-চিনতে পারছেন? জানালার কাঁচের শার্সি টা সরাতে সরাতে প্রশ্ন করলো নার্স মেয়েটা।
কিছুক্ষণ অপলক চেয়ে রইলেন অনমিত্র। শেষ শীতের সকালের ঝলমলে রোদ এসে পড়েছে মেয়েটির ফর্সা গালে। হুবহু সুরঞ্জনার মুখের আদল।
- পেশেন্ট লিস্টটা দেখে ডিটেইলস্ টা পড়তেই অনুমান করেছিলাম আপনিই হতে পারেন। জানালার কাছে থেকে বেডের দিকে সরে এসে বললো আরাধ্যা। এই ক্যানসার হসপিটালে খুব কড়াকড়ি।এক প্রকার জোড় করেই আপনার ডিউটিটা নিয়েছি আমি । খুব কৌতুহল হচ্ছিলো আমার।
বয়স তেইশ-চব্বিশের আরাধ্যার বুদ্ধিদীপ্ত মুখের থেকে চোখ সরাতে পারছেন না বয়স উনপঞ্চাশের অনমিত্র।ধীরে ধীরে স্মৃতির দরজা খুলে যেতেই পনেরো-কুড়ি বছর আগের যুবক অনমিত্রকে খুঁজে পেলেন তিনি।
- তোমার বাবা মারা যাওয়ার আগে আমার খোঁজ করতেন?
- হম্।নিয়মিত আপনার কথা বলতেন।আপনাকে ভীষণ ভালোবাসতেন বাবা।কিন্তু আপনি জানতেন বাবা মারা গেছেন, তবুও গেলেন না আমাদের বাড়ি?
- যে কারনের জন্য তোমাদের বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছিলাম সেই কারণটা আরো বড় হয়ে উঠতো... বলতে বলতে চুপ করে গেলেন অনমিত্র।
সেই কত বছর আগে গ্রামের ডাক্তারবাবু হয়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে জয়েন করার সময় এই অজ পাড়াগাঁয়ে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ একা এবং অচেনা। আরাধ্যার পরিবার খুব সহজেই আপন করে নিয়েছিল তাঁকে।বাড়ি থেকে দূরে কোথাও কর্মস্থান, এমনি কোনো দূর গ্রামে কাজের মধ্যে ডুবে থাকবেন চেয়েছিলেন। আর হল ও তাই।পিছুটান ছিল না তেমন।দাদার সংসারে মা থাকতেন। সপ্তাহান্তে বাড়ি ফিরতেন।মা হঠাৎ মারা যেতে আর বাড়ির টান অনুভব করতেন না তেমন।যোগাযোগ ছিল তবে আরাধ্যার পরিবার আর গ্রামের মানুষের ভালোবাসায় ক্রমশ জড়িয়ে পড়েছিলেন অনমিত্র।
-কারণটা কী, আমার জানার খুব ইচ্ছে ।যখন আপনি চলে এসেছিলেন আমি তখন খুব ছোটো।আরাধ্যা অনমিত্রের পায়ের কাছে বেডে এসে বসলো। অল্প অল্প মনে আছে ,মাও বলতো আমি না কি সব সময় আপনার পিছু পিছু ঘুরতাম সারাক্ষন।
-তোমার মা কোথায় ? গ্রামেই?
-না, মায়ের শরীরটা খুব একটা ভালো নেই। বেশ কিছু টেষ্ট করাতে হবে।তাই কিছুদিন হলো এখানে আমার কাছে এনে রেখেছি।
-শরীরে কীসের সমস্যা হচ্ছে ?
- সে অনেক রকম, কখনো বলছে বুকে ব্যথা, কখোনো পেটে, হাঁটুতে।খেতে পারছিল না একদম। আমি বললাম এখানে থেকে লাভ নেই, চলো আমার কাছে। ছোটো কাকারা আছে ,তারা এদিকটা দেখভাল করে নেবে ঠিক।
- আর তোমার দাদা?
- আপনি যাকে গড়েপিটে মানুষ করে দিয়েছেন সে কোথায় থাকতে পারে ? দু'বছর হলো ব্যাঙ্গালোরে সফ্ ট
ওয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং-এ মাস্টারস্ করে এখন ওখানেই একটা বড় কোম্পানিতে রয়েছে। মা বলে তোর মিত্রবাবু থাকলে তোকেও তোর দাদার মতো মানুষ করে দিত। কিছুক্ষন থেমে আরাধ্যা বলে, গ্রামের সকলের মুখে এখনো আপনার নাম শুনি,সবার জন্য আপনি অনেক কিছু করেছেন।সবাই আপনাকে খুব ভালোবাসতো, তবু আপনি কেন চলে এলেন ?
