অসমতল কাঁচা রাস্তায় অটোরিকশা প্রচুর ধকল দিচ্ছিল। রক্তিম আর মিতুন একমিনিটের জন্যেও স্থির হয়ে বসে থাকতে পারছিল না। একে অপরের গায়ে বারেবারেই ঢলে ঢলে পড়ছিল। যদিও ব্যাপারটা ওদের দু'জনের কাছেই বেশ উপভোগ্য। সদ্য বছরখানেক বিয়ে হয়েছে। এখনো রোমান্সে ভরপুর ওদের দাম্পত্য।
রক্তিম কলকাতার একটা মাল্টি-ন্যাশানাল কোম্পানীর একজিকিউটিভ অফিসার। ছুটিছাটা কম। তাও সপ্তাহখানেকের জন্যে এই মসস্বল শহরে শ্বশুরবাড়িতে ছুটি কাটাতে আসতে পেরেছে, এই ঢের। এসেছে অবশ্য নদীর টানে।
এই শহরেই কেটেছে মিতুনের মেয়েবেলা। এখানকার স্কুল-কলেজেই তার পড়াশোনা। বাবা এখানকার কলেজের লেকচারার। এখন রিটায়ার্ড। মা তো সেই কবেই ওদের ছেড়ে চলে গেছেন। তারপর বাবা কত কষ্ট করে তাকে আগলে আগলে মানুষ করেছেন, সেসব কথা রক্তিম বহুবার মিতুনের মুখে শুনেছে।
শহরটা ছোট হলেও স্বয়ংসম্পূর্ণ। স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত সবই আছে। তবে আকর্ষনীয় কিছু নেই। শুধু একটা নদী ছাড়া। নদীই এই শহরের সম্পদ।
শহর থেকে মোটে চার-পাঁচ কিলোমিটার দূরে সেই নদী। এখানে ছুটি কাটাতে এসে নদী না দেখে ফিরে যাবে, এমন বেরসিক রক্তিম নয়। তার ওপর বাবার উস্কানি। মিতুনকে প্রায় আদেশের সুরে বাবা বলেছেন – 'যা না, ওকে নিয়ে একবার নদীর দিকটা ঘুরে আয় না…'
মিতুনের অবশ্য এখন নদী নিয়ে তেমন আগ্রহ নেই। বলতে গেলে, এই নদীর কোলে্পিঠেই তো মানুষ হয়েছে সে। নদীর শান্তস্বভাবের মনোরম মায়াময়ী রূপ যেমন সে দেখেছে, তেমনি বন্যার সময় তার উত্তাল ভয়ংকর রূপও সে মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছে। নানা ঋতুতে নদীর নানা চরিত্র তার নখদর্পণে।
তবু বাবার কথামতো সে রক্তিমকে নিয়ে চলেছে অটোরিকশা রিজার্ভ করে। নদী দেখাবে।
বিকেল ক্রমশ মরে আসছিল। তবু সূর্যাস্তের অল্প আগেই ওরা পৌঁছে গেল। পৌঁছে গেল নদীর কাছে। নদীটা উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রবাহিত। খুব একটা চওড়া না। এখানটা আরো কম চওড়া। যেন শাড়ির রূপোলি পাড়। এপার-ওপার অনায়াসে দেখা যায়। ওপারে বেশ কিছুদূর বালিময়। তারপর গাছগাছালির ধোঁয়াটে আভাস। সেইসব গাছগাছালির মধ্যেই লুকিয়ে আছে কত গ্রাম্য ঘর-গেরস্থালি!
