পর্ব-৩
' নতুন জীবন' থেকে ফিরে আসার পর কিছুতেই মন বসাতে পারছিল না অর্ক ।বড় অস্থির লাগছিল - - - এতটা অস্থির, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়তো জীবনে প্রথমবার মাঠে নামার সময়েও হয়নি ওর ।সময় যেন থমকে দাঁড়িয়ে ছিল আজ এক জায়গায় ।কি করবে কিছু ভেবে না পেয়ে মনোজ কে ফোন করল ।
"কিরে, সব ঠিকঠাক আছে তো? মহারাজ কি বললেন?
" উনি একটু সময় চেয়ে নিয়েছেন রে - - -? "
" অদ্ভুত ব্যাপার তো - - -! একজন অনাথ ছেলেকে দত্তক নিবি তাতে ওনার অসুবিধার কি হল? "
ইতস্তত করে বলল" জানিনা রে--- তবে একটু চিন্তায় আছি। যদি উনি না বলে দেন।"
" এত চিন্তা না করে তুই বরং বিশ্রাম নে---কাল মাঠে দেখা হবে।"
রাই জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়ার পর আর কাউকে নিয়ে এতটা উদগ্রীব হয়নি ও। কোনো এক অজ্ঞাত অধিকারবশে আজ শ্রাবণ ওর হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে। শ্রাবনকে দেখলে এক অদ্ভুত স্নেহ কাজ করে - - - একেই কি অপত্য স্নেহ বলে? এর উত্তর জানা নেই অর্কর।
" যদি তুমি থাকতে--- হয়তো আমাদের সন্তানও এত বড়ই হত। কোন্ অজানা অপরাধের বোঝা আমার কাঁধে চাপিয়ে কোথায় হারিয়ে গেলে রাই? তুমিতো আমাকে ছাড়া ভাবতেই পারতে না---- তাহলে এতগুলো বছর আমাকে ছেড়ে কোথায় কিভাবে আছো?"
এত বছর ধরে এই একই প্রশ্ন ওকে কুরে কুরে খাচ্ছে। এসব ভাবতে ভাবতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিল অর্ক। ভোরবেলা এক অদ্ভুত স্বপ্নে ঘুমটা ভেঙে গেল---" আজ স্বপ্নে রাই তুমি শ্রাবণকে আমার হাতে তুলে দিয়ে চলে গেলে - - - - এসবের মানে কি? শ্রাবনের সাথে কী সম্পর্ক তোমার? এর উত্তর আমি কোথায় পাব? আর নতুন কোনো প্রশ্নের ভার বইবার ক্ষমতা নেই আমার। "
নিজের মনকে সংযত করে ফ্রেশ হয়ে একটু তাড়াতাড়িই মাঠে পৌঁছল অর্ক। মনটা হাল্কা করার জন্য আজ অনেকক্ষণ প্র্যাকটিস করল ও। খেলা শেষে মনোজকে সাথে নিয়ে ফুটবল অ্যাকাডেমিতে ঢুকতেই কোচের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়" গুডমর্নিং অর্কদা। তুমি শ্রাবণ নামের যে ছেলেটিকে ভর্তি করে দিয়েছ - - -"
"হ্যাঁ - - - হ্যাঁ, কেমন দেখছ ওকে?"
