ছোটগল্প।। টাইগার বাম ও ভীরু ভালোবাসা ।। মুক্তি দাশ
0
ফেব্রুয়ারী ০৬, ২০২১
শিয়ালদা সাউথস্টেশনে বারুইপুরগামী লোক্যাল ট্রেনে ওরা উঠে পড়ল। ট্রেন ছাড়তে এখনো মিনিট পাঁচেক। বারোনম্বর প্ল্যাটফর্মে দিব্যি দাঁড়িয়ে আছে ট্রেন। ফাঁকাই বলতে গেলে। ট্রেনের পাশ বরাবর একটা অপেক্ষাকৃত নিরিবিলি কামরার সন্ধানে চোখ রেখে প্ল্যাটফর্ম ধরে সুখেন্ হেঁটে যাচ্ছে খুশিকে পাশে নিয়ে। ট্রেনের মাঝামাঝি একটা মোটামুটি পছন্দসই কামরা পাওয়া গেল। খুশির দিকে তাকিয়ে সুখেন কামরাটা দেখিয়ে জিগেস করল, 'উঠবে?'
খুশি ঈষৎ অধৈর্য গলায় বলল, 'ওঠোই না…সবই তো ফাঁকা, যেখানে হোক উঠলেই হল…'
দেখেশুনে বেছেবুছে একটা কামরা ঠিক করল সুখেন। কামরার শেষপ্রান্তে, যেখানে লম্বা টানা সিট থাকে, তারই একেবারে জানলার দিকে খুশিকে বসতে দিয়ে সুখেন নিজে তার পাশে বসে পড়ল। ট্রেনের গতির বিপরীতমুখী জানলায় বসেছে খুশি। ইচ্ছে করেই। শেষ পৌষের কনকনে ঠান্ডা হাওয়ার হাত থেকে যতটা বাঁচা যায়!
শীতের সময় দিনের বেলাটা এমনিতেই ছোট! এই তো এখন সাড়ে তিনটে বাজে, এরই মধ্যে সূর্য তেজ কেমন নিস্তেজ, নিষ্প্রভ হয়ে আসছে! একটু বাদেই ঝুপ করে সন্ধে নামবে। সুখেন আর খুশি রোজই এইসময় ফেরে কলেজ থেকে। দু'জনেই ওরা একইসংগে শিয়ালদার জর্জকলেজে বি.সি.এ. কোর্স করছে। এটা সেকেন্ড ইয়ার। ফেরার সময় ওরা বারুইপুর লোক্যালই বেশি পছন্দ করে। তাতে অনেক সুবিধে। খুশি সোনারপুরে নেমে যাবে। আর সুখেন তো থাকে বারুইপুরেই। তাছাড়া ডায়মন্ডহারবার বা লক্ষ্মীকান্তপুর, কাকদ্বীপ প্রভৃতি একটু দূরপাল্লার লোক্যালগুলোতে যা ভিড়ভাট্টা!
এইবার ট্রেন ছাড়বে। হুইসেল মারল। এখনও লোকজন উঠতেই আছে। সেইসংগে কিছু হকারের ওঠানামা।। সুখেন একজনের কাছ থেকে নুন-মাখানো দু'প্যাকেট বাদাম কিনে একটা প্যাকেট খুশির দিকে বাড়িয়ে দিল। ঠিক সেইসময় ফের হুইসেল বাজিয়ে ট্রেনও গড়াতে শুরু করেছে।
এতক্ষণ জানলা দিয়ে বাইরের অপসৃয়মান সন্ধ্যাকালীন প্রকৃতি দেখছিল খুশি। সবে পার্কসার্কাস ঢুকছে। ভিড় বাড়ছে। তারই মধ্যে ছোট্ট একটুখানি হাঁ করে প্যাকেট থেকে বাদাম মুখের মধ্যে চালান করে দিয়ে সুখেনের দিকে ঘুরে বসল খুশি। বলল, 'হ্যাঁ, যা বলছিলাম…' তারপর অভিমানী গলায় বলল, 'তখন কলেজছুটির সময় বেরোবার জন্যে এমন তাড়াহুড়ো করছিলে, আমার কথা ভালো করে শুনলেই না…
সুখেন বাদাম চিবোতে চিবোতে ভুরু নাচিয়ে জিগেস করল, 'কী?...কী বলছিলে?
