ছোটগল্প ।। অন্যরূপের সন্ধান ।। সেখ মেহেবুব রহমান
অন্যরূপের সন্ধান
সেখ মেহেবুব রহমান
আজ প্রায় এক বছর পর অগ্নিভ বিকনা গ্রামে মামার বাড়িতে এসেছে। বাঁকুড়া শহরের অদূরেই কয়েকজন গুণী ডোকরা শিল্পীদের গ্রাম বিকনা। ডোকরা এদেশের প্রাচীনতম হস্তশিল্প। ইতিহাসের সেই ধারা এই গ্রামের মানুষের আজও সাফল্যের সাথে বাহন করে নিয়ে চলেছে। এই শিল্পকর্মকে সামনে রেখেই নভেম্বরের প্রথমার্ধে মেলার আয়োজন হয়। সেই টানেই মামার বাড়ি ছুটে আসা।
ছোটোবেলা থেকে এখানেই অত্যন্ত আদর যত্নে বড়ো হয়েছে অগ্নিভ। চার বছর বয়সেই মা মারা যায়। বাবা ব্যবসায়িক কাজে সর্বদা ব্যাস্ত থাকতেন। ছেলেকে দেখাশোনার সময় তাঁর সেভাবে হত না। বাধ্য হয়েই মাতৃহারা অগ্নিভর ঠাই হল মামার বাড়িতে। এদিকে মামার বাড়ির মানুষজন মা মরা অসহায় ছেলের মায়া ত্যাগ করতে পারেনি। অচিরেই অগ্নিভ হয়ে ওঠে সকলের মধ্যমণি।
অগ্নিভ এখন খড়গপুর আই আই টি থেকে ম্যাটালারজিকাল সায়েন্স এ পোস্ট ডক করছে। দু বছর হল ওখানে আছে। গবেষণার চাপে নিয়মিত বাড়ি আসা হয়না। কিন্তু ছৌ নাচের টান মন থেকে কীভাবে মুছে ফেলবে? ছোটবেলায় বিকাল থেকে রাত অবধি ছৌ নৃত্য শিল্পীদের নাচের তালে মাতাল হয়ে অজান্তেই নিজেকে ওদেরই একজন করে তুলেছে তা টের পায়নি।
অগ্নিভর আসার খবরে মামারবাড়িতেও গতকাল থেকে হইহই রব। সকলের খুশীর অন্ত নেই। অগ্নিভ সকাল দশটার মধ্যেই এখানে চলে এসেছে। মাত্র দু'দিন থাকার সময় হবে। তাই কোনো দেরি করেনি। বড়দের সাথে হাসি ঠাট্টা, ছোটোদের সাথে হুল্লোড় আর জমজমাটি খাওয়া দাওয়ায় দুপুর অতিক্রান্ত।
মধ্যানোভোজেনের পর অগ্নিভ ঘরে এল। কিছুক্ষণ বিশ্রাম তারপর মেলার উদ্দ্যেশে রওনা। কিন্তু একা একা মেলায়! প্রিয় সঙ্গিনীরই তো পাত্তা নেই। ছোটবেলার বর বউ খেলার সাথী দেবস্মিতাই অগ্নিভর হবু সহধর্মিণী। দেবস্মিতা অগ্নিভর ছোটমামার বন্ধুর মেয়ে। এখন যাদবপুর থেকে ইতিহাসে এম ফিল করছে। অন্তর আত্মার টানে আজ সেও এখানে।
মামার বাড়িতে থাকতে আসা ছোট্ট অগ্নিভর দিকে দেবস্মিতাই প্রথম বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয়। একসাথে পড়াশোনা-খেলাধুলা, আনন্দ-হুল্লোড় এক অন্যকে পরস্পরের কাছে নিয়ে এসেছিল। এখন ওরা প্রাপ্তবয়স্ক, নিজেদের প্রতি দায়িত্ববোধও অনেকগুনে বেড়ে গেছে। ওদের ভালোবাসা আজ পরিণতির পথে।
বরাবরের মতই দেবস্মিতা অগ্নিভর একদিন আগেই গ্রামে চলে এসেছে। ফোনে অগ্নিভকে সেকথা জানিয়েও ছিল। তাহলে দুপুর গড়িয়ে বিকাল হতে চলল একবারও এল না কেন? এসে থেকে ওকে দেখতে না পেয়ে অগ্নিভর মন ব্যাকুল হলেও, বাড়ির লোকজনের সামনে সেকথা লজ্জায় জানাতে পারেনি। এখন বিছানায় শুয়ে বেশ কয়েকবার ফোনও করল। রিং হলেও কেউ রিসিভ করেনি। ও কি রাগ করেছে, কিন্তু কেন? বালিশে মুখ গুঁজে ভাবতে শুরু করে অগ্নিভ। একথা সেকথা ভাবতে গিয়ে হঠাৎ মনে এল কাল রাতে ফোনে ওর আজব আবদারের কথা। না না আবদার ঠিক নয়, দাবী। বেশ জোরালো দাবী।
প্রাপ্তবয়স্ক প্রেমিকা ভালবাসার সাথে প্রেমিকের উষ্ণ ছোঁয়ার প্রত্যাশী। ভরা যৌবনে প্রত্যেক প্রেমিকা তাঁর প্রেমিককে মূয়রীর মতো প্যাখম মেলে আহ্বান করে শারীরিক গন্ধ, উষ্ণতার স্বাদ পেতে। যৌবনের এই ডাকে দেবস্মিতা মত্ত হলেও অগ্নিভর বুকের মাঝে আগুন এখনও জ্বলেনি। লোকচক্ষুর অন্তরালে দেবস্মিতা অগ্নিভকে মত্ত হবার আহ্বান জানালেও, ওকে উন্মত্ত করতে পারেনি। দেবস্মিতাও চাই অগ্নিভর ঠোঁঠের ছোঁয়ায় নিজের মায়াবী চোখ, কোমল ওষ্ঠদ্বয় ভিজিয়ে নিজেকে রাঙিয়ে নিতে। কিন্তু প্রত্যেকবারই তীরে এসে তরী ডোবে। যার পুরো কৃতিত্বটাই অগ্নিভর। অগ্নিভ আর পাঁচজনের সামনে সিংহর গর্জন করলেও এই ব্যাপারে ভিজে বেড়ালের থেকেও ভীতু।
গতকাল রাতে দেবস্মিতা অগ্নিভকে বলে, এবার যদি ঠোঁঠের স্পর্শ দিতে না পারে তাহলে বিয়েই ক্যান্সিল। কিন্তু দেবস্মিতা কথাটা সিরিয়াসলি বলেছে! অগ্নিভ আন্দাজ করতে পারেনি। অতঃপরে স্থির করল সরাসরি ওদের বাড়ি গিয়ে দেখা করবে। জামা প্যান্ট পরে ফোন নিয়ে বেড়তে যাবে এমন সময় ছোট মামি এসে হাজির। হন্তদন্ত হয়ে অগ্নিভর বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যাওয়া দেখে বললেন, "কীরে, কোথাও বেরচ্ছিস নাকি?"
