'মনা, ও মনা, মনালী কোথায় গেলি মা?' মনালীকে সারা বাড়ির লোক খুঁজে হয়রান। অবশেষে মনালীর বাবা অরূপবাবুই মেয়েকে ছাদের চিলেকোঠার ছোট্ট ঘরটাতে আবিষ্কার করলেন। মেয়ের থমথমে মুখের দিকে তাকিয়ে তাকে কাছে টেনে নিয়ে বললেন, ''কি রে মনা তুই একলাটি কি করছিস? নিচে কত লোকজন, আমি তোর জন্যে মা নিয়ে এসেছি; চল্ মনা, তোর নতুন মায়ের সঙ্গে আলাপ করবি চল।''
- না, আমি কিছুতেই যাব না, ও আমার মা নয়।'' মনালী জেদ ধরে।
- ''আচ্ছা, আলাপ পরে করবি না হয়, এখন নতুন মাকে দেখবি চল।''- মেয়ের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে অরূপবাবু মেয়েকে বোঝাতে লাগলেন।
- ''দেখেছি, কালো, বিচ্ছিরি- ওটা আমার মা কিছুতেই হতে পারে না, আমার মা কত সুন্দর ছিল।'' বলে মনা অঝোরে কাঁদতে লাগল।
অরূপবাবু অনেক ভুলিয়ে ভালিয়ে মেয়েকে নিচে নামিয়ে আনলেন, মোক্ষদাদিকে স্নান করিয়ে, খাইয়ে দিতে বললেন। মনালী তো কিছুতেই খাবে না, স্নানটা যা হোক করে নতুন জামার লোভ দেখিয়ে করানো গেল।
মোক্ষদাদিই এখন মনালীকে দেখাশোনা করে। অভাবী হলেও তার মনের কোনে মনালীর জন্যে কোথায় যেন একটা ভালবাসার বাসা আছে, এটা বোধহয় মেয়েদের জন্মগত প্রবৃত্তি। মোক্ষদা মনালীকে নিয়ে রান্নাঘরের আড়ালে গিয়ে বলল, ''তুমি কিছু খাচ্ছ না কেন? কত্ত ভাল ভাল সব খাবার। তোমার আগের মা তো আকাশের তারা হয়ে গেছে- তুমি না খেলে ভারি কষ্ট পাবে।''
- কষ্ট না হাতি, কষ্ট পেলে আমার কাছে আর আসত না?
- আসবে, ঠিক আসবে, দেখবে তুমি ঠিক আগের মাকে খুঁজে পাবে, হয়ত কোন নতুন রূপে।
গল্প করতে করতে মোক্ষদাদি মনালীকে খাইয়ে দিতে লাগল। মাকে ফিরে পাবার আশায় মনালীও খেয়ে নিল।
মনালীর বিষণ্ণ মুখ অরূপবাবুর মনে দুশ্চিন্তার কালো মেঘ ঘনিয়ে আনল। কিন্তু এছাড়া আর উপায়ই বা কি ছিল! তাঁর প্রথমা স্ত্রী ছিলেন বেশ সুন্দরী, কিন্তু অবস্থাপন্ন ঘরের মেয়ে হওয়ায় তেমন বিশেষ কাজকর্মও জানতেন না, ইদানিং যকৃতের ক্যান্সার ধরা পড়ার পর তো একদম শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছিলেন, মাস তিনেক হল গত হয়েছেন। মনালীর দিদিমা মেয়ের অসুখের সময় অনেকদিন এসে থেকে ছিলেন। মেয়ের মৃত্যুর পর কাজকর্ম মিটিয়ে তিনিও ভারাক্রান্ত মনে একবুক কান্না নিয়ে নিজের সংসারে ফিরে গেলেন, স্বামী ও ছেলেকে ছেড়ে বেশিদিন থাকার খুবই অসুবিধে। মনালীকে নিয়েই খুব সমস্যা। তাকে স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরী করানো, টিফিন গোছানো, ব্যাগ-বই গোছানো, সে বিরাট কাজ। খুব জেদী মেয়ে, মা চলে যাবার পর থেকে আরও জেদী হয়ে পড়েছে। কত আর অফিস কামাই করে বাড়িতে বসে থাকবেন