শ্রাবনের রোদ্দুর (প্রথম পর্ব)
সুপ্তা আঢ্য
" গো--- ও--- ল, গো - - ও-- ও-- ল"
দেখলেন স্যার, আবারো একটা কি দারুণ গোল দিল আমাদের শ্রাবণ ।
দেখো দেখো সুবিমল, ছেলেরা জিতে গিয়ে শ্রাবনকে কোলে তুলে আনন্দে নাচানাচি করছে। আর শ্রাবণ---বরাবরের মতই আজও চুপচাপ, ওর কোনো হেলদোল নেই।
ঠিক বলেছেন স্যার। ওর নাম আর স্বভাব একইরকম - - - - স্বভাবগম্ভীর।
বাংলার শিক্ষক সুবিমল বাবুর কথায় হেসে উঠলেন অধ্যক্ষ মহারাজ প্রাণতোষ বাবু। ওনার নির্দেশে সুবিমল বাবু মাইক হাতে নিয়ে বলতে লাগলেন, " বিগত পনেরো দিন যাবৎ বিভিন্ন আবাসিক বিদ্যালয়ের মধ্যে যে ফুটবল টুর্নামেন্ট আয়োজিত হয়েছে, আজ শেষ ফাইনাল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছিল' নতুন জীবন অনাথ আশ্রম' ও' আশা অনাথ আশ্রমের' মধ্যে। এদের মধ্যে বিজয়ী হয়েছে
' নতুন জীবন অনাথ আশ্রম', আর সর্বোচ্চ গোলদাতা আমাদের আশ্রম এরই ছাত্র শ্রাবণ সেনগুপ্ত।
সবাই বোধহয় তৈরিই ছিল। সুবিমল বাবুর কথা শেষ হবার সাথে সাথেই পুরোমাঠ হাততালিতে ফেটে পড়ল। আজ সবাই ভীষণ খুশি---- সর্বোচ্চ গোলদাতা আর কেউ নয় - - - বরাবরের মতই আজও সেই শ্রাবণ। সুবিমল বাবুর ঘোষণা মত শ্রাবণের হাতে পুরস্কার তুলে দিতে এগিয়ে এলেন ফুটবল জগতের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব এবং এই আশ্রমের ভালো মন্দের সাথে বহুদিন ধরে যুক্ত অর্কজ্যোতি চৌধুরী। শ্রাবনকে দেখে এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেলেন অর্কজ্যোতি। কোনওরকমে নিজেকে সামলে পুরস্কারটা ওর হাতে তুলে দিয়ে অভিনন্দন জানিয়ে নিজের চেয়ারে বসলেও মনের ভিতরটা উথাল পাথাল করছিল। বারবার ছেলেটির দিকে চোখ চলে যাচ্ছিল অর্কজ্যোতির । এক অদ্ভূত অজানা টান অনুভব করছিলেন ভিতরে ভিতরে। অনুষ্ঠানের শেষে আশ্রমিকরা শ্রাবণ কে নিয়ে হৈ হৈ করতে করতে চলে গেলে হঠাৎ করেই বুকের ভিতরটা ফাঁকা হয়ে গেল অর্ক জ্যোতির। আজকের বিখ্যাত ফুটবলার অর্কজ্যোতি চৌধুরী এই অনাথ আশ্রমের সাথে বহুদিন ধরে যুক্ত, নিয়মিত অর্থ সাহায্য ছাড়াও বহু আশ্রমিক কে বিভিন্নভাবে সাহায্য করেছেন উনি----এখনো তাই করে চলেছেন। সব আমন্ত্রিত অতিথিরা চলে গেলে অধ্যক্ষ মহারাজের কাছে শ্রাবণ সম্পর্কে সবকিছু জানার পর বললেন " ওর ভবিষ্যৎ জীবন তৈরীর জন্য যা প্রয়োজন আমাকে বলবেন---আজ থেকে আমি ওর দায়িত্ব নিলাম।" ওনার কথায় অধ্যক্ষ মহারাজ কিছু না বলে নীরবে হাসলেন, নীরব হাসিতে অনেক না বলা কথা গোপন করা যায়।
আশ্রম থেকে ফিরে এসেও মন শান্ত হচ্ছিল না অর্কজ্যোতির। শ্রাবনের মুখটা বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল।" এ আমি কাকে দেখলাম! এ যেন আমার কৈশোর আমার সামনে ধরা দিয়েছে। কিন্তু ওই চোখ, ওই হাসি---- ও যে বড়ই পরিচিত! এটা কি করে সম্ভব? তাহলে কি---!"