অভিমানিনীর সাথে দেখা করতে যাওয়ার কথা এড়িয়ে গিয়ে অগ্নিভ বলল, "হ্যাঁ মামি, এই একটু বেরোছিলাম। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ফিরে আসব"।
"সে না হয় ঠিক আছে, কিন্তু আর একটু পরে বেরোলে ভাল হত না। সবাই মিলে একসঙ্গে যেতাম বেশ"
"কিন্তু মামিমা এখন যদি না যায় তাহলে...."
"তাহলে কী?"
প্রসঙ্গ ঘোরাতে অগ্নিভ জোর গলায় বলল, "ও কিছু না, আমি চেঞ্জড করে নিচ্ছি এখন। সন্ধ্যেই তোমাদের সাথেই যাব"।
অগ্নিভ কিছু একটা গোপন করছে আন্দাজ করতে পেরে মামিমা বললেন, "বয়সটা আমার কম হয়নি। আর মাথার চুল গুলো দেখছিস পাক ধরেছে। কি হয়েছে সত্যি করে বল?"
অগ্নিভ মাথা নিছু করে লাজ্জুকভাবে বলল্, "আসলে কাকিমা আমি এসেছি জেনেও স্মিতা এখনও অবধি একবারও দেখা করতে এল না। তখন থেকে ফোন করছি, রিসিভও করছে না! তাই ওদের বাড়ি যাচ্ছিলাম"।
মামিমা মজা করে বললেন, "আচ্ছা এই ব্যাপার। ভাগ্নেবাবু এখন আশিকি হয়ে বেরছিলেন"।
অগ্নিভ আপশোষের সাথে বলল, "আসলে তা নয় কাকিমা। আমি এলাম কিন্তু ও একবার দেখা অবধি করতে এল না!"
মামিয়া বললেন, "ওতো এসেছিলরে অগ্নি"।
অগ্নিভ বিস্মিত হয়ে বলল, "এসেছিল! অথচ আমি আসার অপেক্ষা করল না"।
"বলল ওর নাকি কাজ আছে"
"কাজ?"
"হ্যাঁরে, তোর জন্য নিজের হাতে রান্না করেই চলে গেল। বলল পরে আসবে"
"এই মেয়ে যে কি'করে! ভাল লাগে না..."
মামিমা একটু সন্দেহের ভঙ্গিতে বললেন,"কেন'রে ওই ভাবে কেন বলছিস? আচ্ছা তোদের নিজেদের মধ্যে কিছু সমস্যা হয়নি তো?"
"ঘোরতর সমস্যা"
"মানে! কী সমস্যা?"
"কিস..."
"কী, কিস!"
অগ্নিভ একটূ অন্যমনস্ক ছিল। নিজের অজান্তেই মুখ ফসকে 'কিস' বলে মামিমার প্রতিক্রিয়ায় হুঁশ ফিরতে তৎক্ষণাৎ নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, "হিস… মানে হিসি, হিসি পেয়েছে। আমি জলদি আসছি"
কথা শেষের আগেই অগ্নিভ টইলেটে গিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করল।
যাহ বাবা, কি যে বলে। আসুক বেড়িয়ে দেখি পরিষ্কার করে কিছু বলে কিনা। ভাবতে ভাবতে মামিমা বিছানায় বসলেন। এদিকে পরিস্থিতি সাময়িক সামাল দিয়ে মিনিট দুই পর অগ্নিভ বেড়িয়ে এল।
অগ্নিভকে বেড়িয়ে আসতে দেখে উনি দ্রুত বললেন, "নিজেদের মধ্যে ঝগড়া ঝাটি বাধিয়েছিস নাকি? দ্যাখ না বললে কিছু সমাধান বেরবে?"
অগ্নিভ বিড়বিড় করে বলল, "কি করে বলি তোমায় মামি। এ যে অদ্ভুত সমস্যা"
"কীরে বিড়বিড় করছিস কেন?"
"না না কিছু না। আসলে কেন যে রেগে আছে বুঝতে পারছি না। ওর সাথে দেখা না করলে..."
"বুঝতে পারছি। অনেকদিন সামনা সামনি কথা-টতা বলিসনি তাই রেগে আছে। তুই কি এখনই যাবি?"
"হ্যাঁ, মানে মনটা বড্ড অস্থির লাগছে একবার বেরোলে ভালো হয়"
মামিমা বিছানা উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, "বেশ তাহলে আর জামাটামা খুলতে হবে না। আগে দেখা করে আই বুঝলি। আমি ওপরে গেলাম। সাবধানে যাবি..."
সময় বিলম্ব না করে কথা শেষে ছোটমামি বেড়িয়ে গেলেন। অগ্নিভ টেবিল থেকে ফোনটি নিয়ে, পকেটে ঢুকিয়ে বেড়িয়ে পড়ল।
সকাল থেকে আকাশের মুখভার। ভ্যাঁপসা গরম। বৃষ্টির কোনো লক্ষন নেই। বিকাল হয়ে এলেও আবহওয়ার কোনো পরিবর্তন হয়নি। আজকালকার দিনে নভেম্বরেও এই ধরণের ওয়েদার অপ্রত্যাশিত নয়। অগ্নিভ বাড়ি থেকে বেড়িয়ে হাঁটা শুরু করল। শরীর এগিয়ে চললেও মন দেবস্মিতাতেই স্থির হয়ে রয়েছে। আচ্ছা স্মিতার সঙ্গে দেখা হলে কি বলবে। যদি আবার চুম্বনের কথা বলে, কেলেঙ্কারির শেষ থাকবে না। অগ্নিভর হৃদস্পন্দন ক্রমেই বাড়তে লাগল।
রাঙামাটির পথ বেয়ে, রাস্তায় দু তিনটি বাঁক নিয়ে মিনিট দশেকের মধ্যে দেবস্মিতার বাড়ির সামনে পৌঁছে, গলার স্বর নামিয়ে ভয়ে ভয়ে ডাকল, "স্মিতা স্মিতা..."
দরজা খুলে দেবস্মিতার বাবা বেড়িয়ে এলেন। দরজায় অগ্নিভকে দেখে তিনি বললেন, "আরে অগ্নি তুমি। কেমন আছো? সকালে এসেছ?"
