।।২।।
পরদিন সকালে আড়াল থেকে শ্রাবনকে অর্কর সাথে বেরোতে দেখে মৈত্রেয়ী। শরীর খারাপের অজুহাতে নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ে ও। চোখের সামনে ভেসে ওঠে মনের পাতায় ভিড় করে থাকা স্মৃতিগুলো। আজকের বিখ্যাত ফুটবলার সেদিন ছিল এক উঠতি তরুণ। ওর চোখে ছিল হাজারো স্বপ্ন যে স্বপ্নে নিজের সাথে সাথে মৈত্রেয়ীকেও রাঙিয়ে দিত ও। বয়সে কিছুটা ছোটো হওয়ায় মৈত্রেয়ীর আব্দার, ছেলেমানুষী বড়ো অনায়াসে মেনে নিত অর্ক। ওর নাকটা টিপে ধরে বলত"তুমি এখনও ছোটই রয়ে গেলে রাই। একটা বাচ্চা মেয়ের সাথে প্রেম করছি বলে জেলে না যেতে হয় আবার।" মৈত্রেয়ী রাগ করে মারত অর্ককে, আর স্বভাব সিদ্ধ প্রাণখোলা হাসিতে ভাসিয়ে নিয়ে যেত অর্ক ওর রাইকে। মৈত্রেয়ীর পৃথিবীর পরিধিটা জুড়ে ছিল শুধু অর্ক। একটা ছোট্ট ঘটনায় ওদের নিষ্কলুষ ভালোবাসার নৌকোর গতিপথটা কোথায় হারিয়ে গেল।
এক বর্ষার দিনে কলেজে যাওয়ার পথে অর্ককে ফোন করতেই ওর বন্ধু মনোজ ফোনটা ধরে অর্কর অসুস্থতার কথা জানায়। অর্কর কষ্ট ও কিছুতেই সহ্য করতে পারত না। কলেজে না গিয়ে অর্কর কাছে গিয়ে দেখল ও জ্বরে প্রলাপ বকছে আর মনোজ ওর কপালে জলপট্টি দিচ্ছে। রাইকে দেখে মনোজ বলে "তুমি ওর কাছে থাকো। আমি বরং ওষুধগুলো নিয়ে আসি।" পরম মমতায় রাই ওর কপালে জলপট্টি দেয় আর মাথায় হাত বোলাতে থাকে। জ্বরতাপিত কপালে শীতল নরম চেনা হাতের ছোঁয়ায় নিশ্চিন্তে নিজেকে সঁপে দেয় অর্ক। কিছুটা পরে একটু জ্বর কমলে সামনে ওর রাইকে দেখে অবাক হলেও বেশ খুশিই হয় অর্ক। ওর সেদিনের দৃষ্টিতে এমন কিছু ছিল যা রাই অস্বীকার করতে পারেনি। সবকিছু ভুলে ভালোবাসার জোয়ারে ভেসে গেল দুটি হৃদয়। সেই একটা দিনের মধুর মিলন স্মৃতিকে মনের মতো করে অন্তরের অন্তঃস্হলে সাজিয়ে রেখেছে রাই ।
বেশ কিছুদিন পর নিজের ভিতর আর একটা প্রাণের স্পন্দনের কথা টের পায় রাই। এমনিতেই রাই অব্রাহ্মণ হওয়ায় ওদের সম্পর্কের পরিনতি নিয়ে প্রথম থেকেই উদ্বিগ্ন ছিল অর্ক। এই পরিস্থিতিতে ও আর নতুন করে অর্ককে বিব্রত করতে চায়নি। আমাদের সমাজে মাতৃত্ব অহংকার হলেও কুমারী মায়ের পূজা কেউ করে না। তাই ওদের ভালবাসার নিদর্শনকে সম্মান জানাতে আর সবাইকে বিড়ম্বনার হাত থেকে মুক্তি দিতে এক গহীন অন্ধকার রাতে নতুন ঠিকানার খোঁজে ঠিকানাবিহীন হয়েছিল ও। অনেক ঝড়ঝাপটা পেরিয়ে অসুস্থ শরীরে এই আশ্রমে পৌঁছেছিল রাই। ও আর ওর অনাগত সন্তান আশ্রয় পেয়েছিল এখানে। ওর নতুন নাম হয়েছিল মৈত্রেয়ী। পুরোনো সবকিছুকে সবার থেকে আড়ালে রেখে বর্তমানকে সাথে নিয়ে পথ চলছিল ও। এইসব ভাবতে ভাবতে কখন যেন চোখটা লেগে গিয়েছিল মৈত্রেয়ীর।হঠাৎ প্রচন্ড ঝড়ের দাপটে ঘুমটা ভেঙে যেতেই বাইরে বেরিয়ে দেখল ঝড়ের দাপটে গাছগুলো নুয়ে পড়ে পবনদেবকে স্বাগত জানাচ্ছে। সাথে কাড়া - নাকাড়ার মতো মেঘ বজ্রের গর্জনের মাঝেই রূপালী আলোর ঝলসানিতে নিজের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে বিদ্যুল্লতা। শ্রাবণের জন্য মাতৃহৃদয় উতলা হয়ে উঠল।
ওদিকে সারাটা দিন মিঃ চৌধুরীর সাথে কাটিয়ে ফুটবল অ্যাকাডেমিতে ভর্তি হওয়ার আনন্দে এতটাই মশগুল যে বাইরে ঝড়ের দাপট অনুভব করতেই পারে না। শ্রাবনের বন্ধুরাও ওর এই ভাবান্তরে বেশ অবাকই হয়ে যায়।
কিরে শ্রাবণ, তুই তো এত ঝড় ভালবাসিস ! বাইরে যাবি না? রাজেন জানতে চাইল।
ওর কথায় স্বপ্নের জগতে ভাসতে ভাসতে শ্রাবণ বলল"জানিস রাজেন, চৌধুরী স্যার না ভীষণ ভালো। খেলার ব্যাপারে কত কি জানেন! আর সবাই ওনাকে কত সম্মান জানায়!"
