গল্প।। প্রতিরোধ ।। রণেশ রায়।।
১
রঞ্জুবাবুর শোবার ঘর। ছিমছাম। মালপত্রের ভারে ভারাক্রান্ত নয়। পরিষ্কার, কোথাও এতটুকু ধূলো নেই। ঘরের দেওয়ালে তাঁর স্ত্রীর একটা ছবি। ঘরের আয়তনের সঙ্গে সংগতি রাখে ছবিটার মাপ। ফলে তাঁর ছবিটাও যেন আরও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। একদিকে একটা পড়ার টেবিল । সঙ্গে চেয়ার। আরেকদিকে একটা আলমারি। ঘরের মধ্যে দুজনের শোবার খাট। তবে অনেকদিন হল রঞ্জুবাবুকে সে একাই আশ্রয় দেয়। এই খাটের সঙ্গে রঞ্জুবাবুর অজস্র মধুর স্মৃতি জড়িয়ে। রাতে স্ত্রীর সঙ্গে মান অভিমানের খেলা। প্রেমের সঙ্গে দৈহিক সম্পর্কের গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা। এ নিয়ে রসিকতা। সেগুলোর কোন কোনটা এখনও রঞ্জুবাবুকে আলোড়িত করে। তিনি বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়েন। আজ বাড়িতে বলতে গেলে প্রথমজন-ই নেই। তিনি নিজে এখন প্রথমজন আর একমাত্র মেয়ে শুভা দ্বিতীয়জন। তৃতীয়জন হলেন প্রায় চল্লিশ বছরের মহিলা মিনুদেবী। তিনি রান্নাবান্না ঘর পরিষ্কার সব-ই করেন। মেয়ের আগেই এ বাড়িতে প্রবেশপত্র। এই তৃতীয় জনের কল্যানেই ঘরটা এত পরিষ্কার থাকে। আর মেয়ের হাতের ছোয়ায় ঘরটার এই সহজ অথচ সুন্দর সাজ।
মেয়ে শুভার মায়ের সাথে মুখোমুখি পরিচয় হয় তাঁর মায়ের ওই ছবির মাধ্যমে। মায়ের ছবি দেখে শুভা বোঝে সে কেন এত সুন্দরী। মায়ের গুনাগুনের সঙ্গে তাকে পরিচয় করিয়ে দেন তাঁর বাবা। স্বামী স্ত্রী কেউ গত হলে একজনের প্রশস্তিতে সবসময়েই তৎপর থাকেন অন্যজন। তাই শুভা জানে যে তাঁর মা সর্বগুনসম্পন্না ছিলেন।ভাবতেই শুভা উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। কোন ত্রুটি হলে বাবা মেয়েকে সবসময়েই মনে করিয়ে দেন তার মায়ের এরকম ভুল কোনদিন হত না। এতে শুভা কখনই কিছু মনে করে না। বরং মায়ের প্রতি বাবার এই টানটা তাকে খুশি করে । সে ঠাট্টা করে বাবাকে বলে, `মা থাকলে তুমিও আজ এত অন্যমনস্ক থাকতে না`।
রঞ্জুবাবু তাঁর শোবার ঘরে পায়চারী করছেন। বোধহয় ভাবছেন কিভাবে মেয়ের কাছে কথাটা পারবেন। তিনি মেয়ের অবস্থানটা জানেন। কিন্তু তার পথ থেকে তাকে সরিয়ে নিতে হবে। তাঁর নিজের মধ্যেও দ্বন্দ্ব। একসময়ে তাকেও তাঁর বাবার সন্মুখীন হতে হয়েছিল একই প্রশ্নে। ইতিমধ্যে মেয়ে শুভা ঘরে ঢোকে। বাবা চেয়ারে আর মেয়ে খাটে। কয়েকদিন ধরেই শুভা বুঝতে পারছিল যে বাবা নির্মলের সঙ্গে তার সম্পর্কটা মেনে নিতে পারছেন না। তবে সেও নিজের সিদ্ধান্তে অটল। রঞ্জুবাবু সরাসরি প্রশ্নটা না তুলে বলেন :
------ শুভা, তোমার বয়স হল। এবারতো বিয়ের কথা ভাবতে হয়। ভেবেছ?
------ তাড়াতাড়ির কি আছে? আরও কিছুদিন যাক। তখন ভাবা যাবে। শুভা এড়িয়ে যেতে চায়। কিন্তু বাবা সেটা চান না। যেন আজ-ই একটা এস পার ওস পার চান। বলেন
------ মা বেঁচে থাকলে আমাকে ভাবতে হত না। কিন্তু বোঝতো বাবা হিসেবে এখন সেটা আমাকেই দেখতে হয়। শুভা বলে:
------ এখন আমিতো বড় হয়েছি। আর চাকুরিও করছি। তুমি আর এ ব্যাপারে ব্যস্ত হয়ো না।
------ ভালো ভালো সম্বন্ধ আসছে। শুভা যেন একটু উত্তেজিত হয়ে ওঠে। বলে:
------ আমাকে না জানিয়ে সম্বন্দ্ধ দেখছ কেন? যার বিয়ে তার মতামত নেবে না ?