অগ্নিভ তৎক্ষণাৎ পা ছুঁয়ে প্রণাম নিয়ে বলল, "ভালো আছি কাকু। আপনি শরীর ঠিক আছে তো। প্রেসার র্নম্যাল?"
"হ্যাঁ বাবা এখন একদম সুস্থ বুঝলে। তা তুমি বাইরে দাঁড়িয়ে কেন ঘরে এসো"
"না না কাকু এখন না। স্মিতা ঘরে নেই?"
"ওতো মেলায় গেছে। মেলায় ট্যুরিস্টদের গাইড করে কেমন আনন্দ পায় তাতো তুমি জানো"
"নিশ্চয়..."
"তুমি ভিতরে এসে বসো। আমি ওকে ফোন করে ডাকছি"
"আপনি আবার ব্যাস্ত হতে যাচ্ছেন কেন। আমি মেলায় গিয়ে ওকে ঠিক খুঁজে নেব" অগ্নিভ দ্রুত প্রত্যুত্তর দিল।
দেবস্মিতার বাবা বললেন, "তুমি আসবে না বলছ"।
অগ্নিভ বলল, "কাকু রাগ করবেন না। আমি সন্ধ্যের সময় নিশ্চয় আসব"।
দেবস্মিতার বাবা উত্তের যে খুব একটা সন্তুষ্ট হলেন তা নয়। তাও সম্মতি জানিয়ে বললেন, "তাহলে তখনই এসো"
"অবশ্যয়, আসি কাকু"
কথা শেষে অগ্নিভ পুনরায় রাঙা মাটির পথ অনুসরণ করল। তবে এবারের গন্তব্য ডোকরা হস্তশিল্প মেলা প্রাঙ্গণ। পায়ে হেঁটে মিনিট কুড়ির কিছু বেশি সময় নিয়ে অগ্নিভ মেলায় হাজির হল।
সারিবদ্ধভাবে সাজানো স্টলগুলোয় প্রর্দশিত হচ্ছে ডোকরা শিল্পীদের নিখুঁত শিল্পকর্ম। তাদের দক্ষতা আর নৈপুন্যে জীবন্ত হয়ে উঠেছে দশভুজা থেকে বীণাপাণি, নৃত্যে মগ্ন নারী মূর্তি থেকে বাঙলার লোকশিল্পীদের অবায়ব। ফুটে উঠেছে গ্রামীন ভারতীয় রীতিনীতি। রয়েছে কচ্ছপ, হাতি, ঘোড়া প্যাঁচার মতো পশুপাখির মূর্তি। মেলার এক প্রান্তে চলছে ছৌ নৃত্য শিল্পীদের মহিষাসুরর্মদিনী, অন্য প্রান্তে সন্ধ্যেয় মঞ্চ মাতানোর জন্য বাউলশিল্পীরা প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
মেলায় হাজার ভিড়ের মাঝে দেবস্মিতাকে খুঁজে বাড় করতে অগ্নিভর মিনিট দশ সময় লাগল। দেবস্মিতাকে জনা দশ ট্যুরিস্ট ঘিরে রয়েছে। ওদের আড়াল থেকে মাঝে মাঝে দেখা যাচ্ছে দেবস্মিতা হাত নেড়ে কি যেন সব বোজাচ্ছে। অগ্নিভ ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে এসে বলল, "কিরে, এত ব্যস্ত ফোনটাও ধরতে নেই। তোকে হন্যে হয়ে খুঁজলাম এতক্ষণ।"
দেবস্মিতা অগ্নিভর দিকে না তাকিয়ে বলল, "কাজের সময় কথা বলি না, ফোন ধরি না"।
"যাহ বাবা। এমন রেগে বলছিস কেন?"
"আমি রেগে নেই"
"তাহলে কথা বলতে দোষ কোথায়"
"কথা বলতে পারি তবে…"
"তবে?"
"এক বছর ধরে যেটা চায়ছি যদি এক্ষুনি দিতে পারিস"
সবার সামনে দেবস্মিতা এমন কথা বলবে অগ্নিভ বুঝতে পারেনি। কথা শুনে চমকে উঠল। বিড়বিড় করে বলল, "না মানে, এখন কীভাবে…"
অগ্নিভর কথা শুনে দেবস্মিতা তারস্বরে হাসতে শুরু করল। অগ্নিভ হাত নেড়ে কিছু একটা বোঝাতে গিয়েও থেমে গেল। হয়ত বুঝেছে এরপর কিছু বলতে গেলে হাটে হাড়ি ভেঙে যাবে। ট্যুরিস্টরাও ওদের কথা শুনছে। যদিও মাথা মুণ্ডু কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না। বেঁটেখাটো সাইজের একজন ভদ্রলোক অগ্নিভকে উদ্দেশ্য করে বলল, "দাদা আপনি রাগ করবেন না। রিলেশনশিপে থাকলে মাঝে মাঝে এরকম হয়। তবে দিদি কিন্তু বেশ ভালো মানুষ"।
অগ্নিভ ভদ্রলোকটিকে থামিয়ে বলল, "দাদা আপনি সব জানেন না। আপনি মেলা দেখুন। আপনার দিদি খুব ভালো গাইড করতে পারে"।
ভদ্রলোক বললেন, "আহা রাগ করছেন। বলছি দিদি আপনার থেকে কি গিফট চেয়েছেন?"
