Click the image to explore all Offers

গল্প।। পর্ণমোচী ।। বিশ্বনাথ প্রামাণিক



 

 ১

‘’বন্ধুর বাড়ি আমার বাড়ি

মধ্যে ক্ষীর নদী

উইড়া যাইবার সাধ ছিল

পাঙখা দেয় নাই বিধি’’’   ---মুর্শিদি গান

 

সকাল হতে না হতেই হঠাৎ দরোজায় বারবার করাঘাতে চমকে ওঠে হিরন।

- শুনছেন? এটা কি …

  ভুত দেখার মতো চমকে উঠে থমকে যায় সে- কে ও!

সহসা বাকরুদ্ধ হয়ে পলকহীন নেত্রে চেয়ে থাকে হিরন্ময়।

### 

বসন্তের আগমনে গাছের হলুদ হয়ে যাওয়া পাতাগুলো বৃন্তচ্যুত হয়ে ঝরে পড়ছে। তারপর বাতাসের পাখায় ভর করে ভাসতে ভাসতে, পাক খেতে খেতে মিশে যাচ্ছে মাটির হিমেল বিছানায়। পুরানো মায়া কাটিয়ে নতুন নতুন পাতা দিয়ে নতুন জীবন শুরু করার স্বপ্নে সে তখন বিভোর। হিরন অবাক হয়ে এই সময় পর্ণমোচীর ঝরে যাওয়া পাতার ঘূর্ণন দেখতে থাকে।   

        সে অন্যদের মতো গুছিয়ে কথা বলতে পারে না। হঠাৎ করে বন্ধু-বান্ধব আত্মীয়-স্বজনদের মাঝে ঢুকে পড়লে নিজেকে কেমন অবাঞ্ছিত বলে মনে করে। অকারনে দাঁত বের করে হেসে থাকে। দেখে কেউ কেউ অবঞ্জা করে, কেউ বা বিরক্ত হয়। শুধু ভাবনার জগতে তার বিচরণ। এখানে সে তার নিজের জগতকে ছুঁতে পারে। সমাজে সে নাকি বড় বেমানান।    

   তার এই নিঃসঙ্গ জীবন থেকে মুক্তির লালসা, একদিন তাকে টেনে নিয়ে গিয়ে ছিল সেই কৃষ্ণার কাছে- যে তার এই একাকী জীবনে হঠাৎ শুক তারার মতো জ্বলে উঠেছিল। তাদের কলেজের সবথেকে চপল মেয়েটি। শ্যামাঙ্গী, শীষালো নাকের পাতলা ছিপছিপে গড়নের অষ্টাদশী মেয়েটি যখন হাসিতে গড়িয়ে পড়ত, অবাক হয়ে চেয়ে থাকত সে।  

আজও চোখ বুঝলে সে যেন স্পষ্ট দেখতে পায়, সে যেন তারই পাশে হেঁটে চলেছে সমান তালে, কথার ফুলঝুরি উড়িয়ে। যে তার সহানুভুতি, স্নেহ, প্রেম দিয়ে তাকে আগলে রেখেছিল। অল্প দু’একজন বন্ধুর মধ্যে সেই ছিল তার সবচেয়ে আপনার। স্কুলের গণ্ডি পার হয়ে প্রথম কলেজে ভর্তি হয়ে দিকভ্রান্ত নাবিকের মতো খেই হারিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে যে তার হাত ধরেছিল। যাকে নিয়ে সে সুখস্বপ্নে রাতের পর রাত হারিয়ে গিয়েছিল, তাকে সে কেমন করে ভুলবে! কেমন করে ভুলবে সেই মায়াবি চোখ, সেই প্রথম বন্ধু সম্ভাষণ।

   

সে সব কতদিন আগের কথা।  

      চিরকালের উদাসী হীরু মাঝে মাঝে তাদের একতলা বাড়ির খোলা ছাদে গিয়ে আপন মনে পায়চারি করতে করতে মেঘেদের সঙ্গে কথা বলে।

 তার মনে হয় যেন আকাশটাও সমানতালে তার সঙ্গে লুকোচুরি খেলায় মেতে উঠেছে। কালো, ধূসর, নীলাভ মেঘগুলো আপন খেয়ালে ভেসে চলেছে। জানালার সামনে এসে দাঁড়ায় হিরণ। মেঘেদের এত ব্যস্ততা কিসের! অলকানন্দার আকাশে-বাতাসে বিরহী যক্ষের প্রিয়াকে ওরা আজও নাকি খুঁজে চলেছে! অদ্ভুত ওদের অধ্যাবসায়, ওরা থামতে জানে না, তাই বোধ হয় ওদের থামা নেই

 সেও কি তবে ঐ বিরহী যক্ষের মতো নির্বাসিত! সমাজ-সংসার, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন থেকে সে কি সত্যিই পালিয়ে বেড়াচ্ছে!    