অরূপবাবু। স্ত্রীর অসুখের চিকিৎসায় অনেক টাকা-পয়সা খরচ হয়ে গেছে- নানান সমস্যা আর চিন্তায় অরূপবাবু জর্জরিত হয়ে পড়লেন। মনালী জ্যেঠু-জ্যেঠিমা চেন্নাইতে থাকেন। মনালীর জ্যেঠিমাই মাঝে একবার এসে এসব অব্যবস্থা দেখে তাঁর দূরসম্পর্কের এক বোনঝি রীনার সঙ্গে অরূপবাবুর বিয়ের সম্বন্ধ একেবারে পাকা করে ফেললেন। দেখতে রীণা হয় তো ভাল নয়, কিন্তু খুব কাজের। গরীবের মেয়ে তার ওপর রং ময়লা, চওড়া কপাল- রূপও নেই, রূপিয়াও নেই, অতএব মেয়েদের যা হয়, সম্বন্ধ করতে করতেই কপাল আরও চওড়া হয়ে যায়। যাক্ রীণার কপাল ভালই বলতে হবে, অরূপবাবুর মত সুপুরুষ তাঁকে বিয়ে করতে রাজী হয়েছেন। রাজী না হয়ে উপায়ও ছিল না। সংসার একেবারে অচল। অফিসও অনেক কামাই হয়ে গেছে। তাছাড়া সবকাজেই পারদর্শী শুনে মনটা একটু খুঁতখুঁত করলেও শেষ পর্যন্ত অরূপবাবু সম্মতি দিয়েই ফেললেন। কিন্তু এমন বিপত্তি হবে কে জানত। তাঁর পছন্দ হলে কি হবে, মেয়ের মাকে পছন্দ হল না, এ কি জ্বালা রে বাবা।
বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ হবার পর অরূপবাবুর দাদা-বৌদিরা চেন্নাই ফিরে গেলেন। আত্মীয়-স্বজনরাও চলে গেল। মনালীর নতুন মা রীণা বেশ গুছিয়ে সংসার করতে লাগল, কিন্তু মনালী কিছুতেই তার নতুন মায়ের ত্রিসীমানায় আসবে না। রীণা কিন্তু হাল ছাড়ে না, খুবই চেষ্টা করে মনালীর মন পেতে। রোজ নতুন নতুন মুখরোচক টিফিন বানিয়ে দেয়, নানারকম রান্না করে খাওয়ায়। মনালীর বাবা তো খুব খুশি, তিনি তো আগে এত যত্ন-আত্তি পাননি। কিন্তু মনালীর মন তার নতুন মা কিছুতেই পায় না। মনালীর জন্যে অরূপবাবুরও বেশ দুশ্চিন্তা। তিনি কত ভুলিয়ে ভালিয়ে মেয়েকে মায়ের কাছে নিয়ে আসতে চান- কিন্তু মনালীর মুখে সেই এক বুলি, 'ও আমার মা নয়, আমি ওর কাছে যাব না।' একদিন তো অরূপবাবু খুব রেগে গেলেন, বললেন, ''মনা, এমন ব্যবহার করলে আমি তোকে নিয়ে হোস্টেলে ভর্তি করে দিয়ে আসব, অসভ্য মেয়ে কোথাকার।'' মনালীকে অন্য জায়গায় ভর্তি করবে শুনে রীণা তো কেঁদেই ফেলল, বলল, ''তুমি একটু ধৈর্য ধর, আমাকে একটু সময় দাও, আমি ঠিক মনার মা হয়ে যাব একদিন, তুমি দেখে নিও। তুমি ওকে এই নিয়ে আর বকাঝকা করো না প্লিজ, ওতে ওর মন আরও খিঁচড়ে যাবে।'' রীণা দুপয়সা আয়ের জন্য বাপের বাড়িতে নানারকম খেলনা, হার, দুল তৈরী করে দোকানে সাপ্লাই দিত। মনালী পুতুল খেলতে খুব ভালবাসে তাই রীণা অরূপবাবুকে দিয়ে নানারকম পুতুল তৈরী করার সাজসরঞ্জাম আনাল। কাজের ফাঁকে ফাঁকে নানা ধরণের সুন্দর সুন্দর পুতুল তৈরী করে মনালীকে উপহার দিতে লাগল। মনালী পুতুলের লোভ সামলাতে পারে না। পুতুল নেবার সময় মায়ের কাছে