প্রেমেরগল্প।। কাগজের টুকরো।। সেখ মেহেবুব রহমান
কাগজের টুকরো
সেখ মেহেবুব রহমান
আফিস থেকে বেড়িয়ে মিনিট কুড়ির মধ্যে তিয়াসা বিধাননগরের ওয়াটার সাইড ক্যাফের সামনে এসে দাঁড়াল। ও এই এলাকারই একটি সফটওয়্যার কম্পানিতে কর্মরত। বেশ উঁচু পোস্টে আছে এখন। স্বাভাবিকভাবেই কাজের চাপ অত্যন্ত বেশি। এইরকম কর্মপিপাসু জীবনই তো চেয়েছিল ও। কিন্তু মনের প্রাপ্তির ছোঁয়া পেতে গিয়ে সাংসারটা ঝোড় হাওয়ায় ঝরা পাতার ন্যায় অজানার দেশে উড়ে যাবে, কল্পনাও করতে পারেনি। পাঁচ বছরের বৈবাহিক সম্পর্ক কয়েক মাসের জটিল আইনি পক্রিয়ার মাধ্যমে ভেঙে গিয়ে সম্পর্কর ইতি পড়েছে। বাস্তবিক অর্থেই ওর মন ভালো নেই। সমাজের সরল সম্পর্কগুলো পালন করা এতটা কঠিন, আগে কখনো বোঝেনি। এই মানসিক যন্ত্রণা হোক কিংবা কাজের প্রেসার সব কিছু থেকেই নিষ্কৃতি পেতে ছুটে আসে এখানে। সাময়িক বিরতি, একটু নিজেকে নিজের কাছে সময় দেওয়া। এইভাবেই চলছে বেশ কয়েক মাস।
তিয়াসা এরেঞ্জম্যারেজড করেছিল। ওর যে ভালোবাসা ছিল না, তা নয়। ব্যাচমেট সৌভিকের সঙ্গে চার বছরের প্রেম, যদিও সেই প্রেম পূর্ণতা পায়নি। সৌভিককে ভুলে নিজের স্বামীর সঙ্গে ঘর বাঁধতে প্রথমে কষ্ট হলেও, ধীরে ধীরে সব কিছু মানিয়ে নিয়েছিল। সত্যি বলতে তিয়াসার বিয়ের পর সৌভিক বা তিয়াসা কেউই কারও জীবনে ইন্টারফেয়ার করেনি।
স্বামী সুখে তিয়াসার বিবাহিত জীবনের প্রথম দিন গুলো ভালোভাবে কাটলেও, পরে জটিল হয়ে ওঠে। মূলত তিয়াসা নিজে কিছু করার কথা বললে সম্পর্কের তিক্ততা শুরু হয়। ও স্বাধীনচেতা মেয়ে, ঘরোয়া জীবনযাপনে থাকেনি কখনওই। হাসবেন্ডের হাজার বিরোধিতা সত্বেও কাজে যোগ দেয়। শুরু হয় অশান্তি, মানসিক টানাপোড়ন। নারীপুরুষের এই সামাজিক মনমাল্যিনের পরিসম্পাতি ঘটে ডির্ভোসের মাধ্যমে, ছিঁড়ে যায় সাত পাকের বাঁধন।
তিয়াসা এখন ওর মেয়ের সাথে বিধাননগরেই একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকছে। ওদের বিবাহের দেড় বছর পর মেয়ের জন্ম। যদিও ততদিনে বাবা'মায়ের সংঘাত শুরু হয়ে গেছে। আদালতে মকদ্দমা চলার সময় তিয়াসার হ্যাসবেন্ড নিজের মেয়েকে দাবি করেনি। এই একমাত্র যুদ্ধে তিয়াসা বিনা বাঁধায় জিতে গেছে।
এখন গাড়ি র্পাকিং সাইডে রেখে ক্যাফে ঢুকে, সুন্দরভাবে ডেকোরেট করা আসন গুলির একদম শেষটিতে গিয়ে বসল। ব্যাগ থেকে সেলফোনটি বার করে হোয়াটসঅ্যাপের মেসেজ গুলো দেখে ফোনটি টেবিলের ওপর রাখল। তারপর টেবিলে রাখা ম্যাগাজিনটি হাতে নিয়ে একমনে পড়তে শুরু করল। মিনিট দুই তিন পর একজন ওয়েটার এসে মাথা নামিয়ে নিচু স্বরে বলল, "অর্ডার প্লিজ ম্যাডাম…"
কথা কানে আসতেই তিয়াসা ম্যাগাজিন মুখের সামনে থেকে সরিয়ে, মাথা তুলে বলল, "একটা ক্লোড কফি"
"আর কিছু ম্যাডাম?"
