অঞ্জনা গোড়িয়া
বেজে উঠলো বিয়ের সানাই । হইচই আনন্দ সারাবাড়ি। শুধু কনের মুখ থমথমে। চোখ দুটো ঠিক আষাঢ়ের মেঘে ঢাকা তারা।
শ্রীলেখা। শান্ত নম্র অষ্টাদশী মেয়ে। আজ তার ই বিয়ে। বাড়ির একমাত্র মেয়ে।
একটু পরেই বিয়ের আসরে টুকটুকে বেনারসী শাড়ি পরে রাঙা হয়ে বসবে ।
নিশ্চয় খুব সুন্দর দেখতে হয়েছে আমার শ্রীলেখাকে । ওড়না ঢেকেছে খোঁপায়। টুকটুকে লিপস্টিকে রাঙা হয়েছে ঠোঁট। চন্দনের ফোঁটা,গলায় রজনীর মালায় নিশ্চয় আরও অপরূপ হয়ে উঠেছে আমার শ্রীলেখা। পান পাতায় আড়ালে ঢেকে রেখেছে মুখটা। কৃষ্ণচূড়া গাছের তলায় বসে একার মনে ভেবে চলেছে নীলয়।
নীলয়ের ছোটোবেলার খেলার সাথী। ভালোবাসার সাথী। মনের সাথী। বন্ধু। ভালোবাসা।
কখনো ভাবতেই পারে নি শ্রীলেখাকে এভাবে হারাতে হবে?
কত দিন দেখিনি ওকে। যেদিন থেকে বিয়ে ঠিক হয়েছে। বাড়ির বাইরে আসা বারন। কড়া পাহাড়ায়। নীলয়ের সাথে আর দেখা হয় নি।
সে দিন যখন শেষ বারের মতো দেখা করতে গেল শ্রীলেখা। একটা লাল গোলাপ হাতে দিয়ে বলে ছিল, এটা যত্ন করে রেখে দিও।
যত দিন এটা কাছে থাকবে,বুঝবে আমি তোমার ই আছি। আর কথা হয় নি। তারপর ই বিয়ের পিঁড়িতে শ্রীলেখা।
কনে সাজে একবার দেখতে ইচ্ছে করছে। ওকে আসতেই হবে। নীলয়ের চোখদুটো জলে ভরে যাচ্ছে। আর নিজের মনে ই বলে চলেছে কত কথা।
" আমার ডাকে না এসে থাকতে ই পারবে না। " সারাদিন খাওয়া দাওয়া না করে বসে আছে। শ্রীলেখাদের বাড়ির পিছনে একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ। এখানেই অপেক্ষায় । যেখানে প্রতিদিন দেখা করত শ্রীলেখার সাথে। নীলয় শ্রীলেখার প্রেম কাহিনি পাড়ার সবার মুখে মুখে।
কত গল্প কত হাসি ভালোবাসা আদর।
রথের মেলা থেকে একবার লাল পুঁতির মালা এনে ছিলো। গলায় পরিয়ে দিয়ে বলেছিল, এই আমাদের মালা বদল হয়ে গেল। এবার শুধু সিঁদুর দান। একদিন তাও পরিয়ে দেব। শ্রীলেখা ও মজা করে বলেছিল,ইস এভাবে বিয়ে হয় নাকি?
সানাই বাজবে। গান বাজনা হবে। কত আত্মীয় পরিজন থাকবে। বিয়ের কনে সেজে তবে ই বিয়ে করব।
এ যে পুতুল খেলার বিয়ে নয়। সত্যি কারের বউ হবো তোমার।
কত কথাই মনে আসছে নীলয়ের।
নীলয় বড়ো একা। দুজনের দেখা স্বপ্নটা আজ মিথ্যে হয়ে গেছে।
সারা দিন বাড়ি ফেরে নি। নীলয়ের মা খুঁজে খুঁজে পাগল।মঞ্জুকে হেঁকে বললে ,একবার দেখ্ না রে। ছেলেটা না খেয়ে একা কোথায় বসে আছে ?