" কিরে, দরজা খোলা রেখে ঘর অন্ধকার করে বসে আছিস যে! মাঠে সিলেকশন নিয়ে কোন গোলমাল হয়নি তো? কিরে, কোন প্রবলেম?
মনোজের কথায় সম্বিত ফিরে পেয়ে হেসে বলল" নারে! আজ 'নতুন জীবনে' গিয়েছিলাম। বাচ্চাগুলোর খেলা দেখতে দেখতে আমাদের সেই চেনা মাঠ, পুরনো দিনগুলোয় ফিরে গিয়েছিলাম।"
বেশ কিছুক্ষণ কথা বলে মনোজ চলে গেলে অন্ধকার ছাদে দাঁড়িয়ে রইল অর্কজ্যোতি। আজ আর আলোর মুখোমুখি হবার ইচ্ছে হচ্ছিল না ওর। অতীতকে ভুলে থাকার জন্যই নিজেকে চরম ব্যস্ততায় ব্যস্ত করে রাখলেও আজ সেই অতীতই প্রশ্নবানে জর্জরিত করছে ওকে। অন্ধকারে চোখ বন্ধ করতেই শ্রাবণের সাথে সাথে আর একটা মুখ ভেসে উঠছিল বার বার। অর্ক কিছুতেই বুঝতে পারছিল না----- এতদিন ধরে ওই আশ্রমের অনেক ছেলেকে ও দেখেছে। আজ হঠাৎ শ্রাবনকে দেখে এই অন্য অনুভূতির কারণ কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছিল না অর্ক । আর এই না বোঝা, খুঁজে না পাওয়া ওকে আরো অস্থিরচিত্ত করে তুলছিল।
পরদিন সারাটা সময় জুড়ে কাজের ফাঁকে ফাঁকে শ্রাবনের ওই নিষ্পাপ মুখটা বারবার মনে পড়ছিল" যেভাবেই হোক শ্রাবণ সম্পর্কে সবকিছু জানতেই হবে।" 'নতুন জীবনের' অধ্যক্ষ মহারাজের সাথে কথা বলে বেশ কিছুটা সময় চেয়ে নিল ও।
সময়মতো অর্ক যখন' নতুন জীবনে' পৌঁছলো, তখন সন্ধ্যা আগত প্রায়। প্রদীপের আলোয় রোজকার মত আশ্রম সেজে উঠেছে, প্রার্থনা গৃহে সমবেত কন্ঠে মন্ত্রোচ্চারণ ও প্রার্থনা সংগীত হচ্ছে। সুরের মূর্ছনায় আবিষ্ট হয়ে পায়ে পায়ে প্রার্থনা কক্ষের সামনে গিয়ে দেখল---- সমবেত সঙ্গীত শেষে আশ্রমিকরা চোখ বুজে হাতজোড় করে পদ্মাসনে বসে আছে আর ঈশ্বরের সামনে প্রার্থনা সংগীত গাইছে শ্রাবণ। খেলাধুলার সাথে সাথে সুরের দক্ষতাও ওর অপূর্ব---- মা সরস্বতী স্বয়ং ওর কন্ঠে যেন বিরাজ করছেন। অস্থিরতা টা আবার বেড়ে উঠলো। এই গানের ভঙ্গিমাটি ওর বড় পরিচিত। শ্রাবনকে যতই দেখছে, ওর মন ততই উচাটন হয়ে উঠছে।
আরে, অর্কজ্যোতি বাবু, আপনি এসে গেছেন? আমি আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। চলুন অফিসে যাওয়া যাক।
আমি আসলে ওদের গান শুনছিলাম। কি অসাধারণ উপস্থাপনা ওদের। আমিতো মুগ্ধ হয়ে গেছি। আর ওই যে ছেলেটি একা গান করছিল, ওতো মা স্বরস্বতীর আশীর্বাদ ধন্য।
একদম ঠিক বলেছেন, শ্রাবন তো আমাদের গর্ব। লেখাপড়া, খেলাধুলা, গান---- সবকিছুতেই পারদর্শী ও। স্বভাবটাও বড় ভালো।
এটা আপনি ঠিক বলেছেন মহারাজ। কাল ওর খেলা দেখার পর থেকেই একটা আকর্ষণ বোধ করছিলাম। আর আজ ওর গান শোনার পর তো অভিভূত হয়ে গেছি। ওকে একবার ডাকবেন--- কথা বলতাম ওর সাথে।
অবশ্যই---- চলুন অফিসে বসেই কথা বলা যাবে।
কিছুক্ষণ পরেই শ্রাবণ এসে শান্ত, নতমুখে দাঁড়াল।
তোমার নাম কি? আমাকে চেনো তুমি?
