ছোটগল্প।। ফিরে আসা।। শংকর লাল সরকার
সকালে উঠোন ঝাঁড় দিতে দিতে মাজায় হাত দিয়ে জামগাছটার ছায়ায় বসে পড়ল শিবানী। শরীর আর চলছে না। মনের ক্লান্তি শরীরে ভর করেছে। তার কি দোষ ছিল? ভগবান তাকে সব সুখ দিয়েও কেড়ে নিল। ভোম্বলের টালির চালের ঘরে সুখের অভাব ছিল না। ট্রেনে হকারি করে ভোম্বল যা কামিয়ে আনত তাতেই ওদের সংসার চলত। ভোম্বলের শক্ত সমর্থ চেহারাটা ছিল দেখবার মতো। আর তার চাহনীতে এমন জাদু ছিল যা দেখলেই শিবানীর বুকটা কেঁপে উঠত। পুরুষালি হাতদুটো কত সহজে ওর উথালপাতাল শরীরটাকে শান্ত করত। ভোম্বলের নিশ্বাস এখনও গরম হয় কিন্তু তা যেন শুধুই হাহাকার বয়ে আনে। এসব নিয়ে শিবানী কিভাবে বাকি জীবন বেঁচে থাকবে?
চলন্ত ট্রেন থেকে নামতে গিয়ে ভোম্বল ছিটকে পড়ল। লাইনের বাইরের দিকে পড়েছিল বলে প্রাণে বেঁচে গেল। যমে মানুষে টানাটানির পর মাসখানেক বাদে যখন হাসপাতাল থেকে ফিরল তখন ওর চেহারা অর্ধেক। যেন একটা বাজ পড়া নারকেল গাছ। লাঠিতে ভর দিয়ে কোনমতে চলাফেরা করতে পারে।
শিবানীর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। শ্যাল-শকুনের দৃষ্টি এড়িয়ে শিবানীকেই বেরতে হল উপার্জনের আশায়। কয়েকটা বাড়িতে ঠিকেঝিএর কাজ। মাস গেলে থোক কতগুলো টাকা, অভাবের সংসারে তাই বা কম কী? চোখের সামনে তরতাজা যুবতী মেয়েকে পেলে অনেক পুরুষেরই পিরীতির ইচ্ছা জেগে উঠে। একবাড়িতে দাদাবাবু ভুল বুঝল। সামান্য কটা টাকায় কিনে নিতে চাইল ওকে। এত সস্তা শিবানী! সেই বাড়ির কাজ ছাড়তে হল। বাড়ি ফিরে সেদিন আছাড় খেয়ে পড়েছিল ভোম্বলের উপরে। ওর বুকে নাক ঘষল, চুমায় চুমায় ভরিয়ে দিল। কিন্তু ওর শরীর জাগল না। একসময় হেরে গিয়ে হাঁফিয়ে উঠে ভোম্বল বলল আমাকে ছেড়ে দে বউ, আমি এখন বাজ পড়া গাছ। আমি আর তোকে সুখ দিতে পারব না। সে কথা শুনে শিবানীর বুকটা হাহাকার করে উঠেছিল। সব মেয়েই যা চায় সেও তার বেশি কিছু চায়নি। কিন্তু ভগবান তাতেও বাধ সেধেছেন।
আকাশপাতাল কিএত ভাবছিস? দীপেনের গলার আওয়াজে চমকে তাকাল শিবানী। দীপেন প্রায় প্রতিদিনই আসে। ও আসলে দুঃখের সংসারে যেন আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। শিবানীর চোখমুখ তখন খুশিতে ঝলমল করে উঠে। দীপেন ঘরের ভিতরে এসে ভোম্বলের পাশে বসল। প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে বলল, নাও ধরাও। বিষাদভরা দৃষ্টিতে ভোম্বল তাকাল দীপেনের দিকে। সংকোচের সঙ্গে সিগারেটা হাতে নিয়ে বলল কদিন বড়ো অভাব চলছে, ঘরে চাল বাড়ন্ত। কটা টাকা যদি ধার দিতে পার, আমি ঠিক শোধ দিয়ে দেব। দীপেন সদ্য পঞ্চায়েতের সদশ্য হয়েছে দুপাঁচশ টাকা তার কাছে কিছু নয়। একটা দুশো টাকার নোট হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল শোধ দেবার কথা পরে, আর লাগলে বোল।