"ভীষণ ভালো। টেকনিকগুলো একবারের বেশি শেখাতেই হয় না। চলো না - - - ওই তো মাঠেই খেলছে।"
দূর থেকে ওর খেলা দেখতে দেখতে মনোজ বলে "এ তো ছোটবেলার সেই অর্ক! আর ওর খেলা দেখে মনে হচ্ছে - - - এটা ওর জন্মগত প্রতিভা। তোর সাথে এত মিল---জাস্ট ভাবাই যায় না। "
মাঠেই অধ্যক্ষ মহারাজের কাছে খবরটা পেয়ে আনন্দে, উত্তেজনায় বাকরুদ্ধ হয়ে গেল ও। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অধ্যক্ষ মহারাজের সাথে দেখা করল অর্ক। শ্রাবণের কোনো আপত্তি নেই জানতে পেরে উৎফুল্ল চিত্তে মনোজকে সবটা জানিয়ে আইনি প্রক্রিয়াগুলো মেটাতে উকিলের সঙ্গে দেখা করল ও।
বহুদিন পরে রাইয়ের ছবিটা বের করল---দুদিকে লম্বা বেনী ঝোলানো, কপালে ছোট্ট কালো টিপ আর হলুদ শাড়িতে অসাধারণ লাগে রাইকে। "কতগুলো বছর তোমাকে দেখিনা। তোমার ইচ্ছে করে না আড়ালটাকে সরিয়ে সামনে এসে দাঁড়াতে। তোমার ওই ভ্রূ-ভঙ্গী, চোখের কোলের হাসি খুব মিস করি । জানো রাই, শ্রাবণকে দেখলেই তোমার কথা বেশী বেশী করে মনে পড়ে যায়।" রাইয়ের সাথে কথা বলতে বলতে কোনো কোনো রাত শেষ হয়ে নতুন দিনের শুভারম্ভ হয়ে যায়।
আশ্রম থেকে শ্রাবনের আসার দিন যত এগিয়ে আসতে থাকে, এক নতুন সম্পর্ক তৈরীর আনন্দে বিভোর হয়ে থাকে অর্ক। শ্রাবণের মনের মতো করে বাড়িটাকে সাজানোয় মগ্ন হয়ে থাকে ও। শ্রাবণও বেশ খুশি। অনাথ হওয়ায় মা-বাবার স্নেহ বঞ্চিত হয়েই বড়ো হচ্ছিল ও। এত বছর পরে কেউ ওকে নিজের সন্তানের স্বীকৃতি দিচ্ছে - - - - নাই বা হলো রক্তের সম্পর্ক, তবু শ্রাবণ ওনাকে উপযুক্ত সম্মান ও ভালবাসা নিশ্চয়ই দেবে। তবে আশ্রম থেকে চলে যাবার দিন যত এগিয়ে আসছে, বড়ো কষ্ট হচ্ছে শ্রাবনের। মনে হচ্ছে খুব কাছের কাউকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে চিরদিনের জন্য।
"আমাদের ভুলে যাবি না তো শ্রাবণ? আমরা কিন্তু তোকে খুব মিস করব রে।"
"কি যে বলিস তোরা--- একসাথে বড় হয়েছি, কত দুষ্টুমি করেছি। সেগুলো কি ভোলা যায়? আর তাছাড়া উনি তো বলেছেন প্রতি রবিবার আমি তোদের সাথেই কাটাবো।"
"সত্যি! তাহলে তো ভালই হবে।"
"তোরা ঘুমিয়ে পড়ে, আমি একটু পরে শোবো।"
সবাই ঘুমিয়ে পড়লে শেষবারের মতো আশ্রমের সাথে একা থাকতে ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়ালো শ্রাবণ। অন্ধকার রজনীর নিস্তব্ধতা ওর বড়ো প্রিয়। এই আশ্রমের প্রতিটা গাছপালা, আকাশ- বাতাস, মানুষজন সব ওর খুব কাছের--- আত্মার আত্মীয়। অনাথ শ্রাবণের এরাই ছিল আপনজন। এদের ছেড়ে নতুন সম্পর্কের নতুন আশ্রয়ে যাচ্ছে --- আনন্দ, উত্তেজনা, দুঃখ, ভয় সবকিছু মিলিয়ে অদ্ভুত এক অনুভূতি হচ্ছে ওর। এতসবের মধ্যে কাছের কাউকে ছেড়ে যাওয়ার কষ্টটাই সবচেয়ে বেশি।