ভদ্রলোক্টির কথা শুনে দেবস্মিতা পুনরায় হাসতে শুরু করল। অগ্নিভর দু'গাল লাল হয়ে উঠেছে। বাকি লোকজনও হাসতে শুরু করল। অগ্নিভ পরিস্থিতি সামাল দিতে বলল, "বেশ তুই ওনাদের মেলাটা পুরো ঘুরিয়ে দেখা তারপর না হয় কথা বলব"।
দেবস্মিতা হাসতে হাসতে অগ্নিভর কথায় সম্মতি জানাল। তারপর অন্য দোকানগুলো ঘুরে দেখার জন্য সামনের দিকে এগিয়ে চলল। এদিকে অগ্নিভ এক জায়গায় স্থির হয়ে ভাবতে লাগল, হবু স্ত্রীর সামনে এইসব ব্যপারে কথা বলতে আজও একইরকম নার্ভাস! স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সেই ভদ্রলোক বললেন, "কি দাদা চলুন সবাই তো এগিয়ে গেল"।
অগ্নিভ বলল, "না না আপনারা যান"।
ভদ্রলোক বললেন, "আরে ধুর মশায় গার্লফ্রেন্ডতো এইরকম কথা বলবেই। ভয় পেয়ে থেমে গেলে চলবে না। আমাদের সামনে দিদিকে যে ভাবে হোক ইম্প্রেসড করুন"।
"বলছেন"
"আলবাত"
"কিন্তু যদি আবার এইভাবে"
"চেষ্টা করে দেখুন না"
"ওকে, বলছেন যখন ট্রাই করেই দেখি" কথা বলে অগ্নিভও সামনের দিকে পা বাড়াল।
বেশ কিছু স্টল এগিয়ে যাবার পর এক ভদ্রমহিলা সামনের স্টল থেকে দূর্গার্মূতি তুলে নিয়ে বললেন দেবস্মিতাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, "কি অসাধারণ কারুকার্য! কতটা ধৈর্য পরিশ্রম দিলে এমন জিনিস সৃষ্ট সম্ভব"।
দেবস্মিতা সম্মতি জানিয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই অগ্নিভ বলে বসল, "হ্যাঁ নিশ্চয়। এখানকার মানুষজন অত্যন্ত পরিশ্রমী। আপনি স্বচক্ষে ওনাদের মূর্তি তৈরি করতে দেখলে অবাক হয়ে যাবেন। এগুলো সবই পিতলের তৈরি। অনেক আগে অবশ্য ব্রোঞ্জ ব্যবহার হতো"।
অগ্নিভর উত্তরে সকলে সম্মতি জানাল। দেবস্মিতা যদিও অগ্নিভকে রাগিয়ে দেবার জন্য বলল, "তুই এর বেশি কিছু জানিস। ম্যাটালরজিক্যাল সায়েন্স নিয়ে পরছিস বলে শুধু পিতল পিতল"
দেবস্মিতাকে ইন্সপাইরাড করতে অগ্নিভ কথাটা বলল বটে কিন্তু পরে ওরই কথা শুনে আবার তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল। অতএব শুরুতেই প্রেচেষ্টা বিফল। রেগে গিয়ে বলল, "তুই আর কি জানতে চাইছিস বল। দেখি আমি অ্যান্সার দিতে পারি কিনা"।
সহাস্যে দেবস্মিতা প্রত্যুত্তর বলল, "দ্যাখ তুই নিজেই কেমন রেগে যাচ্ছিস। আর একটু আগে আমাই বলছিল"।
"না না তুই প্রশ্ন কর"
"ঠিক তো, তখন উত্তর দিতে না পারলে কিন্তু"
"জানি জানি, যা চাইবি তাই দেব। হয়েছে?"
"ভেবে বলছিস?"
"একদম"
ওদের মিষ্টি ভালোবাসার উত্তপ্ত বাক্যালাপে ট্যুরিস্টগুলো বেশ মজাই পাচ্ছিল। একজন দেবস্মিতাকে উদ্দ্যেশ করে বললেন, "আপনার বন্ধু কিন্তু বেশ মজাদার। ভালোবাসে আবার ঝগড়াও করে। দেখে স্মার্ট মনে হলেও আপনার প্রতি ওর একটু ভয় ভয় ভাব আছে"।
দেবস্মিতা মিষ্টি হেসে বলল, "ভয় ভয় নয়। বেশ ভয় পায়" এক্তু থেমে বলল, "আচ্ছা অগ্নি বলত ডোকরা শিল্প আজ থেকে কত বছর আগে কোথায় প্রথম শুরু হয়েছিল?"
অগ্নিভ এরকম প্রশ্ন শুনে প্রথমে ভ্যবাচাকে খেয়ে গেল। পরে অবশ্য আকাশ পাতাল এক করে ভাবল কিন্তু কোনো উত্তর বেড় করতে পারল না। অবশেষে মাথা নেড়ে হার শিকার করল। দেবস্মিতা হাতে একটি নারী মূর্তি তুলে নিয়ে মুচকি হেসে বলল, "আজ থেকে প্রায় চার হাজার ক্রীষ্টপূর্বাদ আগে মহেঞ্জদারো সভ্যতায় প্রথম শুরু হয়েছিল আমাদের এই ডোকরা শিল্প। তখন অবশ্য পিতলের ব্যবহার শুরু হয়নি। প্রথমে তামা আর পরের দিকে ব্রোঞ্জ দিয়ে শিল্পীরা মূর্তি তৈরি করতেন"।
দেবস্মিতা কথা শেষ হওয়ার আগেই অগ্নিভ থামিয়ে বলল, "তুই হিস্ট্রির স্ট্যাডুন্ট, তুই জানবি নাতো আমি জানব!"
যদিও উপস্থিত লোকজনের মধ্যে কেউই অগ্নিভর কথায় কর্ণপাত না করে দেবস্মিতার মুখের দিকে চেয়ে রইল। অগ্নিভর এই হাবভাব সবটাই ওর জানা। দেবস্মিতা মিষ্টি হেসে বলল, "আচ্ছা বলুন তো প্রথম আবিষ্কৃত ডোকরা শিল্পের নিদর্শন কী?"
এহেন প্রশ্নে সকলে এক ওপরের দিকে মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে লাগল। দু এক জন উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করলেও কনফিডেন্সের অভাবে উত্তর মুখ দিয়ে বেড় করার আগেই গলাধাকরণ করল। অতপরে একজন অতি উৎসাহী মন নিয়ে বলল, "দিদি আমাদের দ্বারা পসিবেল নয় আপনিই বলুন"।
দেবস্মিতা নিজের হাতা থাকা নারী মূর্তিটি ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতে করতে বলল, "উত্তরটা মুখে না পড়লেও চোখে কিন্তু আমরা সবাই দেখেছি। ছোটবেলায় মহেঞ্জদারো সভ্যতার ইতিহাস পড়ার সময় লেখার একপাশে নৃত্যেমগ্ন নারী মূর্তির ছবি আমরা সবাই দেখেছি। ওটাই ডোকরা শিল্পের প্রথম নিদর্শন। গবেষকদের মতে, মূর্তিটি আজ থেকে প্রায় সারে চার হাজার বছর আগের"।
দেবস্মিতার মুখ থেকে এক অজানা ইতিহাস মন্ত্র মুগ্ধের মতো শুনে সবার চোখে মুখে তৃপ্তির ছাপ স্পষ্ট। বেঁটেখাটো চেহারা ভদ্রলোকটি এতক্ষণ মন দিয়ে শুনে, আগ্রহবশত জিঙজাসা করলেন, "আচ্ছা মূর্তিটি কি তামার তৈরি?"
দেবস্মিতা বলল, "না না ততদিনে মানুষ ব্রোঞ্জের ব্যবহার শিখে গিয়েছিল। মূর্তিটিও ব্রোঞ্জের"
ভদ্রোলোক বললেন, "আচ্ছা দিদি, বিকনা ছাড়া ভারতের আর কোথাও ডোকরা শিল্পের অস্তিত্ব নেই?"
