আষাঢ় মাস। দুদিন ধরে অনবরত আষাঢ়ের বর্ষা হচ্ছে । চারিদিক মাঠ-ঘাট বৃষ্টির জলে কানায় কানায় পূর্ণ। চাষিরা মাঠে চাষের কাজে ব্যস্ত। আজ সন্ধ্যার দিকে আমরা ক'জন ক্লাবে বসে আড্ডা দিচ্ছি। বেশ ক'দিন হল বিদ্যুৎ সংযোগ নেই । কেরোসিন ল্যাম্পের আলো জ্বলছে বটে, কিন্তু এ হেন আবছা আলোয় চারিদিক কেমন এক মায়াবি গা ছম ছমে পরিবেশ, সবার মুখ ভালোভাবে বোঝা যাচ্ছে না। আমি ,প্রভাস,সৌমেন ও গৌতম ক্যারাম খেলছি অন্য ছেলেরা কেউ কেউ গল্প করছে আবার কেউ কেউ তাস খেলছে। বাইরে অনবরত বৃষ্টি হচ্ছে। চারিদিকটা থমথমে ভাব। বাইরেটা বেশি অন্ধকার। চারিদিকে ব্যাঙের গোঙানির শব্দ ও নানান পোকার ডাকে বিচিত্র শব্দের সৃষ্টি করছে।
আমাদের ক্লাবের পাশ দিয়ে বড় পাকা রাস্তা গেছে- যে রাস্তাটি গোসাবা থেকে পাখিরালা পর্যন্ত সংযোগ করেছে। ঠিক রাত আটটার দিকে বৃষ্টির প্রকোপ একটু বাড়লো। সেই সময় প্রভাস একটি সিগারেট ধরাতে যাচ্ছে ঠিক তখনই দেখলাম কিছু লোক হুড়মুড় করে ক্লাবে ঢুকে পড়ল। প্রভাস সিগারেটে সবে বার কয়েক টান দিতে না দিতেই তাদের মধ্যে একজন এসে বলে উঠল, তোরা কি খেলছিস ? আমাদের মধ্যে সৌমেন খিটখিটে ভাবে বললে" কি খেলছি সেটা তুমি বুঝতে পারছ না?" আমি আস্তে আস্তে যখন ঘাড় ঘুরিয়ে তাকে দেখলাম, তাকে দেখে চমকে গেলাম। দেখলাম মাথায় এক ঝাঁক চুল যা কখনো চিরুনি পড়েছে বলে মনে হয় না। সারা শরীরে কাটার দাগ- যা অল্প অন্ধকারেও জামার ফাক ফোকর থেকে অল্প-বিস্তর দেখা যাচ্ছে। দাঁতগুলো হলুদ আর কালো দাগে ভর্তি । দাঁতের ফাক গুলোতেই বেশি কালো দাগ পড়ে গেছে। বিশাল লম্বা চওড়া চেহারা ।গায়ের রং কালো। আমি ভালো করে লোকটার দিকে তাকালাম এবং দেখতে লাগলাম । প্রথমে মনে করতে না পারলেও আমি কিছুক্ষণ পরে তাকে চিনতে পারলাম ।লোকটির নাম যতটা মনে পড়ছে যাদব মন্ডল ।ডাক নাম কালী। আমি বাবার মুখে শুনেছি এই যাদব বাবু ওরফে কালি খুব সাহসীও শক্তিশালী। আমি তার সঙ্গে কথা বলছি এমন সময় আমার পাশ থেকে গৌতম বললো- যাদব বাবু ভালো গল্প জানে। আমিও সঙ্গে সঙ্গে যাদব বাবুকে আবদার করে বললাম, তাহলে আপনি আমাদের একটি গল্প শোনান। যাদব বাবু প্রথমে রাজি হল না। একটু অনুনয়-বিনয় করতে রাজি হলেন ।আমি একটু জোর দিয়ে বললাম এই বর্ষার পরিবেশে গল্প ছাড়া কিছু ভালো লাগে না ।আপনি একটা গল্প বলুন। সবাই বলল হ্যাঁ হ্যাঁ যাদব বাবু একটি গল্প হোক ।আমরা সবাই চেয়ার টেনে যাদব বাবুর সামনে গিয়ে বসলাম এবং যাদব বাবুকে বসতে দিলাম ।আমি গোপালকে ইশারা করতেই গোপাল একটা সিগারেট ধরিয়ে যাদব বাবুকে দিল।
