অনেক স্বপ্ন দেখেছিল দুজনে ৷শুধু ভিন জাত বলে সমাজ মানেনি ৷ওরা বাবাকে বুঝিয়ে ছিলো-এমন হলে ছেলেকে যেন ত্যাজ্যপুত্র করে ৷এ দেশ শুধু পোশাকের মধ্যে ধর্ম খোঁজে,খাদ্যের মধ্যে আস্তিক নাস্তিকের সন্ধান পায় ৷কিন্তু বুকের মধ্যে যে একজন ধ্যানমগ্ন মানুষ আছে তাকে এরা চেনে না,মানে না ৷তবু সায়ন চেয়েছিল আফসানাকে নিয়ে সে পালাবে,দূরে গ্রাম ছেড়ে অনেক দূরে শহরের ভিড়ে ৷সেখানে থাকবে না নামাবলীর চোখ রাঙানি, জপ- তপের হুমকি,টুপি দাড়ির হুজ্জতি ৷বাপ মার দেওয়া এই নাম পদবী সব রেখে নতুন নামে, নতুন পরিচয়ে 'ও'আর আফসানা বেঁচে থাকবে ৷কিন্তু কি যে হলো কে জানে!যে রাতে ওরা বাড়ি ছাড়বে বলে ঠিক করল, সেই রাতে আফসানাদের মসজিদ থেকে ঘোষণা হল- হাসিমপুরের হিন্দুরা জোট বেঁধেছে ভাইজান,তোমরাও জোট হও ৷সায়নদের শিব মন্দির থেকেও হাঁক দিল -চন্ডিপুরের মোল্লারা আজ রাতে আমাদের গ্রাম আক্রমন করবে তোমরা সবাই সজাগ থেকো ৷সায়নরা জানে,বহুদিন থেকে একটা চাপা উত্তেজনা ছিল ৷নেতারা নানাভাবে এসে বুঝিয়ে গেছে-মোল্লাদের দেশ এটা নয়,ওদের দেশ পাকিস্তান ৷এখান থেকে যদি তাড়ানো যায় সবকিছু হিন্দুদের হয়ে যাবে ৷ সায়ন বুঝতে পারেনা জন্ম থেকে সে দেখে এসেছে- আওলাদ চাচা, রমজান চাচা, নওশাদ ভাইদের ৷ অথচ নেতারা বলছে এদেশ ওদের নয়! একটা চাপা নিশ্বাস ফেলে সায়ন ৷ তারপর আপন-মনে বলতে থাকে-আওলাদ চাচার সঙ্গে রাজমিস্ত্রির কাজ করতে গিয়েই তো তার মেয়ে আফসানার সঙ্গে পরিচয় ৷রহিমা চাচি তাকে নিজের ছেলের মতোই ভালোবাসো, স্নেহ করে ৷এ সম্পর্ক তো বুকের মধ্যে ওই ধ্যানমগ্ন মানুষটার সঙ্গে ৷তাকে কি পোশাক-আশাক, নামাবলী, খাদ্যাভ্যাস দিয়ে আটকে রাখা যায়! এ প্রশ্ন নিয়ে সে অপেক্ষা করে আছে পরপারের জন্য ৷
অনেক রাত ৷যে যার ঘরে নিদ্রাহীন চোখে সতর্ক৷দূরে কুকুরের ঘেউ ঘেউ ডাক ।কিছু মানুষের আর্তনাদ। ছুটোছুটির শব্দ৷নীরব রাত বোমা গুলির আওয়াজ আর আর্ত চিৎকারে ক্রমশ ভারী হয়ে এল ৷সারারাত ধরে চলল তান্ডব লীলা ৷ভোরের আলো ফোটার আগে শান্ত হয়ে এল সবকিছু ৷কেউ জানে না কারা এমন করে গেল ৷পরদিন সায়ন দেখলো,তাদের গ্রাম অক্ষত ৷পাশের চন্ডিপুর গ্রাম দাঁড়িয়ে আছে তার পোড়া কঙ্কালসার দেহ নিয়ে ৷সেই রাতে মারা গেল অনেকে৷প্রচুর মানুষ জখম হল ৷গ্রাম ছেড়ে পালালো বহু মানুষ ৷ সায়ন ছুটে এলো আফসানাদের গ্রামে ৷বুকে যন্ত্রণা আর চোখে অশ্রু নিয়ে পোড়া শ্মশানে খুঁজতে লাগলো তার ভালোবাসাকে, তার প্রিয়জনকে ৷চেনাই যাচ্ছে না কোন কিছু ৷ একরাতেই কেমন যেন সব এলোমেলো হয়ে গেল ৷ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর পুলিশ এল, প্রশাসন এল, মিডিয়া এল, এমনকি হারানো মানুষগুলোও ফিরে এলো! তবে তারা সাদা কাপড়ে সমস্ত শরীরটাকে ঢেকে !প্রিয়জন হারানোর যন্ত্রণা বুকে নিয়ে সবাই কাঁদছে ৷এমনকি তাদের হাসিমপুর গ্রামও কাঁদছে ৷সায়ন নীরবে এসে দাঁড়ায় চন্ডিপুরের সার্বজনীন কবরস্থানে ৷ অনেক মানুষের ভিড়৷কেউ তাকে কিছু বলল না ৷সবাই যেন ক্লান্ত ৷ শেষবারের মতো প্রিয় মানুষের মুখ গুলো দেখিয়ে দাফন করা হবে। একে একে রহমত চাচা,আসগার ভাই,মমিন দা, তাহিরা চাচি.....হঠাৎ একটা লাশের কাছে এসে সায়ন প্রিয় হারানোর যন্ত্রণায় জ্ঞান হারালো ৷
অনেকদিন পর সবাই যখন শোক কাটিয়ে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করছে সায়ন একদিন এল আওলাদ চাচার কাছে ৷তার ইচ্ছা আফসানার কবরের উপর নিজের হাতে স্মৃতিসৌধ বানাবে ৷মৌলভী সাহেবের অনুমতি নিয়ে সায়ন তৈরি করল তার ভালোবাসার ঘর ৷আফসানা জীবিত থাকতে যে ঘরের স্বপ্ন দুজনে দেখেছিল সেই ঘর তার মৃত্যুর পরে সায়নের অশ্রু দিয়ে নির্মিত হলো ৷সমাধি স্তম্ভের গায়ে এক অভিমান ভরা এপিটাফ জ্বলজ্বল করতে থাকে-" আমাদের প্রেম লেখা হোক জলের অক্ষরে"৷হয়তো আফসানাও অনেক কথা বলতে চেয়েছিল ৷ বলতে পারেনি ৷ তাই অভিমান নিয়ে প্রিয় মানুষের ঘরে সে আজো পাশ ফিরে শুয়ে আছে ৷
:::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::
নাম- মোয়াল্লেম নাইয়া
গ্রাম+পোস্ট- ইমামদ্দী পুর
থানা-ঢোলাহাট
জেলা-দক্ষিণ২৪পরগনা
পিন-৭৪৩৩৯৯
ফোন নম্বর-৯৯৩৩১৯৫৭৫২