 আত্মীয়-স্বজন! তার আর আছেটা কে? বাবার কথা তার ভালো মনে পড়ে না। আর মা- যিনি সুখে দুঃখে বন্ধুর মতো সব সময় তাদের দু’ভাই বোনকে আগলে রেখেছিলেন, তাও তো আজ কত বছর হল, তিনি এ পারের মায়া ছেড়ে বড় নিশ্চিন্তে ওপারে ঘুমাচ্ছেন। শুধু তার চোখে ঘুম নেই। যাক ভালই হয়েছে। কৃষ্ণাকে তিনি যে বড় ভালোবাসতেন। বড় ভরসা করতেন। হয়ত তাকে নিয়ে স্বপ্নও দেখেছিলেন।   

 আর থাকবার মধ্যে ছিল এক বোন। সেও এদেশের মায়া ছেড়ে সুদূর আমেরিকা প্রবাসী। ভগ্নিপতি আই টি সেক্টরের বড়ো বাবু, তাকে তো যেতেই হবে। সেবার ভালো এক সম্বন্ধে এল। মা আর না করতে পারেনি। যেখানে যা কিছু ছিল জোগাড় করে, বাবার পি এফ এর জমানো টাকা দিয়ে বোনকে বিয়ে দিয়ে হিরণময় এখন নিশ্চিন্ত। যাক বোনটাকে নিয়ে আর অন্তত ভাবনা নেই। ওরা সুখী হোক।

  শুধু সে…

না, এজন্য কাউকেই সে দোষ দেয় না। আফসোসও করে না। চাকরির চেষ্টা সে যে করেনি, তা নয়। বরাবরই পড়াশোনায় ভালো ইংরেজি অনার্সের ছাত্র হিরণময় আপন মনে হেসে উঠে। একসময় তার মনে হতো দশটা পাঁচটার চাকরি, বউ বাচ্চা-সব যেন কেমন বাঁধা ধরা নিয়মে চলে।

  জীবনে বৈচিত্র্য কই!   একদিন সে এই বৈচিত্র্যের টানে ভাসতে ভাসতে খুঁজে পায় তারি মত একজনকে। যাকে নিয়ে জীবনের সব দিনগুলো কাটাতে পারত, যাকে নিয়ে হয়ত রঙিন স্বপ্নে ভেসে বেড়াতে বেড়াতে হারিয়ে যেত তার প্রথম বসন্তের দিন গুলিতে…… রোজ এ সময় রোমাঞ্চিত, শিহরিত হিরন মেঘেদের দেশে তাকে খুঁজে বেড়ায়, সে আজ কোথায়! জীবনের নৌকায় ভাসতে ভাসতে সে সব মেনে নিতে শিখে গেছে যে।  

 

 

   তখন সবে দুপুরের সূর্য পশ্চিমে হেলতে শুরু করেছে। আর তারি আলো এসে পড়েছে ওদের উঠানে। হালকা শীতের আমেজ ছড়িয়ে আছে বাতাসের গায়ে। পড়ার ঘরে বিছানার উপর গায়ে একটা চাদর জড়িয়ে বাবু হয়ে বসে একমনে শেক্সপীয়ারের ‘ম্যাকবেথ’ পড়ছে হীরু। তার মা  রান্নাঘরে চা বানাতে বানাতে সহসা সাইকেলের ক্রিং ক্রিং আওয়াজে মুখ তুলে বাইরে তাকিয়ে দেখেন মাঝবয়সি রতন হাতে এক গোছা চিঠির তাড়া বাছতে বাছতে বলে- চিঠি আছে। রেজিস্টি চিঠি…  

 রান্না ঘর থেকে উঁকি দিয়ে সুশীলা জিজ্ঞাসা করেন- কার বাবা?

-হীরুর নামে, সই করতে হবে।    

  মা ডাক দেন- হীরু এদিকে একবার আয় তো বাবা, দেখ তো তোর একটা কি চিঠি এসেছে।

-আসছি মা। বইটা মুড়ে রেখে হীরু ক্ষিপ্রপদে ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে আসে

 -কই কি চিঠি, দেখি---

-ঐতো, ওখানে যা, দেখ রতন দাঁড়িয়ে আছে।

- কি চিঠি গো রতনদা?