দেবস্মিতা উৎফুল্ল হয়ে বলল, "কেন পাওয়া যাবে না। ঝাড়খণ্ড, ছত্রিশগড়, মধ্যপ্রদেশেড় বহু মানুষ এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। আমাদের বর্ধমান, পুরুলিয়াতেও ডোকরা শিল্পীদের খোঁজ পাওয়া যায়। তবে তাঁরা সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন"।
নারী মূর্তিটি রেখে দিয়ে পরের স্টলের দিকে যেতে যেতে দেবস্মিতা পুনরায় বলে চলল, "তবে শুধু আমাদের দেশে নয়, এই শিল্পের প্রচলন প্রাচীন ইজিপ্ট, মেসোপটেমিয়া ও গ্রীক সভ্যতায় পাওয়া যায়"।
বেঁটে ভদ্রলোকটি দেবস্মিতার দিকে তাকিয়ে হাসি হাসি মুখ করে বললেন, "আপনিতো অসাধারন ইতিহাস জানেন জাস্ট অ্যামাজিং। রিসার্চ টিসার্চ করছেন নাকি?"
দেবস্মিতা হেসে বলল, "হ্যাঁ এম ফিল করছি যাদবপুর থেকে"।
বেচারা অগ্নিভ এতক্ষণ চুপচাপই ছিল। দেবস্মিতার উত্তরের পরিপ্রেক্ষিতে 'আমি খড়গপুর। ম্যাটালরজিক্যাল সায়েন্সে পোস্টডক করছি' বলতেই দেবস্মিতা মজা করে বলল, "না তুই আলিপুর"
"আলিপুর!"
"হ্যাঁ আলিপুর। চিড়িয়াখানার গরধব তুই। দু'বছর ধরে একটা জিনিস চায়ছি দিতে পারিস নি এখনও!"
"স্মিতা, তুই আমায় সত্যি সত্যি রাগিয়ে দিচ্ছিস। ভালো হবে না বলে দিলাম"
'ঝগড়া' শব্দটি একটু অন্যরকম। বিভেদমূলক, যার ধ্বংসাত্মক রূপ বড়োই ক্ষতিকর। তবে কাছের মানুষের সাথে অহেতুক ঝগড়ার তৃপ্তিই আলাদা। এমন ঝগড়ার মানে নেই, আবার গভীর মানে আছে। ভালোবাসার মানে। অগ্নিভর চোখ মুখ রক্তবর্ণ হয়ে উঠতে দেখে দেবস্মিতা হাসতে হাসতে বলল, "তোকে হেভি লাগছে এখন!"
অগ্নিভ এতক্ষণ দেবস্মিতার সাথেই হাঁটছিল। কিন্তু প্রেমিকার বারংবার মিষ্টি বজ্রাঘাতে বিদ্ধস্ত হয়ে থমকে দাঁড়িয়ে অভিমানের সুরে বলল, "খুব মজা পাচ্ছিস তাই না। তোর সাথে কথা বলতে আসাই ভুল হয়েছে। আমি আর যাচ্ছি না। তুই এনাদের নিয়ে থাক, আমি চললাম। পাজি মেয়ে..."
কথা আর কাজের মধ্যে অগ্নিভ কয়েক সেকেন্ডও সময় নিল না। তৎক্ষণাৎ উলটো পথে হাটা দিল। ট্যুরিস্টগুলো এতক্ষন দুই শালিকের খুনসুটি জমিয়ে উপভোগ করছিল। তবে অগ্নিভর উল্টো পথে হাটা দেখে বেঁটেখাটো ভদ্রলোক বললেন, "অগ্নিদা খুব সাধাসিধে মানুষ বলুন। আপনি যে এতক্ষণ ইয়ার্কি করছিলেন, বুঝতেই পারলেন না!"
দেবস্মিতা বলল, "ও ছোট থেকেই এরকম। সাধাসিধে, নরম মনের। আসলে ওকে এইভাবে রাগিয়ে দিয়ে অভিমান ভাঙতে আমি এক অন্যরকম তৃপ্তি অনুভব করি"।
"আপনার মাথায় ভালোরকম দুষ্টুমি আছে দেখছি"
"তা অবশ্য আছে। তবে সেটা অগ্নির ক্ষেত্রেই এপ্ল্যাই করি"
দেবস্মিতার কথায় সকলে হাসতে শুরু করে দিলেন। ধীরে ধীরে অদৃশ হয়ে যাওয়া অগ্নির দিকে তাকিয়ে ভদ্রলোক বললেন, "অগ্নিদা আপনাকে ভীষণই ভালোবাসে। আপনি এতক্ষণ এত কথা বললেন, তারপরও অবাক চোখে আপনার দিকেই তাকিয়ে ছিলেন। এবার কিন্তু ওনার মনোভঞ্জনের সময়"
দেবস্মিতা মিষ্টি হেসে বলল, "রাগ যখন আমার ওপর, আমাকেই কিছু একটা করতে হবে"।
একজন ভদ্রমহিলা দেবস্মিতার পাশে এসে মাথায় হাত রেখে বললেন, "তুমি এবার যাও। বেচারার সাথে এবার অবশ্য ভালোভাবে কথা বল। আমরা নিজেরাই মেলার বাকিটা দেখে নেব। তুমি যাও"।
সকলেই ওনার কথায় সম্মতি জানাল। দেবস্মিতাও অনতিবিলম্বে প্রেমিকের অভিমান ঘোচাতে অগ্নিভর পথ অনুসরণ করল।
ভিড় অতিক্রম করে অগ্নিভর দিকে যেতে যেতে দেবস্মিতা ডাক দিল, "এই অগ্নি দাঁড়া। দাঁড়া বলছি। আমি আসছি তো"।
অগ্নিভ যদিও ওর ডাকে কর্ণপাত না করে এগিয়ে চলল। বার কয়েক আওয়াজ দেওয়ার পরেও অগ্নিভ না থামায় শেষ অবধি দৌড়ে গিয়ে ওর সাথ ধরল। অগ্নিভ অবিচল রইল। কোনোরূপ বাক্য বিনিময় ছাড়াই দু'এক পা হাটার পর দেবস্মিতা অগ্নিভর দিকে তাকিয়ে বলল, "কিরে কথা বলবি না? ভীষণ রেগে গেছিস বল?"