কী বলবেন অনমিত্র? তার কাছে যে কোনো উত্তর নেই। ভালোবাসার বন্ধনে জড়িয়ে যেতে যেতে ক্রমশ বন্দী হয়ে পড়ছিলেন কি ? কোনো অশনি সংকেত? মন খারাপের একদিন জানালা দিয়ে গন্ধরাজ লেবু গাছের ডালে ছোট্ট একটা নীল পাখি দেখলেন অনমিত্র।পাখিটা এদিক ওদিক উড়তে উড়তে হঠাৎ কোথায় যেন হারিয়ে গেল।
লাঞ্চ টাইমের বেল বেজে উঠতেই আরাধ্যা উঠে দাঁড়ালো।দরজাটা সামান্য খুলে লাঞ্চের ট্রে হাতে আরেকজন নার্স এলো।
-আজ আমার ডিউটি এই পর্যন্তই ছিল। আরাধ্যার মুখে মৃদু হাসি।এরপর দুদিন অফ আছে আমার। দুদিন বাদে আমি আসবো।তখন থেকে ফুল-ডে থাকবো।
দুটো দিন যেন কাটতেই চায়নি অনমিত্রের।প্রবল আগ্রহ নিয়ে মেয়েটার জন্য অপেক্ষা করছিলেন তিনি। তৃতীয় দিন সত্যি যেন ফুটফুটে একটা লাল ফুল কেবিনে প্রবেশ করলো। আলো হয়ে উঠলো চারপাশ। অনমিত্র একটু উঠে বসার চেষ্টা করছিলেন।আরাধ্যা কাছে গিয়ে ধরে বসতে সাহায্য করলো।
-রে গুলো শরীরটাকে খুব দূর্বল করে দেয়। লড়াইয়ের ক্ষমতাই কমিয়ে দেয়। কী করে বাঁচবে মানুষ?
- আপনি পারবেন। দাদা প্রায়ই বলে আপনার কাছ থেকে পাওয়া হার না মানা মানসিকতা দাদাকে এতদূর নিয়ে এসেছে।
-তোমার মা কেমন আছেন ?
-দুদিন টেষ্টগুলো করালাম। রিপোর্ট দিন তিনেক বাদে পাবো। সেই অনুযায়ী ট্রিটমেন্ট।সকালের ওষুধ খাওয়ানোর শেষে আরাধ্যা বললো, আজ একটা বিশেষ দিন ।কী দিন বলুন তো ?
আরাধ্যার মুখে মিষ্টি হাসি দেখে অনমিত্র বললেন, তোমার ভ্যালেন্টাইন কোথায় ?
আরাধ্যা একটু শব্দ করে হেসে উঠলো,নেই...
-নেই? তা কি করে হয় ? আমাদের সময় এসব সবে নতুন বিষয় , ততটা ছড়িয়ে পড়ে নি। কিন্তু তোমাদের তো ব্যাপারই আলাদা।ভ্যালেন্টাইন নেই, মানা যায় না।হাসতে হাসতে বললেন অনমিত্র।
- না, নেই তো।মা বলে, মানুষ তো আছে হাজার, মনের মানুষ কজনা হতে পারে? আমার মা আমার খুব ভালো বন্ধু।আচ্ছা আপনি মনের মানুষ পান নি? তাই কি বিয়ে করেন নি? আপনার সম্পর্কে জানতে আমার খুব কৌতুহল হয়।
-আমি তো বুড়ো হয়ে গেছি, খানিকটা শব্দ করেই হাসলেন অনমিত্র।আমার সম্পর্কে জেনে কী করবে?
- কে বললো আপনি বুড়ো হয়েছেন? যথেষ্ট কম বয়সী মনে হয় আপনাকে।
-বুঝতে পারছি নার্সিংটা ভালোই রপ্ত করেছো। বেঁচে থাকার উৎসাহ যোগাচ্ছো? অনমিত্র খুব হাসছেন আজ।
-মোটেও না, আপনি এমনিতেই ভিতরে ভিতরে উদ্দীপনায় ভরপুর চিরযুবক।আপনাকে উৎসাহ দেওয়ার প্রয়োজন কী?
-এবারে সত্যি লড়াইটা খুব কঠিন।অদৃশ্য ঘাতক যে কখন স্টেজ টু তে নিয়ে এসেছে বুঝতেও পারিনি।
- আপনি তো জানেন , এই অবস্থা থেকে অনেকেই একেবারে কিউর হয়ে গেছে ,আর আপনি তো জীবনীশক্তিতে ভরপুর একজন উদ্যমী মানুষ।
-আমার কথা ছাড়ো। আজ এই বিশেষ দিনটা তো একটু অন্য রকম ভাবে কাটাতে হয় .. বয়ফ্রেন্ড ছাড়া কি মানায় ?
