গল্প ।। পলাশ ।। চন্দন চক্রবর্তী
মাঘের শেষ । কুয়াশার চাদর মুড়ে ঘুমিয়ে থাকা অযোধ্যা পাহাড়ে ভোর হল । কাছের জঙ্গলে বন মোরগের ডেকে উঠল । আঁকা বাঁকা পায়ে চলা পথ পাহাড়ের ঢাল বেয়ে একটু একটু জাগছে । মিনিট পাঁচ হাঁটার পর ওই দূরে ফুলমনিদের গ্রাম এখন স্পষ্ট । সার দেওয়া ছোট ছোট ঘরগুলো যেন শিল্পীর ক্যানভাসে আঁকা ।
ফুলমনি আর ঘন্টা খানেক পরেই আসবে । রান্না করে ঘর গুছিয়ে রেখে যাবে । বিকেলে আমি কাজ থেকে ফিরলে আমাকে চা দিয়ে ফিরে আসে ।
ফুলমনি সদ্য যৌবনা । তার চলনে মাতাল ছন্দ,হাসিতে উচ্ছলতা, দৃষ্টিতে কোমলতা । যেন কালো কষ্টি পাথরে খোদাই করা বনদেবী ! তার রূপ দেখে যে কোন পুরুষের নিজেকে সামলে রাখা সাধ্যাতীত ।
আমি শহুরে মানুষ । জঙ্গলের গাছ গাছড়া,ফুল ফল,পাখি,কত আর জানি । তবু যেটুকু জানি, না জানার ভান করি । ওর তাতেই আনন্দ । ছুটির দিন আমাকে জঙ্গল দেখাতে নিয়ে যাবে । আমাকে এটা ওটা দেখিয়ে ওর মুখে অপার আনন্দের রেখা ফোটে । আমি ওকে দু চোখ ভরে দেখি ।
আগেই বলে রেখেছে পলাশ ফুটলে আমাকে দেখিয়ে আনবে ।
ঘন্টা খানেক ঘুরে আস্তানায় ফিরলাম । কিন্তু ঘরের দরজা বন্ধ ! তবে কি ফুলমনি আসে নি ! এমন তো হয় না ! তবে কি অসুস্থ হল;না কোন বিপদ !
ঘর খুলে বসে ভাবছি কি হতে পারে ।
বছর দশ এর কোন বাচ্চা এসে খবর দিয়ে গেল ফুলমনি আজ আসবে না । ওর স্বামীকে কাল রাতে বুনো শুয়োরে ঘায়েল করেছে । স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ভর্তি ।
কাছেই স্বাস্থ্য কেন্দ্র । গিয়ে দেখি বেডে শুয়ে ওর স্বামী । বা পায়ে ব্যান্ডেজ বাঁধা । ফুলমনি পাশে দাঁড়িয়ে । চোখ মুখ বসে গেছে । রাতে ঘুম না হওয়ার ফল । কথা বলে যা বুঝলাম ; রাতে ওর স্বামী পাশের গ্রামে থেকে মহুয়া খেয়ে অনেক রাতে মাতাল হয়ে ফিরছিল । আচমকা বেরিয়ে এসে দাঁতাল শুয়োরে ঘায়েল করে গেছে । সঙ্গে যে ছিল সেই ওর স্বামীকে ঘাড়ে করে ঘরে দিয়ে গেছে ।
আঘাত গুরুতর । ডাক্তার বলছে রুগীকে পুরুলিয়া সদরে নিতে হবে । কিন্তু নিয়ে যাওয়ার সমস্যা । অফিসের জিপটা চেয়ে পাঠালাম ।
পুরুলিয়া সদর হাসপাতালে রুগী ভর্তি করে ফিরে আসবো । ফুলমনি থেকে গেল । ওকে অনেক বোঝান হল ! ও অবিচল রইল । অগত্যা কিছু টাকা দিয়ে ফিরে এলাম ।
দিন দশ বাদে ছুটি হলে জিপ পাঠিয়ে ওদের আনানোর ব্যবস্থা করলাম ।
আজ সকালে ফুলমনি কাজে এসেছে । এতগুলো দিন কি ভাবে কোথায় কাটলো,কি খেলো,সে ওই জানে । অথচ ওকে দেখে কে বুঝবে ! সেই অবিচল হাসি, সেই চাহনি ।
কালের স্রোতে দিন গড়িয়ে এখন ভরা ফাল্গুন । ওর উৎসাহে ছুটির দিন দেখে চললাম পলাশের শোভা দেখতে ।
একজন শহুরে মানুষের পাশাপাশি একজন আদিম মানবী হেঁটে চলেছে উত্তাল আনন্দে অরণ্য পথে প্রকৃতির বসন্ত আয়োজন অবলোকন করতে ।
অরণ্য পথে পায়ের তলায় ঝরা পাতা ভাঙার মরমর ধ্বনি । নর নারী মন বনে বসন্তের মৃদু মন্দ বাতাসের দোলাচল । সে কি শুধু পলাশের আগুন ছড়ানো শোভায় স্থিতু হবে ! আকাশে বাতাসে বসন্তের যে আয়োজন তা দুটি হৃদয়ে রিনি ঝিনি লহরী তুলবে সে আর বেশি কি !
বাবু ওই যে পলাশ ।
ফুলমনির মধু মাখা কন্ঠস্বরে যে কম্পন তা হৃদয়ে অনুরণিত হল । কর্ন কুহ্বরে বারংবার ধ্বনিত হল,বাবু ওই যে পলাশ ! ওই যে পলাশ ।
পলাশের রক্তিম আভা তখন দুটি হৃদয়ে সঞ্চারিত ।
ফুলমনির চোখে পূর্ন আভাস পেয়ে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারিনি । ওর গালে আমার জীবনের প্রথম চুম্বন এঁকে দিলাম ।