"না"
ওয়েটার চলে যেতেই তিয়াসা আবার ম্যাগাজিনে চোখ রাখল। ম্যাগাজিনটির ফ্রন্ট পেজে বাংলা ফ্লিম ইন্ড্রাস্টির এক প্রতিষ্ঠিত অভিনেত্রীর বিবাহিত জীবনের টানাপোড়নের ঘটনা রং চড়িয়ে, গুছিয়ে লেখা হয়েছে। এই সমাজের উঁচু সারির মানুষদের জীবনেও যে এইরকম ঘটনা ঘটতে পারে সেটা ভেবে চমকে ওঠে তিয়াসা। মাত্র ছয় মাসে আগে নিজেও এই ধরনের ঘটনারই তো সাক্ষী থেকেছে। জীবন কত বর্ণময়।
মিনিট দুই পর ওয়েটার এসে কফি কাপটি টেবিলের ওপর রেখে চলে গেল। কাপ রাখার শব্দে তিয়াসার মনসংযোগ বিঘ্নিত হতেই চোখের সামনে থেকে ম্যাগাজিন সরিয়ে সেটিকে কাছে টেনে নিল। তারপর আলতভাবে চুমুক দিতে দিতে ম্যাগাজিনের পাতায় পুনরায় চোখ রাখল।
লেখাটির প্রতি এতটাই মগ্ন ছিল যে খেয়ালই করেনি কখন পূর্ণ কফি কাপ অর্ধপূর্ণ হয়ে শেষ হয়ে গেছে। লাস্ট চুমুক দিতে, দু তিন ফোঁটার বেশি পানীয় না আসাতে উপলব্ধি করল, কাপটি ফাঁকা হয়েছে। কিন্তু এখনও বেশ কয়েকটা লাইন পড়া বাকি। সময় বিলম্ব না করে মন দিয়ে পড়তে উদ্দ্যত হল। পড়া শেষে ম্যাগাজিন পাশে রেখে, ফোন অন করে টাইমটা দেখে নিয়ে ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে নিল। সন্ধ্যে হয়েছে, এবার বাড়ি যেতে হবে। বেশি দেরি হলে মেয়ে যে বড্ড অস্থির হয়ে ওঠে। তিয়াসা ফেরার ব্যাপারে মন স্থির করল।
নিজের আসন ছেড়ে উঠে সারিবদ্ধ টেবিল চেয়ারের মাঝ দিয়ে খুব সাবধানে বেড়িয়ে আসতে হঠাৎই দূরের টেবিলে এক মাঝ বয়সী ব্যক্তিকে দেখে থমকে দাঁড়াল।
খুব চেনা এক দৈহিক গঠন। একইরকম কোঁকড়ানো মাথার চুল, পরনে সেই প্রিয় নীল জিন্স আর কমলা পাঞ্জাবী। বসার ধরণটাও তো পরিচিত। এত মিল! দু'চোখে গভীর বিস্ময় নিয়ে সেদিকে এগিয়েও পায়ের গতি রুদ্ধ হল। মনে মনে ভাবল, দূর এসব কি ভাবছি! এখন এসবের কোন মানে আছে? কিন্তু তারপরেও…। মন মানল না তিয়াসার। দাঁড়িয়ে আরও ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ শুরু করল।
এই পাঁচ বছরে ওরা পরস্পরের মুখোমুখি হয়নি ঠিকই কিন্তু জীবনের একটা সময় দুজন দুজনকে ভালোবেসেছে। একে অন্যের কাঁধে মাথা রেখে দীর্ঘ সময় কাটিয়েছে। সৌভিকের কানের নিচে দুটি তিল আছে। ওপর থেকে বোঝা যায় না। একবার তিয়াসা ওকে জড়িয়ে ধরে কানের নিচে চুমু দিতে গিয়ে সেটি আবিষ্কার করে। পরে সেই তিল নিয়ে কত গল্প বানিয়েছে। তিল দুটির পাশাপাশি সহবস্থান দেখে নাম দিয়েছিল তিয়াসা সৌভিক…
এগিয়ে গিয়ে কি কথা বলা উচিত, যদি সে না হয়। আর যদি হয় তাহলে কি বলবে? এইরকম একাধিক অনুত্তর প্রশ্ন মনে নিয়ে সেই জনৈক ব্যক্তির দিকে এগিয়ে গিয়ে, পাশে দাঁড়িয়ে নিচু স্বরে বলল, "সৌভিক?"