যাদব অরফে কালীর গল্প একটু গম্ভীর ভাবে: যাদব বাবু সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে আমাদের প্রশ্ন করলে "তোমরা কি ধরনের গল্প শুনতে চাও? সবাই বলে আমরা বর্ষার সময় একটা ভয়ের গল্প শুনতে চাই ।যাদব বাবু বললেন শোনো তবে একটা সত্য ঘটনা যা শুনলে তোমরা শিবিরে উঠবে।যা আমি নিজের উপলব্ধি করেছি। এবং প্রত্যক্ষ করেছি ।যাদব বাবু গল্প বলা শুরু করলেন।
গত চৈত্র বৈশাখ মাসের ঘটনা তোমরা ভালো করেই জানো চৈত্র ,বৈশাখ মাস মধু কাটার মাস অর্থাৎ যারা জঙ্গলে যায় তাদের ক্ষেত্রে এই ভাষাটা প্রচলিত যে মহলের মাস। মহল হলো জঙ্গলের মধ্যে মধু কাটার সময়। আমাদের সবার মনোযোগ যেন যাদবপুর ওই মুখের দিকে আকর্ষণ করে আছে ।তিনি বললেন ওই সময় বনদপ্তর জঙ্গলে যাওয়ার জন্য যাদের নৌকা থাকে তাদের পাস বা লাইসেন্স দেয় ।ওই লাইসেন্সে 7-9 জন জঙ্গলে যেতে পারে ।যার নামে লাইসেন্স থাকে সে ছাড়া বাকি দের নোমিনি কাটাতে হয় ।এর জন্য বনদপ্তর সামান্য টাকা নেয়। কারণ যদি বাঘের আক্রমণে কেউ মারা যায় তার পরিবার সরকার থেকে মোটা অঙ্কের একটি টাকা পায় ।এই রকম প্রচুর লোক লাইসেন্স নিয়ে জঙ্গলে মাছ, কাঁকড়া ও মধু কাটতে যায় ।ওই লাইসেন্স এ একটি শর্ত আছে যার নামে লাইসেন্স করা হবে তাকে অবশ্যই একটি নৌকা থাকতে হবে।এই রকম একটি লাইসেন্স এ আমরা নয় জন জঙ্গলে যাব ঠিক করি। ন'জনের মধ্যে একজন করে পালা করে রান্নার কাজে ব্যস্ত থাকবে ।বাকি চার জনের মধ্যচারদু' জন করে গ্রুপ করে প্রত্যেকে একটি করে ধারালো ছোরা নেবে কারণ জঙ্গলের মধ্যে পথ তৈরি করবে অর্থাৎ যে পথ দিয়ে জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করবে সেই পথে চিহ্ন করবে যাতে ওই চিহ্নিত চিহ্ন ধরে ফিরে আসা যায়।তারা খালি গায়ে লুঙ্গি পরে ভালো করে কাছা বেঁধে।মাথার পেছনে বাঘের প্লাস্টিকের মুখোশ পড়ে গাছের মাথার দিকে তাকিয়ে জঙ্গলের মধ্যে হাটতে হয়। যেই মৌমাছি দেখতে পায় সঙ্গে সঙ্গে তার পিছনে মাথা উঁচু করে দৌড়াতে হয় ।এই কথাটি শুনার পর আমরা ক্লাবে যত জন ছিলাম একটু ভীত হলাম ।আমি ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলার জিজ্ঞাসা করলাম কেউ যদি গাছের উপরে থাকা মৌমাছি দেখতে দেখতে দৌড়ায় আর তার সামনে বাঘ থাকলে কিভাবে বুঝবে ?তাকে তো আক্রমণ করবে? যাদব বললেন" অবশ্যই " আমার গায়ে কাঁটা দিতে শুরু করলো।মুখে কোন শব্দ নেই । সবাই নিস্তব্ধ ।আবার আমরা শুনতে থাকলাম যাদব বাবু আবার বলা শুরু করলেন ।এভাবে আমরা দৌড়াতে দৌড়াতে কোথাও মধু পেলাম তো পেলাম, না হলে কপাল খারাপ ।তোমরা আমার প্রশ্ন করতে পারো "তাহলে যে দুজন মৌমাছি দেখতে পাবে তারা দুজন মৌচাক কাটবে ?"