দশ
আলো আর তার বাবাকে খোঁজার বৃথা চেষ্টা করেনি সে জানে মায়ের বয়স যদি 90 হয় নিশ্চয়ই বাবা এতদিন আর বেঁচে নেই।করুনার প্রকোপ কিন্তু এখনো বিশ্বজুড়ে রয়েছে তবে কিছু ক্ষেত্রে ছাড় মিলেছে দু-একটা ট্রেন হয়তো চলাচল করছে তাই আলো তার স্ত্রীকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল গ্রামের বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশ্যে । বিরাজিল সুযোগের সন্ধানে ছিল কবে ট্রেন চালু হবে একটা ট্রেন চালু হলেই সে মিনতি কি নিয়ে তাদের গ্রামের বাড়ি যেতে পারে সে বেরিয়ে পড়ল এবং মালপত্র নিয়ে মিনতির সঙ্গে।পথে পরিচয় হলো বিড়ালের সঙ্গে আলো বলল তোমার বাড়ি কোথায় বিরাজিল বলল আমার গ্রামের বাড়ি শালার তবে আমরা শহরের দিকে থাকতাম গ্রামের মাঝে মাঝে বেড়াতে যেতাম।
আলো বলল আমিও গ্রামের গরিব ঘরের ছেলে আমার মা একা থাকেন গ্রামে আমি জীবিকার সন্ধানে এখানে এসেছিলাম চাষবাসে কোন লাভ পেতাম না ঐজন্য চার্জার ছেড়ে আমরা পালিয়ে এসেছি মিরাজুল বলল কিন্তু চাষবাস ছারলে হবে না চাষবাস কে ভিত্তি করেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে না হলে বাইরে বাইরে কতদিন ঘুরে বেড়াবে কতদিন কত ছেলে যে এইভাবে অকালে মরে যায় জীবনে পথহারা হয়ে যায় তার ইয়ত্তা নেই।
আলো বলল ঠিক বলেছ আমরা বাড়ি গিয়ে তাই করবো চাষবাস চেষ্টা করবো আর না হলে লোকালি কোন কাজ খুঁজে নেব দেশে থেকে গ্রামে থেকে কাজ করার মতো আনন্দ আর কোথাও নেই।
কিন্তু মানুষ ভাবে এক আর হয় আরেক করোনা সংক্রমণ নাকি 14 15 দিন পর ভালোভাবে বোঝা যায় এখন এদের দেহে কোন কণার প্রকোপ ছিল না কিন্তু ধীরে ধীরে সেই প্রকোপ প্রকৃষ্ট রূপে ধরা দিতে লাগলো।
ট্রেনে চেপে বিরাজিল বলল মিনা থেকে দেখতো কপালে হাত দিয়ে আমার জ্বর জ্বর লাগছে কেন শরীর খারাপ লাগছে এদিকে আলোর অবস্থা আলো বলছে আমার জ্বর জ্বর লাগছে তার স্ত্রীকে বলল তোমার কি শরীর খারাপ করছে তার স্ত্রী ও বলল হ্যাঁ শরীর খারাপ একসাথে সবারই হয়েছে তাহলে চলো প্রথমেই আমরা স্টেশনে নেমে হসপিটালে দেখা করব।।
তারা স্টেশনে নেমে প্রথমেই চলে গেল হাসপাতলে কিন্তু সেখানে বিরাট লাইনে লাইনে দাঁড়িয়ে তারা বুঝল বেশিক্ষণ থাকতে পারবে না। বিরাজিল বলল-এই 130 কোটির দেশ ভারত বর্ষ এখানে কি করে প্রত্যেককে চেকআপ করবে কি করে প্রত্যেকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে চিকিৎসা প্রদান করবে এটা কি সম্ভব সম্ভব হতে পারে সরকার যা প্রচেষ্টা চালাতে চালাতে সম্ভব হতেও পারে।
এগারো
সবিতাদেবীর পালিতা কন্যা লতিকার বিয়ে হয়েছে জয়ের সঙ্গে।
লতিকা স্বামীকে ডেকে বললো, শোনো আমি বাজারে যাচ্ছি। তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে।
