সংঘমিত্রা সরকার কবিরাজ
দিন কয়েক ধরেই দুর্গা লক্ষ্য করছেন বড় মেয়েটা যেন একটু বেশিই উদগ্রীব।কোথাও সুস্থিরভাবে দু - দন্ড বসতে পারছে না। সকালে তানপুরাটা নিয়ে গানের রেওয়াজে বসেছিলো বটে - কিন্তু সুর তালে মাঝে মাঝেই ছন্দ কাটছিলো।কি যে হলো! আজকালকার ছেলেমেয়েদের মনের গতি বোঝা ভার।তার উপর আবার বড়টি একটু বেশিই রাশ ভারী।বিদ্যের ভারে যেন মস্ত পাহাড়ের মতো অচঞ্চল। সর্বদাই যেন অন্যজগতে বিচরণ করছে।ছোটটিকে তবু পারা যায় ,নামে লক্ষী।কিন্তু কোথাও চিরটিকাল স্থিরতা নেই, চপলমতি।তবে নিজেই দেখেশুনে একটা ভালোই বিয়ে করেছে।মন দিয়ে ঘর- সংসার টাও করে।ওকে নিয়ে অতো চিন্তা হয় না। বড় টাকে নিয়েই যত সমস্যা। অতি - জ্ঞানবতী হলে যা হয় আর কি।বিয়েটাও ঠিক ভাবে করলো না। বুড়ো ব্রহ্মাটার সাথে লিভ টুগেদার করে।মা - বাবার সংসারেই পড়ে আছে। বাবা - মায়ের যে কত জ্বালা।কিন্তু এই নিয়ে তিনিই বা কিছু বলবেন কোন মুখে।নিজেও তো বাবা মায়ের আপত্তি সত্ত্বেও চালচুলোহীন এক বুড়োকে বিয়ে করেছিলেন। অল্প বয়সে যা হয় আর কি?
পিরিতে মজিল মন কিবা হাড়ি কিবা ডোম। কিন্তু তার স্বামীটি মানুষটা খারাপ নন।তবে কিনা নুন আনতে পান্তা ফুরোয় এই দশা নিয়ে কি সারাজীবন ধুয়ে খাওয়া চলে। সংসার চালাতে হাড়ে দুব্বো ঘাস গজিয়ে গেলো। সোনার পিতিমে মা - বাবার আদরের দুর্গা এখন হাড়মাস কালি হয়ে শ্যামাঙ্গী ভবতারিণী কালী।
সে যাক গে, মরুক গে ,এই বয়সে এসে আর আফসোস করে লাভ নেই। মেয়ে বড় হয়েছে , সব কথা কি মায়ের সাথে বলবে।এমনিতে সংসারের জাঁতাকলে পরে তিনিও তো রনচন্ডী ।ছেলে মেয়েদের সাথে একটু দুরত্বই হয়ে গেছে। তার মধ্যে লক্ষীটা দূরে থাকে বলে একটু মা - মা বেশি করে।আর গণেশটাতো চিরকালই নাদুস - ভুদুস , আদুরে , মায়ের আঁচল ধরা। বাপের ধারা পেয়েছে কিছুটা।ছোটটা তো বাউন্ডুলে।সারাদিন শরীর চর্চা করছে ,আর কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে।তার টিকি ধরে সাধ্য কার।
সাত - পাঁচ ভাবতে ভাবতে দুর্গা লক্ষীকে ফোন লাগান। বড় বোনের মনের খবর ছোটটা যদি কিছু দিতে পারে।তিনবারের চেষ্টাতেও ফোনটা ধরল না মেয়েটা।হাড় পিত্তিটা জ্বলে যায় দুর্গার।একেতো করোনা অসুরের দৌরাত্ম্য, একঘন্টা ধরে ফোনে ভাষণ শুনতে হচ্ছে ,কাজের সময় তারউপর ফোন ধরে না ,কোথায় যে যায়।ভালো বড়লোক পেয়েছে, ঠিক কোনো শপিংমল কিংবা সুপারমার্কেট ঘুরতে গেছে ঘরে তো পা টেকেই না ,রোগ জ্বালার ভয় -ডর ও নেই যেন। সারাদিন টাকা উড়াচ্ছে খালি ।মেয়ে ভালো থাক - সুখে থাক ,তাতে কোনো আপত্তি নেই।কিন্তু পড়তো তার মতো হাড়- হা ভাতের সংসারে ! বুড়ো শিবটাতো সারাজীবনটা চোখ বুজে মটকা মেরে পরে রইলো। ঘরে - বাইরে সব যুদ্ধ তিনি একাই সামলে চললেন।