সেতো হবেই----! অত বড় একজন খেলোয়াড় বলে কথা।
ঠিকই বলেছিস। কিন্তু জানিস,ওনার একটুও অহংকার নেই। কত গল্প করলেন আমার সাথে। ওনার ছোটবেলার কথাও বললেন।
তোর ইচ্ছের কথাটাও ওনাকে বলেছিস নাকি?
হ্যাঁ, বলেছি তো। উনি বলেছেন আমাকে সব রকম ভাবে সাহায্য করবেন। তবে সামনেই পরীক্ষা তো, তাই এখন পড়াশোনায় বেশি করে মন দিতে বলেছেন।
তুই কি বাইরে যাবি?
নাঃ---- তুই যা। সারাদিন পড়া হয়নি। আমি বরং একটু পড়তে বসি।
বই সামনে থাকলেও আজ শ্রাবণের মন ছিল অন্য কোথাও। বড্ড মনে পড়ছিল চৌধুরী স্যারকে। ওনার প্রতি এক অন্যরকম আকর্ষণ অনুভব করছিল ও। হঠাৎ জানালার বাইরে বৃষ্টি দেখে মনটা উদাস হয়ে যায় শ্রাবণের। শ্রাবণ জানে---ও অনাথ। তবু মাঝে মাঝে নিজের কারোর জন্য মনটা বড় উচাটন হয়ে যায়। মনে হয় ওর যদি মা থাকতো----! মায়ের অভাব আজকাল বড়ো বেশি করে অনুভব করে শ্রাবণ। তবে সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার - - - চৌধুরী স্যারের কাছে গেলেই সব অভাববোধ এক নিমেষে উধাও হয়ে যায়। ওনাকে খুব কাছের মনে হয় - - - - একেবারে নিজের কোনো আপনার জন।
শ্রাবণকে 'নতুন জীবনে' ছেড়ে আসার পর থেকেই মনটা ভার হয়ে আছে অর্কর। সারাদিন একসাথে কাটানোর পর থেকেই ওকে আর কাছছাড়া করতে মন চাইছিল না অর্কর। হঠাৎ করে রাই জীবন থেকে চলে গিয়ে একটা বড়ো প্রশ্নচিহ্ন রেখে যায় ওর সামনে যার ভার ও আজও বয়ে চলেছে। রাই-এর জন্য অপেক্ষায় আর প্রশ্নের ভার বইতে বইতে কখন যে রাই ওর সমস্ত সত্ত্বার সাথে মিশে গেছে বুঝতেই পারেনি অর্ক। আলাদা করে রাইকে মনে করার প্রয়োজনই হয় না আজ আর। আজও ওর হৃদয়- সিংহাসনটা নববধূর আগমনের অপেক্ষায় সুসজ্জিত হয়ে অপেক্ষা করছে। আজ হঠাৎ শ্রাবণ এসে নিজের অধিকারেই কখন যেন সেই জায়গাটা দাবী করছে। ওরা দুজনেই সেই অধিকারকে অনুভব করতে পারে - - - শুধু জানে না কিসের সেই অধিকার? আর এই নতুন প্রশ্নের ভার অর্ককে আরও অস্থির করে তুলছে। বড়ো ইচ্ছে করে শ্রাবণ কে নিজের কাছে রাখতে, অপূর্ন স্বপ্নগুলো শ্রাবণের চোখে এঁকে দিয়ে ওর জীবনটাকে স্বপ্নীল করে তুলতে। এসব ভাবতে ভাবতে কখন যেন চোখটা লেগে গিয়েছিল ওর ।হঠাৎ ফোনের আওয়াজে ঘুমটা ভেঙে গেল অর্কর। কখন যে সকালের রোদ্দুর মুখে এসে পড়েছে বুঝতেই পারেনি অর্ক।
"কিরে, আজ প্রাকটিসে এলি না যে?" মনোজ উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চাইল।
ঘুমিয়ে পড়েছিলাম রে। তোর তো কোনদিন এমন হয় না। শরীর খারাপ হয় নি তো রে?