পরদিন সকালে মৈত্রেয়ী আড়াল থেকে শ্রাবনকে ওর বাবার সাথে চলে যেতে দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবল "এই বেশ ভালো হল। ঈশ্বর আজ ওদের মিলিয়ে দিয়েছেন - - - - নাই বা জানলো ওরা ওদের সম্পর্কের কথা। কিন্তু সত্যিটাতো আর মিথ্যে হয়ে যাবে না। আজ এই পৃথিবীতে আমার নিশ্বাস নেওয়ার প্রয়োজনও ফুরিয়ে গেছে।" যতদিন যেতে লাগলো মৈত্রেয়ীর মনের সাথে সাথে শরীর ও ভেঙে পড়তে লাগলো। নিজের ঘর থেকে বেরোনো বন্ধ করে দিয়েছিল মৈত্রেয়ী। পুরনো স্মৃতিগুলো নিয়েই দিনগুলো কাটতো ওর। দিন শেষ হয়ে আসছে বুঝতে পেরে শ্রাবণ ও অর্কর জন্য দুটো আলাদা খাম তৈরি করে অধ্যক্ষ মহারাজের হাতে দিয়ে বলল" আমার মৃত্যুর পর ওদের এগুলো দিয়ে দেবেন।"
" একথা কেন বলছো?"
" শ্রাবণ ওর বাবাকে পেয়েছে। ওর জীবনে আমার প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যাবার সাথে সাথে পৃথিবীতে আমার নিঃশ্বাস নেবার প্রয়োজনও শেষ হয়ে গেছে মহারাজ।" কথাগুলো বলে ধীর পায়ে মহারাজের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায় মৈত্রেয়ী।
শ্রাবণ আসার পর কখন যে মনের মেঘ কেটে গিয়ে রৌদ্রোজ্জ্বল দিনের শুভারম্ভ হয়ে গেছে জানতেই পারেনি অর্ক। ওদের সম্পর্কটাও বেশ একটা সহজাত বোধেই তৈরি হয়ে গেছে। নতুন কোন সম্পর্ক বলে মনেই হয় না ওদের। রাইয়ের সমস্ত সত্ত্বা যেন শ্রাবনের মধ্যে মিশে আছে। ভীষণ অদ্ভুত ছেলেটা। ওর অনুভূতিগুলোও রাইয়েরই মত--- অল্পেই আঘাত পায়। রাইও ঠিক এরকমই ছিল। একটু বকলেই দু'চোখ থেকে মুক্তোর মতো জলবিন্দু ওর ফর্সা নরম গাল দুটোকে ভিজিয়ে দিত। কত আদর করে মান ভাঙত মানিনীর। আজ অনেকদিন পর একা ঘরের লাগোয়া ছাদে এসে দাঁড়ালো অর্ক। রাই চলে যাবার পর থেকেই মধ্যরাতের ঘুমন্ত তারাদের মাঝে একা জেগে থাকা চাঁদের সাথে মনের সব কথা ভাগ করে নিত ও। আজ পূর্ণিমার জোছনা ছড়ানো রূপোলী চাঁদ কে দেখে মনে পড়ে গেল, এক বিকেলে গঙ্গার ধারে বসে অস্তগামী সূর্যের আদুরে আলোয় মেঘের ঘোমটার আড়ালে থাকা পূর্ণিমার লজ্জাবনত চাঁদকে দেখে বলেছিল" কালিদাসের কাব্যে মেঘ বিরহী যক্ষের দূত হয়েছিল, চলনা আমরা চন্দ্রমাকে আমাদের দূত হতে অনুরোধ করি।" সুযোগ পেলেই রাইকে নিয়ে মজা করতো অর্ক। ওর ছেলেমানুষীটা ভারী পছন্দের ছিল অর্কর। সেদিনও সুযোগটা হাতছাড়া করতে মন