বালি এখন রোদের স্নিগ্ধ রশ্মিতে সোনালী লাগছে। অসীম মুগ্ধতায় কথা হারিয়ে ফেলল রক্তিম। এবং মিতুনও। এখন সে অনেকখানি, প্রায় তুলোর মতো নির্ভার নেচে বেড়াচ্ছিল। ওকে এখন দেখে বোঝার উপায় নেই যে, এই নদীর খুব কাছাকাছি, মাত্র কয়েক কিলোমিটারের ব্যবধানে সে তার শৈশব ও বাল্য ও কিশোরকাল কাটিয়ে গেছে। যেন এই প্রথম সে নদী দেখছে। আশ্চর্য! এত কাছাকাছি, তবু এদিকটা তেমন আসা হয়নি তো! যা-ও দু'একবার এসেছে স্কুল-কলেজের বন্ধুদের সাথে, কি বাবার সাথে – এই নদীর এত রূপ, এত সৌন্দর্য, এত ঐশ্বর্য আগে কখনো দেখেনি! হয় তখন দেখার চোখ ছিল না, নয়তো দেখার অনুভূতিটাই অপরিপক্ক ছিল। নাকি আজ সংগে রক্তিম আছে বলেই তার দর্শনযোগ্যতা এক বিশেষ মাত্রা পেয়ে গেছে? কি জানি! আনন্দে মরে যাচ্ছিল মিতুন। এরকম ভালো লাগা জীবনে কখনো আসেনি। আজ এলো।
মনে পড়লো, বিয়ের পর বাবার কাছে প্রথম যেদিন ওরা জোড়ে এসেছিল, বাবা ওকে আলাদা করে ডেকে নিয়ে জিগেস করেছিল, 'তুই সুখী হয়েছিস তো মা?'
মিতুন তখন লজ্জায় লাল হয়ে শুধু বলেছিল, 'জানিনা, যাও…'
বাবা হাসতে হাসতে বলেছিল, 'আমি জানি, য়্যু আর হ্যাপি!'
মিতুন অবাক, 'কী করে বুঝলে?'
বাবা বলেছিল, 'দেয়ার ইজ নো কসমেটিক্স ফর বিউটি লাইক হ্যাপিনেস!'
মিতুন মনে মনে বলল, এই নদীর ধারে আমার আজকের এই হ্যাপিনেসটা তুমি আর দেখতে পেলে না বাবা!
অনতিজোর বাতাস দিচ্ছিল। বাতাসের ঝাপটা গায়ে, চুলে, মাথায়, সর্বশরীরে। সেই বাতাসের মধ্যে যেন ওরা, মিতুন আর রক্তিম, নিজেদের সম্পূর্ণ সঁপে দিয়েছে। যে-যার মতো করে সুর্যাস্তের মনোরম শোভা নিজেদের মোবাইল-ক্যামেরায় ফ্রেমবন্দী করে রাখছে। সেলফি তুলছে। বালিময় ছুটোছুটি, দাপাদাপি, ফষ্টিনষ্টি, খুনসুটি। তারপর একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়ল দু'জনেই।
রক্তিম বলল, 'চল, নদীর তীর বরাবর ওদিকে একটা চক্কর মেরে আসি।'
- 'না বাবা!' দারুণ হাঁপাচ্ছিল মিতুন, 'আমি আর পারছি না! তুমি যাবে তো যাও…'
রক্তিম হাসল, 'এরই মধ্যে?'
মিতুন যেন কথাটা স্বীকার করে নিয়ে ফিক করে হেসে দিল, 'তুমি যাও না! আর শোনো, বেশি দেরি করবে না বলে দিলাম…অটোওয়ালাকে বেশিক্ষণ আটকে রাখা যাবে না!'
রক্তিম হালকাভাবে বলল, 'আর তুমি এখানে একা একা বসে থাকবে? এসে যদি দেখি কিডন্যাপড হয়ে গেছ?'