উত্তর না ওই দু'জন বাকিদের "কুই কুই"বলে একটা শব্দ হয় সেই শব্দের মাধ্যমে সবাইকে এক জায়গায় জড়ো করবে। জঙ্গল সব সময় নিস্তব্ধ থাকে ।শব্দটি বহুদূর পর্যন্ত যায়। সবাই এক জায়গায় আসার পর দুজন ছরা দিয়ে নির্দেশিত পথ দিয়ে নৌকায় যায় এবং নৌকা থেকে যে সমস্ত জিনিসপত্র গুলো মৌচাক কাটার জন্য প্রয়োজন হয় তা সংগ্রহ করে নিয়ে আসে। তার পর একটি লাঠির মাথায় জঙ্গলে পাতা দিয়ে মশাল তৈরি করা হয় যার সাহায্যে ধোঁয়া তৈরি করা হয় ।মৌমাছি উড়ে চলে যায় ।চাক থেকে যায় ।তারপর দা বা লম্বা ছোরা দিয়ে চাক কেটে ড্রাম ভর্তি করা হয়।তার পর কাঁধে করে ওই নির্দেশিত পথ দিয়ে নৌকায় ফিরে আসা হয়। তারপর যাদব বাবু একটু গম্ভীর গলায় বলে এই সময় সবাই সবার কাজে ব্যস্ত থাকে যদি বাঘের আক্রমণ হয় কোন রকম ভাবে তার প্রতিরক্ষা অসম্ভব। আমি সবার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম কারোর মুখে কোনরকম কোন শব্দ নেই ।অধীর আগ্রহে জবুথবু হয়ে গল্প শুনছে।
যাদব বাবু গল্প বলতে থাকলেন: এইরকম ভাবে আমরাও মধু সংগ্রহ করছি আমাদের মত প্রচুর দল যেমন মোল্লাখালি,কুমিরমারি ,গোসাবা ,পাখিরালা, ঝড়খালি ,সোনারগাঁ ,পিরখালি ইত্যাদি জায়গার লোক মধু সংগ্রহ করছে। সুন্দরবনের প্রায় 284 দ্বীপ আছে যার বেশির ভাগ বাংলাদেশ এ। গ্রামের গরিব মানুষ নানাভাবে মধু,মাছ সংগ্রহ করে জীবন জীবিকা নির্বাহ করে ।তোমরা ভালো করে জানো মাছ,মধু সংগ্রহ করতে গিয়ে প্রচুর মানুষ কুমির ও বাঘের আক্রমণে প্রাণ ত্যাগ করে ।ওই হিংস্র পশু কত মায়ের ,কত মেয়ের সিঁদুর মুছে দিয়েছে ।এইজন্যই তো আমাদের সুন্দরবনে বিখ্যাত বিধবারা অবস্থিত ।মনে মনে ভাবলাম একদম ঠিক কথা বলেছে সত্যিই আমাদের এলাকায় এমন কয়েকটি গ্রাম আছে যা বিধবা পাড়া নামে খ্যাত।
যাদব বাবু বললেন আমাদের দলে 9 জনের মধ্যে 8 জন মধুর জন্য এদিক-ওদিক যাযাবরের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছি। এদিক থেকে ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছি কিন্তু মধুর দেখা নেই। বিভিন্ন দলের সঙ্গে দেখা হলে তাদের জিজ্ঞাসা করলে -কেউ বলে মধু পেয়েছি আবার কেউ কেউ বলে মধু পাইনি। আমরা দ্বিতীয় দিনে একটি মৌমাছির পেছনে অনেকটা দৌড়ে কিছুদূর গিয়ে একটি মৌচাক দেখতে পাই ।মৌচাক কাটতে বেশ কিছুটা সময় কেটে গেল। ওই মৌচাক থেকে প্রায় আমরা 8 কেজি মধু পাই ।ওই বিশাল নিস্তব্ধ দৈত্যাকার জঙ্গলের মধ্যে আমরা নিঃশব্দে বুকে একরাশ ভয় নিয়ে জঙ্গলের মধ্যে মধু কেটে বেড়াচ্ছি ।