- রেজিস্ট্রি চিঠি। এই এইখানে আগে একটা সই করো।

-রতন একটু বস বাবা, চা করেছি একটু খেয়ে যেও।   

-না, মাসিমা আজ নয়, অন্য একদিন এসে খাব। একগাদা চিঠি সব বিলতে বিলতে সন্ধ্যে হয়ে যাবে। তারপর হীরুর দিকে চেয়ে বলে- নাও নাও এখানে একটা সই করে দাও।

সুশীলা আর আপত্তি করেন না। ওভেনে বসানো সসপ্যানের ফুটন্ত জলে  চা ফেলে দিয়ে নাড়তে নাড়তে রান্না ঘরের জানালা দিয়ে একদৃষ্টে ওদের দিকে চেয়ে থাকে।

রতন পাকা লোক। খাতার নির্দিষ্ট জায়গায় সই করিয়ে, চিঠি দিয়ে, সাইকেলের বেলে ঠুং করে একটা ঘন্টা বাজিয়ে নিমিষের মধ্যে উধাও হয়ে যায়।     

হিরণময় চিঠির খামটা বাম হাতে ধরে ডান হাতের আঙুল দিয়ে তার মুখটা কাটতে কাটতে ঘরে এসে ঢোকে। মা পেয়ালাতে দু’কাপ চা হাতে নিয়ে বারান্দায় উঠতে উঠতে কৌতুহলী দৃষ্টিতে চিঠির দিকে চেয়ে বলে- কার চিঠি রে খোকা?

অন্যমনস্কভাবে হিরণময় উত্তর দেয়- দেখে তো মনে হচ্ছে পরিচিত কারো…

-পরিচিত কারো মানে!   

হিরণময় এবার বেশ একটু বিরক্ত হয়ে বলে- আগে তো দেখতে দাও।

সুশীলা নিজেকে সামলে নিয়ে বলে- নে তোর চা, ধর।  

মায়ের হাত থেকে চায়ের কাপ নিয়ে ঘরে ঢোকে হীরু। চিঠির উপরে লেখা তার নাম ঠিকানা। বড্ড চেনা হাতের লেখা যে।

সেই একটা চিঠি তার জীবন একেবারে আমূল বদলে দিয়েছিল।  

  

###

 

সব, সব মনে আছে তার। সে দিন যেকথা  সে খুলে বলতে পারেনি মাকে। কেমন করে বলবে- এক হেরে যাওয়া সৈনিকের কাহিনি।    

তবু বোধহয় মায়ের চোখে সব টাই ফাঁকি দেওয়া যায়নি। মা সব ঠিকই বুঝে গিয়েছিলেন বোধ হয়।

  কয়েক দিন পরে একদিন শরীরটা একটু ম্যাজ ম্যাজ করছে বলে সে অবেলায় ঘরে শুয়ে সঞ্চয়িতার পাতা একটার পর একটা উল্টে যাচ্ছিল। মা পায়ে পায়ে তার পড়ার ঘরে ঢুকে এসে বলেন- এই অবেলায় শুয়ে আছিস কেন বাবা? স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে হীরু বলে- এমনি। এই শরীরটা একটু ম্যাজ ম্যাজ করছে তাই…

-কৈ দেখি, বলে মা তার বিছানার পাশে বসে কপালে হাত ছোঁয়ান- কৈ, কিছু নেই তো, গা তো একদম ঠিক আছে, তুই যা একটু বাইরে থেকে ঘুরে আয়, দেখবি ভালো লাগবে।  

- না, আজ আর ইচ্ছা করছে না মা। তুমি বরং একটু কড়া করে এক কাপ চা করে নিয়ে এসো । খেতে খেতে সঞ্চয়িতাটা পড়ি একটু…   

-আচ্ছা, তুই তবে উঠে বস।

একটু পরে তাদের দুজনের জন্যে তৈরি করা চায়ের কাপ হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকে মা বলেন- নে ধর। বিস্কুট খাবি?  

- না।

চা খেতে খেতে মা বলেন- ক’ দিন ধরে দেখছি তুই আর খুব একটা বাইরে যাচ্ছিস না, মনটা খারাপ করে… কি হয়েছে বাবা?

-কৈ কিছু না তো মা।    

-আমাকে লুকাস না হীরু। চিঠি খানা আসা থেকে দেখছি… , কি হয়েছে তোর?