চায়নি ওর। ছদ্ম গাম্ভীর্যের সাথে বলল" অমাবস্যার চাঁদকে অনুরোধ করবে বুঝি! তাহলে তো আরও কয়েকটা দিন অপেক্ষা করতে হবে। আজ তো সবে পূর্নিমা----! "ওর কথায় রাই রেগে ওকে মারতে শুরু করতেই দুহাতে ওকে জড়িয়ে ধরে বলত "এত রেগে গেলে চাঁদও যে কাছে আসবেনা। রাইকিশোরী , যতদিন দূরে আছো, ততদিন না হয় চন্দ্রমাই থাকুক আমাদের মধ্যমা হয়ে। এবার রাগ কমেছে তো? " কাঙ্ক্ষিত স্পর্শে শিহরিত হয়ে লজ্জায় ওর চওড়া বুকের মাঝে আরো মিশে যেত রাই।
আজ শ্রাবণকে পেয়ে রাইয়ের অভাববোধ করা, ফাঁকা হয়ে যাওয়া মনটা নতুন করে বাঁচার রসদ খুঁজে পেয়েছে। স্বপ্নে আজকাল রাইকে বড় বিষন্ন দেখায়----হয়তো ভাবে শ্রাবণ ওর ভালোবাসায় ভাগ বসাচ্ছে--- এখনো সেই রকম ছেলেমানুষই রয়ে গেল রাই।
।। অন্তিম পর্ব।।
আশ্রম থেকে চলে আসার পর কটাদিন বেশ মনমরা লাগছিল
শ্রাবনের। ফেলে আসা আশ্রম--মহারাজ--বন্ধুদের সাহচর্য পেতে চাইত মন। কিন্তু
মি. চৌধুরী অর্থাৎ বাবার আন্তরিক স্নেহ, ভালোবাসা অচিরেই সেই অভাবকে ভুলিয়ে
দিয়েছে। ওনার প্রতি অদ্ভুত এক টান অনুভব করে ও। এত স্নেহ স্পর্শের মাঝেও
হঠাৎ হঠাৎ অন্য কারোর জন্য মনটা বড়ো হু-হু করে। সেই অজানা অচেনা কাউকে মনে
মনে খুঁজে চলে শ্রাবণ ।
পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য
শ্রাবনকে এখন ফুটবল প্র্যাকটিসে যেতে দেয় না অর্ক।খুব ভোরে উঠেই পড়তে
বসে যায় শ্রাবণ। একদিন অর্কর উঠতে দেরী দেখে শ্রাবণ ঘরে গিয়ে বিছানায়
রাইয়ের ছবিটা দেখে অবাক হওয়ার সাথে সাথে চমকে ওঠে। নিঃশব্দে নিজের ঘরে
ফিরে এসে আকাশ-পাতাল ভাবতে থাকলেও ভাবনার কোনো তল খুঁজে পায় না ওর অপরিনত
মন। অনেক চেষ্টা করেও বাবার কাছে নিজেকে লুকোতে পারে না শ্রাবণ।
"কিরে, কী হয়েছে? এত অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে কেন তোকে?"
"কিছু না - - - এমনিই - -"
"আমি তোর বাবা - - - - শ্রাবণ! আমার কাছে লুকোলে কার কাছে মনের কথা বলবি?"
"তুমি মৈত্রেয়ী মাকে চেন?"
"নাতো!? আমি তো ওনাকে কখনও দেখিইনি, চিনব কি করে ওনাকে? "
" তুমি চেননা---তাহলে - - - "
" কী বলবি বল্ - - - "
" তুমি রাগ করবে না তো? "
" দূর বোকা, তোর ওপর আমি কখনও রাগ করতে পারি? "
" সকালে তোমার ঘরে গিয়েছিলাম, ওখানে - - - মৈত্রেয়ী মায়ের ছবি দেখলাম - -।"
নিজের কানকে নিজেই বিশ্বাস করতে পারছিল না অর্ক। বারবার শুনতে চাইছিল
শ্রাবনের কাছ থেকে। মৈত্রেয়ী - - - - ওর হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসা - - - রাই!