তিয়াসার মিষ্টি কণ্ঠস্বর শুনে সেই ব্যক্তি পিছন ফিরে তাকাতেই, তিয়াসার যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখে হালকা হাসির রেখা জানান দিল সৌভিকের উপস্থিতি ।
সৌভিকের এইরকম প্রতিক্রিয়ায় তিয়াসা বলল, "কীরে অবাক হয়ে গেলি নাকি, আমি তোকে অনেকক্ষণ আগেই দেখেছি। পিছন ফিরে বসে আছিস। একটু ভয়ে ভয়ে এলাম। ভাবছিলাম যদি তুই না হয়ে অন্য কেউ হয়…"
সৌভিক তখনও নিজের চোখকে বিশ্বাস করে উঠতে পারেনি। পাঁচ বছর আগে এই তিয়াসাই তো ওকে একা করে চলে গিয়েছিল, সব সম্পর্ক ভেঙে নতুন জীবন শুরু করেছিল। এই জন্য অবশ্য এখন আর তিয়াসার ওপর রাগ নেই। কিন্তু চোখের সামনে আচমকা ব্যাথিত অতীত ভেসে উঠলে মনের মধ্যে যে প্রশ্ন অবশ্যাম্ভাবী। তিয়াসার দিকে তাকিয়ে পুনরায় বলল, "তুই এখানে কি করছিস?"
দ্বিতীয়বার একই প্রশ্ন শুনে তিয়াসার মনে হল, হয়তো ভুল সময়ে এসে পড়েছে। ভারী গলায় বলল, "আমি এসে সমস্যায় ফেলে দিলাম বল…"
"আরে না না, তা কেন হবে। তুই ভুল ভাবছিস তিয়াসা" কথা শেষ করার আগেই সৌভিক সামনের চেয়ার থেকে নিজের ব্যাগ সরিয়ে নিয়ে, তিয়াসাকে সেখানে বসার জন্য অনুরোধ করল। তিয়াসাও হয়তো মন থেকে সেটাই চেয়েছিল, কাঁধ থেকে ব্যাগ নামিয়ে টেবিলে ওপর রেখে, নির্দিষ্ট আসনে বসল।
"সত্যি বল, তোর কোনো প্রবলেম নেই তো?" বসেই তিয়াসা আরও একবার জিঞ্জাসা করল।
সৌভিক এবার একটু হেসে বলল, "তুই না সত্যি! তোর সাথে কথা বলতে কিসের প্রবলেম রে?"
মুখে সামান্য হাসি নিয়ে তিয়াসা বলল, "অনেক দিন পর দেখা হল তাই ভাবলাম যদি তোর সমস্যা হয়"। একটু থেমে সৌভিককে দু'চোখ ভরে দেখে বলল, "সত্যি বলতে, তোর সাথে দেখা হয়ে খুব ভালো লাগছে'রে সৌভিক। একটুও বদলাসনি, একদম আগের মতই।"
"যার সঙ্গেই দেখা হোক সবাই একই কথাই বলে। বয়স বাড়লেও তার প্রভাব এখন বুঝতে দিয়নি, বুঝলি" কথা শেষে দু'জনেই হাসতে শুরু করল।
তিয়াসা বলল, "আচ্ছা আচ্ছা, কেমন আছিস বল"।
"ভালো, তুই?"
