গল্প।। পিঠে পাব্বন ।। সংঘমিত্রা সরকার কবিরাজ
0
মার্চ ০১, ২০২১
কাল মকরসংক্রান্তি । সুন্দরীবালার মনটা ছোঁক ছোঁক করে ওঠে।নোলাটা আউলিয়ে ওঠে।আজকাল বড় বেশি খাই খাই বাতিক হয়েছে সুন্দরীবালার ।বয়সটা নেহাত কম হলো না।চোখে তো আজকাল ঠিক করে সবকিছু ঠাহর হয় না।সবটাই কেমন ঝাঁপসা লাগে।কানদুটোও তো গেছে।জোরে না বললে কিছুই শুনতে পায় না খালি নাকটাই যা ঠিক আছে।কি রান্না হয় সব বুঝতে পারে।কিন্তু পেটে তো সব সয় না। মাঝে মাঝে কাপড়ে- চোপোড়ে হয়ে যায়।তাই রমলা মাঝে মাঝে খুব চিৎকার করে। রমলা তার ব্যাটার বউ।মাগী খুব দজ্জাল।মুখে খুব চোপা।তবে মনটা ভালো বটে।ওই নারকেলের মতো আর কি।বাইরেটা রস কষহীন ,কিন্তু ভেতরটা রসালো খানিক বটে।
রমলাকে সুন্দরী খুব বেশি দোষ দিতে পারে না। যদিও বিড়বিড় করে খানিক গাল ও দেয় ,আপনমনে হারামজাদী - আবাগীর বেটি বলে।তবে খুব সাবধানে যাতে রমলার কানে না যায়।তার লিজের ব্যাটা তো সুবিধের লয়।মদখেকো অকম্মার ঢেঁকী।ওই রমলা ছিলো বলেই এখনো যা হোক দুমুঠো - দুবেলা খাবার পায় সুন্দরী। ব্যাটার তো কিছুই রোজগার লাই। জুয়াখোর ,নেশাখোর - বজ্জাতের শেষ। নিজেই বউয়ের ঘাড়ে বসে খায়।রমলা তিনবাড়ি কাজ করে তিনজনের সংসারটা ঠেলে।
সুন্দরী জারের আকোশে আরও খানিক জুবুথুবু হয়ে কাঁথাখানাকে গায়ে টেনে বসে।কয়দিন হলো তাদের লতুন পাকাবাড়ি হইছে।সরকার দিছে তাই। এখন আর ঠান্ডা হাওয়াটা ঘরে ফাঁকফোঁকর দিয়ে ঢুকে পরে না ,তবুও গতরে কি আর সে গরম আছে।এখন এটুকুতেই বড় জার লাগে।আজ রমলার আসতে একটু দেরীই হবে বলেই গেছে।পশ্চিমপাড়ার বড় বাবুদের ঘরে মেজ বউটার আবার বাতের ধাত।মাগী গায়ে গতরে সরেস, কিন্তু কাজে কম্মে এক্কেবারে নাই। রমলাকে তাই বেশি কিছু পয়সা দিয়ে রাতের রুটি তরকারিটা বানিয়ে নেয়।আজ পিঠে - পাব্বনের দিন, তাই রুটি নয় খানকতক পিঠে - পুলি বানিয়ে দিতে হবে রমলাকে আগেই বলেছিলো মেজগিন্নি। পিঠে বানানো বড় ঝকমারী ,সময়ের কাজ।তা বছরভরের কাজ গিন্নিদের মন একটু আধটু না জুগিয়ে চললে তো লয়। তার উপর খানিক বেশি মাইনে দেয় বলে কথায় কথায় বেশি কাজ করিয়ে নেওয়ার ধান্দাতেই থাকে।
বসে থাকতে থাকতে ঝিমুনিতে চোখদুটো লেগে আসে সুন্দরীর ।রমলা আসবে তবে খানিক ফ্যানভাতে করে শাশুড়ি বৌতে খাবে খেয়ে শোবে।এখন তো আর কাঠের জ্বাল নেই ,গ্যাস হয়েছে ,সরকার নাকি কম পয়সায় দিছে।যাক গে ,মরুক গে - কি সুখ হছে বাবা তার জানা নেই।উনোনটো ধরালে খানিক হাত - পা- গুলান সেঁক পেতো ,এখন সে উপায় নাই।মাগো ছি - ছি ! কি সব হলো গেলো ,লুকে বুলে ইসব নাকি গরিবদের উন্নতি। মাগো উন্নতির কি ছিরি। প্যাটের ভাতের তো যে কে সেই টান, জিনিসপত্রের কি দাম মাগো।পাড়ার হনুমান মন্দিরের চালাটাই সবাই আলোচনা করে ,সুন্দরী সব শোনে মন দিয়ে।কদিন আগেই প্যাঁজের কি দাম বাড়লো । হাতে ছ্যাঁকা।একটু পান্ত যে খাবে প্যাঁজদিয়ে তার সে উপায় ছিলো না।একদিন রমলা কতো চোপা করলো একটুকরো প্যাঁজের লেগে।যাকগে কি সব আবোলতাবোল কথা যে ভেবে চলেছে।এই এক বয়সের দোষ। রমলা এর লেগেই মুখ করে।