কিছু ভাবতে পারছিল না ও। যাকে পাগলের মতো খুঁজে বেড়িয়েছে এতবছর ধরে - -
- সে ওর এত কাছে থেকেও ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকতে চেয়েছে! আর শ্রাবণ - - -
রাইয়ের সন্তান - - -! তাহলে কি - - -! আর কিছু ভাবতে পারে না অর্ক।
শ্রাবনকে জড়িয়ে ধরে ধরে কাঁদতে থাকে পাগলের মতো। কিছু বুঝতে না পেরে
শ্রাবণও ওর বাবাকে জড়িয়ে ধরে রাখে।
একটু ধাতস্থ
হয়ে অর্ক শ্রাবণকে পাগলের মত আদর করতে থাকে। "তোকে আমার চোখ চিনতে না
পারলেও মন ঠিকই চিনেছিল। আমি তোর পালিত পিতা নই শ্রাবণ - - - তুই আমার
আত্মজ---আমার অংশ - - - আমার সন্তান।"
শ্রাবণ কিছু বুঝতে না পেরে হতভম্বের মতো তাকিয়ে থাকে অর্কর দিকে।
"চল্ শ্রাবণ, যাবি?"
"কোথায় - - -?"
"তোর মায়ের কাছে। মৈত্রেয়ীই তোর মা। "
বিস্ময়ে হতবুদ্ধি শ্রাবনের মুখে কথা সরে না। হতভম্ব শ্রাবণকে নিয়ে
আশ্রমে পৌঁছে অধ্যক্ষ মহারাজের সাথে দেখা করতেই শুনল মৈত্রেয়ী অসুস্থ।
শ্রাবণ কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে গেল ওর মায়ের কাছে - - - জন্মাবধি অনাথ
পরিচিতি নিয়ে বড়ো হতে হতে হঠাৎ করে আপনজনের কথা জানতে পারলে
রাগ-দুঃখ-অভিমান সব মিলেমিশে একাকার হয়ে যে অনুভূতি জন্ম নেয় - - - তার না
তো কোনো নামকরণ করা যায়, না কোনো সমীকরনে ব্যাখ্যা করা যায়। ওকে অনুসরণ
করে ওরা দেখল, শ্রাবণ মৈত্রেয়ীকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে আর মুখে হাসি চোখে জল
নিয়ে কতদিনের জমানো আদরে, স্নেহে ভরিয়ে দিচ্ছে মা তার সবচেয়ে বড়
সম্পদ, আদরের ধন---সন্তানকে।
"আমাকে আর তোমার থেকে দূরে সরিয়ে দেবে না তো মা? তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছি - - - তুমি যাবে তো?"
"আমি
- - - কোথায় যাব রে! আমার যে দিন শেষ হয়ে আসছে বাবা। একজন মায়ের কাছে
সবচেয়ে আনন্দের মুহুর্ত সন্তানের মুখে চিরকাঙ্খিত মা ডাক শোনা - - - আজ
আমার সেই প্রত্যাশার অবসান হয়েছে। "
" আর আমার কাছে
তোমার কোন প্রত্যাশাই কী নেই রাই?" যে কন্ঠস্বর শুনলে একদিন ওর শরীর মন
রোমাঞ্চিত হয়ে উঠত, যার গলায় নিজের নাম না শুনলে দিনটাই বৃথা হয়ে যেত - -
- - - আজও যে আওয়াজ ওর সমগ্র অন্তরাত্মা জুড়ে আছে - - - - - যে ভরাট
গলার প্রাণখোলা হাসিটা মনে করেই ওর রাত্রি যাপন হয় - - - - সমগ্র সত্ত্বা
জুড়ে থাকা সেই চিরপ্রিয় আওয়াজে প্রায় ভুলে যাওয়া নিজের নাম শুনে চমকে
উঠে তাকিয়ে দেখে দরজার বাইরে অধ্যক্ষ মহারাজের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে অর্ক।
"তুমি - - -!"