স্বামী জয় বলে, ঠিক আছে। যাও।
জয় চাকরী করে একটা বেসরকারি কারখানায়। লোহার রড তৈরি হয়। ছুটি বুধবার। আর এই একটা ছুটির দিনে জয় আর বাইরে বেরোতে চায় না। নিজের পছন্দ গাছ লাগানো। তাছাড়া বাড়ির উঠোনে ঘাস, জঙ্গল পরিষ্কার করতেই তার দিন কেটে যায়। আর লতিকা এই সুযোগে বাজার করা, বিল দেওয়া সব বাইরের কাজ সেরে নেয়।
যখন জয় চাকরী পায় নি, তখন ছাত্র পড়িয়ে তার রোজগার হতো মোটা টাকা। সবটা খরচ না করে সে জমিয়ে রাখতো নিজের অ্যাকাউন্টে। বরাবর স্বাধীনচেতা ছেলে। কাউকে নিষেধের বেড়ায় রাখতে তার মন সায় দিতো না। গ্র্যাজুয়েট হবার আগে অবধি মেয়েদের সাথে কথা বলতে তার শরীর ভয়ে কাঁপতো। তার কারণ আছে।
তখন কলেজর পড়ে। হিরু বলেএকট ছেলে ভালোবাসতো অনিতাকে। অনিতা আল্ট্রামডার্ণ মেয়ে। স্কুটি চালিয়ে কলেজে আসতো। আর পোশাকে ছিলো খোলামেলা মেজাজের পরিচয়। হিরু কালো সাদাসিধা একজন শহরের ছেলে। আমাদের বন্ধু বান্ধব অনেকে আড়াল থেকে অনিতাকে দেখতো কিন্তু সামনে গিয়ে কথা বলতে পারতো না। কিন্তু হিরু পারতো। ওদের দুজনের কলেজে নাম হয়েছিলো, ওথেলো, দেসদিমোনা।জয়ের মনে পরছে, কলেজে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে
একদিন হিরু বললো, অনিতা, চলো সিনেমা দেখতে যাই। অনিতা রাজি হলো। হিরু আমাদের সকলকে যেতে বললো। আমরা সবাই অবাক। মলয় বলছে, কার মুখ দেখে উঠেছিলা। অসীম বললো, অনিতার সাথে সিনেমা। এই সুযোগ মিস করা যাবে না। ওদের পাল্লায় পড়ে জয় গিয়েছিলাো। হাওড়ার পুস্পশ্রী হলে। ভিতরে অন্ধকার, হিরু আর অনিতা সামনে এগিয়ে বসলো। জয়রা পিছনে।ওরা দেখলো ওরা সিনেমা দেখা বাদ দিয়ে একে অপরকে জড়িয়ে বসে। আলো আঁধারিতে এর বেশি কিছু দেখতে পাইনি জয়।
তারপর একমাস হিরু ও অনিতাকে দেখতে পাই নি জয়।
লতিকা বাজারে গেছে। জয় বাড়িতে একা। মেয়ে স্কুলে গেছে। জয় বিছানায় গা এলিয়ে কলেজ জীবনের কথা ভাবছে। ঘন্টা খানেক হয়ে গেলো। লতিকা বাজারে গেছে।
জয় ভাবছে,আমার
নিজের মনের আয়নায় হিরুর ছবি।
অসীম একদিন আমাকে নিয়ে সুরে্ন্দ্রনাথ কলেজে গেছে। হিরুর সঙ্গে দেখা। অসীম বললো, কি ব্যাপার হিরু তোরা আর কলেজে যাস না। কেমন আছিস। এখানেই বা কি করছিস। হিরু নোংরা জামা প্যান্ট পরে কলেজের সামনে ফুটপাতে বসে আছে। আমরা তো নরসিংহ কলেজে পড়ি। আজকে কাজ আছে বলে এই কলেজে আসা।
আমি হিরুকে জিজ্ঞাসা করলাম, বল কিছু বল।
হিরু অন্ধকার মুখ তুলে বললো, জীবন শেষ। অনিতা বিয়ে করে আমেরিকা চলে গেছে।
হাতে হিরুর সাদা কাগজে মশলা পুড়ছে। ধোঁয়াটা নাক দিয়ে টেনে নিচ্ছে।
