হাসির ছোটগল্প।।
- দিন পনের হল অজয়বাবু সকাল ছটায় মর্নিংওয়াকে বেরিয়ে নটা সাড়ে নয়টায় বাড়ি ফিরছেন। এই নিয়ে প্রায় রোজই সহধর্মিণী সরলা দেবীর সঙ্গে ছোটখাটো বাকযুদ্ধ চলছেই।
--- এই সময় এতক্ষণ ধরে হাঁটাহাঁটির কি দরকার আমি ভেবেই পাই না।একটা অঘটন তুমি ঘটিয়েই ছাড়বে দেখছি। বাবুকে দেখ,একটা উঠতি বয়সের জোয়ান ছেলে কেমন ঘরে বসে দিন কাটাচ্ছে। আর তোমার,ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা। আমার কথা তুমি কানেই তুলবে না। শোনো, শেষ বারের মত বলছি, কাল যদি সাতটার মধ্যে ঘরে না ঢোক আমি অনশন শুরু করব। একটানা বলার পর,সরলা দেবী কমা টানতেই অজয়বাবু মুখ খুললেন।
--- আসল কথা লকডাউনের এই সুবর্ণ সুযোগটা কাজে লাগাচ্ছি। আবার তো অফিস কাছারি শুরু হবে। তখন এত সময় পাব কোথায়? বাজারহাট, দাঁড়ি কাটা, তোমার হুকুম তামিল করার পর নাকে মুখে গুঁজে ছোটা। তাই এই কটা দিন সাধ মিটিয়ে মর্নিংওয়াকে মন দিয়েছি। তাছাড়া এখন যতটুকু পারো ছেলেকে আঁচলে বেঁধে রাখ। লকডাউনও উঠবে আর পাখি ফুড়ুৎ। তখন খাঁচায় শুধু আমাকেই পাবে।
--- তুমি কোন্ স্কুলে পড়তে গো? এত চমৎকার ভাষাজ্ঞান। সরলা দেবী ছোট্ট করে পেরেক ঠুকলেন।
--- ক্ষীরদাপ্রসাদ বচনবাগীশ উচ্চ বিদ্যালয়।
--- ঠিকই ধরেছি,তা নাহলে কি এই রকম কথার ক্ষীর পরিবেশন করতে পারতে?
--- আমি ফার্স্ট বয় ছিলাম। অজয়বাবুর গলায় গর্বের সুর।
--- হ্যা,তা বুঝতেই পারছি। এখন যাও বাথরুমে সব জামাকাপড় ছেড়ে চান করে বেড়িয়ে এসো। আমি চা জলখাবার তৈরি করছি।
সকাল সকাল করোনার চেয়েও মারাত্মক এক দুঃসংবাদ বয়ে আনলো পিন্টু। রোজ খবরের কাগজটা দরজায় গ্রিলের ভাঁজে ঠেসে দিয়ে চলে যায়। আজ ডোরবেলটা বাজতেই সরলা দেবীর মনে হলো যেন সাইরেন বাজছে। দরজা খুলতেই পিন্টুর মুখোমুখি। তার মুখে গায়ের সঙ্গে মানানসই মাস্ক আর হাতে খবরের কাগজ। পিন্টুর কথা শোনার পর সরলা দেবী মুখ খুললেন।
--- তুমি কাকুকে ঠিক দেখেছ? ভুল হচ্ছে না তো?