"হ্যাঁ রাই, আমি - - -। যাকে তুমি বিনা অপরাধে অপরাধী করে রেখেছ এতগুলো বছর।"
নিঃশব্দে কাঁদতে থাকে মৈত্রেয়ী।
"এতবড় সত্যিটা সেদিন আমার কাছ থেকে কেন লুকিয়ছিলে রাই? আমাকে কষ্ট দিয়ে, শ্রাবণকে অনাথ করে কেন রাখলে?"
অর্কর কথায় সবটা বুঝে শ্রাবণকে নিয়ে অধ্যক্ষ মহারাজ ওদের একা থাকতে দিয়ে চলে যান নিজের ঘরে।
ওর উত্তরের অপেক্ষা না করেই অর্ক বলে চলেছিল "কোন সুযোগ না দিয়ে এতগুলো
বছর আমাকে অপরাধী করে কেন রাখলে? তুমি তো আমাকে ছাড়া ভাবতেই পারতে না।
এতগুলো বছর, মাস, দিন---আমাকে ছেড়ে কী করে পারলে থাকতে? তোমার প্রিয় সখা
চন্দ্রমা কোনো বার্তাই কী দেয়নি তোমাকে?"
"আমাদের
সম্পর্কের পরিনতি নিয়ে তোমার চিন্তা অনেক চেষ্টাতেও গোপন করতে পারোনি তুমি।
নতুন করে তোমার বিড়ম্বনা আর বাড়াতে চাইনি---তোমার ভালোবাসার নিদর্শনকে
কোনও মূল্যে হারাতেও চাইনি। তাই তাকে বাঁচিয়ে রাখতেই তোমাকে ছেড়ে, পরিবারের
সবাইকে ছেড়ে চলে এসেছিলাম। আমি জানি, আমার অপরাধের সীমা নেই তোমার কাছে - -
- তাইতো তোমাকে এত কাছে পেয়েও নিজেকে শাস্তি দিতে তোমার থেকে দূরে সরিয়ে
রেখেছি। নিজের গর্ভজাত সন্তানকে দিনের পর দিন চোখের সামনে দেখলেও বুকের
মাঝে জড়িয়ে ধরতে পারিনি---"দিনের পর দিন মনের ভিতর চেপে বসে থাকা জগদ্দল
পাথরটাকে একনিঃশ্বাসে সরিয়ে দিয়ে ক্লান্তিতে শরীর আর সঙ্গ দিল না ওর।
মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছিল মৈত্রেয়ী। তাড়াতাড়ি অর্ক ওকে কোলে তুলে অতি
যত্নে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল" অযত্নে,
অবহেলায় নিজেকে যে শেষ করে ফেলেছ!"