তুই হেরোইনের নেশায় জীবন শেষ করিস না হিরু। বললো, অসীম। আমি বললাম কি করে জানলি তুই,যে ওটা নেশার জিনিস।
---- আমি আমাদের পাড়ায়একজনকে ওই নেশায় মরতে দেখেছি। তখন সকলের আলোচনায় বুঝেছি নেশার মারাত্মক প্রভাব
হিরুকে নিষেধ করতে হবে।
মুখ ঘুরিয়ে দেখা গেলো হিরু পাগলের মতো ছুটছে। একটা দোতলা বাসে চেপে পড়লো হিরু। তারপর ওর দেখা আর কোনোদিন পাইনি। নাটক শুরুতেই শেষের বাজনা বাজিয়ে অনিতা মহাসুখে ঘর করছে বিদেশে।
জয় ভাবছে, আর নিজের মনের সঙ্গে কথা বলে চলেছে।
পরে শুনেছিলো জয় চিরকালের মতো হিরু তাদের ছেড়ে চলে গেছে অচিন দেশে।সেই থেকে জয় মেয়েদের একটু এড়িয়ে চলতো ভয়ে। ভালোবাসার ভয়ে...।
আবার জয়, যার পাল্লায় পরেছে তার কবে যে পরিবর্তন হবে কে জানে। মনে মনে ভাবে অসীমের কথা, জানিস শতকরা আশি ভাগ মানুষ ভালো। তা না হলে পৃথিবী অচল হয়ে পরবে। সে ছেলে হোক কিংবা মেয়ে। আশি শতাংশ মানুষ সৎ মানুষ।
লতিকা বাজারে গেছে দুঘন্টা হয়ে গেছে। এর মধ্যে মেয়ে রুমা চলে এসেছে। মেয়ে বলছে, বাবা, আমি আজ স্কুলে যাবো না।
--- ঠিক আছে, তোর মা আসুক বলবি।
---- তুমি একটু বলে দিও
----বেশ বলে দেবো।
সংসারে কে যে কখন কোন রোলে অভিনয় শুরু করে দেয় বোঝা মুস্কিল। লতিকা সব ব্যাপারে স্বাধীন। তবু সবাইকে বলে বেড়ায়, জয় স্বামী হয়েও তাকে সন্দেহ করে।
জয় সব জানে, শোনে। কিন্তু ঝগড়া এড়িয়ে যায়। সংসারে যার সাথে সব সময় থাকতে হবে তার সাথে ঝগড়া করতে ভালো লাগতো না। তারপর মেয়ে বড়ো হয়েছে।
জয়ের মনে পরছে,তখন বিয়ে হয়েছে এক বছরও হয়নি। লতিকা বাপের বাড়িতে গেছে।
জয় দেখা করতে গিয়ে দেখে, লতিকা ঘরে কার সঙ্গে কথা বলছে। অন্ধকার ঘর। শ্বশুর, শ্বাশুড়ি অন্য ঘরে। জয় আর শ্বশুর বাড়িতে ঢোকে নি। লোকজন ডেকে এনে দেখে, দুজনে বিছানায় শুয়ে গল্প করছে। তারপর অনেক জল গড়িয়ে গেছে কিন্তু লতিকার স্বভাবের পরিবর্তন হয় নি। পরপুরুষের সঙ্গে বিছানায় গল্প করার অনুমোদন সেদিন গ্রামের লোকে দেয়নি। তার বেশি অসভ্য কথা ভাবতে জয়ের রুচিতে বাধে।
লতিকা এখনও মেয়েকে বাড়িতে রেখে প্রতিবেশিদের বাড়িতে ঘন্টার পর ঘন্টা গল্প করে। পুরুষ মানুষের সঙ্গে কথা বলতে তার বেশি ভালোলাগে। জয় বাধা দিয়েছে অনেকবার। কিন্তু ও কাজে ব্যস্ত থাকে। বেশি কিছু বলতে পারে না।
মেয়ে বড়ো হয়েছে। এবার তারও শখ আছে, আহ্লাদ আছে। মেয়ে বলে, বাবা আমি কার্তিক লড়াই দেখতে কাটোয়া যাবো। জয় বলেছিলো, নিশ্চয় যাবে।কার্তিক লড়াই দেখতে মেয়েটা কাটোয়া মামার বাড়ি চলে গেলো।
জয় বলছে, মেয়েটা নেই বাড়িটা ফাঁকা লাগছে। লতিকা বলে, বড়ো হয়েছে। পঁচিশ বছরের হলো। এবার বিয়ে দিয়ে দাও।
জয় বললো, তোমার তো অনেক জানা শোনা। সবাইকে বলে দেখতে পারো।
