা শুরু হল। তারপর সব শেষ। এত বছর ধরে নিজের হাতে গড়ে তোলা সুন্দর সংসারটাকে ফেলে রেখে স্বার্থপরের মত চলে গেল। একবারও ভাবল না কারও কথা। কথাগুলো বলতে গিয়ে সুবোধবাবুর গলাটা ধরে আসে। প্রসঙ্গ পাল্টানোর চেষ্টা করেন।
--- তা হ্যারে, তোর বাবা মা কাল আসছেন তো?
--- বাবার শরীর খুব একটা ভাল নেই। মা আসবেন। মামা মামীরও আসার কথা। আর আমাদের অফিসের দু চারজনকে বলেছি।
--- তা বেশ ভালই করেছিস। তোর মা তো লোক খাওয়াতে খুব ভালবাসত,তুই তো জানিস। কিরে,তুই আবার কি ভাবছিস?
শ্বশুরের কথায় হঠাৎ চমকে ভাঙে রিমির।
--- বাবা, তোমাকে একটা কথা বলতে ভুলে গেছি- কাল রাতে আমি মাকে দেখেছি। পরিষ্কার দেখেছি,আমাকে বললেন,কাল তোর বাবাকে ভাঁপা ইলিশ রেঁধে খাওয়াবি। তাই তো কথাটা তোমাকে বললাম।
--- আজ আমারও মাছ নিয়ে আসার সময় তোর মায়ের কথা খুব মনে পড়ছিল রে! কিছুতেই তাকে ভুলতে পারছি না। ঠিক আছে, তুই যখন বলছিস,অল্প একটু খাব। সুবোধ বাবু রিমির মাথায় হাত রেখে আস্বস্ত করলেন।
দেয়াল থেকে মায়ের ছবিটা কাল রাতেই নামিয়ে রেখেছিল বাবলু। সকালে উঠে ছবিখানা চন্দন আর ফুলের মালায় সাজিয়ে, একগোছা ধুপকাঠি জ্বেলে রেখে কিচেনে ঢুকে পড়ে রিমি। মোটামুটি পঁচিশ তিরিশ জনের খাওয়ার অর্ডার ক্যাটারিং এ দেওয়া হয়েছে। প্রতি বছরের মত ইলিশের আইটেমগুলো সেই করবে।
অনুপমার চলে যাওয়ার দিন থেকে আজ অবধি রিমি,ওই এক মেয়ে সুবোধবাবুকে যে অন্তরঙ্গতায় বেঁধে রেখেছে তার তুলনা নেই। ছেলের বউ কবে যে মেয়ে হয়ে গেল টেরই পেলেন না তিনি। আজ তাঁর মনে হয়,হয়ত অনুপমা তার এত তাড়াতাড়ি চলে যাওয়ার কথা বুঝতে পেরেছিল। তা নাহলে কি সংসারের সব ভার ওইভাবে মেয়েটার হাতে তুলে দেয়? বুঝেছিল,এই মেয়েই পারবে সব সামাল দিতে। আর এখন যা পরিস্থিতি, সকাল থেকে রাত অবধি ওই মেয়ের হেফাজতে নিশ্চিন্ত থাকা।
--- অনুপমা,চার বছর আগের সেই দিনটার কথা আজ ভীষণভাবে মনে পড়ছে। ঘর জুড়ে ভেসে বেড়াচ্ছে ভাঁপা ইলিশের গন্ধ। এই গন্ধে কেন জানি না আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। রিমি মা,স্বপ্নে পাওয়া তোমার আদেশ পালন করছে। আমার কোন আপত্তিই টিকল না। জানি, তুমি অনেক দূরে, তবুও মেয়েটাকে সাহস আর শক্তি জোগাও। শুধু ভয় হচ্ছে, সেদিনের মত আজ আবার কোন বিপদ হবে না ত? হঠাৎ রিমি ঘরে ঢুকতেই সুবোধবাবুর ঘোর ভাঙে।
--- একি বাবা,তুমি আবার মন খারাপ করে বসে আছ? আচ্ছা তুমি এইরকম ভেঙে পড়লে আমাদের কি ভাল লাগে? আমাদের বুঝি কষ্ট হয় না?
--- আরে আমার কিচ্ছু হয়নি। বাবলু ফিরেছে?
--- না, এখনও ফেরেনি। আমি বললাম আজ আর বেরিও না। সেই বেরোল। দুজনের কথার মাঝখানে বাবলুর বাইক এসে দাঁড়ায় আবাসনের নীচে।
--- কিরে কোথায় গিয়েছিলি? রিমি মা চিন্তা করছে। ছেলের কাছে কৈফিয়ত চাইলেন সুবোধবাবু।
--- রিমির একটা মেডিক্যাল রিপোর্ট আনতে গিয়েছিলাম। বাবা, তুমি কি জানো? তোমার রিমি মা, আমার সন্তানের মা হতে চলেছে।
--- বলিস কি! আজ তোর মায়ের মৃত্যুবার্ষিকীর দিনে এমন একটা সুখবর,আমি ত ভাবতেই পারছি না। বাবা আর ছেলের কথায় রিমি লজ্জায় পাশের ঘরে পা বাড়ায়। সঙ্গে সঙ্গে বাবলুও তার পিছু নেয়।
--- অনুপমা,শুনলে ছেলের কথা। আমি জানি, তুমিই আবার ফিরে আসছ তোমার সংসারে। এসে দ্যাখো,তোমাকে ছাড়া আমরা কেউ ভাল নেই। তুমি আর দেরি কোর না। তোমার আসার অপেক্ষায় আমি একটা একটা করে দিন গুণব। আর শোন, আজ আর ভাঁপা ইলিশ খেতে আমার কোন কষ্টই হবে না।
স্ত্রীর ছবির দিকে তাকিয়ে সুবোধবাবুর মনে হল,তিনিও হাসছেন।
--------------------
ছবি ঋণ- ইন্টারনেট
--------------------
সমাজ বসু।।
৫৬এ, মিলন পার্ক।। ডাক--গড়িয়া
কলকাতা--৭০০০৮৪
ফোন--৯০০৭৮৬৯৯৬৬