"শ্রাবণ ওর
বাবাকে পেয়েছে ।যে স্নেহের আঁচলের ছায়া আমি বিছিয়ে দিতে পারিনি, সেই
স্নেহ-ভালোবাসা তুমি ওকে দিয়েছ। আমার বেঁচে থাকার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে।"
"তোমার অভাব, প্রয়োজনীয়তা কখনও শেষ হবে না রাই। একবার যখন তোমাকে
হারিয়ে ফিরে পেয়েছি, আর নতুন করে তোমাকে হারাতে পারব না। বাবার সাথে মাকেও
যে বড়ো প্রয়োজন শ্রাবনের। যে নিঃসঙ্গ মনটার সকাল হয় হারানো ভালোবাসাকে
ফিরে পেয়ে নতুন দিনের নতুন স্বপ্নের আগমনের অপেক্ষায় আর রাত্রির গভীরে
সেই স্বপ্নের বিসর্জনের যন্ত্রণায় মনটা ভেঙ্গে যেতে যেতে আবার নতুন
স্বপ্নের আশায় বুক বাঁধে - - - তাকে চিরকালের মতো বিসর্জিত হতে তুমি দিও
না রাই। "
অর্কর কথাগুলো শুনে কান্নায় ভেঙে পড়ল
রাই।অতিরিক্ত অবহেলায় এত উত্তেজনা আর সহ্য হল না ওর দুর্বল শরীরের। হঠাৎ
আরও অসুস্থ হয়ে পড়ায় আশ্রমের সকলের পরামর্শে রাইকে হাসপাতালে নিয়ে যায়
অর্ক। দিকভ্রান্তের মতো অচৈতন্য রাইকে পাঁজাকোলা করে হাসপাতালে নিয়ে
যাওয়ার সময় বিখ্যাত ফুটবলার অর্ক জ্যোতি চৌধুরীর সাথে সতীর মৃত্যুতে শোকে
পাগল মহাদেবের কোনো পার্থক্যই খুঁজে পাচ্ছিল না কেউ।
শ্রাবণকে মহারাজের জিম্মায় রেখে হাসপাতালেই বসে রইল অর্ক।তিনদিন একইভাবে
অচৈতন্য হয়ে আছে রাই।মনোজ ওর কাছে এসে বলল"আমি আছি এখানে। তুই বাড়ি
গিয়ে একটু বিশ্রাম নে। ওর জ্ঞান ফিরলেই তোকে খবর দেব।"
"নারে, ওকে সুস্থ করে নিয়েই ফিরব। ওকে ছেড়ে চলে গেলে আবার আমি হারিয়ে ফেলব ওকে।"
ডাক্তার, নার্স কারো কথাতেই ও হাসপাতাল ছেড়ে গেল না। আজ অর্কজ্যোতি
চৌধুরী কোনো বিখ্যাত ফুটবলার নয় - - - এক ভাগ্যবিড়ম্বিত অসহায় প্রেমিক।
তিনদিন পর ভোররাতে নার্স এসে বললেন" ওনার জ্ঞান ফিরেছে,এখন উনি বিপন্মুক্ত।
কিন্তু বেশি উত্তেজনাও আবার ওনার শরীরের জন্য ভালো না।"
নার্সের কথায় অল্প হেসে কেবিনে ঢুকে বলল"কেমন আছো রাই?"
রোগক্লিষ্ট মুখে অল্প হেসে শ্রান্ত কন্ঠে বলল"আমাকে যেতে দিলে না বলো! এখনও সেই আগের মতো একগুঁয়েই রয়ে গেছ।"
রাইয়ের শীর্ন হাতটা নিজের হাতে নিয়ে বলল" আমার ভালোবাসার জোর যে অনেক
বেশী। মৃত্যুকে যখন ফেরাতে পেরেছি, আমার রাইকিশোরীকে আর কেউ আলাদা করতে
পারবে না আমার কাছ থেকে। শ্রাবণ এতদিন যা পায়নি - - - আদরে - ভালোবাসায়
ওর সেই অভাব ভরিয়ে দেব আমরা। আর কখনও আমাকে একা করে চলে যাবে না তো রাই?
খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছেও তোমার ভালোবাসা ছাড়া যে আমি নিঃস্ব"।
কোন উত্তর না দিয়ে অর্কর চওড়া বুকের নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে নিজেকে সঁপে দিল
রাই। এত বছরের দুঃখ-যন্ত্রণা-বিরহ ভুলে দুটি হৃদয় যখন এক হয়ে গেল, তখন
আকাশে শেষরাতের চন্দ্রমা আজ আর মধ্যমা না হয়ে মিটিমিটি হেসে ওদের
ব্যথাতুর জীবনে নতুন আনন্দময় ভোরের সমারম্ভ করতে উদীয়মান সূর্যকে
আমন্ত্রণ জানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
--------------------