হীরু মাথা নিচু করে আছে দেখে মা এবার বলেন- মন খারাপ করিস না বাবা। জীবন তো নদীর মতো। নদীর স্রোতে কত নুড়ি বালি, মনি মুক্তা আসে-যায়, নদীর তাতে কি এসে যায়! সে তো  কখনো থেমে থাকে না। 

-মা…   

আমি সব জানি খোকা। দুঃখ করিস না। একদিন যে সব কেড়ে নিয়ে চলে গেল, দেখিস আবার এমন একদিন আসবে যে নিজেই সব ফিরিয়ে দেবে। নদী যেমন নেয়, তেমনি ফিরিয়েও দেয় যে বাবা।  

 

 

আজ হঠাৎ দরজা খুলে হিরনের মায়ের সেই কথাগুলো মনে পড়ে গেল। তবে কি তার এবার ফিরে পাওয়ার পালা?

কিন্তু কী বা ফিরিয়ে দেওয়ার আছে ওর? কেন আজ এভাবে এত দূরে ছুটে এসেছে? সে কি বিবেক দংশন? নাকি সশরীরে এসেছে ক্ষমা ভি…

-কিরে ভেতরে যেতে বলবি? নাকি এখানে এভাবে দাঁড় করিয়ে রাখবি?

সম্বিত ফিরে পেয়ে হিরন তাড়াতাড়ি দরজা খুলে বলে- আয়। 

তারা দু’জনে বোধহয় দু’জনকে দেখে চমকে উঠেছিল। আগন্তুক এবার মৃদু হেসে বলে- আসলে তোর বিশ্বাস হচ্ছে না তো হঠাৎ কোথা থেকে?

-হ্যাঁ ঠিক তাই।

-চলেই এলাম, বুঝলি।

-মানে?

-মাসিমা কোথায়?  তাঁকে তো দেখছি না।

-মা তো নেই।

-নেই মানে! চমকে ওঠে কৃষ্ণা। অথচ সে একটা খবর পায়নি।

 স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে হিরণময় অভিমানাহত ভারাক্রান্ত গলায় বলে উঠে- হঠাৎ এভাবে চলে আসবি, মা আর জানবে কি করে! তাই বোধ হয় হিসাবের গণ্ডগোল করে ফেলেছিল। একটু আগে ভাগেই চলে গেল।

অস্ফুটে কৃষ্ণা যেন তার কথায় জিভ বুলিয়ে নিয়ে বলে- চলে গেল!   

হালকা হাসি ছড়িয়ে দিয়ে এবার হীরন বলে - যাক, ও সব কথা এখন থাক, এতদিন পরে এসেছিস আয় ঘরে এসে বস, আগে একটু বিশ্রাম নে…  

হীরু কৃষ্ণাকে নিয়ে তার পড়ার ঘরের দিকে পা বাড়ায়। অপ্রস্তুত কৃষ্ণা এবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে- কেমন আছিস?

-ভালো।

 মুখটা তুলে কোন ভনিতা না করেই স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করে কৃষ্ণা বলে- জানি তোর আর তর সইছে না। বলবো সব বলব- কোথা থেকে, কীভাবে এলাম, কেন এলাম এই তো! তারপর একটু থেমে আবারো সে বলে-গলাটা শুকিয়ে গেছে, আগে একটু জল দে।

 হিরণময় ঝরনাদিকে ডাকতে গিয়ে ---বলে হঠাৎ থেমে যায়। তারপর নিজের মনেই হেসে উঠে বলে- আসলে অভ্যাস হয়ে গেছে তো। তুই ঘরে গিয়ে বস আমি আনছি।

উদগ্রীব হয়ে মুখের দিকে চেয়ে থাকে কৃষ্ণা। হিরণময় মৃদু হাসার চেষ্টা করে কিন্তু কিছু বলে না।

-তোর বউ?   

হিরণময় হাসে। অনেক দূর থেকে এসেছিস আগে একটু বোস, সব জানতে পারবি। হীরু রান্নাঘরে যায়।   

 

কৃষ্ণা পায়ে পায়ে ওর পড়ার ঘরে গিয়ে ঢুকে। একতলা পুব মুখো ছোট্ট দুটি ঘর। দক্ষিণের জানালাটা এখনো খোলা। জানালার ওপারে ছোট বটগাছটা সেই একিই রকম দেখা যাচ্ছে। শুধু ওটা আর আগের মতো নেই। অনেক বড় হয়ে গেছে। যাবেই তো, তেরোটা বছর তো কম নয়। বই পত্তর, বিছানা চাদরের কি হাল করে রেখেছে! ওর বউটা নিশ্চয় অগোছালো, মনে মনে সে একটু বিরক্ত হয় কি! হাত লাগিয়ে বিছানাটা কি সে একবার গুছিয়ে দেবে? কি জানি ওর বউ এ সব দেখে আবার কি মনে করবে! হয়ত মনে মনে ভাববে- যত সব আদিখ্যেতা!     