"তোর মত নিজেকে ফিট রাখার ক্ষমতা নেই ভাই"
"আচ্ছা। তাহলে আমার থেকেও কিছু শেখার আছে। চলে আসিস, ফিট থাকার মন্ত্র শিখিয়ে দেব"
তিয়াসা তারস্বরে হাসতে শুরু করল। সৌভিকও প্রথমে সঙ্গ দিয়ে পরে হাসিয়ে থামিয়ে বলল, "কাকু কাকিমা সবই ভালো আছেন তো?"
"বাবার ব্লাড প্রেসারটা বেড়েছে, আদারওয়ায়িস সবই ভালো"
যদিও এর উত্তরে সৌভিক কিছু বলল না। হঠাৎই নিশ্চুপ হয়ে তিয়াসাকে পর্যবেক্ষণ শুরু করল। এইভাবেই সৌভিক ওকে আগে দেখত। কিন্তু এখন এসবের মানে কী? দুজনের গতিমুখ এখন আলাদা। একে অন্যের জীবন থেকে বহু দূরে। রাগভিমান মনে থেকে নির্লিপ্ত। তিয়াসা অবাক হয়েই বলল, "কিরে? ওইভাবে কি দেখছিস?"
সৌভিক গম্ভীর হয়ে বলল, "তোর চোখ মুখ দেখে মনে হচ্ছে না তুই ভাল আছিস, এনি প্রবলেম?"
সৌভিকের চোখ ওর প্রতি আগের মতই তীক্ষ্ণ রয়েছে। মাত্র কয়েক মিনিটের সাক্ষাতেই সন্ধান করে ফেলেছে, তিয়াসার বুকের মাঝে লুকিয়ে থাকা সর্বস্ব ধ্বংসকারী ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির। বাধ্য হয়ে দ্রুত সৌভিকের প্রশ্নবাণ সামলে বলল, "ও কিছু না। কোম্পানিতে ক'দিন কাজের চাপ যাচ্ছে।"।
"কাজের চাপের ব্যাপারটা বুঝলাম। কিন্তু তাও তোর চোখে মুখের যন্ত্রণার ছাপ স্পষ্ট বুঝতে পারছি। কেমন একটা লাগছে। ঠিকমতো নিজের খেয়াল টেয়াল রাখিস?"
"ধুর, যতসব উল্টোপাল্টা প্রশ্ন"
"ওকে ওকে…"
তিয়াসা বলল,"বাই দ্যা ওয়ে, অফিস কি এখান থেকেই চালাচ্ছিস, এত কাগজপত্র ছড়িয়ে রয়েছে"।
টেবিলের ওপর থেকে হাত সরিয়ে চেয়ারে ঠেস দিয়ে সৌভিক একটু সিরিয়াস হয়েই বলল, "নীলিমার আজ ডেলিভারির ডেট আছে, পাশের নার্সিংহোমেই ভর্তি। অফিসের ইম্পরট্যান্ট কিছু ফাইলে সাইন বাকি ছিল। বললাম এখানেই নিয়ে চলে আসতে"।
'নীলিমা', 'ডেলিভারি' শব্দ দুটি তিয়াসার কানে তির্যকভাবে ঢুকল। সৌভিকের কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে বলল, "'নীলিমা'! নামটা আগে শুনিনি তো। ডেলিভারি…"।
সৌভিক কিছু বলতে যাবে তার আগেই তিয়াসা ওকে থামিয়ে, টেবিলের ওপর দু'হাতে ভর দিয়ে সৌভিকের যতসম্ভব কাছে গিয়ে প্রশ্নতুর চোখে বলল, "দাঁরা দাঁরা, তুই বিয়ে করেছিস? 'নীলিমা' তোর স্ত্রীর নাম?"