জয়ের মেয়ে রুমা বাবার মতো হয়েছে। সে সাদা সিধা। কোনোরকম চালাকি তার মধ্যে নেই। কার্তিক লড়াই দেখতে গিয়ে অনি র সঙ্গে তার প্রেম হয়েছে।অনিকে তার খুব ভালো লেগেছে। সে তাকে বিয়ে করতে চায়।রুমা বাড়ি এসেই বাবাকে বলছে,বাবা কাটোয়ার অনি বলে একটি ছেলেকে আমার ভালো লেগেছে।আমি তাকে বিয়ে করতে চাই।
---- ঠিক আছে তোর মাকে বলবো।
জয় রাজি। ছেলে স্কুলের শিক্ষক। কিন্তু লতিকা বলছে, আমি যেখানে ছেলে দেখেছি তাদের বড়ো ব্যাবসা। অল্টো গাড়ি আছে। ওখানেই বিয়ে হবে।কিন্তু মেয়ে বেঁকে বসেছে।
বেশ কয়েকদিন ধরে মেয়ের বিয়ে নিয়ে অশান্তি হচ্ছে জয়ের বাড়িতে।
জয় বললো, খুব স্পর্শকাতর ব্যাপার, একটু সাবধানে ম্যানেজ করবে,যদি কিছু করে বসে।
লতিকা বললো, যা করে করবে। আমি ওই ছেলের সাথেই বিয়ের ব্যবস্থা করবো।
যে ছেলেটিকে রুমা ভালোবাসে সে একটা বেসরকারি ফার্মের মালিক । তার নাম হারু। অপরের বিপদে আপদে এক ডাকে সকলে হারুর হেল্প পেয়ে থাকে। বন্ধুরা সকলেই হারুর বিয়ের ব্যবস্থা শুরু করে দিয়েছে। হারুর বন্ধুর লিষ্টে পুলিশ অফিসার থেকে আরম্ভ করে অল্টো গাড়ির মালিক লিপিকার পছন্দ করা জামাই অবধি আছে। হারু এখনও রুমার মায়ের অপছন্দের কথা জানে না। সমাজসেবার জন্য অনেক বড়ো বড়ো পুরস্কার হারু পেয়েছে। পুরস্কারের টাকাও সমাজসেবার কাজে লাগায়। কত বেকার ছেলে তার দয়ায় কাজ করে খায় তার হিসাব রাখে না হারু। মায়ের হারাধন ওরফে হারু রত্নধন হয়ে সমাজের ভালো কাজ করে।
রুমার মন খুব খারাপ। সাত আটদিন হারুর সাথে দেখা হয় নি। কিছুতেই মা রাজী হচ্ছে না। সে ভাবছে, বেঁচে থেকে লাভ নেই। কিন্তু বাবা আছে। তাকে কেন দুঃখ দেবো, এই কথা ভেবে সবকিছু ঈশ্বরের ইচ্ছার উপর ছেড়ে দিলো নিজের ভবিষ্যৎ ।
এদিকে হারু ভাবছে, রুমা কেন দেখা করছে না। মোবাইলে অন্য কথা বলে এড়িয়ে যাচ্ছে।
হয়তো লজ্জা পাচ্ছে। বিয়ের দিন ঠিক হবে তাই।লাজুক হয় ভদ্র স্বভাবের মেয়েরা।
বন্ধুরা বলছে, হয়, হয় এরকম হয়। তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে। হঠাৎ ওরা খবর পেলো অল্টো গাড়ির মালিকটি রোড অ্যাক্সিডেন্ট করে রাস্তায় পরে আছে। সঙ্গে সঙ্গে হারু বন্ধু বান্ধব ডেকে চলে গেলো স্পটে। এখন রাত সাতটা বাজে। মহুকুমা হাসপাতালে ভর্তি করে দেওয়া হলো। সে যাত্রা বেঁচে গেলো সে।
রুমার মা লতিকা এসেছে রুমাকে সঙ্গে করে,আহতকে দেখতে। তারা ফলমূল নিয়ে এসেছে। মেয়েকে নিয়ে ঘরে ঢুকেই দেখে,হারু তার বন্ধুদের নিয়ে বসে আছে। পুলিশএসেছে। লিপিকা শুনছে, পুলিশ জিজ্ঞাসা করছে, গাড়ির মালিক কে? শুয়ে শুয়ে আহত ছেলেটি বলছে,হারু সরকার। পুলিশ বলছে, তিনি কোথায়?