প্রেমিকার নরম সুরের করুন আকুতি অগ্নিভর রাগ প্রশমিত করতে পারল না। নিরুত্তর থেকে আগের মতই এগিয়ে চলল। ভিড়ের মাঝে দেবস্মিতা কখনো পিছিয়ে পরছে আবার ছুটে এসে সাথ ধরছে। অগ্নিভ একবারের জন্য ওর দিকে ভালোভাবে চাইল না। নিরুপায় হয়ে দেবস্মিতা পিছন থেকে অগ্নিভর ডান হাত টেনে ধরে পদগতি রুদ্ধ করল। অগ্নিভ তৎক্ষণাৎ বলল, "হাত ছাড় বলে দিলাম। আমায় যেতে "।
দেবস্মিতা অগ্নিভর চোখেচোখ রেখে মিষ্টি হেসে বলল, "সরি অগ্নি। প্লিজ এবারের মতো ক্ষমা করে দে। প্লিজ"
দেবস্মিতার এহেন আকুতি অগ্নিভকে রুদ্ধ করার জন্য যথেষ্ট। বাস্তবেও ব্যাতিক্রম হল না। হৃদয় যে প্রেমিকার দিকে ছুটে যেতে চায়। কিন্তু রাগ সম্পূর্ণ প্রশমিত হয়নি। থমকে দারিয়ে ভারী গলায় বলল, "আবার রাগাতে এসেছিস!"
দেবস্মিতা মাথা নেরে বলল, "না'রে অগ্নি। প্লিজ রেগে থাকিস না"
"তাহলে ক্ষমা চাইতে?"
"হ্যাঁ, প্লিজ অগ্নি ক্ষমা করে দে। আর ওমন বলব না। প্রমিশ…"
"বেশ ক্ষমা করতে পারি কিন্তু একটি শর্তে"
"কী"
অগ্নিভ একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে, মাথা নামিয়ে আস্তে আস্তে বলল, "এখন থেকে সন্ধ্যে অবধি আমার সাথে মাঠে বসে গল্প করতে হবে। আমি তোর সাথে একান্তে সময় কাটাতে চাই"।
দেবস্মিতা হাঁফ ছেড়ে বলল, "যাক বাবা বাঁচালি আমাই। মাথা নামিয়ে ফিস ফিস করে এমন বলতে শুরু করলি! কি না কি ভাবলাম"।
অগ্নিভ নিরীহভাবে প্রত্যুত্তরে বলল, "মানে! কি ভাবছিলি?"
দেবস্মিতা হাসতে হাসতে বলল, "চল চল, তোকে কিছু বুঝতে হবে না"।
অগ্নিভর ডান হাত শক্তভাবে ধরে দেবস্মিতা মেলা থেকে প্রস্থানের পথ অনুসরণ করল। মেলার শেষে কয়েকজন ডোকরা শিল্পীর বাড়ি। তারপর পায়ে হাটা সরু পথ মাঠের অভিমুখে। দুপাশে গগনচুম্বী গাছপালা, ছোটোখাটো কয়েকটা ডোবা আর সেগুলিকে ঘিরে ঘন বাঁশঝাড়। মাঠের ওপার হইতে কোমল বাতাস ভেসে এসে গাছের পাতা ধীরে ধীরে আন্দোলিত করে দিচ্ছে। আরো কিছুটা পথ এগিয়ে সবুজ ধান ক্ষেতের দিকে তাকিয়ে দেবস্মিতা বলল, "কি দারুন লাগছে বলল। সবুজ ধানখেত, প্রাণ জোড়ানো হাওয়া"
দিগন্তের দিকে তাকিয়ে নিরলস উত্তর দিল, "এখানে এসে সারা দিনের গুমোটটা একটু কাটল। একটু স্বস্তি পেলাম। আকাশের মুখটা দ্যাখ!"
অগ্নিভর মুখের দিকে তাকিয়ে আপসোসের সাথে বলল, "তোকে নিয়ে আর পারা যায়া না। কোথায় আমি একটু রোম্যান্টিক কথা বলছি। আর তুই!"
"মানে? এতে রোম্যান্টিক হবার কি আছে!"
"তুই খুজে পাবি না। চল সামনের ওই ফাঁকা জায়গাটায় গিয়ে বসি"
সামনে কয়েকফুট দূরেই সবুজ ঘাসে মোড়া সমতল জায়গার ওপর বসল। দেবস্মিতা কাঁধের ব্যাগটি পাশে রেখে অগ্নিভর দিকে বেশ কিছুক্ষন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে মুচকি হাসতে লাগল। অগ্নিভ প্রথমে অন্যমনষ্ক ছিল। হঠাৎ দেবস্মিতার এরূপ আচরণে বিস্মিত হয়ে বলল, "এভাবে তাকিয়ে দেখার কি আছে? হাসিরই বা কি হল?"
দেবস্মিতা এবার সশব্দে হেসে বলল, "তোকে দেখে হাসি পাচ্ছে। দারুণ লাগছে কিন্তু"।
অগ্নিভ বলল, "তা এতে হাসির কি হল। আমায় প্রথম দেখছিস?"
দেবস্মিতা মুখের হাসি আর একটু চওড়া করে বলল, "তা নয়। তবে এই রোগা প্যটকা শরীরে মাথায় লম্বা লম্বা চুল রেখে একদম ইউনিক লাগছে! আর রাগে মুখটা ফুলিয়ে আকাশের মতো গম্ভীর করে রেখেছিস"।
অগ্নিভ মুখ যথা সম্ভব ফুলিয়ে বলল, "আবার শুরু করলি। এইজন্য ভাল লাগে না"
দেবস্মিতা বলল, "ওকে ওকে আর নয়। কিন্তু এখনও যদি মুখভার করে থাকিস আমার ভাল লাগবে বল। এবার একটু হাস না"।
অগ্নিভ চোখে মুখে বিরক্তি নিয়ে বলল, "আসলে এই ওয়েদারটা খুব অস্বস্তিদায়ক। তারপর তুই লাস্ট ওয়ান অ্যাওয়ার ধরে রাগিয়ে"।
দেবস্মিতা অগ্নিভর হাতের আঙুলগুলো অলত স্পর্শ করে চোখে চোখ রেখে বলল, "মনটা বিষিয়ে দিয়েছি তাইতো। আসলে তোকে এইভাবে রেগে মুখভার করে দেখতে মনের মধ্যে কেমন একটা তৃপ্তি আসে। এই ছোট ছোট ভালোবাসার ইঙ্গিত গুলো বুঝিস না। হাদা একটা!"
অগ্নিভ হাসল। দেবস্মিতা দূরে লম্বা কয়েকটা বাবলা, শিরীষ, তাল গাছের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলল, "অগ্নি তোর মনে পরছে গাছগুলির আড়ালে কেমন লুকোচুরি খেলতাম। তুই সব সময় চোর হতিস। আর আমরা সবাই মিলে বুদ্ধি করে তোকেই চোর করতাম। রেগে জেতিস, মুখে কিছু বলতিস না। আচ্ছা বর্ষার সময় ডোবাগুলো ভরে গেলে জলে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতার কাটাতাম সেকথা মনে আছে?"