মঞ্জু নীলয়ের ছোটো বোন। খুঁজতে খুঁজতে পৌঁছে গেল সেই কৃষ্ণচূড়ার তলায় ।
মঞ্জুকে একবার নিয়ে গিয়েছিল শ্রীলেখার সাথে ভাব করাতে।
কানটা মুলে বলেছিল ,'দেখ তো বোন ,তোর বৌদিকে পছন্দ হয় কি না ?
শ্রীলেখা লজ্জায় রাঙা হয়ে গিয়ে ছিল। মঞ্জু বউদির গলা জড়িয়ে ধরেছিল, আমার তো ভারী পছন্দ দাদাভাই। কবে নিয়ে আসবি বাড়ি।
"খবরদার বোন। এখন না। ওর ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হোক। তারপর আমিই জানাব সবাইকে।"
মঞ্জু শ্রীলেখাকে বলেছিল, বৌদি যেদিন আমাদের বাড়ি আসবে খুব মজা করব।
শ্রীলেখা লাজুক মুখে বলেছিল ,তোমার দাদা যেদিন নিয়ে যাবে সেদিন ই আসব। সব কিছু ছেড়ে এক কাপড়ে।'
হঠাৎ কালবৈশাখীর ঝড়ের হাওয়ায় সব স্বপ্ন আশা ভালোবাসা তছনছ হয়ে গেল।
নীলয়ের মায়ের কানে পৌঁছে গেল খবর টা।
পিতৃহীন নীলয়কে একাই মানুষ করেছে ছোটো থেকে। তাই অধিকার শাসন আবদার মায়ের অনেক বেশি। তাই এত দিন নীলয় মায়ের সব কথা শুনে আসছে। মায়ের কথা অমান্য করার সাহস নেই।
মায়ের কড়া আদেশ, ঐ ছোটজাতের মেয়ে যদি বাড়ি আনিস তো ,আমার মরা মুখ দেখবি।
হয় তুই থাকবি নয় তো আমি ই চলে যাবো কোথাও । "
অনেক বুঝিয়ে ও রাজী করাতে পারে নি । অশান্তির কারন অনেক গভীরে। শ্রীলেখার বাবার সঙ্গে নীলয়ের মায়ের দ্বন্দ্ব । কি কারনে তা নীলয়ের জানা নেই।
তার ই মধ্যে শ্রীলেখার বাবা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ল হার্ট এটার্কে । অতি কষ্টে বেঁচে ফিরল বটে।
মেয়েকে দিয়ে প্রতীজ্ঞা করিয়ে নিল,আমার পছন্দ করা ছেলেকেই বিয়ে করতে হবে । নইলে আর বাঁচব না।
শ্রীলেখা বরাবরই চুপচাপ। মেনে নিল বাবার আদেশ। নীরবে ভালোবাসার বলি দিয়ে বাবার পছন্দ করা ছেলের সাথে ই রাজি হলো বিয়েতে। আজ ই বিয়ে শ্রীলেখার।
নীলয় আজ শেষ বারের মতো দেখা করতে বসে আছে কৃষ্ণচূড়া গাছের তলায়।
কনে বেশে দেখার ইচ্ছে টা জানিয়ে ছিল গোপনে।
বর এসে হাজির। সবাই ব্যস্ত বরকে বরন করতে। সেই সুযোগে শ্রীলেখা পিছনের দরজাটা খুলে বেরিয়ে আসতে গেল। বাঁধা হয়ে দাঁড়ালো বাবা। একটি বার যেতে দাও বাবা। কথা দিচ্ছি দেখা করে ই ফিরে আসব।
"ঘরে যা মা। বিয়ের কনেকে এভাবে বাইরে যেতে নেই।"
ত্যাগের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ভালোবাসা আর কি আছে মা? তোকে দেখলে ওর আরও মন খারাপ হবে? তুই কি তাই চাস? ওকে যদি ভালো দেখতে চাস,সব ভুলে যা। আর পিছন ফিরে তাকাস না।