হারু হাত তুলে বললো,এই যে স্যার আমি।
পুলিশটি বললেন, ও আপনি। সমাজসেবক নামেই আপনাকে চিনি। নমস্কার নেবেন।আজকে আপনার নাম জেনে খুশি হলাম। নো প্রবলেম।
----কি যে বলেন। মানুষ হয়ে মানুষেরএকটু সেবা করার চেষ্টা করি বন্ধুদের নিয়ে। এরাই আমার সব।
পুলিশ তাদের কাজ করে চলে গেলো।
লতিকা সব শুনেছে। হারুর মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, তোমার মা রত্নগর্ভা। তোমার জন্যই অনেকে প্রাণ ফিরে পায়। রুমা দেখলো ওর মায়ের চোখটা জলে চিক চিক করছে। তারপর লিপিকা ফলমূল হারুর হাতে দিয়ে বললো,বাবা তোমার মা বাবাকে ব'লো আমরা দেখা করবো। হারু ঘাড় নেড়ে সায় দিলো।রুমার হাল্কা হাসিতে হারু নিশ্চিন্ত হলো।
সারা রাস্তা লতিকা মেয়ের সাথে কথা বলতে পারেনি লজ্জায়। বাড়িতে আসার পথে পরশমণির স্পর্শে রঙ পালটানোর খেলা দেখছিলো শরতের আকাশে, লিপিকা। আলোর লিপি আজ থেকে তার আকাশে রঙের আলপনা, সত্য, সুন্দরের ছবি এঁকে দিলো।
ঘরে ঢুকেই লতিকাকা এই প্রথম স্বামীকে একটা প্রণাম করে ফেললো প্রসন্নমনে...
লতিকার মেয়ে রুমা বিয়ে করে চলে গেল বিদেশে।
জয় দুহাজার কুড়ি সালের মার্চমাসে কোভিড নাইনটিন বা করেনার অসুখে মরে গেল। লতিকা দাহকাজও দেখতে পায় নি লকডাউনের কারণে।
লতিকা একা বেঁচে রইল। সে ঠিক করল করোনা রোগ বিষয়ে জনগণকে সচেতন করার কাজে নামবে। মৃত্যুভয় তার কেটে গেছে স্বামীর শোকে। জয়কে বারণ করলেও শোনে নি লতিকার কথা। জয় বাইরে বসে তাস খেলত।
বারো
বিরাজুল বেঁচে গেল। কিন্তু রূপা বাঁচে নি। সে কোভিড নাইনটিনের আক্রমণে পরপারে চলে গেছে। বিরাজুল কোনওরকমে বেঁচে ফিরেছে আইসোলেশনে থেকে সুস্থ হয়ে। তার মনে পরলো আলোর কথা মিনতির কথা। রাতের অন্ধকারে হাঁটতে হাঁটতে চলে এলো আলোর গ্রামে।
মিনতির কাছে শুনলো আলো মরে যওয়ার মর্মান্তিক কাহিনী। বিরাজুলও রূপার মরে যাওয়ার কথা বলল।
পরেরদিন সকালে চলেনএল লতিকা।
সুনীল এই গ্রামেরই ছেলে।নদীয়া জেলার বীরহট্ট গ্রাম। এখানে তার আশ্রম আছে। সকলে তারা ঠিক করল গ্রামের লোকদের সচেতন করবে। আশেপাশে তিরিশটা গ্রাম আছে। তারা টোটোতে চেপে মাইকে সচেতনতার কাজ শুরু করল। থানায় একটা পারমিশন নিয়ে রাখল। সকলে মুখে মাস্ক বেঁধেে দূরত্ব বজায় রেখে কাজ শুরু করল। লতিকা বিরাজুল আর মিনতিকে সুনীলের কথা বলতে শুরু করল। এক রাতে মিনতির ঘরে। সে বলল সুনীলরা খ্রীষ্টান। তার আসল। নাম যোশেফ। তবে এ গ্রামে সে সুনীল নামে প্রসিদ্ধ এক সমাজকর্মী।
তেরো
সুনিল টোটো চালায়। মাধ্যমিক পাশ করে আর পড়ার সুযোগ পায় নি। টাকা রোজগারের জন্য বাবার মারা যাবার পর এই কাজে নেমেছে। বাবা বলতেন,কোনো কাজ ছোটো নয়। আর খেটে খাওয়া সম্মানের কাজ।