পাশের বাড়িতে নলেন গুড় দিয়ে কি হচ্ছে যেন, গন্ধে মালুম হচ্ছে।দুবার জোরে জোরে নাক টানতে গিয়ে বিছানায় টুপুস করে টলে পরে।ঢুলু ঢুলু চোখে তার মনে পরতে থাকে উমনো ঝুমনোর গল্প।লোভী বামুন বাপটা দু-খানা পিঠে খাওয়ার দোষে কচি মেয়েদুটোকে জঙ্গলে দিলো।সে কি দুখের কাহিনী গো।যাই হোক বাবা, ঠাকুরের কেপায় মেয়ে দুটোর শেষ অবধি রাজপাট হয়েছিলো বটে।ঘুমলাগা চোখে ভাসতে ভাসতে সে দেখতে পায় নিজের ডাগরডুগুর কাঁচা বয়সটাকে বর টা তার ভালোই ছিলো ।ভাগচাষীর ঘর ছিলো তাদের।নিজের বিঘা দুয়েক জমিও ছিলো। মোটা ভাত কাপড়ের অভাব কোনোকালেই ছিলো না।কপালের ফ্যার।রাস্তা বড় হলো তাদের জমিগুলান রাস্তার প্যাটেই গেলো ।পয়সা যা দু- চারটে হাতে এলো ,হারামজাদা ছেলেটা মদ - মাগী করে উড়িয়েই দিলো।তাদের বড় গ্রামটা দেখতে দেখতে শহর হয়ে গেলো।সব যেন স্বপন পারা লাগে আজকাল।
দুর বাবা বউটা আজ বড় দেরী করছে।ছেলেটা তো কত রেতে ঘর ঢোকে তার ঠিকঠিকানা থাকে না।শরীরটো আর জুতের যায় না। বুকে বড় ব্যথা আজ সন্ধ্যে থেকেই।কাল বাবুদের বাড়ি থেকে নিশ্চয় পিঠে আনবে।দু -খান বেশি করে তাকেই দেবে সে জানে। সাথে মুখঝামটাও দেবে।'বেশি খেয়ে পেট ডেকো না যেন।' বউটা আর জন্মে তার মেয়ে ছিলো।
বুকের বেদনাটা কিরকম ছুঁচের মতন লাগছে না!হে ঠাকুর ; কাল পিঠে দুখানা যেন খেতে পাই।আহা ,কতদিন নলেনগুড়েরপায়েস খাই নি।পাটিসাপটা, ভাপা পিঠে, আঁশকেপিঠে ,দুধপুলি,সরুচাকলি, গোকুল পিঠে ,- কত যে নাম ,কত যে বাহার তার ।জিভে জল আসে সুন্দরীর।কিন্ত জিভটা এতো খটখটে লাগছে কেন -তেষ্টায় বুকের ভেতরটা যেন কেমন করছে, হাত পাটা এতো অসাড় লাগছে কেন- একটু জল!
'মা - ওমা' ;বুড়িটা সন্ধ্যে থেকে ভুতের মতো ঘুমোবে।রাস্তার আলোটাও আজ জ্বলছে না।সব দায় তার।আজ একটু বেশিই রাত হয়ে গেলো।এখন তো শাশুড়িটাই সব। রমলার নিজের মা টা তো মরেছে অনেককাল হলো।হাড়বজ্জাত হারামজাদা বরটাতো তার সারাজীবনটাকে কালি করে দিয়েছে।কোথায় নেশা ভাঙ করে মরছে কে জানে।ছেলেটাতো বউটাকে1নিয়ে ভেগেছে অনেক দিন হলো।শ্বশুরের ঘরেই থাকে।এদিকপানে ভালে না। মাঝে মাঝে মনে হয় মরণ হলে বাঁচি1।বুড়িটা সাড়া কেন দেয় না। রমলা ঘরে ঢুকে তাড়াতাড়ি আলোটা জ্বালে, দেখে বুড়িটা জলের কলসীর উপর মুখ গুজুড়ে পরে আছে।শরীলে কোনো সাড়া নেই। তাড়াতাড়ি তুলতে গিয়ে দেখে কেমন যেন হিম শরীর।রমলার হঠাৎ করে খুব শীত করতে থাকে।
------------------
Tags