--- না কাকিমা, আমি ভালভাবেই দেখেছি। মনা তো মাদার ডেয়ারি বুথের টেবিলে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে। আর মনার সাইকেল চালিয়ে ব্যাগ ভর্তি দুধের প্যাকেট নিয়ে কাকু পাটুলির দিকে যাচ্ছে। কাকুর কি চাকরি চলে গেছে? পিন্টুর প্রশ্নটা সরলা দেবীকে মাটিতে মিশিয়ে দিল। মনে হলো, লজ্জায়,অপমানে এখুনি তার পাতাল প্রবেশ হবে। কাটা গাছের মত পড়তে পড়তেও নিজেকে কোনরকমে সামলে পিন্টুর নাকের ওপর দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। কাগজটা সেন্টার টেবিলে রেখে দেয়াল ঘড়িতে চোখ রাখলেন। আটটা বেয়াল্লিশ। অন্য সময় হলে কুড়ি মিনিটের ভেতর ব্যাগ গুছিয়ে ছেলেকে নিয়ে, সংসারে একরাশ ঘেন্নার মাটি চাপা দিয়ে কবরডাঙ্গায় বাপের বাড়িতে রওনা দিতেন। কিন্তু এখন তার কোন উপায় নেই।
--- মা, একি তোমার কি হয়েছে? এখন এভাবে শুয়ে আছ কেন? ছেলের কথায় উঠে বসলেন সরলা দেবী।
--- তোর বাবা ইদানিং পাটুলিতে বাড়ি বাড়ি দুধের প্যাকেট বিলি করে বেড়াচ্ছে।
--- এই আজগুবি খবরটা পেলে কোত্থেকে? মনে হয় স্বপ্ন দেখেছ। মায়ের পিঠে হাত বুলিয়ে রনি বলল।
---স্বপ্ন হলে তো বেঁচেই যেতাম। কিন্তু মর্নিংওয়াকের নাম করে এত বড় ছলনা আমি কিছুতেই মেনে নেব না।
--- আহ্ মা, তুমি অযথাই রাগ করছ। আমার মনে হয় তোমার বুঝতে কোথাও ভুল হচ্ছে।
---- আর বোঝার কি আছে? মনার সাইকেল, মনার ব্যাগ আর ব্যাগ ভর্তি দুধের প্যাকেট। একদিকে মনা স্বপ্নের মেইন রাস্তায়,অন্যদিকে সাইকেল চালিয়ে তিনি বাইপাসের ধারে। এরপরেও বলবি ভুল বুঝেছি।
--- সরলা,দরজা খোলো। স্বামীর কন্ঠস্বরে সরলাদেবী পড়ি কি মরি ভাবে ছুটলেন দরজা খুলতে। এ লড়াইটা তাকে একাই লড়তে হবে।
--- একি! তোমায় এমন কেন লাগছে? শরীর খারাপ? ব্যাস, কেরোসিনের ডিব্বায় জ্বলন্ত কাঠিটা গিয়ে পড়ল।
--- কান খুলে শুনে রাখো, লকডাউন পর্যন্ত তোমার সঙ্গে আমরা আছি। তুমি এক ঘরে,আমি আর রনি এক ঘরে। লকডাউন ভাঙার এক মিনিটের মধ্যে এই সংসার ভেঙে চলে যাব। সরলা দেবীর চোখে আগুনের হল্কা।
--- আরে কি হয়েছে বলবে তো? অজয়বাবু বুঝলেন, তিনি ফাঁদে পড়েছেন। কিন্তু মনা ছাড়া ব্যাপারটা তো কেউ জানেই না। মনাকে ধাক্কা মেরে তুলে, সাইকেল আর ব্যাগটা এইমাত্র জমা দিয়ে এলেন। তাহলে?
--- ছিঃ ছিঃ, শেষ পর্যন্ত বাড়ি বাড়ি দুধের প্যাকেট বিলি করে বেড়াচ্ছ? সরলা দেবীর কথা শোনামাত্রই হাসিতে ফেটে পড়লেন অজয়বাবু। তাঁর হাসির গমকে রনি পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে এল।
দরজাটা হাট করে খোলাই ছিল। ঘরের ভেতর পুরো পরিবার আর চৌকাঠের বাইরে দাঁড়িয়ে,সরলা দেবীর প্রধান শত্রু মনা। মনাকে দেখামাত্রই ভূত দেখার মত চমকে উঠলেন অজয়বাবু।
--- ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে তো চোখ দুটো ফুলে ঢোল। ব্যাঙ্গ মিশ্রিত তিরটা ছুঁড়লেন সরলা দেবী। দ্বিতীয় তির ছোঁড়ার আগেই অজয়বাবু মনার দিকে বিষ্ময় ছুঁড়ে দিলেন, কিরে, তুই আবার এই সময় এখানে কেন?