ছোটবেলার স্মৃতি অগ্নিভকে সর্বদাই আবেগ বিহ্বল করে তোলে। দেবস্মিতার তা অজানা ছিল না। প্রেমিকের মন ভাল করতে তাই শৈশবেই পারি দিল। অগ্নিভ দূরে গাছগুলোর দিকে একবার তাকিয়ে মাথা ঘুরিয়ে নিয়ে বলল, "ডোবায় চান করার জন্য মামার কাছে কেমন বকুনি খেয়েছিলাম। তুইতো কেঁদে ছাড় পেয়ে যেতিস। আমাই তো কানমলা থেকে গালে চর সব কিছুই খেতে হত"।
দুজনে তারস্বরে হেসে উঠল। দেবস্মিতা অগ্নিভর ডান গাল আসতে করে টিপে দিয়ে বলল, "তখন তুমি যা মোটা ছিলে! সব মার তোর সয়ে যেত"
অগ্নিভ বলল, "তা সইবে না। গন্ডারের চামড়া আমার"।
বিষণ্ণ মনে দাড়িয়ে থাকা গাছগুলোর দিকে দেবস্মিতা বলল, "দেখতে দেখতে কত বড়ো হয়ে গেলাম বলল। কিন্তু কি মনে হয় জানিস, শৈশবটা ঐ গাছগুলোর আড়ালে এখনও লুকিয়ে আছে"।
"আর ফিরে পাওয়া যাবে না বল"
"না'রে, এই বয়সে কি লুকোচুরি মানায়"
"হুমু"
প্রাণবন্ত হাসি ওদের অজান্তেই হারিয়ে গেল। কান খারা করে নিজেদের ফেলে আসা শৈশবের চিৎকার শুনতে লাগল।
মিনিট খানেকের নিস্তব্ধতা পর হঠাৎই দেবস্মিতার কপালে একফোঁটা বৃষ্টির জল এসে পড়তে, মুহূর্তেই সারা শরীরে শিহরণ জাগিয়ে দিল। আকাশ পানে তাকাতেই শত শত জলকণা এই দুই বাল্যবন্ধুর দিকে গোলাপের ন্যায় নেমে আসতে লাগল। বৃষ্টির স্পর্শে শৈশবের চিৎকার আরও বেশি কানে বাজতে লাগল। এদিকে সারাদিন মন ভারাক্রান্ত থাকার পর প্রকৃতিও নিজেকে প্রাণবন্ত করে তুলতে চাইছে। ক্ষনিকের মধ্যে বৃষ্টির বেগ বেরে গেল। বিষণ্ণ মনা গাছপালাগুলো প্রাণ ফিরে পেয়ে মনের আনন্দে দুলতে লাগল। দুজনে তৎক্ষণাৎ উঠে দাড়িয়ে পড়ল। এখন দৌরে গিয়েও কোনো নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছানো সম্ভব নয়। বাধ্য হয়ে বাল্যবেলার বন্ধুদের নিচে গিয়েই দাঁড়াল। বৃষ্টির সময় গাছের নিচে আশ্রয় বিপদসঙ্কুল হলেও, এখন উপায় তো নেই।
অগ্নিভ হাত দিয়ে মাথা যথা সম্ভব ঢেকে রেখে বলল, "ছোটবেলায় এরকম কত ভিজেছি বল। আজ আবার একই রকম ফিলিংস হচ্ছে"।
দেবস্মিতা বলল, "ঠিক বলেছিস অগ্নি। তখন বৃষ্টি মানেই ভেজার জন্য হইহই করে কেমন বেরিয়ে পরতাম। আমার কি মনে হচ্ছে বলত, এই গাছের তলায় না দাড়িয়ে খোলা আকাশের নিচে গিয়ে নিজেকে ভিজিয়ে নিতে"।
অগ্নিভ আপত্তির সুরে বলল, "অনেকদিন বৃষ্টিতে ভেজা নেই। এখন ভিজলে যদি সর্দি হয়"।
দেবস্মিতা নিজের ব্যাগটা অগ্নিভকে দিয়ে বলল, "তোকে ভিজতে হবে না। ভীতু কোথাকের। ব্যাগটা মাথায় দিয়ে দাড়া। আমি যাচ্ছি"। তারপর অগ্নিভর উত্তরের অপেক্ষা না করেই ছুটে চলে গেল। অগ্নিভ ব্যাগ মাথায় দিয়ে কোনোরকমে দাড়িয়ে রইল।
সন্ধ্যে নেমে এসেছে। আকাশের কালো মেঘ, চারিদিক আরও অন্ধকার করে তুলেছে। সন্ধ্যের শেষ অনুজ্জ্বল আলোক রশ্মির পথ অনুসরণ করে অগ্নিভ দেখল কিভাবে এক একটা জলকণা মহাশূন্য থেকে দ্রুত গতিতে ধেয়ে এসে দেবস্মিতার গাল স্পর্শ করছে। তারপর ওর প্রেমিকার কোমল ঠোঁঠ আলত করে ছুঁয়ে প্রবাহমান নদীর ন্যায় কন্ঠ বেয়ে বক্ষের উপরিংশে এসে পৌছছে। কিন্তু মনের তৃপ্তি যেন তখনও মিটছে না। র্নিলজ্জের মতো দেবস্মিতার কালো ব্লাউজের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে বিভাজিকার মধ্যে নিজেকে লুকিয়ে নিচ্ছে। এক ফোঁটা কণার এইরূপ দুঃসাহস অগ্নিভর সরল মনকে লোভী করে তুলল। সহজেই জলকণা ওর প্রতিদবন্ধী হয়ে উঠল। মন চাইল সেই একই পথ অনুসরণ করতে।
দেবস্মিতা দু'হাত প্রসারিত করে এলোমেলো ভাবে নেচে চলেছে। তীব্র বেগে ওর কোমর কম্পিত হচ্ছে। নাচতে নাচতে জমা জল ছিটিয়ে দিচ্ছে অগ্নিভর দিকে। পড়নের লাল শারী ভিজে শরীরের সঙ্গে আঠার মতো এঁটে গেছে। স্তনদ্বয়ের কিয়দাংশ কখনো কখনো ব্লাউজের ফাক দিয়ে উঁকি মারছে। নাচতে নাচতে যখন ও পিছন ফিরছে স্কন্ধ হইতে কোমর অবধি অর্ধন্মুক্ত ভেজা পিঠের খাঁজগুলি অগ্নিভর মনকে আরও বিষিয়ে দিচ্ছে।