আজ টোটো নিয়ে সকালে বেরোনোর পর সুনিল চায়ের দোকানে এলো। চায়ের দোকান বন্ধ কেন? ভেবে পেলো না। অসিমকে দেখতে পেয়ে সুনিল জিজ্ঞাসা করলো,কি রে দোকান বন্ধ কেন? অসিম বললো,জানিস না, সমর বাবু মারা গেছেন। তাই তার সম্মানে, আজ দোকান বন্ধ।
সুনিল টোটো রেখে সমরবাবুর ছেলের সংগে দেখা করতে গেলো। সমরবাবু সমাজসেবক। তিনি দয়া করে টোটো কিনে দিয়েছেন। সুনিল কে তিনি খুব ভালোবাসতেন। তার বাবাকেও ভালোবাসতেন। তাই তার ছেলের কাছে গিয়ে খোজ নেওয়া দরকার।
সুনিলের ছোটোবেলার কথা মনে পড়ছে। তাদের বাড়ির কাছে একটা পুকুর ছিলো। একটা পানকৌড়ি ডুব দিয়ে তাকে খেলা দেখাতো। কি যে খুঁজে বেরাতো পুকুর জুড়ে জানত না সে। শাপলা ফুল তুলে বাউরি বৌ একটা ফুল তার হাতে দিতো। বেশ ভালো ছিলো সেই সময়গুলো। রাস্তা পার হতে গিয়ে বেজি আর শিয়াল দেখে তার মনে আনন্দের সীমা থাকত না। লাল মোরাম রাস্তায় হারিয়ে যেতো তার মন।ছুটে চলে যেতো কদ তলার মাঠ পেরিয়ে অজয়ের ধার। সেখানে পা ডুবিয়ে বসে থাকত। ছোটো মাছগুলো পায়ে চুমু খেয়ে চলে যেত বারে বারে। বালির চরে বালিহাঁসগুলো খেলা করত আপন খেয়ালে।
তারপর কালের পরশে কালি লাগে মনে। এখন আর তেমন করে ধরা দেয় না মন। সংসারের চাপে গড়িয়ে যায় অজয়ের বানভাসি জল। সমস্ত ভাললাগা স্বপ্নগুলো এলোমেলো হয়ে যায় জীবনে।
সুনিল ভাবে,এই সংসারে টাকার দাম সবথেকে বেশি। যার টাকা আছে লোকে বলে তার নাকি পৃথিবীটা হাতের মুঠোয় চলে আসে। সে বিশ্বাস করে না। টাকা থাকলে কি প্রকৃতি ধরা দেয়। ধনী হলেই কি কবিতা লেখা যায়। যায় না। তাহলে সে নীল আকাশে তার মন ওড়াতে পারে না। আয়নায় প্রেমিকার মুখ দেখতে পায় না।নীল আকাশে মন ওড়ে না। শুধু অর্থ বাড়াবার চিন্তা তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় লোভের সাগরে। চিন্তা করতে করতে কখন যে দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমেছে জানতে পারে নি। আজ খালিহাতে বাড়ি গেছে। মায়ের হাতে টাকা দিতে পারে নি। মা রাতে খাবারের সময় বললেন,শুনেছিস সমরবাবু মারা গেছেন। -
----হাঁ,মা, শুনেছি।
-----তাদের বাড়িতে দেখা করেছিস।
-----একবার গেছিলাম। ছেলে আমাকে চেনে না। তার বাবার সাথে আমার পরিচয়ের কথা বললাম। ছেলে অত পাত্তা দিলো না। আমি তারপর মাঠে বসে খেলা দেখছিলাম।
----দুপুরে আবার কি খেলা।
-----মা, সারা জগত খেলায় ব্যাস্ত। শুধু দেখার মত চোখ চাই।শোনার মত কান চাই।
------ঠিক বলেছিস। তোর বাবা যখন ছিলেন,তখন একবার চুপি পাখিরালয়ে নিয়ে গেছিলেন। কি সুন্দর তাদের চলাফেরা। ওড়া। ওদের উড়তে দেখে মন চলে গেছিলো নীল আকাশে। তোর বাবা বললেন, নামো, নামো। পরে যাবে। আমরা দুজনেই ছোটো হয়ে গেছিলাম। তোর বাবাও তোর মত ভাবুক ছিলেন। তাইতো ভরা চাঁদের আলোতে লাইন পার হতে গিয়ে ট্রেন চাপা পরলেন আমাদের রেখে। তখন তুই তিন বছরের ছেলে। তারপর বাড়ি বাড়ি কাজ করে তোকে বড় করেছি। চাকরি না পেলেও মন তোর ছোটো নয়। তুই বাবার মতোই বড়ো মনের মানুষ।