- 'আবার!' কপট রাগে ফোঁস করে উঠল মিতুন। ততক্ষণে রক্তিম চলে যাচ্ছে। মিতুন পেছন থেকে গলা চড়াল, 'তাড়াতাড়ি ফিরো কিন্তু…'
- 'ঠিক আছে।' ঘুরে হাত নেড়ে দিল রক্তিম, 'এনাফ টাইম আছে।'
মিতুন এখন ইচ্ছে করলে রক্তিমের চলে যাওয়াটা অনেকক্ষণ ধরে চেয়ে চেয়ে দেখতে পারে। যতদূরেই যাক রক্তিম, মিতুন ওকে ঠিক দৃষ্টির মধ্যে ধরে রাখতে পারবে। কিন্তু মিতুন উল্টোমুখ হয়ে বসে পড়ল। রক্তিমকে পেছনদিক থেকে দেখতে ওর একটুও ভালো লাগে না। কেমন যেন পরাজিত-পরাজিত পুরুষ মনে হয়।
বালির ওপর হাঁটু মুড়ে বসে চারপাশটা ভালো করে দেখে নিচ্ছিল মিতুন। সূর্য অস্তাচলে। ডান দিকে নদী বইছে নিঃশব্দে। বাঁ-দিকে উঁচু পাড় ঘেঁষে কিছু ঘন ঝোপঝাড়। জঙ্গল টাইপের। এতক্ষণ মিতুন খেয়াল করেনি। এখন হঠাৎই নজরে পড়ল। এবং আচমকা মিতুনের মনে হলো, এই জায়গাটা, এই ঝোপঝাড়-জঙ্গল তার অতি পরিচিত। বহুদিনের চেনা যেন। আগে কখনো ঠিক এই জায়গায় সে এসেছিল? কই, মনে পড়ছে না তো! তাহলে এই জঙ্গল, ঝোপঝাড় সে কোথায় দেখেছিল? স্বপ্নে? নাকি আগের জন্মে? ভাবতে ভাবতে কেমন সম্মোহিতের মতো হয়ে যাচ্ছিল মিতুন।
# # #
স্কুলের একদঙ্গল ছেলেমেয়ে নদীতীরে বড়দিনের পিকনিক করতে এসেছে। সংগে টিচার-ম্যামরাও। ছেলেরা সব বালিতে উইকেট পুঁতে ক্রিকেট পেটাচ্ছে। আর রেষারেষি করে আনাজ কুটতে বসেছে মেয়েরা। কেউ কেউ আবার বালির ওপর শতরঞ্জি বিছিয়ে গানের জলসা বসিয়েছে। এতসব হৈ-হল্লার মধ্যে মোম-মোম চেহারার ছোট্ট একটি মেয়ে একমনে বসে খুব উৎসাহের সংগে পেঁয়াজ কুচোচ্ছিল। আর বারবার পেঁয়াজের ঝাঁঝে সজল হয়ে যাওয়া চোখদুটো হাঁটুর কাছে ফ্রকটায় ঘষে মুছে নিচ্ছিল। তার দিকে কারোরই তেমন নজর নেই।
হঠাৎ মেয়েটি বাঁ-হাতের কড়ে আঙুলে একটু জ্বালা অনুভব করল। পেঁয়াজের ঝাঁঝে চোখে এমনিতে ঝাপসা দেখছিল। অসাবধানে বঁটিতে কখন আঙুলটাই কেটে ফেলেছে। ইসস্! কি রক্ত! কী হবে এখন? উঠে পড়ল মেয়েটা। কাউকে কিচ্ছুটি বলল না। বললে তো এখন সবাই হাসবে-টাসবে! হয়তো বলবে, এ মা! মেয়েটা তো কোনো কম্মের নয় রে! মেয়েটি আর একটুও দেরি না করে ডান হাতের মুঠোয় বাঁ-হাতের আহত কড়ে আঙুলটা চেপে ধরে ছুটল। পাশেই অনেক ঝোপঝাড় নিয়ে একটা ছোটখাটো জঙ্গল। সেখানে নিশ্চয়ই সেই গাছটা পাওয়া যাবে। একবার বাড়ির উঠোনে পড়ে গিয়ে মেয়েটির হাঁটু ছড়ে গিয়েছিল। ওর বাবা তখন লতার মতো খুব ছোট একধরণের গাছের পাতার রস বার করে ওর হাঁটুর ক্ষতটায় লাগিয়ে রক্ত বন্ধ করে দিয়েছিল। গাছের নামটা জানা হয়নি। দেখলে চিনতে পারবে। মেয়েটি নিচু হয়ে ঝোপের ভেতর সেই নাম-না-জানা আশ্চর্য গাছ খুঁজে খুঁজে বেড়াচ্ছিল। পাচ্ছিল না। আঙুলটা থেকে থেকে ভয়ানক যন্ত্রণা দিচ্ছে। দিক। ও কিছু না। আপাতত রক্তটা বন্ধ হয়ে যাক তো!