এইভাবে সারাদিন ক্লান্ত পরিশ্রমের পর জঙ্গলের মধ্যে খালের ভিতরে নৌকায় রাত কাটাতাম। প্রাণ হাতে নিয়ে জঙ্গলের মধ্যে সারা দিন কাটত ।সকাল হলে আমরা আবার আটজন পূর্বের নিয়ম অনুযায়ী অন্য একটি দ্বীপে গিয়ে মৌমাছি খোঁজার কাজ শুরু করলাম। তৃতীয় দিনে ওই দ্বীপে আমরা পরপর দুটি মৌচাক পেলাম। ওই দুটি মৌচাক থেকে একইভাবে মধু সংগ্রহ করলাম ।দুটি মৌচাক থেকে প্রায় 15 কেজি মধু পেলাম। মধু কাটার পর ড্রাম গুলিকে কাঁধে করে নিয়ে নৌকার দিকে আসছি ও নিজেদের মধ্যে কথা বলছি এমন সময় আমাদের বুকের হাড় ঠান্ডা করে শোনা গেল বাঘের গর্জন ।একবার নয় বারবার গর্জন করতে করতে বাঘ মামা আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। আমাদের গায়ে ঘামের জল গড়িয়ে মাটিতে পড়তে লাগল। আমাদের সবার পা কাঁপতে আরম্ভ করেছে। আমরা ক্লাবে ছেলেরা সবাই অবাক চোখে যাদব বাবুর মুখের দিকে কম্পিত বুকে তাকিয়ে থাকলাম। তিনি বললেন আমরা তখন মধু ড্রাম সাবধানে লুকিয়ে বড় গাছের গোড়ায় জড় হলাম। সবাই খুব ধীরে কথা বলছি যাদব বাবু বললেন বাঘ নিশ্চয়ই আমাদের গন্ধ পেয়েছে। সবাই সাবধানে লম্বা গাছের উপরে আশ্রয় নিলাম। এদিকে জঙ্গলের মধ্যে সন্ধ্যা হতে আরম্ভ করেছে ।আমরা গাছের উপর নিঃশব্দে বসে থাকলাম ।যাদব বাবু কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন আমাদের শরীর ঘামে ভিজে যাচ্ছে ।উফ কি ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি ।আমরা উপর থেকে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি বাঘটি গর্জন করতে করতে গাছের নিচ থেকে অন্য দিকে চলে যাচ্ছে ।আমি একবার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললাম যাই হোক বাঘ আমাদের দেখতে পায়নি। যদি দেখতে পেত তাহলে আটজনের মধ্যে একজনকে না নিয়ে ওখান থেকে ও যেতই না ।ঈশ্বরের কৃপায় এ যাত্রায় আমরা বেঁচে গেলাম। দুই থেকে তিন ঘণ্টা পর আমরা তারাতারি গাছ থেকে নেমে এলাম। সাবধানে তাড়াতাড়ি করে ড্রাম নিয়ে নৌকার দিকে তাড়াহুড়ো করে চললাম। নৌকায় আসার পর তারাতারি ওই দ্বীপ ছেড়ে বেরিয়ে এলাম ।নৌকা নিয়ে আমরা সন্ধ্যার দিকে অন্য দ্বীপে ঢুকে পড়লাম ওই দ্বীপের যেতে যেতে অনেকটা সন্ধ্যা গড়িয়ে গেছে।
ওই দ্বীপে আমরা একটি লম্বা খালের মধ্যে অনেক দূর পর্যন্ত নৌকাটা তুলে নিয়ে গিয়ে সেখানে রাত কাটানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। আমরা সবাই মিলে নৌকাটা ভালো করে বেঁধে তার চারিদিকে বেশ কিছুটা দূর থেকে গোল করে নিয়ে অনেকটা উচু করে নেট জাল দিয়ে ঘিরে দিলাম। যাতে করে কোনভাবে বাঘ নেট জাল টপকে এপারে না আসতে পারে। ঘেরা হয়ে যাওয়ার পর রাত দশটার দিকে আমরা খাওয়া-দাওয়া শেষ করলাম। তারপর আমরা কজন বসে কিছুক্ষণ গল্প করলাম। কিছুক্ষণ পরে ঘুমানোর জন্য পরিকল্পনা করলাম। সবাই একটা করে টর্চ ও একটা করে ছোৱা নিলাম। আমাদের মধ্যে পাঁচজন নৌকার ছইয়ের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ল ।