( পূর্ব-প্রকাশিতের পর )
শতরূপা ও অভিরূপা উপহাসের ভঙ্গীতে হাসিতে লুটিয়ে পড়তে পড়তেই অভিরূপা তার দিদিকে আরেকটা প্ল্যান দিয়ে বসলো। বললো , একজন প্রেমিকের তো পরীক্ষা নেওয়া হলো, এবার তোর আরেক জন প্রেমিকের পরীক্ষা নেওয়া হোক সে তোকে কতোটা ভালবাসে । শতরূপা না-জানার ভাণ ক'রে বললো, আরেকজন ? মানে ?
-----কেন ? ঐ যে মাঝরাত পর্যন্ত তুই ফোনে লেগে থাকিস , অভিষেক না কী-যেন নাম। সে তো তোর এখনকার প্রেমিক, আমি সব জানি দিদি, আমাকে লুকাবি না, তুই তো এখন তার দিকে একেবারে ঢ'লে আছিস ! ওকে আবার কেন এখন টানছিস, আমি তো অরিন্দমের কাছ থেকে ছুটকারা পেতে চেয়েছিলাম ।
ওকে টানার এখন দরকার নাই, সে যখন হবে তখন হবে। অভিরূপা বললো, তা বললে হবে না দিদি, দুটোকেই পরখ করতে হবে ।আর অরিন্দমের থেকে তুই এখনো ছুটকারা পাসনি , আমার ধারণা সে আবারো আসবে। এই ব'লে সে তার দিদির ফোনটা নিয়ে অভিষেকের নম্বরে ফোন লাগালো। ওপারে হ্যালো বলতেই,অভিরূপা বললো, আপনি অভিষেক মাওয়ার তো ? সে হ্যাঁ বলতেই , অভিরূপা ব'লে চললো, শতরূপা করোনা আক্রান্ত, সিরিয়াস অবস্থা। বেলেঘাটা আইডি হসপিট্যালে নিয়ে যেতে হবে। তার আগে আপনাকে একবার দেখতে চায়। কালকেই আসতে হবে সকাল ন'টার মধ্যে, নইলে দেখা হবেনা।
আপনার তো গাড়ি আছে না ? একবার দেখা ক'রে যান । তার পরে এলে দেখা হবে না । অভিষেক থমকে' বললো , করোনা ! সিরিয়াস! - কিন্তু লকডাউনের সময় আমাকে বাড়ি থেকে বেরোতে দিবে না। আমার যাওয়া সম্ভব নয়।করোনা রোগীর কাছ থেকে দূরে থাকাই এখন শ্রেয় । উনাকে তুরন্ত বেলেঘাটা হসপিট্যালে নিয়ে যান। অভিরূপা জানত চায়লো, কী বলছেন ? আসতে পারবেন না ? আপনি ওর প্রেমিক না ? অভিষেক ব'লে উঠলো, প্রেমিক আবার কিসের ? ও আমার সহপাঠী বন্ধু, এর বেশী কিছু না। আমার যাওয়া সম্ভব নয়। ব'লেই সে ফোন কেটে দিলো। ফোন স্পীকার মুডে ছিল । শতরূপা সব শুনলো। অভিরূপা ওর দিদিকে বললো, কি রে দিদি, তোর এই প্রেমিক তো পাত্তাই দিলো না। শুনলি তো, সে আসবে না।
শতরূপা বিষণ্ণ হলো, কিছুটা অবাকও হলো। বললো, বললাম ওকে টানার দরকার নাই। অভিরূপা বললো, কিন্তু তোকে ও পাত্তাই দিলো না। দিদি তুই এখন কী করবি ? পরক্ষণেই হাসতে হাসতে বললো, সে ভাবা যাবে 'খন, তুই এখন করোনা থেকে সেরে তো ওঠ্ । তোর অরিন্দম নিশ্চয় আবার ফোন করবে ।
সেদিন অরিন্দম সন্ধ্যার পর কোনোক্রমে বাড়ি ফিরে এসে হাত -পায়ের ব্যথায় কাহিল হ'য়ে পড়লো । কাপড় ছেড়ে গরম জলে সাবান দিয়ে ভালো ক'রে হাতমুখ পা ধুয়ে , মাকে ব'লে এক কাপ গরম চা খেয়ে শুয়ে পড়লো। মা অনেক জিজ্ঞাসা করলো, কিন্তু কোথায় গেছিল বললো না। সে বিশ্বাস করতে পারছে না যে শতরূপার এই অবস্থা হয়েছে। সে এই অবিশ্বাস নিয়ে কখন্ ঘুমিয়ে পড়েছিল তার হুঁশ ছিল না। সকাল বেলায় তার মা তাকে ডেকে তুললো। গায়ে