- 'এ্যাই মেয়েটা, ওখানে কী খুঁজছ?'
চমকে উঠল মেয়েটি। আর একটু হলেই ভিরমি খাচ্ছিল আর কি! ঝটিতি ঘুরে দুটো হাতই পেছনদিকে করে সোজা হয়ে দাঁড়াল। সামনে পনের-ষোলো বছরের দারুণ ফর্সা এক ছেলে। ধনুকের ছিলার মতো টানটান শরীর। সুন্দর পরিচ্ছন্ন মুখ। ছেলেটিকে ও চেনে। ওদের স্কুলেই বছরখানেক হল এ্যাডমিশন নিয়েছে। উঁচু ক্লাসে পড়ে।
মেয়েটি এগিয়ে এসে ঝাঁঝের সংগে বলল, 'মেয়েটা মেয়েটা বলছ কেন? আমি তো মিতুন!'
ছেলেটি বলল, 'তাই বুঝি? আমাদের স্কুলে পড়?'
- 'হ্যাঁ তো, তুমি জানো না?
- 'কোন ক্লাস?'
- 'ক্লাস সিক্স।'
- 'আ-চ্ছা! তো ওখানে কী করছিলে?'
- 'যা করলাম! তোমাকে বলতে হবে নাকি? তুমি এখানে এসেছ কেন?'
- 'আমি তো, মানে আমরা ওদিকটায় ক্রিকেট খেলছিলাম তো…আমাদের বলটা এদিকে চলে এসেছে, তাই খুঁজে বেড়াচ্ছি।'
- 'তাহলে খুঁজবে যাও…আমাকে জ্বালাচ্ছ কেন?'
ছেলেটি এবার হেসে ফেলল। জিভে চুকচুক করে বলল, 'আহা রে! খুব জ্বলছ বুঝি?'
তারপর হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলল, 'তুমি তখন থেকে পেছনদিকে হাত করে দাঁড়িয়ে আছ কেন শুনি? কী লুকিয়ে রেখেছ? আমাদের বল নয় তো?
রাগে অপমানে জ্বলে উঠল মিতুন। ছেলেটা ওকে চোর ভেবেছে নাকি? সাহস তো কম না! দু'টো হাতই সামনে এনে সটান ছেলেটার মুখের ওপর মেলে ধরল, 'কোথায় তোমাদের বল? চোর ভেবেছ নাকি? এই দ্যাখো…ভালো করে দ্যাখো…'
অতঃপর ছেলেটি যা দেখল ভয়ে আশংকায় ওর ফরসা মুখ সাদা হয়ে গেল একেবারে। বলল, 'ইস! এত রক্ত কেন? দেখি, দেখি…'
বলেই খপ করে ওর বাঁ হাত ধরল। মিতুন তো তখন ভয়ানক অপ্রস্তুত। হেনস্থার একশেয! কোনোরকমে মিয়োনো স্বরে বলল, 'কেটে গেছে!'
- 'দুষ্টু মেয়ে কোথাকার! কী করে কাটলো?'