------ সেটা প্রয়োজন মনে করছি না। বাবা হিসেবে আমি আমার কর্তব্য পালন করছি। রঞ্জুবাবু বলেন।
শুভা যেন একটু উদ্ধত হয়ে ওঠে। তার উত্তর
------ মেয়েদের অধিকারটা তোমরা কোনদিন মানতে পার না। অথচ মুখে প্রগতিশীল।
------ তোমার অধিকারটা কি? বাবার তির্যক প্রশ্ন।
------ কেন, মেয়েদের নিজের পছন্দটা নিজে করার অধিকার। তুমিতো জান নির্মলকে আমার পছন্দ। সেখানে আমাকে না জানিয়ে সম্বন্ধ দেখাটা আমার অধিকারকে অস্বীকার করা নয়? অনেকটা মুখের ওপরেই মেয়ের জবাব। রঞ্জুবাবু মেয়ের এই স্পর্ধা দেখে স্তম্ভিত হয়ে যান। মেজাজ ঠিক রাখতে না পেরে বলেন:
------ ওই একটা দুশ্চরিত্র ছেলে। জেনেশুনে তাকে মেনে নিতে পারি না। ওকে বিয়ে করলে পরের দিনই ফিরে আসতে হবে। তোমার অধিকার পেতে গিয়ে আমাকে কোন দায়ের মধ্যে ফেলবে ভাবতে পারছ? উপযুক্ত ছেলে হ`লে আমি উপযাজক হয়ে বিয়ে দিতাম। তোমার সঙ্গে সেটা হত আমারও সুখের বিষয়।
------ তুমি কি করে জানলে সে দুশ্চরিত্র? আর যদি সেরকম কিছু হয়ও জেন আমি দায় হয়ে তোমার কাছে ফিরব না। থাক, আমার স্কুল আছে। বলে শুভা হনহন করে বেরিয়ে যায়। রঞ্জুবাবু অসহায়ের মত বসে থাকেন।
২
বেশ কিছুদিন ধরেই রঞ্জুবাবু তাঁর মেয়ের্ পরিবর্তন লক্ষ্য করছেন। অমন সুন্দর সরল মুখটা যেন দিন দিন কঠিন হয়ে উঠছে।একটা কাঠিন্যের রেখা ফুটে উঠেছে মুখে। চোয়াল শক্ত হচ্ছে। চোখের নরম চাহুনি তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে।পদচালোনায একটা দৃপ্ত ভাব।যেন এক উদ্ধত যৌবন। চুল থেকে মাথা পর্যন্ত এই ঔদ্ধত্য কিসের সন্ধানে ? প্রশ্ন ওঠে রঞ্জুবাবুর।তাঁর এক এক সময় মনে হয় যে মেয়ে বড় হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলেদের সঙ্গে অবাধ মেলামেশা। প্রেমে পড়েছে। প্রেমে পড়লে মেয়েরা লুকিয়ে কোথাও প্রেমিকের কোলে মাথা রেখে উচ্ছল হয়ে ওঠে। তুলে ধরে তার জীবনের কামনা বাসনা একটি শিশুর সারল্য নিয়ে। কিন্তু যখন বাড়ি ফেরে তখন সেই উচ্ছাস লুকোবার জন্য সে কঠিন হয়ে ওঠার চেষ্টা করে বাবা মাকে বোঝাতে যে সেরকম কিছু নয়। সে প্রেমে পড়ার মেয়ে নয়। তার ব্যক্তিত্বের কাছে কেউ ঘেষতে সাহস পায় না। আবার রঞ্জুবাবুর মনে হয় সেই ঘটনার কথা যা মেয়ের ইজ্জত নিয়ে টানাটানি করেছিল। সে ব্যাপারে একটা বিদ্বেষ মেয়ের মধ্যে হয়ত একটা ঘৃনার আগুন জ্বালিয়েছে। আর সে আগুনে জ্বলেই মেয়ের এমন উদ্ধত আচরণ । আবার মনে হয় মেয়ে তার দিদিমার সংস্পর্শে এসে কঠিন চিন্তাভাবনাকে লালন করছে যার প্রশ্রয়ে মেয়ের চেহারায় এই পরিবর্তন। দিদিমার ভাবনাচিন্তার সঙ্গে রঞ্জুবাবু একমত নন। তিনি মেয়েদের অধিকার, স্বাধীনতা নিয়ে একটু বাড়াবাড়ি করেন। একটা মহিলা সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত আছেন। আর সেদিনের সেই ঘটনার পর মেয়ের দিদিমার কাছে যাতায়াত বেড়ে গেছে। রঞ্জুবাবু ভীত হয়ে পড়েন।