জ্বর। পাড়ার ডাক্তারকে দেখালো। ডাক্তার সাবধানতাবশতঃ কয়েকটা রক্ত পরীক্ষা করিয়ে ওষুধ দিলো, বললো,সর্দ্দিজ্বর হয়েছে। চিন্তার কোনো কারণ নাই। দু-এক দিনের মধ্যেই সেরে যাবে। সেই মতো অরিন্দম কয়েক দিনেই সুস্থ হ'য়ে উঠলো। তার মনে এখন দ্বন্দ্ব চলেছে, তাকে কেউ কি ভাঁওতা দিলো ? বা মজা করলো ? যদি সত্যিই হয় , একবার ফোন ক'রে দেখলে হয় শতরূপার কেমন অবস্থা । এই দোলাচলে প্রায় দশ দিন কেটে গেল। একদিন বেপরোয়া হ'য়ে সে ফোন ক'রেই বসলো শতরূপার ফোনে। ফোন বেজে গেল , কেউ ধরলো না। অরিন্দম দ্বিতীয় বার ফোন লাগালো। এবার অভিরূপা ধরলো, সব শুনে বললো,ও, শতরূপা ? ও এখনও হাসপাতালে। অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে, হয়তো সেরে উঠতে পারে। ডাক্তাররা কোনো আশ্বাস দ্যায়নি। অরিন্দম বললো, যাক বাবা, একটু ভালো আছে তো, নিশ্চয় সেরে উঠবে। বাড়ি এলে কাইন্ডলি একবার জানাবেন ,একবার দেখে আসবো। অভিরূপা বললো, সে আগে তো আসুক , যদি দেখা করতে চায় তো আসবেন।
আপনি কে বলছেন ? ---অরিন্দম প্রশ্ন করায় অভিরূপা ফোনটা কেটে দিলো।
অরিন্দমের তবু দ্বন্দ্ব কাটে না। কী বলতে চেয়েছিলো শতরূপা ? না তার ইন্ধনে তার ফোন থেকে কেউ তাকে বিভ্রান্ত করছে? সে কি তাকে দূরে সরিয়ে দিতে চায় ? কিন্তু তাহলে দেখতে চায়বে কেন ? বেশী ফোন করলে হয়তো বিরক্ত হবে বাড়ির লোক । তবু সে সপ্তাহে সপ্তাহে ফোন ক'রে খোঁজ নেয়। সপ্তাহ তিনেক বাদ সে খবর নিয়ে জানতে পারলো , শতরূপাকে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনা হয়েছে।তবে বাইরের লোকের এখনও তার সাথে দেখা করা নিষেধ। এখন সঙ্কট কেটে গেছে, তবে পুরোপুরি সুস্থ হ'তে বেশ কিছুদিন সময় লাগবে। দেখা করতে চায়লে অরিন্দমকে বলা হলো, আগে ঠিকমতো সুস্থ হোক, তারপর যদি ও চায় তো জানাবো,তখন আসবেন।
অরিন্দম রহস্যের মধ্যে দিন গুণতে লাগলো, কবে সে শতরূপার সাথে দেখা করতে পারবে।
ইতিমধ্যে অরিন্দমের একটা ভালো খবর এলো।সে প্রায় বছরখানেক আগে ডব্লিউ বিসিএস পরীক্ষায় পাশ ক'রে ভাইভা দিয়েছিল,তার রেজাল্ট বের হয়েছে। তাতে সে গ্রূপ-'এ' তে চান্স পেয়েছে। হয়তো কিছুদিনের মধ্যে নিয়োগ হ'য়ে যাবে। অবশ্য তার আগে মেডিকেল ও পুলিশ ভেরিফিকেশন হবে ।এই খবরটা সে প্রথমেই বাড়িতে মাকে জানালো।বাড়ির সবাই খুব খুশী। কিন্তু কবে হবে সেইটাই কথা। সরকার তো এখন টালমাটাল।তবে ভোটের আগে নিশ্চয় হবে। শতরূপাকেও খবরটা জানানো দরকার। তাই সে আবার ফোন করলো।তার মনে হলো, কেউ একজন ফোনটা ধ'রে ফিসফিস ক'রে বলছে, অরিন্দম ফোন করেছে, দিদি তুই ধরবি ? বেচারা অনেকদিন ধ'রে তোর সাথে কথা বলতে চায়ছে, একবার ধর্ । তারপর ফোনের হাত বদল হলো। শতরূপা ফোন ধ'রে কষ্টের ভাণ ক'রে বললো, কে,অরিন্দম ? বলো ।