উচ্ছসিত শ্রাবণ অবলীলায় আত্মসংযম করে মুখ নীচু করে বলল"শ্রাবণ সেনগুপ্ত। আপনি তো খুব ভালো ফুটবল খেলেন, টিভিতে দেখেছি আপনাকে।"
তোমার ভালো লাগে ফুটবল খেলতে?
হ্যাঁ---- ভীষণ। আমি তো বড় হয়ে আপনার মতোই হতে চাই।
ওকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে অর্কজ্যোতি বলল " না শ্রাবণ, তুমি আমার থেকেও বড় খেলোয়াড় হবে। আমি অধ্যক্ষ মহারাজের সঙ্গে কথা বলছি। তোমাকে ভালো কোচিং এ ভর্তি করে দেব। এতে তুমি আরো উন্নতি করতে পারবে। আচ্ছা শ্রাবণ, তোমার কোন ক্লাস চলছে যেন?
খুব নম্র স্বরে বলল" আমি ক্লাস নাইনে পড়ি"।
" ঠিক আছে শ্রাবণ, তুমি এখন নিজের ঘরে যাও। আর হ্যাঁ, খেলার সাথে সাথে লেখাপড়া টাও কিন্তু মন দিয়ে করতে হবে"।
শ্রাবণ চলে যেতেই অর্ক জ্যোতি অধ্যক্ষ মহারাজ কে জিজ্ঞেস করল" ওকে কোথায় পেয়েছিলেন? বড় সুন্দর ছেলেটি! এত সুন্দর বাচ্চাকে কেন যে কেউ ফেলে যায়? "
একটু চুপচাপ থাকার পর অধ্যক্ষ মহারাজ বললেন" ওকে কেউ ফেলে যায়নি। ওর জন্ম কাহিনী আর পাঁচটা বাচ্চার থেকে একটু আলাদা। আমরা এটা সবার কাছ থেকে গোপন রাখার চেষ্টা করেছি। আজ আপনাকে বলব, কিন্তু আপনার কাছে অনুরোধ দয়া করে আপনি এটা গোপন রাখবেন।
অর্কজ্যোতির সম্মতি পেয়ে অধ্যক্ষ মহারাজ বললেন" আজ থেকে ষোলো বছর আগে এক ভোরবেলা আশ্রমের দরজার বাইরে এক যুবতী মেয়েকে অসুস্থ অবস্থায় পাওয়া যায়। চিকিৎসার পর জানা যায়, মেয়েটি গর্ভবতী ও কুমারী। ভালোবাসা পরিত্যক্ত হলেও ভালোবাসার চিহ্নকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য ও মরিয়া ছিল। অনাগত শিশুটিকে বাঁচাতে আমরাও সকলে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। মেয়েটি মানসিকভাবে এতটাই বিধ্বস্ত ছিল যার প্রভাব পড়েছিল ওর শরীরে। বাঁচার কোন আশাই ছিল না ওর । অনেক বছর অনাথ শিশুদের সাথে আছি। কিন্তু চোখের সামনে একটা সদ্যোজাত শিশুকে অনাথ হতে দেখতে মন চাইছিল না। তাই সবার প্রার্থনায় আর দৈব কৃপায় মেয়েটি বেঁচে যায়। কিন্তু আশ্রমের নিয়মানুসারে শ্রাবণ একটু বড় হবার সাথে সাথেই ওর মাকে ওর থেকে আলাদা থাকতে হয়। ও এখন শুধুমাত্র নবজাতকদেরই দেখাশোনা করে। বড়ো ধৈর্যশীলা, মমতাময়ী মা ও। "একটানা বলার পর একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়লেন অধ্যক্ষ মহারাজ ।
ওনার সাথে দেখা করা যায় না?,
সেটা সম্ভব নয় অর্কজ্যোতিবাবু। সেদিনের পর থেকে ও কখনও নিজের সন্তানের মুখোমুখি হয় নি। শ্রাবণ আজও জানে না ওর মায়ের পরিচয়। ও শুধু দূর থেকে জলভরা চোখে ছেলেকে দেখে আর প্রানভরে আশীর্বাদ করে। মৈত্রেয়ীর স্বপ্নকে সামনে রেখেই শ্রাবণকে বড়ো করে তোলার চেষ্টা করছি আমরা।
মৈত্রেয়ী - - - বুঝি ওর মায়ের নাম?