মনোজকে ক্লাবে থাকতে বলে আধঘন্টার মধ্যেই ওখানে পৌঁছে যায় অর্ক।
"জানিস মনোজ, ওকে না দেখলে তুই বুঝতে পারবি না - - - শ্রাবণকে দেখলেই আমার ছেলেবেলাটা চোখের সামনে দেখতে পাই। ওর মাঠের প্রতিটা পদক্ষেপ, অঙ্গভঙ্গী সবটা বড়ো চেনা মনে হয়। তুই দেখবি ওকে?
এত উত্তেজিত হোস না, অর্ক। ও যেদিন খেলতে আসবে, দূর থেকেই ওকে দেখে নেব। ওর সামনে গেলে ও হয়তো কুন্ঠিত হয়ে পড়বে।
তোকে একটা কথা বলব?
হ্যাঁ - - - বল, এত ইতস্তত করছিস কেন? ভাবছি--- শ্রাবনকে দত্তক নেব। ওকে নিজের কাছে রেখে, আমার দেখা অপূর্ণ স্বপ্ন গুলো ওর চোখ দিয়ে আবার নতুন করে দেখতে ইচ্ছে করছে।
তুই এখনও রাইকে ভুলিস নি---- নারে? সেই অভাবটা কি শ্রাবনকে দিয়ে মেটাতে চাস?
তোকে একটা কথা বলা হয়নি--- শ্রাবনকে দেখলে, ওর চোখের দিকে তাকালেই যেন রাইকে দেখতে পাই। মনে হয় শ্রাবণ এর মধ্যে রাই-এর সত্ত্বা মিশে আছে। এটা মনে পড়লেই শ্রাবনের প্রতি আকর্ষণ আরো বেড়ে যায়।
যদি শ্রাবনকে কাছে পেলে তোর অস্থিরতা কমে তাহলে তাই কর। না হলে খেলার মাঠে তোর বেস্ট টা তুই দিতে পারবি না।
ক্লাব থেকে বেরিয়ে' নতুন জীবনে' পৌছে দেখল, অধ্যক্ষ মহারাজ বাগান পরিচর্যায় ব্যস্ত--- আর ছেলেরা তাঁকে সাহায্য করছে। ওকে দেখে শশব্যস্ত হয়ে বললেন " আপনি--!"
একটু অপ্রস্তুত হয়ে অর্ক জ্যোতি বলল" আপনাকে ফোন না করে চলে আসার জন্য সত্যিই দুঃখিত। আসলে, একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে একটু কথা ছিল।"
" না না, ঠিক আছে। চলুন অফিসে যাওয়া যাক।"
সবটা শোনার পর এক অদ্ভুত দোটানায় পড়ে গেলেন উনি। একদিকে শ্রাবণের সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন, অন্যদিকে এক অভাগিনী মায়ের বেঁচে থাকার রসদ - - - - কী করবেন ভেবে না পেয়ে প্রার্থনাগৃহে এসে দেখেন মৈত্রেয়ী ঈশ্বরের সামনে ধ্যানমগ্ন হয়ে বসে আছে। আজকাল বড় আনমনা, উদাসী দেখায় মৈত্রেয়ী কে। 'প্রথম আলো' আর নিজের ঘর এছাড়া আর কোথাও দেখা যায় না ওকে। ঈশ্বরের লীলা বড় অদ্ভুত! অধ্যক্ষ মহারাজ এসেছিলেন ঈশ্বরের সামনে মনের ভার কমিয়ে সমাধানের পথ খুঁজতে, এখানে এসে দেখেন--- মৈত্রেয়ী ঈশ্বরের সামনেই বসে আছে।
ধীর পায়ে ঈশ্বরের সামনে এগিয়ে এসে প্রণাম করে কঠিন বাস্তবের সম্মুখীন হওয়ার শক্তি চেয়ে নিলেন। মায়ের কাছ থেকে সন্তানকে চাওয়ার মত শক্ত কাজ পৃথিবীতে বোধহয় আর নেই। তবু আজ শ্রাবণের ভবিষ্যতের কথা ভেবে, সব দ্বিধা কাটিয়ে মৈত্রেয়ীকে সব জানিয়ে অনুমতির অপেক্ষায় রইলেন।