- 'বঁটিতে…'
আর কিছু বলতে হল না। ছেলেটি হঠাৎ এক অদ্ভুত কান্ড করে বসল। মিতুনের রক্তাক্ত আঙুল মুখের মধ্যে নিয়ে চুষতে আরম্ভ করে দিল। প্রথমে রেগে গিয়ে বাধা দেবে ভেবেছিল মিতুন। পারল না। অপূর্ব এক অনাস্বাদিত প্রশান্তিতে সারাশরীর অবশ হয়ে আসছিল ওর। চুষছে, চুষছে – ক্রমাগত চুষেই চলেছে ছেলেটা। যাবতীয় ব্যথা-যন্ত্রণাও যেন রক্তের সংগে শুষে নেবে। কতক্ষণ ঘোরের মধ্যে মিতুন কেবল চোখ বুজেই রইল। একসময় ছেলেটি বলল, 'যাক, রক্ত বন্ধ হয়ে গেছে! যাও, নদীর জলে হাতটা ধুয়ে এসো এবার।'
বলেই চলে যাচ্ছিল। পেছন থেকে ডাকল মিতুন, 'শোনো…'
- 'কী?' ঘুরে দাঁড়াল ছেলেটি।
মিতুন মিনতির সুরে বলল, 'আমার যে হাত কেটে গেছিল, কাউক্কে বলবে না কিন্তু!'
- 'কেন? বললে?'
- 'বাহ্! তুমি বলে দেবে?'
- 'না। বলবো না। বললে কী হবে, তাই জানতে চাইছি!'
- 'কী আবার! ওরা সব হাসাহাসি করবে, দুয়ো দেবে। আমার লজ্জা হবে।'
বলে মিতুন সত্যি সত্যি কেমন লজ্জা পেয়ে গেল। ছেলেটি এগিয়ে এসে আদরের ভঙ্গিতে ওর মাথার চুল এলোমেলো করে দিল। বলল, 'ঠিক আছে। বলবো না। ওকে?'
বলে আর দাঁড়াল না।
এরপরও বছর দেড়েক সেই ছেলেটির সংগে স্কুলে মিতুনের নিয়মিত দেখা হয়েছে। কোনো কথা-টথা না। কেবল দেখা। সেইসময় মিতুন একদিনও স্কুল কামাই করেনি। তারপর সেবার গরমের ছুটি পড়ে গেল। টানা একমাস। সেই দীর্ঘ ছুটি শেষ হতে মিতুন যেদিন প্রথম স্কুলে এল, ছেলেটিকে আর দেখতে পেল না। পরের দিন – তারপরের দিন – কোনোদিনও না। তবু তার ব্যকুল চোখদুটি নিভৃতে কেবলই খুঁজে বেড়াতো ছেলেটিকে। পরে জেনেছিল, ওরা চলে গেছে। ওর বাবা এখানকার কোর্টে মুন্সেফ ছিলেন কিনা। বদলির চাকরি।
আজ এতদিন বাদে একই নদীর পাশে, একই জঙ্গলের কাছাকাছি বসে মিতুন ছেলেটিকে মনে করল। নিজের বাঁ-হাতের কড়ে আঙুলটা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখল। ক্ষতের কোনো নিশানাই আর নেই। কবে মিলিয়ে গেছে! তবু সমস্ত মমতা ঢেলে দিয়ে সে আঙুলটায় হাত বুলোলো। আদর করল। কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও ছেলেটির নাম মনে করতে পারল না। কী যেন নাম! শুনলেই হাজার জলতরঙ্গের বাজনার মতো বুকের মধ্যে টুংটাং শব্দ তোলে! একবারের জন্যেই কি মনে পড়বেনা? একটা নাম – দুটো, তিনটে, কি বড়জোর চারটে অক্ষরের ব্যাপার – কেন যে মনে থাকে না!
# # #
- 'কী হলো আবার আঙুলে?'