-----মা তোমার ছোটোবেলার কথা বলো। আমার শুনত ভালো লাগে।
-----আমার বাবা ছিলেন পালক নরম,উদার মনের মানুষ। কিন্তু লাঠি খেলা,সড়কি খেলায় তার জুড়ি মেলা ভার ছিলো। দুর্গাদেবী র মূর্তি তিনি নিজেই বানাতেন। আর অই কদিন আমরা বাবার কাছেই থাকতাম। একমাটি,দুই মাটি করে রঙ করতেন মায়ের। চোখ আকার দিনে আমাদের কৌতূহল বেড়ে যেত। সকাল থেকে সাজ সাজ রব। চোখ আঁকা হয়ে গেলে সাদা কাপড়ে ঢেকে দিতেন মায়ের দেহ। সেই ঢাকা খোলা হোতো পুজোর দিনে। ঢাকের বাজনার তালে তালে বেজে উঠতো আমাদের আমোদের তাল। সেই তালে তালে মন নাচত অনেকদিন পড়ার ঘরে। বাবা জোর কোরতেন না কোনোদিন। আমরা আবার মিশে যেতাম সহজ জীবনে।
মা বেটা গল্প করতে করতে রাত দশটা বেজে গেল। তারপর মা চলে গেলেন নিজের ঘরে। ছেলে নিজের ঘরে।
তারপরদিন চা খেয়ে সুনিল বেরিয়ে পরলো নিজের কাজে। টোটো চালিয়ে যা রোজগার হয় তার একটা ভাগ তুলে রাখে অভূক্ত মানুষের জন্য। দিনের পর দিন চলে যায়। সুনিল এখন একটা অনাথ আশ্রম গড়ে তুলেছে তার বাড়ির পাশের জমিতে। মাটির বাড়িতে অনেক অনাথের বাস। প্রথমে একটা ছিল বাড়ি। ধীরে মানুষের সাহায্যে গড়ে উঠল আরও বাড়ি। সে বুঝলো,ইচ্ছা থাকলে টাকা পয়সা বাধা হয় না কোনদিন। আশ্রমের নাম রাখল,সমর নিবাস। সমরবাবু তাকে টোটো কিনে দিয়েছেন। আর তাই তার নামে সে আশ্রমের নাম রাখলো, সমর নিবাস। সুনিলের বন্ধু দেবু বলছে,কে যে কখন কার আত্মিয় হয়ে যায় বোঝা কঠিন। আশ্রমের নাম সুনিল বাবার নামে রাখলো না। রাখলো তার মনের দেবতা সমরবাবুর নামে। তার নিজের ছেলেও এই কাজ করতে পারেনি।
দিকে দিকে সমর নিবাসের নাম ছড়িয়ে গেলো। দান আস্তে লাগল প্রচুর। সুনিল টোটো আশ্রমে রাখে। আরো চারটি টোটো কিনে সে চারটি বেকার ছেলেকে কাজ দিয়েছে। আর সমরবাবুর দেওয়া টোটো দান করেছে তার পাড়ার একটি গরীব ছেলেকে।
সুনিলের পাড়ার ক্লাবে নেতাজী জন্মজয়ন্তি পালিত হচ্ছে। সভাপতি হয়েছে সুনিল।সুনিল বলছে,নেতাজি আমাদের জন্য জীবন দিয়েছেন।সমাজের সকল মানুষের জন্য। আসুন সবাই আমরা আজ গাছ লাগাই,তার সম্মানে। প্রচুর গাছের চারা তার নির্দেশে এসেছে। সেগুলো গ্রামের চারদিকে লাগান হল। গ্রামের পথে পথে গাওয়া হোলো গাছ লাগানোর গান।
সুনিল নিজের হাতে সমর নিবাসের আশেপাশে অনেক গাছ লাগালো। অনাথ আশ্রমের সবাই হাত লাগালো।
এইসব কাজ করছে। হঠাত বাড়ি থেকে হন্তদন্ত হয়ে এল বাড়ির কাজের মেয়েটা। সে বলছে,সুনিলদা,তাড়াতাড়ি বাড়ি আসুন।
-----কেন রে?