'বলছিলাম…' নতুন করে শুরু করল খুশি, 'কাল থেকে মাসখানেক আমি কলেজ আসব না…বুঝেছেন মশাই? দেখা-টেখা হবে না…'
সুখেন বেশ নাটকীয় ঢঙে বলল, 'এ-ক-মা-স! আমি অনাথ হয়ে যাব যে! তারপর সিরিয়াসলি বলল, 'এতদিন বাড়ি বসে করবেই বা কী? নাকি কোথাও যাওয়ার প্ল্যান আছে?...'
'ছোটমামুর কাছে, ব্যাঙ্গালোরে…মায়ের সংগে যেতে হবে' বলে সুখেনের একটা হাত দু'হাতের মধ্যে নিয়ে আলতো করে টিপতে টিপতে খুশি বলল, রাগ কোরো না প্লিজ…আমারও কি কষ্ট হয় না, বল? খুব মিস করবো তোমাকে…খু-উ-ব…'
সুখেন পাক্কা গোয়েন্দার মতো সন্দিগ্ধ গলায় জানতে চাইল, 'আচ্ছা, এই যে একমাসের জন্যে তোমাকে ব্যাঙ্গালোর নিয়ে যাওয়া হচ্ছে…মতলবটা কী? ওখানে তোমার বিয়ে-ফিয়ে দিয়ে দেবে না তো?
'ভ্যাট! কী বুদ্ধি!' খুশি বলল, 'আমার বিয়ে, আমি জানতে পারব না?'
'কবে যাওয়া হচ্ছে?' সুখেনের গলা গম্ভীর।
'পরশু…' খুশি বলল,'দুপুরের দিকে ট্রেন…'
সুখেন হঠাৎ বলল, 'আমি যাব।'
'কোথায়?' আকাশ থেকে পড়ল খুশি।
সুখেন সরাসরি বলল, 'কোথায় আবার! হাওড়া স্টেশনে…তোমাকে তুলে দিয়েই চলে আসব…'
খুশি সুখেনের জানুতে একটা জব্বর চিমটি কেটে বলল, 'একবার এসেই দ্যাখো…ঠ্যাং খোঁড়া করে দেব…পাগল কোথাকার…' বলে বাদামের খালি প্যাকেটটা জানলা গলিয়ে বাইরে ফেলে দিল।
সুখেন অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে হতাশ গলায় বলল, 'আমার কিচ্ছু ভাল্লাগছে না…ধ্যুৎ!'
খুশির হাতদুটো নিজের মুঠোর মধ্যে নিয়ে সামান্য চাপ দিয়ে সুখেন কিছু বলতে যাবে, তার আগেই ঝটকা মেরে হাত দু'খানি মুচড়ে ছাড়িয়ে নিল খুশি। ভয়ার্ত চোখে চারদিক দেখে নিয়ে কপট রাগে হিসহিসিয়ে করে বলল, 'কি হচ্ছে কী? ট্রেনের মধ্যে একগাদা লোক…চেনাশোনাও তো থাকতে পারে…'
সুখেন রীতিমতো নাটক করে চাপাগলায় কিন্তু বীরদর্পে বলল, 'থাকুক। আই ডোন্ট কেয়ার…আমি কি ডরাই সখি ভিখারী রাঘবে?'
ঠিক সেইসময় হঠাৎ কানের কাছে কেউ যেন বলল, 'দেব নাকি কানের গোড়ায়…'
সুখেন ও খুশি দু'জনেরই ভীষণ চমকে গেছে। প্রায় বিষম খাবার জোগাড়। ঘাড় ঘুরিয়ে সুখেন দেখল লোকটাকে। সরাসরি সুখেনের চোখে চোখ রেখে লোকটা তখনও বলে চলেছে, 'এই শীতেও কান একেবারে গরম হয়ে যাবে কিন্তু…দেব নাকি?'