   সারা ঘর ঘুরে ঘুরে, চেয়ে চেয়ে দেখতে থাকে সে। ইস, পড়ার টেবিলটাও একটু গুছিয়ে রাখতে পারে না! এত দামি দামি বইগুলো কেউ এভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখে! কোমরের উপর পরনের কাপড়ের আঁচল খানা ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে টেবিলের সামনে এগিয়ে যায় সে। এলোমেলো বইগুলো হাত লাগিয়ে গুছায়ে রাখতে গিয়ে সহসা সামনের দেয়ালে ঝুলন্ত অনেক দিনের পুরনো একটা জীর্ণ ক্যালেন্ডারের দিকে তার চোখ আটকে যায়।  

সে উৎসুক ভাবে টেবিলের কোল ঘেঁষে ক্যালেন্ডারের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়- লাল হয়ে যাওয়া কাগজগুলো মর্মর করছে। হাত দিলে বোধহয় ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ছিঁড়ে পরবেএখনো কেন যে ওটা রেখে দিয়েছে!    

 নিছক কৌতুহলী হয়ে সে পায়ে পয়ে এগিয়ে যায়- ‘’শ্রীকৃষ্ণ জুয়েলারি হাউস’’, আর ঠিক তারি নীচে লেখা, সাল-২০০৭, ঠিক যে বছর তার বিয়ে হয়েছিল।      

সে ফাগুন মাসে তো এটা হাতে নিয়ে ওদের বাড়ি এসেছিল। আর তার বিয়ে হয়ে গেল পরের বৈশাখে।  সব মনে পড়ছে তার। হীরু এটা দেখে বলেছিল- বাঃ, ফুলটা তো খুব সুন্দর। সাদা চন্দ্রমল্লিকা আমার খুব পছন্দ। এখানা তুই আমার পড়ার ঘরে টেবিলের সামনে ঐ পেরেকটাতে ঝুলিয়ে দে। তুই যখন থাকবি না তখন ওটা আমি দেখব।

কৃষ্ণা সেদিন হেসে বলেছিল- থাকব না তো কোথায় যাব?

সে নিজের হাতে এ খানা ঐ পেরেকে ঝুলিয়ে দিয়েছিল। আজও সে খানা ঐ ভাবেই রয়ে গেছে!  

চোখ বন্ধ করে কৃষ্ণা। সব মনে পড়ে যায় তার।  

 

 সে কোন খবর দিতে পারে নি। হঠাৎ খানিকটা জোর করেই মা বাবার পছন্দের পাত্রকে বিয়ে করে তাকে মুম্বাই চলে যেতে হয়ে ছিল।

এরপর ওকে কত খোঁজার চেষ্টা করেছে সে, ফেসবু্‌ক, টুইটার…

না কোথাও সে হিরনের কোন একাউন্ট পায়নি।

  

ছোট ভাইয়ের ছেলের অন্নপ্রাশনে নিমন্ত্রিত হয়ে আজ তের বছর পর দেশে ফিরে সে। ফ্লাইটে গতকাল মাত্র নেমেছে। আর আজ সকাল হতে না হতেই ছুটে এসেছে। সে জানেই না যে মাসিমা আর নেই। মাসীমার জন্য শাড়ি, মিষ্টি, হিরনের ছেলে মেয়েদের জন্য ক্যাডবেরি, হিরনের জন্য তার সবথেকে প্রিয় বই  

 

অথচ এত এলোমেলো বিছানাপত্র বইখাতা জামা কাপড়- এ তো সংসারের নয়, যেন কোন এক বাউন্ডুলের শ্রী হীন ঘর। তবে কি হিরণময়!

এক হাতে জলের বোতল আর অন্য হাতে প্লেটে সাজানো গোটাকয়েক রসগোল্লা নিয়ে ঢুকে হিরণময় হেসে বলে- কি দেখছিস? নে নে ধর ধর…  মা থাকলে কি আর……

 

-এসব আবার আনতে গেলি কেন?