--- কাকু, তোমার ব্যালেন্সটা ফেরত দিতে এলাম। কথা শেষ করে প্যান্টের পকেটে হাত ঢোকায় মনা।
--- কিসের ব্যালেন্স? সরলা দেবীর কৌতুহল আছড়ে পড়ল।
--- কাকু আজ পাঁচশ টাকার নোট দিয়েছিল। বারো প্যাকেট দুধের দাম কেটে বাকিটা ফেরত দিতে এলাম।
--- তা তোমার কাকু তাহলে মোট বারোটা বাড়িতে,বারো প্যাকেট দুধ বেচে আমার বারোটা বাজিয়েই ছাড়ল!
---- এসব আপনি কি বলছেন কাকিমা? কাকু বাড়ি বাড়ি দুধ বেচতে যাবে কোন্ দুঃখে? কাকু তো পাটুলির কলতলা বস্তির কিছু গরীব পরিবারে বারো প্যাকেট দুধ রোজ বিলোতে যায়। কেন আপনি জানেন না? মনা বেশ ফলাও করে কথাগুলো বলে।
---- জানব কি করে? এই বয়সে কেউ যদি লুকিয়ে চুরিয়ে দান ধ্যানে মেতে থাকে।
--- জানো তো, ওই কলতলার দুধের শিশুগুলোর এক ফোঁটা দুধের জন্য, ওদের কান্না একদিন শুনছিলাম। এই লকডাউনের দিনে বস্তির মানুষগুলোর কোন কাজ নেই। হাতে একটাও পয়সা নেই। দুধ কিনবে কোত্থেকে? তাই ঠিক করলাম, পাশাপাশি কয়েকটা অভাবের সংসারে একটা করে দুধের প্যাকেট দিয়ে আসব। অন্তত দুধটুকু খেয়ে শিশুগুলো বাঁচুক। সরলা, আমি ঠিক করিনি?
--- আঁচল দিয়ে চোখদুটো মুছে সরলা দেবী বললেন, তুমি যে মর্নিংওয়াকের বাহানায় এইভাবে কতগুলো শিশুর প্রাণ বাঁচাতে পারো, আমি ভাবতেই পারিনি। কাল থেকে মহাদেবের পাশাপাশি তোমার মাথায়ও জল ঢালব। তুমি কিন্তু আপত্তি করবে না।
--- আমার তো ঠান্ডা লেগে যাবে।
--- লাগুক ঠান্ডা। জীবনে এই প্রথম সাক্ষাৎ ভগবানের দেখা পেয়েছি। যেভাবে হোক, যেমন করে হোক আমি তাঁর সেবা করব। সরলা দেবীর গলায় মমতার সুর।
--- ঠিক আছে মা,সে নয় হবে। কিন্তু এখন মনাদার জন্য চা বানাও দেখি। রনির কথায়, কিচেনের দিকে যেতে যেতে তিনি বললেন,মনা,কাল সোমবার তাই একটা প্যাকেট বেশি দেবে, তোমার কাকুর মাথায় ঢালব।
সরলা দেবীর কথায়, ঘরের ওপর দিয়ে ঘন্টায় একশ কুড়ি কিলোমিটার বেগে হাসির আমপান বয়ে গেল।
------------------
সমাজ বসু।।
৫৬এ, মিলন পার্ক।। ডাক-- গড়িয়া
কলকাতা--৭০০০৮৪
ফোন--৬২৯১৩৭৭৩৮২