বলে লোকটা তার ব্যাগ থেকে কয়েকটা কান-চাপা ক্যাপ বার করল। ক্যাপ মানে তো টুপি। না, এগুলো তো ঠিক টুপিও নয়। মাথাটাকে বেড় দিয়ে দু'কানের দু'দিকে একেবারে শক্ত করে চেপে বসে। শীতের দিনে পরে খুব আরাম হয়, যাই বল!
সে যাইহোক, ওরা দু'টিতে এখন একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। বাব্বা! যা ভয় পাইয়ে দিয়েছিল! লোকটা ততক্ষণে কামরার অন্যপ্রান্তে চলে গেছে। খুশি মুখে ওড়না চাপা দিয়ে হেসেই চলেছে। হাসির চোটে ওর শরীরটা ক্রমাগত দুলে দুলে উঠছে। আর গম্ভীর হয়ে বসে আছে সুখেন। হঠাৎ ভয় পেয়ে যাওয়ার রেশটা যেন তার কিছুতেই কাটতে চাইছে না।
সুখেনের বাহুতে আবার একটা মোক্ষম চিমটি। হাসতে হাসতে খুশি বলল, 'কী হল, মশাই? বীরপুরুষ অমন চুপসে গেলেন কেন?' বলেই আবার খিলখিলিয়ে ওড়না-চাপা হাসি।
ট্রেন নিউগড়িয়া ছাড়িয়ে গেছে। এবার গড়িয়া স্টেশনে ঢুকবে। গড়িয়ায় ঢুকলেই খুশিকে সিট ছেড়ে উঠে পড়তে হবে। গড়িয়ার পর নরেন্দ্রপুর। তারপরই তো সোনারপুর। আগে থেকে না উঠলে নামার সময় খুব ঝামেলায় পড়তে হয়। গেটের সামনে ভিড় হয়ে যায়। নামার জন্যে হুটোপুটি লেগে যায়। ওঠার তোড়জোড় করতেই সুখেন ওর হাত শক্ত করে ধরে থাকল। বলল, 'চুপটি করে বোসো তো! এত আগে উঠে কী করবে? আগে নরেন্দ্রপুর পেরোক…'
তাই সই। গড়িয়াস্টেশনে ট্রেনটা শুধু দাঁড়ানোর অপেক্ষা। হু হু করে বহুলোক নেমে গেল। সেই তুলনায় খুব কম লোকই উঠল। খুশির নরম হাতদুটো সুখেন মুঠোয় নিয়ে খেলা করছে। এবার আর খুশি আপত্তি করেনি। সে এখন নেমে যাবে কিনা! এটা তারই বোনাস।
অনেক প্যাসেঞ্জারের সাথে একটা নতুন হকারও ঢুকে পড়েছে। নতুন আইটেম নিয়ে। এদিকে যত নামার সময় হয়ে আসছে খুশি ততই বকবক করে যাচ্ছে, শোনো, বেশি রাত একদম জাগবে না…সবসময় মোবাইল ঘাঁটবে না…ভালোভাবে থাকবে…মোটে তো একটা মাস, জানি তারপর আবার দেখা হবে, তবু, বললাম তো, তোমাকে খুব মিস করব…
সুখেন খুশির হাতদুটো আদর করতে করতে শুধু বলল, 'আমিও…'
ওদিকে সেই নতুন হকারটা তখন জোরদমে ভাষণ দিয়ে যাচ্ছে, 'এই যে দাদারা, দিদিরা, ভাইরা, বোনেরা, মাসী ও মেসোরা, দাদু ও দিদারা…
খুশি বিষণ্ণ মুখে বলল, 'এবার ছাড়ো, উঠি…'
হকার বলছে, 'কান খুলে শুনে রাখুন, যেখানে ভালোলাগা সেখানেই ভালোবাসা…'
'ভালোবাসা' শব্দটা কানে যেতেই খুশির আর ওঠা হল না। সুখেন ও খুশি একইসাথে উৎকর্ণ হল। ঈষৎ লজ্জা পেয়ে খুশি অনিচ্ছাসত্ত্বেও তার হাত দু'খানি সুখেনের কবলমুক্ত করে নিল।
হকার তখনো বলছে, 'আর যেখানে ভালোবাসা, সেখানেই প্রেম, আমরা ঘটা করে যার নাম দিয়েছি পীরিতি…'
এবার খুশি একেবারে লজ্জাবতী লতাটি। চোখ তুলে চাইতেও পারছে না পর্যন্ত। হকার লোকটা কি তাদের লক্ষ্য করেই কিছু বলছে? তাদের সম্পর্কটা আঁচ করতে পেরেছে? আসলে লোকটা কী-ই বা বিক্রি করতে চাইছে?