-বারে, আমি এনেছি বুঝি! তুই তো এই এত বড় একটা মিষ্টির প্যাকেট, গুচ্ছের খানেক জিনিস পত্বর নিয়ে…

-তোর বউ, ছেলে মেয়ে কই? তাদের ডাক।

হা হা হা করে হেসে ওঠে হিরণময়। হাসির ধমকে তার সারা শরীর কাঁপতে থাকে। আর তার মুখের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে কৃষ্ণা।

-তুই বিয়ে করিস নি?

কথাটা এড়িয়ে গিয়ে হিরণময় বলে- আমার কথা ছাড়। কিন্তু এ কি করেছিস তুই সারা অঙ্গে জুয়েলারি দোকান খুলে বসেচিস যে। কৃষ্ণা লজ্জায় মাথা নত করে। তাড়াতাড়িতে সে এগুলো খুলে রেখে আসতে পারেনি।

 তারপর মৃদু হেসে বলে, তুই বস, আমি ঝরনাদিকে ডেকে দি।

 হিরণময় দ্রুত বের হয়ে যায় ঘর থেকে। কৃষ্ণা হ্যাঁ করে তার মুখের দিকে চেয়ে থাকে, অস্ফুটে বলে- ঝরনাদি!     

 

 হীরু বের হয়ে গেলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে এখন সে আপন মনে পরম যত্নে পড়ার টেবিলের বই গুলো একে একে গুছিয়ে রাখতে থাকে। আর তখনি হঠাৎই পেয়ে যায় এক খানা পুরানো চিঠি, আর একটি শুকনো গোলাপ। সে খানা পরম যত্নে গুছিয়ে রাখা আছে পুরানো এক ডায়রির মধ্যে-যেন কেউ বুক দিয়ে আগলে রেখেছে তার অমূল্য ধন। ধীরে ধীরে ডায়রির পাতা উল্টে   

আনমনে চিঠিখানা হাতে তুলে নেয়  সে। এ তো তারি হাতের লেখা সেই  চিঠি। ধীরে ধীরে চিঠির ভাঁজ খুলে দ্রুত চোখ বলাতে থাকে সে-       

 হীরু,

‘ এই সমাজে মেয়েদের স্বাধীনতা কতটুকু! জীবনটা যে তোর ইংরাজিতে পড়া নভেল নয়। পাতি বাঙালি সমাজ ব্যবস্থায় এক জন উচ্চবিত্ত্য বামুন বা কায়েস্থ মেয়েকে নিয়ে ঘর বাঁধতে হলে মধ্যবিত্ত্য ঘরে জন্মানো একটি ছেলের যে জোর থাকা উচিত, তা আমাদের সমাজে অধিকাংশ  দলিতরা এখনো অর্জন করতে পেরেছে বলে মনে হয় না।  

শুধু আমাকে পাওয়ার জন্য তোর মতো একজন ভালো নিরিহ মানুষকে এই লড়ায়ে নামিয়ে দিতে মন চাইল না বলে আমাকে ক্ষমা করিস। আমার বিশ্বাস চিরকাল তুই আমার বন্ধু হয়েই থাকবি। সেই বন্ধু যাকে নিঃদ্বিধায় মনের সব কথা বলতে পারি। মাকে ভালো রাখিস, ভালো থাকিস।’    

                                                                                                    - ইতি

                                                                                                              কৃষ্ণা

                      

 আর ঠিক তার পাশে ডায়রির অপর পাতায় সুন্দর হস্তাক্ষরে লাল কালি দিয়ে লেখা-     

                                     বন্ধু,

যা কিছু আনন্দ ছিল দৃশ্যে গল্পে গানে

তব সন্দর্শনে   

 সব আনন্দ লুকায়ে পড়িছে তারি মাঝখানে  

যে দীপ জ্বালিয়ে গেছ তুমি নিজ হাতে

তার শিখা হতে

বিচ্ছুরিত প্রেম ছড়িয়ে পড়ুক ভুবনে…   

  

 সহসা তার দু’চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। প্রবল আবেগে সে চোখ বন্ধ করে, আর সেই বন্ধ চোখের আগল ভেঙে ছর ছর করে গড়িয়ে পড়ে নীরব অশ্রুবিন্দু।  

উন্মক্ত দরজার একটি পাল্লা ধরে অবাক হয়ে সেদিকে চেয়ে থাকে হীরু, তার চোখে পলক পড়ে না।

 

                                                                     

                      ১০ই ফেব্রুয়ারি ২০২১

 

   

 

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.