- আপনি তো আমার বন্ধু। বয়ফ্রেন্ড।আরাধ্যা হেসে বলে, মা বলেছে,আমি আপনার হাতের আঙুল ধরে আপনার সাথে সাথে যখন ঘুরতাম তখন সকলকে বলতাম, এই দেখো আমার বয়ফ্রেন্ড..মনে আছে আপনার ?
- হম্। তাই আবার থাকবে না ?হেসে ফেললেন অনমিত্র, তোমার কিছু মনে নেই?
- কিছু কিছু।তবে এটা খুব স্পষ্ট মনে আছে,আপনি যেদিন চলে এসেছিলেন সেদিন আমি খুব কেঁদেছিলাম।বেশ কিছুদিন মাকে শুধু জিজ্ঞেস করতাম,মা মিত্রবাবু কবে আসবেন? পরে স্মৃতি ঝাপসা হতে মাঝে মাঝে মনে মনে ভাবতাম আপনি কেন চলে এলেন ? দু একবার মাকে জিজ্ঞেস করতে মা বলতো, যিনি চলে গেছেন তিনিই ভালো বলতে পারবেন। আপনিই বলুন এত ভালোবাসা উপেক্ষা করলেন কেন?
কিছুটা যেন উদাস হয়ে গেলেন অনমিত্র।জানালার দিয়ে দূরের আকাশ পানে হাত নেড়ে আরাধ্যার দৃষ্টি আকর্ষন করলেন। ভালোবাসা হল ওই নীল আকাশটার মতো।অশেষ,অফুরান।এর মাঝে যতই দেওয়াল তোলো, মিলেমিশে সব একাকার হয়ে যাবে।আমরা আমাদের স্বার্থে ভালোবাসার মাঝে সামাজিকতার দেওয়াল তুলে ফেলি।অবশ্য এটা প্রয়োজনও।কিন্তু ভালোবাসা? সে তো সমুদ্রের জলের মতোই সারল্যে বহমান। প্রবাহিত স্রোতে কে কোথায় ভেসে যায়...
-আপনার লেখালিখির শখ ছিল। একটা পুরোনো ডায়েরির ভিতরে এটা পেয়েছিলাম,আরাধ্যা তার ব্যাগ থেকে একটা বহু পুরোনো হলদেটে একটা কাগজ বের করলো।বাবা আপনার এই ফেলে যাওয়া ডায়েরিটা আমাকে দিয়েছিল।আমি খুব যত্ন করে রেখেছিলাম।
অনমিত্র সযত্নে হাতে নিলেন কাগজটা, একটু ঘষা লাগলেই ছিঁড়ে যাবে যেন।লেখাটা পড়ে মৃদু হাসলেন অনমিত্র।"ঈশান কোণে মেঘ জমেছে/মাঝ সমুদ্রে উঠলো ঝড়/কে কার আপন?/ কে কার পর?"-কম বয়সের আবেগের বশে অপরিণত লেখা।
- বাবা কিন্তু সকলের কাছে আপনার খুব প্রশংসা করতো।
-তা ঠিক।তবে একটা সত্যি কি জানো?
-কী? আরাধ্যা আগ্রহ নিয়ে তাকায় অনমিত্রের দিকে।
-তোমার বাবা আমায় ঈর্ষাও করতো ভীষণ।আরাধ্যা কিছুক্ষন চুপ করে থাকতে,অনমিত্র ফের বললেন, কথাটা তোমার খুব খারাপ লাগছে হয়তো।
-না তা নয় ? হয়তো বা আপনি ঠিক বলছেন।।তবে ভালোবাসতো আপনাকে বলুন?
- তা অস্বীকার করার উপায় কী? ভালোবাসা দিলে এ মন/ ফেরায় সে কোন জন? ফিক ফিক করে হাসছেন অনমিত্র।
- আপনি খুব হেঁয়ালি করেন জানি। হেঁয়ালি ছেড়ে আসল প্রশ্নের উত্তরটা দিন প্লিজ। তারপর আপনার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে ।
-সারপ্রাইজটা কী? কৌতুহলবশত প্রশ্ন করলেন অনমিত্র।
-উঁহু, আগে উত্তর, তারপর ...
-সত্য অনেক সময় নিমের মতো হয় আরাধ্যা...