একবারটি যায় আবার পুতুল নিয়ে থ্যাঙ্ক য়ু বলেই ছুটে চলে আসে। মনালীর পুতুল নেবার আনন্দে উজ্জ্বল মুখটা আর একটা পুতুল তৈরীর প্রেরণা যোগায় রীণার। বেশ কয়েকটা পুতুল হল মনালীর। এখন মনালী নতুন পুতুলগুলো নিয়েই খেলে, পুরনোগুলোকে বাতিল করেছে। মনালী মনে ভাবে, ''নতুন মা দেখতে খারাপ হলে কি হবে, পুতুলগুলো কিন্তু দারুণ তৈরী করে।'' কিন্তু যতই নতুন পুতুল নিয়ে মেতে উঠুক না কেন মনালী, নতুন মাকে এখনও সে মন থেকে কিছুতেই গ্রহণ করতে পারছেনা।
বসন্ত বিদায় নিল। সব জীর্ণ পুরাতনের অবসান। এল নতুন বছর। নতুন আশায় বুক বাঁধে রীণা। মনার সেই ম্রিয়মান ভাবটা কিছুটা কেটেছে। নতুন নতুন খাবার খাওয়ানোর সময় কাছে বসে থাকলে এখন আর বিরক্ত হয় না, কিন্তু নতুন মায়ের সঙ্গে ভাব সে কিছুতেই করবে না। হঠাৎ খবর এল অফিসের কাজে অরূপবাবুকে দিন কয়েকের জন্য কলকাতার বাইরে যেতে হবে। শুনে মনা তো ভীষণ কান্নাকাটি করতে লাগল। কিছুতেই সে তার বাবাকে ছাড়বে না। অনেক জিনিস আনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে, অনেক বুঝিয়ে অরূপবাবু ছাড়া পেলেন। মুম্বাইতে দিন কয়েক তাঁকে থাকতে হবে। মনা একা একাই শুয়েছে ওর ঘরে- বাবার কাছে শোয়। নতুন মায়ের সঙ্গে তো আর শোবে না। রীণার মনে বড় কষ্ট হয়- এত মায়া পড়ে গেছে মেয়েটার উপর- মনার মনের কষ্ট রীণা উপলব্ধি করতে পারে, তাই তো সে জোর খাটায় না- শুধুই ভালবাসা দিয়ে যায়।
এরই মধ্যে একদিন রাত্রে উঠল প্রচণ্ড ঝড়। রীণা মনার ঘরে এল জানলাগুলো বন্ধ করতে। ঝড়ের আওয়াজে মনার আগেই ঘুম ভেঙে গিয়েছিল, বড় ভয় করছিল তার। নতুন মাকে দেখে এই প্রথম মনালীর খুব ভাল লাগল। মেঘ ডাকছে, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, মনার মনেও যেন আলোর ঝলক লাগতে লাগল, তবে কি মনার মনে মেঘ কাটছে! মনা ভাবতে থাকে, ''না এই মা'কে তো দেখতে খুব খারাপ লাগছে না- বেশ তো হাসছে, আমার গায়ে চাদরটা চাপা দিয়ে দিচ্ছে, ঠিক আমার আগের মায়ের মতই।" হঠাৎ প্রচণ্ড জোরে আওয়াজ হল, কাছেই কোথাও বাজ পড়ল। দারুণ আতঙ্কে মনালী ছুট্টে গিয়ে তার নতুন মাকে জড়িয়ে ধরল। একি কাণ্ড, নতুন মায়ের গায়েও মনা পায় সেই চির পরিচিত 'মা' – 'মা' গন্ধ, যা ছিল তার নিজের মায়ের গায়ে। এই সুগন্ধ প্রকৃত মাতৃস্নেহের গন্ধ যা সব মায়ের গায়েই মাখানো থাকে সহজাত ভাবেই। রীণার বুভুক্ষ নারী হৃদয় এতদিনে কানায় কানায় ভরে উঠল। মুম্বাই থেকে ফিরে এসে অরূপবাবু দেখেন তার মনা সোনা তো মায়ের কাছ-ছাড়াই হচ্ছে না। তাঁরও মনে আনন্দের প্লাবন বয়ে যেতে লাগল।
-------------
ডঃ রমলা মুখার্জী,
বৈঁচি, বিবেকানন্দ পল্লী,
হুগলী, ৭১২১৩৪,