তিনজন নৌকার পিছনের দিকে শুয়ে পরলো ।আমি নৌকার সামনে শুয়ে পড়লাম ।মশারী টাঙানোর কোন বিশেষ সুবিধা নেই। জঙ্গলের মধ্যে অসহ্য কর মশা ।মশা মারার কয়েল জ্বালিয়ে শুয়ে পড়লাম কেউ কেউ শ্যাম্পু গায়ে মেখে শুয়ে পড়ল ।যাদব বাবু তারপর যেটা বললে সেটা শোনার জন্য আমরা কেউ প্রস্তুত ছিলাম না ।ওই কথাটা শোনার পর আমার সারা শরীর ঠান্ডা হয়ে গেল। যাদব বাবু বললেন একটু রাতের দিকে চোখের পাতা দুটো বুজে আসতেই হঠাৎ করে কে যেন বলে উঠলো" আমি এখনো বেঁচে আছি তোরা আমাকে বাঁচা আমাকে ছেড়ে যাস না" আমি তৎক্ষণাৎ এক মুহূর্তের জন্য দেরি না করে কে কে বলে চিৎকার করে উঠলাম। টর্চ দিয়ে এদিক ওদিক আলো ফেললাম কিন্তু কি অদ্ভুত কেউ কোথাও নেই ।তবে আমাদের সঙ্গীদের দিকে দেখলাম কিন্তু কই কারুর কোন অসুবিধা তো হয়নি। সবাইতো নাক ডাকিয়ে ঘুমাছে। তাহলে চিৎকার করলো কে ?মনে মনে ভাবতে লাগলাম আর বিড় বিড় করে বলতে লাগলাম হয়তো অনেক পরিশ্রমের ফলে শরীর ক্লান্ত হয়ে যাওয়ায় উল্টোপাল্টা স্বপ্ন দেখেছি। আবার টর্চ জ্বালিয়ে এদিক-ওদিক ভালো করে দেখে আবার শুয়ে পড়লাম ।শুয়ে শুয়ে ভাবছি অদ্ভুত আমি চিৎকার করলাম তাতে আমাদের ঘুম ভাঙল না? বেশ কিছুক্ষণ পরে আবার একটু ঘুম আসতে সর্বনাশ আবার সেই একই শব্দ" আমি এখনও বেঁচে আছি তোরা আমাকে বাঁচা আমাকে ছেড়ে যাস না" আবার ওই বাক্য শুনে আমার গলার জল শুকিয়ে যেতে লাগলো।
আমি ধড়ফড় করে উঠে টর্চ জ্বালিয়ে সবার দিকে দেখলাম সবাই নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে আমি চিৎকার করে বললাম কে? ওখানে কে? কিন্তু কোন উত্তর নেই ।আমার সহপাঠীরা আমার চিৎকারে উঠে পরল। আমি সবাইকে সমস্ত ব্যাপারটা বললাম কিন্তু ওরা আমার কথা কোন গুরুত্ব না দিয়ে আবার শুতে চলে গেল । মনে মনে ভাবলাম ওই চিৎকার কি আমি ছাড়া কেউ শুনতে পাচ্ছে না। তখন মনে মনে ঠিক করে নিলাম যে কিছু না কিছু এখানে ঘটেছে।আমি জঙ্গলের মধ্যে টর্চ জ্বেলে ভালো করে দেখে নিয়ে আবার নৌকায় মাথায় হেলান দিয়ে ভাবতে আরম্ভ করলাম। এইসব শোনার পর আমি ঘাড় ঘুরিয়ে ক্লাবের অন্য সমস্ত ছেলেদের দিকে দেখলাম ।দেখলাম কারো মুখে কোন শব্দ নেই।
সবাই যাদব বাবুর দিকে হা করে তাকিয়ে আছে ।ক্লাবে শুধুমাত্র নিঃশ্বাসের