ভোম্বল তাকিয়ে দেখে ইতিমধ্যে কলতলা থেকে স্নান সেরে এসেছে শিবানী। দরজার মুখে দীপেনকে দেখে শিবানীর দু'চোখে আলো জ্বলে উঠে। ভোম্বল চেনে ওই দৃষ্টি। বিয়ের পর প্রথম প্রথম ভোম্বল শিবানীর চোখে প্রায়ই সেই দৃষ্টি দেখতে পেত। বিষাদভরা চোখে ভোম্বল ওকে দেখল। এলোমেলো চিন্তাগুলো ওর উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল ও। বউটার আদিখ্যেতায় তার গা জ্বলে। নিজের অক্ষমতার জন্য হাত কামড়ায় ভোম্বল। দুশো টাকার নোটটা তখনও ওর হাতে ধরা।
বিরক্তিতে গা রিরি করে উঠে শিবানীর। বিছানায় শুয়ে সারাদিন ওর উপরে খরদৃষ্টি রাখে ভোম্বল। জীবনটা দিনে দিনে ওর কাছে অসহ্য হয়ে উঠছে। একদিন শিবানীর ভালো লাগত ভোম্বলকে।
এখন ওর দিকে তাকালে ওর মাথায় বিষপোকা কামড়ে দেয়। ফুস করে একটা শ্বাস ছেড়ে নিজের মন্দভাগ্যকে গালমন্দ করে। মরতে কেন যে ভাব ভালোবাসায় মজেছিল। দিনে দিনে মরণফাঁসের মতো গলায় চেপে বসেছে।
ভোম্বলকে আর সহ্য করতে পারছে না। হয়তো দীপেন এজন্য অনেকটা দায়ী। দীপেনকে দেখলেই ওর বুকের ভিতরে নিঃশব্দে একটা আলোড়ন উঠে শিবানী সেটাকে কিছুতেই প্রতিরোধ করতে পারেনা। জীবনের প্রতি শিবানীর বড়ো লোভ হয়।
সরস্বতী পুজো উপলক্ষ্যে কলেজের মাঠে বিরাট মেলা বসে। কলেজের ছেলে মেয়েরা বলে ভ্যালেন্টাইনডের মেলা। সেই মেলায় শিবানী প্রথম দেখেছিল ভোম্বলকে। এখনও প্রতিবছর ও মেলাতে যায়। গত দুবছর ভোম্বল আর যেতে পারেনা। দীপেন ওর সঙ্গী হয়েছে। দীপেনের মধ্যেই শিবানী ভোম্বলের পৌরুষটাকে খুঁজে পায়। মেলা থেকে ফেরবার সময়ে আচমকা বৃষ্টি পড়তে শুরু করল। শীতকালের বর্ষা। দীপেন বলেছিল শিবানী জলে ভিজিস না শরীর খারাপ করবে। ওরা একটা ফাঁকা চালাঘরে আশ্রয় নিয়েছিল। মাকড়সার জালে আটকা পড়া মাছির মতো শিবানী হারিয়ে গিয়েছিল দীপেনের কঠিন আলিঙ্গনে। দীপেন যখন ডাকাতের মতো ওর সবকিছু কেড়ে নিচ্ছিল তখনও শিবানী দূর থেকে ভেসে আসা মেলার কোলাহল শুনতে পাচ্ছিল। ওই মেলাতেই একদিন শিবানী ভোম্বলে মজেছিল। বহুদিন উপবাসের পর পুরুষের স্পর্শে গলতে গলতেই শিবানীর বুকটা হাহাকার করে উঠেছিল। নিজেকে কেমন যেন হীন, বিশ্বাসঘাতক মনে হল শিবানীর। ফুঁপিয়ে উঠে দীপেনকে বলল আমার অভাবের সুযোগ নিয়ে তুই আমার সবকিছু কেড়ে নিয়ে ছিবড়ে করে ছেড়ে দিলি। চতুর হেসে দীপেন বলল তোকে আমি ছাড়লাম কোথায়, তোকে তো আরও গভীরভাবে আঁকড়ে ধরলাম। তোকে নিজের করে না পেলে যে আমার শান্তি নেই।
সেদিনের ঘটনার পর থেকেই শিবানী নিজের ভিতরে আর একটা প্রাণের অস্তিত্ব টের পেতে থাকে। ভোম্বলের সামনে দাঁড়াতেই আজকাল ওর লজ্জা করে যার সঙ্গে দু'বছর যাবৎ কোন শারীরিক সম্পর্ক হয়নি তাকে কী বলবে?