-হোক , আপনি বলুন।
-তোমার মা, সুরঞ্জনা আমাকে ওখান থেকে চলে আসতে বলেছিল।আরাধ্যার একরোখা মনোভাবের কাছে আর আড়াল রাখতে পারছেন না অনমিত্র,এখন বলতে দ্বিধা নেই ,তোমার মা বলেছিল, সব কিছু ঠিকঠাক থাকতে থাকতে আপনি এখান থেকে সসম্মানে চলে যান।গ্রামের মানুষ এমনিতে খুব সরল, কিন্তু সবকিছু তারা সহজভাবে নিতে পারে না । আর পরিবেশ টাও খুব ভালো নয়, সবার ভালোর জন্য আপনার চলে যাওয়াটাই ভালো..
- মা বললো আর আপনি চলে এলেন?
- না শুধু তোমার মায়ের কথায় নয় ,আমিও অনেক ভেবে দেখেছি ,হয়তো তোমাদের বাড়ি ছেড়ে গ্রামের অন্য কোথাও থেকে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চাকরিটা করতে পারতাম।কিন্তু...
-কিন্তু কী?
-আমার জন্য কারোর কোনো ক্ষতি হোক সেটা কোনোদিনই চাইনি আমি...
-আপনি অভিমানে চলে এসেছিলেন।আরাধ্যা অনমিত্রকে পরখ করার চেষ্টা করছে যেন।
- না ভুল করছো আরাধ্যা, আমার এটা একটা নীতি, আদর্শ বলতে পারো , প্রত্যেকেরই জীবনে এমন কিছু নীতি, আদর্শ থাকে।আমি এখনো এটা লালন করে চলেছি।
- আর ভালোবাসা? আপনার নীতি আদর্শের কাছে ভালোবাসা ছোটো হয়ে গেল ?
-তা হবে কেন? ভালোবাসার আধারেই তো বাকি সব কিছু।সকলের ভালো থাকাতে যখন তোমার ভালো বোধ জাগবে তখন তুমি অফুরান সুখ অনুভব করবে।
-আপনার কথাগুলো শুনতে খুব ভালো লাগছে।আপনার ভিতরে যেন অদ্ভূত এক আকর্ষনীয় জগৎ আছে, আর সে কারনেই বোধহয় রক্তের সম্পর্কের না হয়েও ,সকলের এত আপন হয়ে গিয়েছিলেন...
কথা বলতে বলতে আরাধ্যা অনমিত্রের বেডের পাশে প্রোপোজ করার ভঙ্গিতে বসে পরে।ব্যাগ থেকে একটা গোলাপি রঙের গিফ্টের প্যাকেট বের করে অনমিত্রের দিকে হাসিমুখে বাড়িয়ে দেয়,হ্যালো আমার ওল্ড ভ্যালেন্টাইন, মিত্রবাবু, আপনার জন্য আমার সামান্য উপহার, প্লিজ ওপেন ইট...
- কী এনেছো এই বুড়োটার জন্য? আনন্দের ছোঁয়ায় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে অনমিত্রের মুখ।
- খুলুন না...
অনমিত্র যখন ধীরে ধীরে খুলছেন প্যাকেটটা, আরাধ্যা তখন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে পুরোটা খোলার। লাল,হলুদ, সাদা উলে বোনা টুপিটা হাতে নিলেন অনমিত্র, খুব সুন্দর তো!
-রে নিতে নিতে আপনার মাথার চুল কমে গিয়ে এরকম ফাঁকা হয়ে গেছে ,মাকে বলতে দুদিনেই বানিয়ে দিল এটা, বললো তোর মিত্রবাবুকে বলবি এটা পরতে, আমি বললাম, দারুন হবে,এটা আমি আমার ভ্যালেন্টাইনকে গিফ্ট দেবো। মা হেসে বললো, তুই সেই ছোট্টটিই রয়ে গেলি... একটু থেমে আরাধ্যা বললো ,আপনি এটা নেবেন তো?
-কেন নেবো না ? অবশ্যই নেবো।আরাধ্যার মাথায় হাত রেখে অনমিত্র বললেন, তোমার মায়ের হাতের কাজ কিন্তু ভীষণ নিখুঁত!বলতে বলতে টুপিটার সামনের দিকে এক জায়গায় দৃষ্টি আটকে গেল অনমিত্রের।একটা ছোট্ট নীল পাখি,ডানা মেলে আছে। ভিতরে ভিতরে ছট্ পট্ করছে যেন!এই বুঝি জানালা দিয়ে দূর আকাশে উড়ে যাবে...
___________________________________***_________________________________________'
প্রিয়ব্রত দত্ত
বর্ধমান