হ্যাঁ---- তবে এটা আশ্রম এর দেওয়া নাম। পূর্বাশ্রমের নামে ও আর নিজেকে পরিচিত রাখতে চায়নি। বড় অভিমানিনী মেয়ে ও, এতো কষ্ট পেয়েও ছেলের মুখের দিকে তাকিয়েই বেঁচে আছে আজ।যদি কখনও সম্ভব হয় অবশ্যই আপনার সাথে পরিচয় করিয়ে দেবো---- কিন্তু একটা অনুরোধ, ও যে শ্রাবনের মা---- এই পরিচয়টা প্রকাশ করবেন না।
সবকিছু শোনার পর একটু মুচকি হেসে অর্কজ্যোতি বলল" আপনি ওর মায়ের অনুমতি নিয়ে নেবেন। কাল ওকে ফুটবল একাডেমিতে ভর্তি করতে নিয়ে যাব।
একটু রাত বাড়তে, অধ্যক্ষ মহারাজ পায়ে পায়ে এসে পৌছলেন' প্রথম আলো' বিভাগে। মৈত্রেয়ী তখন একটি শিশুর দেখাশোনায় ব্যস্ত। পিছন থেকে গিয়ে ওর মাথায় হাত রাখতেই চমকে তাকিয়ে বলে" মহারাজ আপনি? সব ঠিক আছে তো?" আমার শ্রাবণ কোন অন্যায় করেনি তো?
" শান্ত হও মৈত্রেয়ী মা। এত উত্তেজনা তোমার শরীরের পক্ষে ভালো নয়। শ্রাবণ তোমার সন্তান, ও কি কখনো খারাপ হতে পারে? আমি আজ এসেছি, তোমাকে কিছু কথা বলতে। বিখ্যাত ফুটবলার অর্কজ্যোতি চৌধুরী ওর খেলা দেখে মুগ্ধ হয়ে ওকে ফুটবল কোচিং এ ভর্তি করতে চান। শুধু তাই নয়, ওর ভবিষ্যৎ জীবনে চলার পথে কান্ডারী হতে চান উনি। তোমার কোন আপত্তি নেই তো? "
" অর্কজ্যোতি চৌধুরী----!" নামটা দুবার বিড়বিড় করে পাথরের মূর্তির মত স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল মৈত্রেয়ী।
দেখো মৈত্রেয়ী, এত বড় একটা সুযোগ ও হয়তো আর পাবেনা। আর তাছাড়া উনি খুব ভালো মানুষ---- অনেক বাচ্চারই দায়িত্ব নিয়েছেন আগেও।তোমার কোনো আপত্তি নেই তো?
মৈত্রেয়ী মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিল। ওর মনের ভিতরের ঝড়টা কান্না হয়ে বেরিয়ে আসতে চাইলেও অনেক কষ্টে তাকে মনেই আটকে রেখে মৃদুস্বরে বলল"ওর সব দায়িত্বই তো আপনার। আমি আর কি বলব - - -"
রাত বাড়তে চারিদিক নিস্তব্ধ হয়ে গেলে জানালার পাশে বসল মৈত্রেয়ী। কী অসাধারণ নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে চারিদিকে। সারাদিনের ক্লান্তির শেষে সকলেই নিজেদের নিদ্রাদেবীর হাতে সঁপে দিয়েছে। চাঁদ তারারাও সারা আকাশ জুড়ে নিজেদের গল্পের ডালি সাজিয়ে বসেছে। আর মৈত্রেয়ী না পারছে ওর প্রিয় রজনীর নিঝুমতার সাথে একাত্ম হতে, না পারছে নিদ্রাদেবীকে আহ্বান জানাতে। ওর মনের মধ্যেকার উথাল পাথাল করা কালবৈশাখী ঝড় আজ বহুবছর পর বেরিয়ে এসে সবকিছুকে ওলটপালট করে দিতে চাইছে। নিয়তির কী নিষ্ঠুর পরিহাস! যে অতীতকে ও অন্তরের অন্তঃস্হলে সবার চোখের আড়ালে শুধু নিজের করে রাখতে চেয়েছিল, আজ সে বর্তমান হয়ে ওর একান্ত আপন ভবিষ্যতকে নিয়ে এক নতুন খেলায় মেতেছে। এক অজানা আশঙ্কায় বুকটা কেঁপে ওঠে মৈত্রেয়ীর। "শ্রাবণের জন্যই যে আমার শ্বাস নেওয়া। নাইবা চিনল আমাকে মা বলে - - - তবু তো আমি ওরই মা!" একটা ঝড়ের ইংগিত পায় ও। সেই ঝড়ে এতদিন ধরে লালিত স্বপ্নটা যদি আবার ভেঙে যায় - - - -! আর ভাবতে পারে না মৈত্রেয়ী। একটা চাপা কষ্ট জমাট বাঁধতে থাকে ওর ভিতরে।
ক্রমশঃ -------