তিয়াসার দু'চোখে প্রশ্নের উদ্রেক দেখে সৌভিক অবাক হয়ে বলল, "হুম, নীলিমা আমার স্ত্রী"।
"ও, কিন্তু তুই বিয়ে করলি কবে?"
"লাস্ট ইয়ারের জুনে"
"আমায় জানালি না কেন?"
"কাউকেই বলিনি রে"
তিয়াসা আর কোনো কথা না বলে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। সৌভিক তিয়াসার মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে প্রত্যক্ষ করল, কীভাবে ওর বিয়ে করার কথা শুনে ধীরেধীরে তিয়াসার যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখের ব্যথার রেখাগুলো প্রকট হয়ে উঠল। চেয়ার থেকে পিঠ সরিয়ে নিয়ে তিয়াসার ন্যায় বসে, মৃদু স্বরে বলল, "আমি বিয়ে করব, ভাবতে পারিস নি, বল?"
"না, তা কেন হবে। সবাইকে এই বাঁধনে একদিন বাঁধা পড়তেই হবে"
"তাহলে তোর চোখেমুখে আনন্দ নেই কেন, খুশি হস নি?"
"তুই বিয়ে করেছিস, কিছুক্ষণের মধ্যে তোদের জীবনে নতুন অতিথি আসতে চলেছে। আর আমি খুশি হব না!"
সৌভিক স্পষ্টতই বুঝতে পারছে তিয়াসা কথাগুলো একপ্রকার জোর করেই বলছে। ওর কথা শেষ হওয়ার আগেই ভারী গলায় বলল, "আমার আনন্দে তুই কতটা আনন্দিত হতিস, তা আমি জানি তিয়াসা। কেন এড়িয়ে যাচ্ছিস?"
তিয়াসা মাথা নামিয়ে চুপ করে রইল। সৌভিক ওর উত্তরের অপেক্ষায় এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে। কয়েক মিনিটের নিস্তব্ধতার পর সৌভিক লক্ষ্য করল তিয়াসার মনের গুমোট ভাব বিন্দু বিন্দু জলকণার ন্যায় টেবিলের ওপর অঝরে ঝড়তে লাগল। কম্পিত গলায় বলল, "আমি কেন সেদিন তোকে ছেড়ে চলে গেছিলাম বলত, আজ এই খুশিটা আমাদের দুজনের হত…"
তিয়াসার থেকে এই কথা সৌভিক প্রত্যাশা করেনি। একটু বিরক্ত হয়েই বলল, "কি বলছিস তুই তিয়াসা, তোর হুঁশ আছে!"
"আমি ভালো নেই সৌভিক, সেদিন তোকে ছেড়ে চলে যাওয়ায় আমার সব থেকে বড়ো ভুল ছিল"
"মানে! কি হয়েছে বল"
"আমার ডিভোর্স হয়ে গেছে, ও আমায় বোঝেনি রে"
কথাটা শুনেই ওর হৃদস্পন্দন কয়েক মুহূর্তের জন্য থেমে গেল। তিয়াসা মনের মধ্যে শত দুঃখ নিয়ে বেঁচে আছে, সে কথা ওকে একবার দেখেই বুঝেছিল। কিন্তু বুকের মাঝে দাবানল জ্বলছে আন্দাজ করতে পারেনি। সৌভিকের নতুন সুখী জীবনের কথা দাবানলের ধংসাত্মক রূপকে অন্য মাত্রা দিয়েছে। মনের মাঝে লক্ষাধিক প্রশ্ন নিয়ে বলল, "তোর মতো মেয়েকে ডিভোর্স দিয়ে দিল! বুঝতে পারল না। সত্যি করে বলত ও তোর যোগ্য ছিল?"