দীপেন ওকে বলে তোর কী নিজের একটা জীবন নেই, চিরকাল একটা পঙ্গু লোককে কেন বয়ে বেড়াবি? ওকে স্বান্তনা দেয় কোন চিন্তা নেই। শক্ত করে শিবানীর হাত ধরে বলে তোর পথের কাঁটা আমি উবড়ে ফেলব। আমি ওকে পুড়িয়ে ছাই করে দেব। তারপরেই পকেট থেকে দেশলাই বের করে ফস্ করে একটা কাঠি জ্বালিয়ে শুকনো পাতার উপরে ফেলে বলে এইভাবে ও পুড়ে যাবে। আজ ঠিক ভোর রাত্রেই দরজায় শিকল তুলে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসবে।
জ্বলন্ত পাতাগুলোর দিকে তাকিয়ে আতঙ্কে থরথর করে কেঁপে উঠে শিবানী। ঘরে ফিরে দেখে ভোম্বল দাওয়ার উপরে বসে আছে। সন্ধ্যা হতে চলল এখনও বাইরে বসে আছ কেন?
তোর জন্যে। ভোম্বলের চোখের কোনে একটু হাসি। শুকনো খরখরে হাত দিয়ে ভোম্বল হঠাৎ শিবানীর হাতটা চেপে ধরে। গভীর স্বরে বলে আমি মরদ হয়ে বাড়িতে বসে আছি আর দুটো ভাতের জন্য তোকে উদয়স্ত পরিশ্রম করতে হচ্ছে। অন্যদিন হলে শিবানী ঝাঁঝিয়ে উঠত। আজ কিন্তু ভোম্বলের কথা ওর ভালো লাগল। গভীর সংবেদনশীল চোখে তাকাল ভোম্বলের দিকে। ভিতরে ভিতরে একটা অনুশোচনায় সে জ্বলছে। দীপেনকে ওই আস্কারা দিয়েছে। যে পাপ ওর শরীরে বাড়ছে তার থেকে কিকরে নিস্কৃতি পাবে। ডুকরে কেঁদে উঠে শিবানী। ভোম্বল জিজ্ঞাসা করে কাঁদছিস কেন? মায়ের জন্য মন খারাপ করছে কতদিন দেখিনি। ডাহা মিথ্যা বলল শিবানী।
তাহলে একবার ঘুরে আয়।
না আমি একা নয়, তুইও সঙ্গে যাবি। ভোম্বলের মলিন মুখের ভিতরে যেন নিজের আশ্রয়ভূমি খুজে পায় শিবানী।
অন্ধকারেই রিক্সা ডেকে আনে। ভোম্বল মৃদু আপত্তি করেছিল। শিবানী বলল মায়ের কাছে যাব তাতে আবার লজ্জা কী। দুজনকে একসঙ্গে দেখে মা খুব খুশি হবে। রাতটুকুর জন্য মায়ের বাড়ি গিয়ে যেন নিজের কৈশোর ফিরে পেল শিবানী। খাওয়া দাওয়ার পর সেদিন রাত্রে ভোম্বলকে বুকের উপরে টেনে নিয়েছিল। ভালোবাসার ঘাম একজনের শরীর থেকে আর একজনের শরীরে লাগল। ভোররাত্রে জানলার সামনে দাড়িয়ে দূর থেকে একাএকা আগুনের লেলিহান শিখা দেখল শিবানী। ওর মন ডুকরে কেঁদে উঠে। দীপেন সময়মতো কাজ হাসিল করে ফিরে গেছে।
সকালে নিজের বাড়ি ফিরে দেখল ওদের জীর্ণ কুড়েঘরটা নিভন্ত চিতার মতো লাল হয়ে আছে। চারদিকে পোড়া ছাই। ওদের আসার খবর পেয়েই দীপেন সাইকেলে করে হাজির। ভোম্বলকে লাঠিতে ভর দিয়ে দাড়িয়ে থাকতে দেখে ভীষন অবাক হল। মুখ ফসকে কিছু একটা বলতে গিয়েও চুপ করে গেল।
দীপেনকে সাইকেলে করে আসতে দেখেই শিবানী ওর দিকে পিছন ফিরে তাকিয়ে রইল জামগাছটার দিকে। দীপেন গিয়ে ওর মুখোমুখি দাড়াল, বলল চেহারাটা তো বেশ খোলতাই হয়েছে। তা শরীরটা তোর, কিন্তু পেটেরটা আমার! ওর কথা শেষ হবার আগেই শিবানী ঠাস করে ওকে একটা চড় কষাল। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল অন্যের বউ এর সঙ্গে কিভাবে কথা বলতে হয় জানিস না। তোর মা তোকে এই পেটেই ধরেছিল তাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করগে পেটে বাচ্ছা হলে তা কার হয়?
অপমানে মুখ কালো করে সরে গেল দীপেন। শিবানী ধীর পায়ে ভোম্বলের দিকে এগিয়ে গেল। বলল ছায়ায় চল আমাদের ঘর পুড়লেও মন পোড়েনি। ভোম্বল পলকহীন চোখে তাকিয়ে রইল শিবানীর দিকে।
***
শংকর লাল সরকার
8637852643