প্রেমিকাকে আগেও দেখেছে। অনেক অনেক কাছ থেকে। কিন্তু এইরূপ সৌন্দর্যতার সন্ধান আগে কখনো পায়নি। এমন রুপ চারিদিকের অন্ধকার ঘুচিয়ে দিয়েছে। ওর লোভী চোখ আজ যেন সব লাজ লজ্জার সীমা অতিক্রম করে যাচ্ছে। বারিয়ে দিচ্ছে মনের উষ্ণতা।
অগ্নিভ নিজেকে স্থির রাখতে পারল না। হৃদয়ের উষ্ণ প্রবাহ প্রেমিকার দেহে ছড়িয়ে দিতে দেবস্মিতার দিকে দৌরে গেল। নৃত্যে মগ্ন দেবস্মিতার কোমর শক্ত করে ধরে, কোমল ঠোঠে সজোরে কামড় বসালো। মুহূর্তে দেবস্মিতার শরীরে বিদ্যুৎ এর প্রবাহ ঘটে গেল। দু'চোখ গোল গোল করে পাকিয়ে অগ্নিভর দিকে তাকাল। নীরস অগ্নিভর শরীরে আজ ভালোবাসার উষ্ণতা! চোখেমুখে চিরাচরিত লাজ লজ্জা নেই। আছে পরম স্পর্শ অনুভূতি। দেবস্মিতা নিজেও এই ছোঁয়ার প্রত্যাশী ছিল। অথচ এই রোম্যান্টিক মুহূর্তে ওর শরীর দুর্বল হয়ে আসছে। হৃদয়ের কম্পন লাগামহীনভাবে বেড়ে চলেছে। দু'চোখ যেন গভীর তন্দ্রায় গ্রাস করেছে। মনের উথাল পাতাল কোনোভাবে থামানো যাচ্ছে না। ধীরে ধীরে চোখের পাতা নামিয়ে নিল।
কয়েক মিনিটের উষ্ণতার আদান প্রদানের পর দেবস্মিতা অগ্নিভর থেকে নিজেকে ছিনিয়ে নিয়ে গাছের তলায় গিয়ে দাঁড়াল। চোখ মুখ লজ্জায় লালিম হয়ে উঠেছে। অগ্নিভ এতক্ষন প্রেমিকার ছোঁয়ায় বিভোর হয়েছিল। দেবস্মিতার এহেন প্রস্থানে হুঁশ ফিরল। ডান হাত সামনে বাড়িয়ে কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল। পরম তৃপ্তি নিয়ে খোলা আকাশের নিচে দাড়িয়ে রইল। বৃষ্টি এখনও থামেনি। জমা জলের ওপর ফোঁটা ফোঁটা করে অবিরাম জল পরছে। দেবস্মিতা এক দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে। আর অগ্নিভ নিজেকে আরও একটু ভিজিয়ে নিচ্ছে।
আধঘণ্টা পর বৃষ্টি থামল। অন্ধকার গভীর হয়ে উঠেছে। চারপাশের নিস্তব্ধতা কাটিয়ে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে। অগ্নিভ দেবস্মিতার দিকে তাকিয়ে বলল, "কি'রে চল। এখনও দাড়িয়ে থাকবি"।
দেবস্মিতা নিশ্চুপ রইল। অগ্নিভ কাছে গিয়ে গায়ে হাত দিয়ে পুনরায় বলল, "স্মিতা কি ভাবছিস এত? চল, আর দাঁড়ানো ঠিক হবে না"।
দেবস্মিতা কোনো বাক্য ব্যায় না করে অন্ধকারে কি একটা খুঁজতে লাগল। অগ্নিভ প্রশ্ন করতে শুধু বলল 'ব্যাগটা'। অগ্নিভও সময় নষ্ট না করে খোঁজা শুরু করল। মিনিট তিনেকের সফল চেষ্টায় সেটি উদ্ধার হল। অগ্নিভ ব্যাগটি দেবস্মিতা দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, "জলদি পা চালা স্মিতা। বাড়ীতে সবাই মনে হয় চিন্তা করছে"।
দেবস্মিতা 'হুমু' বলে হাঁটতে শুরু করল। দেবস্মিতার এহেন সংক্ষিপ্ত উত্তরে অগ্নিভ নিচু স্বরে বলল, "কি'রে এইভাবে কেন কথা বলছিস। আমি কি কিছু ভুল করেছি?"
"না। তা নয়"
"তাহলে! তুই খুশি হসনি বল"
"ধুর না'রে বাবা। কিছুই কি বুঝিস না"
হাঁটতে হাঁটতে অগ্নিভ দেবস্মিতার হাতের আঙুল আলত স্পর্শ করে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, "লজ্জা পেয়ে গেছিস তাই না"।
দেবস্মিতা মাথা নেড়ে বলল, "একটু"
অগ্নিভ মজা করে বলল, "না একটু নয়। অন্ধকারে তোর মুখ ভালোভাবে বোঝা না গেলেও আমি আন্দাজ করতে পারছি। এত দিন চায় চায় করে পাগল হয়ে যাচ্ছিলি। আর এখন!"
দেবস্মিতা ভিজে ব্যাগটি নিয়ে অগ্নিভর হাতে আসতে আঘাত করে বলল, "মোটেই নয়। তোকে কিসের লজ্জা পাবো। তুই আমার কাছে এখনও ভিজে বেড়াল!"
"আচ্ছা। তাহলে এখনই একটা দে দেখি"
"না, পারব না"
"কেন শুনি? লজ্জা তাইতো"
"না, মুড নেই"
"আচ্ছা মুড নেই"
দেবস্মিতা ব্যাগটি অগ্নিভর দিকে তাক করে বলল, "আবার মার খাবি বলে দিলাম। পাজি একটা। যা তোর সাথে আড়ি"
দেবস্মিতার কথা শুনে অগ্নিভ তারস্বরে হাসতে শুরু করল। যদিও অন্ধকারে দেবস্মিতার চোখ মুখের অবস্থা খুব একটা ভালো বোঝা গেল না। হয়তো প্রেমিকের ছোঁয়ায় রক্তিম হয়ে উঠেছে ওর সমগ্র শরীর। হয়তো ও এখনও অনুভব করছে, কম্পিত কোমরে প্রেমিকের হাতের ছোঁয়া। হয়তো বা এখনও উপলব্ধি করতে পারছে প্রেমিকের উত্তপ্ত নিঃশ্বাস।
------------------------
ছবি ঋণ- ইন্টারনেট