সম্বিত পেয়ে উঠে দাঁড়াল মিতুন। বেড়ানো শেষ করে রক্তিম কখন পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে, খেয়াল করেনি। আরও খেয়াল করেনি, কখন সন্ধে ঘনিয়েছে। আবছা অন্ধকার চারিদিকে। মিতুন উঠে পড়ে হাত দিয়ে শাড়ি ঝাড়তে ঝাড়তে বলল, 'কিছু না। চলো…'
- 'দাঁড়াও দাঁড়াও।' রক্তিম ওকে আটকালো, 'কিছু তো একটা হয়েছে ঠিকই…দেখি তো তোমার হাত…'
মিতুনের বাঁ-হাত হাতের মধ্যে নিয়ে কড়ে আঙুলটা খানিকক্ষণ ডাক্তারি কায়দায় টিপেটুপে দেখল রক্তিম। তারপর মুখের কাছে আঙুলটা নিয়ে ঠোঁট ছুঁচলো করে কৌতুকের গলায় বলল, 'একটা কিস করবো এখানে? ওনলি ওয়ান…?'
- 'না-আ-আ-আ!' ঝটকা মেরে হাত ছাড়িয়ে অস্বাভাবিক জোরে চিৎকার করে উঠল মিতুন। অনেকটা আর্তনাদের মতো শোনালো।
এবং সেই আর্তনাদের রেশ থামার আগেই, সেই বালির ওপর দাঁড়িয়ে প্রায়ান্ধকারে পাগলের মতো প্রচন্ড শব্দে চরাচর কাঁপিয়ে হা-হা হেসে উঠল রক্তিম।
নিজের ভুল বুঝতে পেরে মিতুন এখন ভয়ানক বিব্রত। ছিঃ! অমন চিৎকার করে ওঠার কী দরকার ছিল? মিতুন অনুতপ্ত, লজ্জিত। কিন্তু তবু তার মধ্যে কোনো অপরাধবোধ নেই কেন? কেন নেই? মিতুন ভাবলো।
অবশেষে একসময় হাসির দমক কমে এলে রক্তিম বলল, 'তুমি নদীর কাছে বড় হলে্ও, তোমার থেকেও নদীর চরিত্রকে আমি বেশি চিনি মিতুন…অনেক বেশি! নদীর কাছে তুমি কিছুই লুকোতে পারবে না, গোপন করতে পারবেনা। সে তোমায় কনফেস করিয়েই ছাড়বে…তুমি না চাইলেও! এই তো, ওদিকে গিয়ে আমিও অনেক কিছুই কনফেস করে এলাম। এখন একেবারে ফ্রেশ। আমি জানি, তুমিও কনফেস করেছ। মানে, করতে বাধ্য হয়েছ!...'
তারপর মিতুনের পিঠে হাত রেখে বলল, 'নাও আর মন খারাপ করতে হবে না…চলো, এবার যাওয়া যাক!'
অতঃপর যন্ত্রচালিতের মতো রক্তিমের হাত ধরে মিতুন এগোতে লাগল। নিশ্চুপ এবং পাশাপাশি। পাশাপাশি – অথচ দু'জনের মধ্যে একনদী ব্যবধান। এবং এইভাবে ওরা অপেক্ষমান অটোরিকশা অবধি পৌঁছে গেল।
অটো রিকশায় বসে মিতুন রক্তিমের বাহুটা আঁকড়ে ধরে থেকে নিমজ্জিত গলায় বলল, 'আমার কিন্তু ভয় করছে!'
রক্তিম খুব দৃঢ় গলায় বলল, 'ভয় কি! আমি তো আছি।'
মিতুন জানতো, তার ভয় দূর করার জন্যে রক্তিম এরকম কথাই বলবে। এটাই নিয়ম। এইধরণের কথা বলার সময় পৃথিবীর সব পুরুষের গলা একইরকম শোনায়। তবু পরম নির্ভরতায় মিতুন রক্তিমের কাঁধে মাথা কাত করল।
___________________________
মুক্তি দাশ
১৩৫, অঘোর সরণী
রাজপুর
কলকাতা-৭০০১৪৯
মোবাইল/হোয়াটসঅ্যাপ : ৯৮৩০৪১৩১২২