হয়ে গেল বরন,মালা বদল, বিয়ে। তখনও নীলয় দাঁড়িয়ে।
" ও "নিশ্চয় আসবে। একবার। গভীর রাতে সানাইএর শব্দ থেমে গেল। সব চুপচাপ। বুঝে নিল স---ব।
মঞ্জু দাদার খোঁজ পেল । কৃষ্ণচূড়ার নীচে।
শুকনো মুখে বোনকে জড়িয়ে কেঁদে ফেলল নীলয়। তোর বৌদিকে আর আনতে পারলাম না বোন।
মঞ্জু অতি কষ্টে চোখের জল আড়াল করল। জোর করে ফিরিয়ে আনল দাদাকে।
তারপর কেমন যেন চুপচাপ। পাথর হয়ে গেল। মুখে হাসি নেই ,দাড়ি গোঁফ ভর্তি। ঘুম নেই। খাওয়া নেই।কাজে যায় না। শুয়ে আছে দিন রাত।
শ্রীলেখা বিদায়ের দিনে একটু ও কাঁদে নি। সবাই এই নিয়ে হাসাহাসি করে। শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে তবু বাবা মায়ের জন্য কাঁদে না মেয়ে।
কবে ই শুকিয়ে গেছে চোখের জল। কেউ তা জানে না।
আজ চেষ্টা করে ও কান্না আসছে না।
তীব্র রাগ ক্ষোভ অভিমান নিয়ে বিদায় নিল শ্রীলেখা।
চোখে এক ফোঁটা জল নেই। থমথমে মুখে নিষ্ঠুর একটা দুরত্ব টেনে নিয়েছে সবার সঙ্গে । চলে গেল গাড়ি। সানাই স্তব্ধ । একবারও ফিরে তাকাল না।
তারপর --
অষ্টমঙ্গলায় এক প্রকার জোর করে নিয়ে এল বর। শ্রীলেখার বাপের বাড়িতে । শাখা পলা হাতে সিঁদুর পরে। নতুন শাড়ি পরেছে। পায়ে আলতা। আজ আর ভয় নেই।। নীলয়ের বাড়ি আজ সে যাবেই।
মিষ্টি নিয়ে হাজির নীলয়ের বাড়ি ।
নীলয়ের মা হকচকিয়ে গিয়ে বলল, একি তুমি? আজ তোমার অষ্টমঙ্গলা। সুতো কাটার অনুষ্ঠান।
তুমি এখানে?
হা হা করে হেসে বলল ভয় পেও না কাকিমা। আর আসব না এখানে। আমার ঠিকানা বদলে গেছে।
শুধু আমার সুখের ঘরের সুখ মিষ্টি নীলয়কে দিতে এলাম। ওকে বলো, শ্রীলেখা ভালো আছে। সুখের নীড় বেঁধেছে।"
আমার ওপর আর রাগ করে থেকো না কাকিমা। নীলয়ের বউ এনো। তোমার মনের মত কাউকে।
কথা গুলো বলে ই দৌড়ে বেরিয়ে এল ঘর থেকে শ্রীলেখা।
কাকিমার চোখেও জল এলো। এত দিনে বুঝেছে কি ভুল করেছে? ছেলেটা কত বদলে গেছে। হাসি খুশি নীলয় বোবা হয়ে গেছে। নিজের জেদে দুটো ভালোবাসার গলা টিপে হত্যা করেছে।
হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল।
নীলয় তখনও গোলাপের কাঁটায় ক্ষতবিক্ষত । আপন মনে বিড়বিড় করে বলে চলেছে, তোমাকে আসতেই হবে আমার কাছে। আমি সেই দিন টার অপেক্ষায় থাকব। জন্মজন্মান্তর ধরে শুধু তোমারই অপেক্ষায়। আমার শ্রীলেখা। শুধু আমারই।
অঞ্জনা গোড়িয়া