অরিন্দম প্রথমেই সে কেমন আছে জানতে চায়লো। তারপর খোঁজখবর নেওয়া শেষ হ'লে বললো, আমার আর বেশিদিন কেরানীর চাকরি করতে হবে না । আমি ডব্লিউ বিসিএস-য়ের "এ" গ্রুপে নির্বাচিত হয়েছি, গেজেটেড পোষ্ট। আশা করি এবার আমাকে কেরানী ব'লে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে পারবে না । শতরূপা তাকে অভিনন্দন জানালো, আর বললো, তুমি একজন ব্রিলিয়ান্ট ছেলে, কেন কেরানীর কাজ ক'রে মরবে, তাই ওসব বলেছিলাম, ওসব মনে রেখো না।ক্ষমা ক'রে দিও। অরিন্দম তাকে দেখতে যেতে চায়লো। শতরূপা বললো, এখন এসো না, বুঝতেই পারছো, সবার এখনও করোনার আতঙ্ক কাটেনি। আরেকটু পরিস্থিতি স্বাভাবিক হোক তখন এসো।- - - করোনাকে জয় করার জন্য অনেক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়ে অরিন্দম কথা শেষ করলো। সেদিন তার খুব আনন্দ হলো।
অভিরূপা পাশে ব'সে থেকে সব শুনছিল। সে বললো, এই লোক তোর সাচ্চা প্রেমিকই হবে। তুই ওকে আর হেলাফেলা না ক'রে ঝুলে পড়্ । এবার এলেই দ্যাখ্ খাতির যত্ন ক'রে আমি তোর বিয়েটা লাগিয়েই দিব। তুই আর ওই অভিষেককে মোটেও পাত্তা দিবি না।ও সুযোগ সন্ধানী। তুই বুঝতে পারিস নি, ও তোর সাথে ফূর্ত্তি ক'রে তোকে ছেড়ে দিতো।
কিছুদিন পর একটা মস্ত ফুলের তোড়া নিয়ে অরিন্দম
শতরূপার বাড়িতে হাজির হলো। দূরত্বে ব'সে আর যথারীতি মাস্ক প'রেই কথাবার্তা হলো। দেখে কিন্তু তার শতরূপাকে করোনা-ফেরা রোগী ব'লে মনে হলো না।- - - তার আদর আপ্যায়ন হলো। শতরূপার মা তাকে আবার আসতে বললেন। এরপর তারা প্রায়ই ফোনালাপ করে। শতরূপা জানায়, সে তার অনলাইন ক্লাশ আবার শুরু করেছে।
করোনার আনলক পিরিয়ড শুরু হলো। এখন প্রায় সবকিছুই খুলে যাচ্ছে। দুই বাড়ির সম্মতিতে তাদের বিয়ের শুভ অনুষ্ঠানও ভালোই ভালোই মিটে গেল, তবে সবই করোনার বিধিনিষেধ মেনে। জীবনধারা এগিয়ে চললো।
বিবাহবাসর হ'য়ে যাওয়ার পর অষ্টমঙ্গলার সময় বাড়িতে আড্ডা দিতে দিতে হঠাৎ অভিরূপা ব'লে বসলো, ভাগ্যিস তোকে করোনার রোগী সাজিয়েছিলাম রে দিদি, নইলে এতো বেপরোয়া প্রেমিক বর তুই কোথায় পেতি ? শুনে তো অরিন্দম একেবারে থ । এতো সিরিয়াস অভিনয় তোমরা আমার সাথে করেছো ? তাও কিনা করোনা নিয়ে !
হতবাক হ'য়ে সে অভিরূপার দিকে চেয়ে রইলো। অভিরূপা কৈফিয়তের সুরে বললো, মাফ করবেন জামাই বাবু, শুধু আপনিই নন , আরো একজন এই পরীক্ষায় ছিলো, তবে সে করোনার ভয়ে পরীক্ষা দিতেই আসেনি । তবে হ্যাপি শেষ, থুড়ি, হ্যাপি শুরু তো হলো ! এই ব'লে সে ও তার দিদি হেসে লুটিয়ে পড়লো ।অরিন্দম বোকার মতো ওদের পানে তাকিয়ে রইলো, শেষে সেও না হেসে পারলো না। - - তবে তার নতুন পোষ্টিং এখনও হয়নি। পোষ্টিং হ'লেই তো বাইরে যেতে হবে। তারা কিছুদিন কলকাতায় দাম্পত্য উপভোগ করুক।
( ১১৪৮ শব্দ )
© বদরুদ্দোজা শেখু , ২৬•০২•২০২১, বহরমপুর
--------------------------------------'''-''''''''-----------