মহারাজের কাছে কিছুটা সময় চেয়ে নিয়ে চলে গেল মৈত্রেয়ী। গমনোদ্যত মৈত্রেয়ী কে দেখে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে মনের ভার লাঘব করতে ধ্যান মগ্ন হলেন অধ্যক্ষ মহারাজ।
মৈত্রেয়ীর পা যেন চলতেই চাইছে না আজ। অনেক কষ্টে শরীরটাকে টেনে নিয়ে এসে নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয় মৈত্রেয়ী। মহারাজের কথাগুলো অনুরনিত হতে থাকে ওর কানে। চিরদিনের জন্য সন্তান হারানোর দুঃখ করবে না শ্রাবণের বাবাকে ফিরে পাওয়ার আনন্দে আনন্দিত হবে - - - বুঝতেই পারে না আজ । দুঃখ, আনন্দ সবকিছু মিলিয়ে এক অদ্ভুত অনুভূতি আজ ওর মাতৃহৃদয়ের। ওর আশঙ্কাটাই সত্যি হয়ে গেল। ফেলে আসা অতীত আজ আবারো ওর দোরগোড়ায়। সারারাত এক অদ্ভুত দোলাচলে কাটানোর পর খুব সকালেই অধ্যক্ষ মহারাজের কাছে গিয়ে বলল "শ্রাবণের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য ওনার প্রস্তাবের থেকে ভালো আর কিছু হতেই পারে না। এক অপারগ মা হয়ে এর বেশী আর কি করতে পারি আমি? মাতৃস্নেহ দিতে আমি পারিনি, ওনার স্নেহে যদি ওর সেই অভাব পূরণ হয় - - - তার থেকে আনন্দের আর কিছু হতেই পারে না।" কথাগুলো বলেই চোখের জল চাপতে না পেরে মৈত্রেয়ী এক দৌড়ে চলে গেল প্রার্থনাগৃহে। ওকে অনুসরণ করে অধ্যক্ষ মহারাজ ওখানে পৌঁছে দেখলেন ঈশ্বরের সামনে কান্নায় ভেঙে পড়েছে এক মাতৃসুখ বঞ্চিত মা। ওকে সান্ত্বনা দেওয়ার বদলে স্হবিরের মত দাঁড়িয়ে রইলেন উনি।" আমাকে ক্ষমা করো প্রভু। আজ ও কেঁদে হালকা করুক ওর মনের ভার। ওর সব কষ্ট দূর করো।
" হে ঈশ্বর, আমাকে ক্ষমা করো। আমি মাতৃজাতির কলঙ্ক---- সন্তানকে স্নেহে ভরিয়ে দিতে পারিনি, পারিনি আমার তৃষিত হৃদয়ের মাঝে ওকে জড়িয়ে রাখতে। ওর রোগে, আনন্দে আমার স্নেহের আঁচল বিছিয়ে দিতেও পারিনি। বদলে আজ ওকে চিরকালের জন্য সরিয়ে দিচ্ছি নিজের কাছ থেকে। আরো কষ্ট আমাকে দাও ঈশ্বর। তাতে যদি আমার পাপের কিছুটা প্রায়শ্চিত্তথ হয়। কিন্তু শ্রাবণের ভবিষ্যতের দিনগুলো স্বপ্নের মত করে সাজিয়ে দিও"বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়ল মৈত্রেয়ী ।
ওর কান্না আর সহ্য হল না মহারাজের। ওর মাথায় হাত রেখে বললেন" শান্ত হও মা। তুমি মাতৃজাতির অহংকার ।তোমার মতো সর্বত্যাগী মা কজন হতে পারে? এই আশ্রমে অনেক শ্রাবণ আছে। তাদের মধ্যে নিজের স্নেহকে বিলিয়ে দাও। তোমার শ্রাবণকে সেখানেই খুঁজে পাবে। "
মহারাজের কথায় শান্ত হয়ে চোখ মুছে'প্রথম আলোয়' চলে এলো মৈত্রেয়ী। মনটাকে বোঝালেও কিছুতেই মানতে পারছিল না অবুঝ মনটা। চোখ দুটো বারবার ভিজে যাচ্ছিল আজ। প্রত্যেকটা শিশুর মধ্যেই শ্রাবনের সেই ছোটবেলার মুখটাই দেখতে পাচ্ছিল আজ।
ক্রমশঃ -------