হকার রহস্যঘন স্বরে বলে চলেছে, 'যেখানেই প্রেম বা পীরিতি, জেনে রাখুন, সেখানেই কিন্তু খালি ব্যথা আর ব্যথা, বেদনা আর কষ্ট…'
একশোবার সত্যি। প্রেমে যেমন সুখ, তেমনি ব্যথাও। খুশি হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছে। এইযে, একমাস দেখা হবে না, একি কম বেদনাদায়ক? ওরা ছোটমামুর বাড়িতে আনন্দ-উৎসব করবে, অথচ সুখেন একা একা…! একি কম কষ্টের? প্রেমের এই ব্যথা-বেদনা থেকে নিস্তার পাওয়ার কি কোনো উপায়ই নেই?
হকার এবার দ্বিগুণ উৎসাহে বলছে, 'আর যেখানেই ব্যথা, সেখানেই…'
হকারটি এবার তার ঝুলিতে হাত চালিয়ে কয়েকটা চ্যাপ্টা ধরণের কৌটো বার করে এনে ফের বলল, '…সেখানেই লাগান এই অত্যাশ্চর্য টাইগার বাম…নিমেষে সব ব্যথা উধাও…'
শুনে এই আসন্ন বিরহজনিত বিচ্ছেদ-বেদনার মধ্যেও ফিক করে এসে ফেলল খুশি। তারপর সে এগিয়ে গেল দরজার দিকে। সেই ফাঁকে একটা টাইগার বাম-এর কৌটো হকারের কাছ থেকে কিনে নিল সুখেন। ট্রেন যথাসময়ে সোনারপুরে স্টেশনে ঢুকে পড়ল। টাইগার বামের কৌটোটা আর দেওয়া হলো না খুশিকে। টুক করে কখন যে নেমে পড়েছে খুশি! প্ল্যাটফর্মে নেমে সে সুখেনের জানলার কাছে এসে হাত নাড়ল। কিন্তু সারামুখ বিষণ্ণতায় ছেয়ে আছে। প্ল্যাটফর্মের ম্রিয়মান আলোর থেকেও সেই বিষণ্ণতা আরও গভীর।
হাত নেড়ে খুশি বলল, 'ওকে…বাই বাই…ভালো থেকো!'
এক্ষুণি ট্রেন ছেড়ে দেবে। মরীয়া হয়ে সুখেনের আকুতি, 'একটু হাসো না, প্লিজ…স্মাইল…স্মাইল…একটিবার প্লি-ই-জ…'
ধরা গলায় খুশি বলল, 'খুব কষ্ট, খুব ব্যথা…'
পুরো কথা শুনতে পেলো না সুখেন। ট্রেন ততক্ষণে গতি নিয়েছে। খুশির সংগে দূরত্ব বেড়ে চলেছে। জানলা দিয়ে যতটা সম্ভব মুখ বাড়িয়ে সুখেন দেখল, আস্ত একখানা প্ল্যাটফর্মসুদ্ধু ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে খুশি।
সুখেন হাতের মুঠোয় তখনো ধরা টাইগার বাম। সে এবার ধীরেসুস্থে জানলার বাইরে হাত রাখল। এবং শেষপর্যন্ত মুঠোটা আলগা করে দিল।
_ছবি ঋণ- ইন্টারনেট __________________________
মুক্তি দাশ
১৩৫, অঘোর সরণী
রাজপুর
কলকাতা-৭০০১৪৯
মোবাইল/হোয়াটসঅ্যাপ : ৯৮৩০৪১৩১২২
Tags