-----মা কেমন করছেন।
কয়েকদিন ধরেই মায়ের শরীর খারাপ। তাই মা নিজেই কাজের মেয়ে রুমাকে রেখেছেন। রুমার কথা শুনেই সুনিল বাড়ি গেলো। তার চোখে জল। মাকে দেখে তার চিন্তা হোলো। ডাক্তার ডাকতে মানা করলেন মা। মা বললেন,আর সময় নেই।তোর বাবা ডাকছেন। এবার যাবো।তবে যাবার আগে আমি এই রুমার হাত তোর হাতে দিলাম। ও খুব ভাল মেয়ে। তোরা বিয়ে করে সুখী হলে আমি শান্তি পাবো। তুই আমাকে কথা দে।
সুনিল বললো,কথা দিলাম।
তারপর সুনিলের মা চলে গেলেন ধারাধাম থেকে। সামনে সুনিল আর রুমা। এক নতুন জীবনের পাঠ মা দিয়ে গেলেন তাকে। মায়ের পায়ে মাথা রেখে কাদতে লাগল সুনিল।
এবার মায়ের শ্রাদ্ধ মিটে গেলো। কয়েক মাস পরে রুমাকে বিয়ে করলো সুনিল। পাড়ার সবাই খুব আননন্দ করলো বিয়েতে। বাপ, মা মরা মেয়েটা খুব ভাল। সকলের প্রিয় রুমা এখন সমাজসেবকের স্ত্রী। তাকে সকলে প্রথম প্রথম কাজের মেয়ে হিসাবেই চিনত। কিন্তু সুনিলের মা জানতে পেরেছিলেন তার ভেতরের কথা। রুমা কাজ করে যা রোজগার করতো তার অনেকটাই সুনিলের দানের বাক্সে দান কোরতো। পাড়ার লোকেরা সুনিল মায়ের কানে কথাটা তুলেছিলো। কিন্তু সুনিল জানত না। রুমার জীবনে ছোটো থেকেই সুনিল আদর্শ পুরুষ। তার বাবা জন্মের আগে মারা গেছেন। আর মা তাকে জন্ম দিতে গিয়ে মারা গেছেন। দাইবুড়ি তাকে ছোটো থেকে মানুষ কোরেছেন। এই দাইবুড়ি পরে দাতাবুড়ি হয়েছিলেন। তিনি তার সবকিছু মানুষের জন্য দান করে গেছেন। তার সমস্ত সম্পত্তি সমর নিবাসে দান কোরেছেন। তিনি রুমাকে বোলতেন,কোনো কাজ ছোটো নয়। খেটে খাবি। তার সুখ আলাদা।
রুমা সুনিলকে ছোটো থেকে মনে প্রাণে ভালোবাসত। কিন্তু সে কথা কোনোদিন মুখ ফুটে বলতে পারে নি। সে খেতে গিয়ে ভাতের থালায় সুনিলের ছবি দেখতে পেত। নীল আকাশে দেখত সুনিলের ছবি। কিন্তু সে ভারতবর্ষের মেয়ে। বুক ফাটে তবু মুখ ফোটে না। নীরব প্রেমের শক্তি তার দেহ মনে।
তার মনের কথা দাইমা জানতেন। তাই রুমার সংগে পরামরশ করে দাতাবুড়ি মরে গেলেন। কিন্তু সুনিলের মায়ের অন্তর জানতে পেরেছিলো রুমার অন্তরের কথা। তাই তিনি তাকে কাজের মেয়ে হিসাবে বাড়িতে এনে পুত্রবধু করে নিলেন ছেড়ে যাবার আগে।
বিয়ের পরে সুনিল বললো রুমাকে,তুমি কি একটা ছেলের মা হতে চাও।আমার কিন্তু অনেক ছেলে আছে। রুমা উত্তর দিলো,আমি তোমার ছেলেমেয়ের দেখাশোনা কোরবো। তারাই আমার নিজের সন্তান।
সুনিল এই উত্তর আশা করেছিলো তার কাছ থেকে। তার অন্তরে বেশ কিছুটা জায়গা রুমা ঘিরে নিল হৃদয় জুড়ে। সে বুঝতে পারলো,তার মা তাকে সঠিক জীবন সাথী খুঁজে দিয়েছেন। মায়ের স্মৃতি জুড়ে মায়ের মাটির বারান্দাকোঠা। এখানে বাবা মায়ের আত্মা শান্তিতে আছে। হৃদ মাঝারে, কোঠার মাঝে তাদের বন্দি কোরেছে রুমা আর সুনিল। তাই সেই কোঠার নাম রাখল বন্দিপাখি...