"আমি জানি না সৌভিক"
"তোদের মেয়ে কোথায়, কার কাছে থাকছে…"
কথা শুনে তিয়াসা অবাক হল। ভেবেছিল হয়তো সৌভিকও ওর মতোই খোঁজ রাখেনি। কিন্তু বাস্তব সম্পূর্ণ উল্টো। তিয়াসার মেয়ের কথাও সৌভিক জানে! অশ্রুজল নিয়ন্ত্রন করে বলল, "আমার কাছেই থাকছে। ওর বাবা ওকে দাবী করেনি"।
তিয়াসার দুই হাতের তালু শক্ত ভাবে ধরে বলল, "ওই তোর একমাত্র বাঁচার সম্বল তিয়াসা। ওর জন্য বাঁচতে হবে তোকে। এইভাবে শেষ হয়ে করে দিস না নিজেকে"।
তিয়াসা মাথা নাড়ল। ঝড় বয়ে যাওয়া দু'চোখ তুলে বলল, "তুই আমার খোঁজ রাখতিস বল, আর আমি কেমন দেখ।"
"সেসব কথা ছাড়"
"না'রে। বল না তুই আমার খজ রাখতিস কিনা?"
তিয়াসার করুন আকুতি ফেলতে পারল না। তিয়াসার থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে, দূরে টেবিলে থাকা গোলাপের স্তবকগুলির দিকে তাকিয়ে বলে চলল, "তোর বিয়ের পর আমি রোজই তোর খোঁজ নিতাম। তুই ভালো আছিস কিনা জানার চেষ্টা করতাম। মনে মনে ভাবতাম ও যদি কোনো দিন তোকে কষ্ট দেয়, তোকে অস্বীকার করে, আমি তোকে নিয়ে পালিয়ে যাব। তোকে নিয়ে বাঁচব। কিন্তু যেদিন শুনলাম তোদের মেয়ে হয়েছে, উপলব্ধি করলাম তোদের সম্পর্কটা শুধু রেজিস্ট্রি পেপারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। সেটা অনেক গভীর হয়ে গেছে, অনেক…"
তিয়াসা নিঃশব্দে কেঁদে চলল। উষ্ণ চোখের জল ফোঁটা ফোঁটা রুপে হাতে পরতেই, সৌভিক ওর দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে বলল, "তারপর আর তোর খোঁজ নিইনি। সেদিনের পর থেকে তোকে ভুলতে চেয়েছিলাম। তখন যদি জানতাম আজ এমন হবে" সৌভিকের কথা রুদ্ধ হল।
"তুই এসব নিয়ে ভাবিস না সৌভিক। নীলিমার তোকে এখন প্রয়োজন। নতুন কেঊ আসছে তোদের লাইফে" কোনক্রমে আবেগ সামলে তিয়াসা বলল।
"সেদিনর ভাবনায় যদি আজও স্থির থাকতাম, তাহলে আজ এক্ষুনি তোকে"
সৌভিকের কথা শেষ হওয়ার আগেই তিয়াসা ওকে থামিয়ে বলল, "এই জন্যই তোকে কিছু বলতে চাইনি। এবার তুই এইসব নিয়েই ভেবে সময় কাটাবি"।
"না মানে"
"চুপ, একদম কথা না। তোর ওয়াইফের ডেলিভারি কখন?"
"ন'টায়"
"এখন কটা বাজে দেখ?"
তিয়াসার কথা শুনে সৌভিক ফোন অন করে দেখে সাতাটা পেরিয়ে গেছে। ধীর গলায় বলল, "সাতটা কভার হয়েছে"
নিজের দু'হাত সৌভিকের স্পর্শ থেকে সরিয়ে নিয়ে অনুরোধের সুরে বলল, "আর সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না। তুই দেরি করিস না"।
"কিন্তু তুই"
"আর কিছুক্ষণ বসেই চলে যাব"
"একাই থাকবি?"