এদিকে কৈলাস থেকে বৈকুণ্ঠ তো আর এপাড়া ওপাড়া নয়, যে যখন তখন আসবে যাবে -- ফোন ই ভরসা।তা সেটুকুও ধরার সময় তার নেই।কোনোভাবে মায়ের উপকারে আসবে সুসার
করবে সে সময় এখনকার মেয়েদের কোথায়।
কিছুক্ষন বাদেইঅবশ্য লক্ষী কল ব্যাক করলো।
'মা কিছু বলছিলে।'
হ্যাঁ - রে ! তোর দিদির কি হয়েছে রে ? আমাকে তো কোনোদিন কিছু বলে না। সারাদিন মুখ হাঁড়ি করে থাকে।কিন্তু কিন্তু কদিন ধরে দেখছি বেজায় অস্থির।একবার করে ব্রহ্মা বুড়োটার সাথে গুজগুজ ফুসফুস করছে ,নইলে বিশ্বকর্মাটার সাথে কিছু শলা করছে। তোমাদের তো আজকাল ছেলে মেয়ে সব সমান। এতো বলি এতো ছেলে বন্ধুদের সাথে সবসময় বকবক করিস না ,কে কার কথা শোনে ।সারাদিন ছেলেদের সাথে গল্প আর চ্যাট। বললেই বলবে পড়াশুনার জন্য ওরাই বেশি প্ৰয়োজনীয়। ওরা খুব হেল্পফুল। কেন বাপু ; শীতলা, ষষ্ঠী , মনসা ,শচী এরা কি মেশার মতো নয়।
তুমি একটুতেই বেশি চিন্তা করো। দিদিকে দিদির মতো থাকতে দাও।এটা ব্যক্তি স্বাধীনতার যুগ।প্রত্যেকেরই নিজের মতো করে বাঁচার অধিকার আছে। তাছাড়া দিদি আমাদের সবার বড়ো ।তুমিই তো অন্য সময় বলো যে দিদি খুব ধীর স্থির বুদ্ধিমতি । আজ আবার কি হলো।
সেটাই তো চিন্তা -আমার অতো শান্ত মেয়েটা কয়দিন ধরে ভারী অশান্ত। শরীর - টরির তো ঠিকই আছে দেখলাম।জ্বর জ্বালাও কিছু নেই। এই করোনার সময় বাপু একটু বেশিই চিন্তা হয়।মায়ের মন তো ।তোরা আর কি বুঝবি? একবার দ্যাখ না সরোটাকে ফোন করে।
ঠিক আছে তুমি এখন এতো চিন্তা কোরো না। আমি বিকেলে দিদির সাথে কথা বলে রাত্রে তোমায় ফোন করবো।
রাত্রে লক্ষী ফোন করে হেসেই খুন। দুর্গাতো শেষে রেগে গিয়েই বললেন ,সারাদিন ফ্যাকফ্যাক করিস
না ।আসল কথাটা বল।অনেক রাত হয়েছে।তোমাদের মতো আমার তো দশটা দাসী বাঁদী নেই - ভোর থেকে উঠে এই বুড়ো হাড়ে আবার সংসারে র জোয়াল টানতে হয়।তোমাদের মতো গভীর রাত অবধি ধিঙ্গিপোনা করলে আমার চলে না।
লক্ষী মনে মনে চটে উঠে।মাটা চিরকালই চন্ডীমার্কা ।একহাতে সব সামলাতে সামলাতে নীরস শুস্ক হয়ে গেছে।নিজেই তো বাবা প্রেম করে ওরকম দেখেশুনে বিয়ে করেছিলে এখন কাঁদুনি গাইলে কি হবে। যতই বলো ,এখানেই তখনকার আর আজকের দিনের ছেলেমেয়েদের তফাৎ।দিদি তো নিজের স্বভাব নিজে বোঝে।কারোর সংসারের বোঝা নিজের কাঁধে বয়ে বেড়াতে সে রাজী নয়। বই এর বোঝা বইতে বইতেই বেচারা কাহিল।সেজন্যই তো সংসারের ঝামেলাতেই যায় নি। দিব্যি লিভ - টুগেদারে আছে।আর সে নিজে বাপু বরের টাকায় দিব্যি রানীর মতো আরামে আনন্দে আছে।