শব্দ ,ব্যাঙের ডাক,ঘুরঘুটে পোকার ডাক ছাড়া কিছুই শোনা যাচ্ছে না।যাদব বাবু
আবার বলতে আরম্ভ করলেন -আমি নৌকার মাথা হেলান দেওয়া অবস্থায় একটু ঘুম
আসতে আবার ওই একই ভাবে বলল। যাদব বাবু এক মুহূর্তের জন্য দেরি না করে সেই
দিকে টর্চ ফেললেন। মনে মনে ভাবলেন কিছুতো এখানে ঘটেছে। আমি আর ঘুমাতে
পারলাম না ।সারারাত জেগে থাকার পর সকাল হতে আমরা তাড়াতাড়ি নেট জাল খুলে
নৌকা নিয়ে ওই দ্বীপ ছেড়ে বেরিয়ে এলাম ।তাতে আমার সহপাঠীরা অনেক বাধা
দেওয়া সত্ত্বেও আমরা ওই দ্বীপ ছাড়তে বাধ্য হলাম। নৌকা নিয়ে অন্য দ্বীপের
দিকে যেতে আরম্ভ করলাম। নৌকা চালাতে চালাতে নদীতে বেরিয়ে আসার পর একটি
মাছ ধরার দলের সঙ্গে দেখা হলো। তাদের ডেকে আমি সব বললাম ।তারা শোনার পর যে
ঘটনাটি আমাকে ব্যাপ্ত করলো তাতে আমাদের সবার মুখের বাক্য কিছুক্ষণের জন্য
হলেও স্তব্ধ হয়ে গেছে। তারা বলল কুমিরমারি একটি দল ওই দ্বীপে ওই খালে পাটা
জাল দিয়ে মাছ ধরছিল ।ওইখানে জাল দিয়ে মাছ ধরার সময় একজন অল্প বয়সী
ছেলেকে বাঘের আক্রমন করেছিল ।বেশ অনেক্ষণ এবং অটো বড়ো বাঘ ও মানুষের
ধস্তাধস্তির পর সেই অল্প বয়সী ছেলেটা সেই বীভৎস লড়াইয়ে ব্যর্থ হয়ে যায়
।সে দৃশ্য তারা মুখে ব্যক্ত করতে পারল না।তাদের প্রত্যেকের চোখে জল বিন্দু
চোখের কোণে থেকে নাকে স্পর্শ করেছে। কি অদ্ভুত বাঘে ও মানুষের লড়াই।
তারপরে ছেলেটাকে বাঘে টানতে টানতে জঙ্গলের মধ্যে নিয়ে যায় ।তখন ছেলেটি
চিৎকার করে বারবার বলতে শোনা যায়" আমি এখনো বেঁচে আছি আমাকে ছেড়ে চলে যাস
না" কিন্তু বাকিরা ভয়ে মাছ ধরা বাদ দিয়ে নৌকার দিকে প্রানপনে ছুটে
পালিয়েছিল।ছেলেটা অনেকবার ওইভাবে চিৎকার করতে থাকে। তার প্রাণ তখনও পর্যন্ত
জীবিত ছিল কাতর স্বরে তার সহপাঠীদের অনুনয়-বিনয় করছিল। যাতে তার প্রাণটা
তারা রক্ষা করে কিন্তু হলো না সদ্য বিয়ে করে মাত্র 15 দিন পর জঙ্গলে
এসেছিল মাছ ধরতে ।তখন যাদব বাবু মনে মনে বললেন আমার ধারণাটা সত্য ছিল ।যাদব
বাবু বললেন এই জন্যই ওই ছেলের অতৃপ্ত আত্মা ওই দ্বীপে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
যারা ঐ দ্বীপে যাবে তারা সবাই ওই কথা শুনতে পাবে। ওই দ্বীপে মধু কাটা হলো
না তারা অন্যদিকে গেল বটে কিন্তু তাদের মধু কাটার মন ছিল না ।যাদব বাবু
ক্লাবে সবার সামনে চোখ বুজিয়ে বলল হে ঈশ্বর ওই ছেলের আত্মাকে শান্তি দাও
।আমরা সমস্ত ছেলেরা গল্প শেষ হওয়ার পর যাদের মুখের দিকে বেশ মিনিট খানেক
তাকিয়ে আছি।আমাদের মুখে কোনো ভাষা নেই। জাদ বাবু বললেন গল্প শোনানো শেষ
হল। রাত অনেক হয়েছে এবার বাড়ী যাওয়া যাক।
[ ধন্যবাদ]