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, "আজ অনেকদিন পর পুরানো স্মৃতিগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। ওগুলো ভেবে আধ ঘণ্টা ঠিক কাটিয়ে দেব। ভাবিস না তুই"।
কথা শেষ করার আগেই সৌভিকের ব্যাগ হাতে তুলে নিয়ে ওর দিকে বাড়িয়ে, ফাইল গুলো ভরে নিতে নির্দেশ করল। সৌভিকও সময়ের গুরুত্ব বুঝে ফাইল ব্যাগ বন্দি করল। চেয়ার ছেড়ে উঠে বলল, "ফোন নম্বারটা নিয়ে নে। পারলে একবার নার্সিংহোমে আসিস"।
মিষ্টি হেসে তিয়াসা সৌভিকের ফোন নম্বার টাইপ করে নিয়ে বলল, "নীলিমার জন্য আমার তরফ থেকে আগাম অভিনন্দন। ফুটফুটে বেবি হোক প্রে করছি"।
"থ্যাঙ্ক ইয়উ"
"আগাম শুভেচ্ছা"
"মেয়ের খেয়াল রাখিস। সাবধানে থাকিস।"
তিয়াসা আর কোনো প্রত্যুত্তর না দিয়ে সুমিষ্ট হাসল। সৌভিক একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে, ব্যাগ নিয়ে ক্যাফ থেকে বেরোনোর রাস্তার দিকে পা বারাল। চোখের সামনে থেকে সৌভিক সম্পূর্ন অদৃশ্য না হওয়া অবধি তিয়াসা আপলক তাকিয়ে রইল।
সৌভিক অদৃশ্য হতেই তিয়াসার চোখ পড়ল টেবিলের ওপরে থাকা কাগজের টুকরো গুলর ওপর। সেগুলিতে পেন দিয়ে কিছু একটা লেখা রয়েছে। আনমনা হয়ে কাগজের টুকরোগুলো নাড়াচাড়া করতে আরম্ভ করল। কিন্তু অদৃষ্টের লিখন বড়ই অদ্ভুত। বেশ কয়েকটি টুকরো একত্রিত হতেই এক পরিচিত নামের অর্ধেক বুঝতে পারল। মুহূর্তে চমকে উঠল তিয়াসা। ছড়িয়ে থাকা বাকি টুকরো গুলো দ্রুত কাছে টেনে নিয়ে জোড়ার চেষ্টা করতে লাগল। সামান্য প্রচেষ্টায় সে কাজ সম্ভব হতেই তিয়াসা হতভম্ব হয়ে পড়ল। দুটো নাম লেখা আছে তাতে। সৌভিকই লিখেছে, ওর হাতের লেখা তিয়াসার আজও মনে আছে। তাছাড়া নাম দুটো ওরা দুজনে মিলে রেখেছিল আজ থেকে পাঁচ বছর আগে। ওদের ভালোবাসার পরিণতির মুখেদের আগাম নাম। ধীরে ধীরে তিয়াসার চোখ দিয়ে পুনরায় রাশিরাশি জলকণা বেড়িয়ে আসতে লাগল। সৌভিক আজও ওকে মনে রেখেছে! জীবনের চরম প্রাপ্তির সময়েও ফেলা আসা প্রেমিকাকেই আত্মস্থ করছে। সেদিন ওকে ছেড়ে যাওয়ায় অনুতপ্ত হতে লাগল তিয়াসা। কম্পিত হাতে কাগজের টুকরোগুলো ব্যাগবন্দি করল। তবে এই যন্ত্রণার মাঝেও প্রাপ্তি আছে। এক অনন্য পাওয়া। অনুভব করল, জীবনের লড়াইয়ে হেরেও ও জিতেছে। ওদের ভালোবাসা আজও অটুট রয়েছে। তৃপ্তি এখানেই। হয়তো আর কোন দাবানল ওকে তপ্ত করতে পারবে না। এবার শুধু মেয়ের জন্য বাঁচা। নতুনভাবে নতুন কিছু পাওয়ার খোঁজে নিমজ্জিত হওয়া।
লেখক পরিচিতি ঃ
নাম- সেখ মেহেবুব রহমান
গ্রাম- বড়মশাগড়িয়া
ডাকঘর- রসুলপুর
থানা- মেমারী
জেলা- পূর্ব বর্ধমান
রাজ্য- পশ্চিমবঙ্গ
ডাকঘর সংখ্যা- ৭১৩১৫১