তা যায় হোক ! লক্ষীর কথা অনুযায়ী দিদিকে সে সন্ধ্যের দিকে ফোন করেছিলো।একথা সে কথার পর ঘুরিয়ে বলেছিলো ,দিদি এবার তো তোর পুজোর সময় এসে গেলো। তুই তো ভীষণ লাকি। করোনার টীকাও নাকি বাজারে এসে গেছে ,তাহলে তো তোর পূজো এবার ধুমধাম করেই হবে।এখনতো আর জমায়েতের ভয় থাকবে না।
তার আপাত গম্ভীর দিদি, চটে গিয়ে মুখঝামটা দিলো - 'বাজে বকিস নাতো' ।স্কুলগুলোই তো এখনো খুললো না।আমার তো সব পড়ুয়াদের নিয়ে কাজ কারবার। তোর ভক্ত যত সংসারী লোকেরা। স্কুল কলেজ না খুললে তারা কোথায় জমায়েত টা করবে শুনি।ওদের নিয়েই তো আনন্দ।আহা ! বেচারাদের কাছে ওটা প্রেম দিবসও বটে। কত নতুন জুটির সেদিন প্রথম মন দেওয়া নেওয়া হয়। ব্যাটা করোনাসুরটা সব ঘেঁটে দিলো। আর শয়তান রাজনীতিবিদগুলো নিজেদের মিটিং মিছিলে লোক জমায়েত হলে তখন ক্ষতি নেই। যত ক্ষতি স্কুল কলেজ খুললে।
লক্ষীও সুযোগ পেয়ে বলে ওঠে , তাই বুঝি কয়দিন ধরে তুই অস্থির । মাও বলছিলো কয়দিন সরোটা আমার ঠিক করে খাচ্ছেদাচ্ছে না।শরীর খারাপ হলো নাকি বুঝতেও পারছি না।
হুমম ,মাতৃদেবী তোমাকে চরগিরি করতে পেছনে লাগিয়েছেন। বুঝলাম।
আর বলিস না ! এবার তো স্কুল কলেজ খোলা নেই। বই খাতাতেও তো পড়াশুনা হচ্ছে না। হচ্ছে মোবাইল আর ল্যাপটপে। তা আমি নিজেই এখনো অনলাইন ব্যাপারটাতে কম্পিউটারের খুঁটিনাটিতে অভ্যস্ত হতে পারিনি। মর্ত্যের মানুষগুলো যাচ্ছেতাই। প্রতিদিন নতুন নতুন নিয়ম পাল্টায়।স্কুল - কলেজগুলোতেতো আজকাল পড়াশুনো বাদ দিয়ে সবকিছুই হয়।রাজনীতির - কূটকাচালি -প্রেম - পিরিতি এমনকি তোর ডিপার্টমেন্টটাও চাল আলু খাওয়া দাওয়া অবধি টেনে নিয়ে আমার আঙিনায় ঢুকিয়েছে।
এবার ঘটনা হলো যে ব্যাপারটাতে আমিই ঠিক করে এখনো সরগর হয়নি সেটাতে কি বলে আমি ছাত্রছাত্রীদের আশীর্বাদ করি। এবার নির্ঘাত ছেলেপিলেগুলো বই এর বদলে ল্যাপটপ আর মোবাইল দেবে পুজোর জায়গায়।আশীর্বাদ দেবো কাকে কি হিসেবে ? খুব ঝামেলায় পরে গেছি বুঝলি। লক্ষী তো সেই থেকেইমনে মনে হেসে যাচ্ছে। যাক দিদির মতো বুদ্ধিমতী ও তাহলে প্যাঁচে পরেছে। মানুষগুলোর বুদ্ধি বলিহারী ,জ্ঞান - বিদ্যার দেবীকেই প্যাঁচে ফেলে দিয়েছে। সব শুনে দুর্গাও হেসে ফেললেন।
-------------
ছবি ঋণ- ইন্টারনেট