মেয়েকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে রঞ্জুবাবুর ভাবান্তর ঘটে। মনে পরে মেয়ের শোকবহুল বিয়গান্ত জন্ম। যেন এই সেদিনের কথা। স্ত্রী সুমনা সন্তান সম্ভবা। তিনি রঞ্জুবাবুকে বলেন :
------ তুনি কি চাও? মেয়ে না ছেলে ? রঞ্জুবাবুর উত্তর
------ কন্যা সন্তানে আপত্তি কোথায়? আজকাল মেয়েরাতো ছেলেদের সমকক্ষ, তারা অনেক দায়িত্বশীল। স্ত্রী বোঝেন স্বামীর আকাংখা কন্যা সন্তানের। তাঁর নিজের মুখটা বিবর্ণ হয়ে যায়। এটা লক্ষ্য করে রঞ্জুবাবু বলেন
------ ছেলে হলেও আমার আপত্তি নেই। আর এটাতো তোমার আমার ইচ্ছের ওপর নির্ভর করে না।
সন্তান প্রসবের মহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত দিনটা পরিষ্কার মনে পড়ে। উনশত্তর সাল বারোই জানুয়ারী। সন্তানের জন্মদিন । আবার একই সঙ্গে তার ও তার সন্তানের জীবনের সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের দিন। স্ত্রীকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। রঞ্জুবাবু হাসপাতালের বারেন্দায় অপেক্ষারত। দুশ্চিন্তাগ্রস্থ থাকায় একের পর এক সিগারেট খেয়ে যান। হঠাত ভেতর থেকে ডাক্তার বেরিয়ে এসে বলেন:
------ একটা সমস্যা হয়েছে। মা-বাচ্চাকে বোধহয় একসঙ্গে বাঁচানো যাবে না। রঞ্জুবাবু ভয়ানক ভয় পেয়ে যান। তার সুপ্ত ভীতিটাই যেন জেগে ওঠে। মুহুর্তের মধ্যে একটা চিন্তা মাথায় খেলে যায়। ভাবেন সন্তানকে এবার হারালেও ভবিষ্যতে পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু স্ত্রীকে হারালে আর ফেরত পাওয়া যাবে না।সন্তানও জন্মলগ্ন থেকে মা-হারা হয়ে যাবে। তিনি বলেন:
------ ডাক্তারবাবু যাই করুন দেখবেন মায়ের যেন জীবনসংকট না হয়। ডাক্তারবাবু ভেতরে যান।
এদিকে রঞ্জুবাবুর স্ত্রী ব্যাপারটা কিভাবে যেন জেনে যান। তিনি আরও জানেন যে যে অস্ত্রপ্রচারটা হতে চলেছে তাতে তাঁর আর ভবিষ্যতে সন্তান ধারণের ক্ষমতা থাকবে না।তিনি ডাক্তারকে বলেন যে যে করে হোক সন্তানকে বাঁচাতে হবে। রঞ্জুবাবুকে ভেতরে ডেকে মায়ের ইচ্ছের কথা জানানো হয়। শত চেষ্টা করেও মাকে নিরস্ত্ করা যায় না। শেষ পর্যন্ত ডাক্তার কিছুটা ঝুঁকি নেন দুজনকেই বাঁচাতে যদিও এতে দুজনেরই প্রাণসংশয় হতে পারে। কিন্তু পুরো সফল হন না। তবে সন্তানকে বাঁচাতে সমর্থ হন। মাকে বাঁচানো যায় না। সন্তান জন্মলগ্নেই মাতৃহারা হয়। রঞ্জুবাবু হারান তাঁর প্রিয়তমা সারাজীবনের সাথীকে। মেয়ের এই জন্ম বৃত্তান্ত মনে পড়লেই রঞ্জুবাবু বিষাদগ্রস্ত হয়ে পরেন। তাঁর আকাংখামতই স্ত্রী তাকে কন্যাসন্তান উপহার দিয়ে গেছেন । কিন্তু একই সঙ্গে তাঁর আকাঙ্খা মেটার আনন্দ হারিয়ে গেছে।
৩
শুভা তৈরী হয়ে রোজের মত স্কুলে রওনা দেয়। স্কুল বেশ দুরে। বাসে করে ঘন্টা খানেক লাগে। যেতে যেতে তার মামার বাড়ির কথা মনে পড়ে। সেখানে দিদা তার বন্ধু, অভিভাবক এবং শিক্ষিকা। অধিকার বোধটা এসেছে দিদার সংস্পর্শে থেকেই। আজ বাবার এই বিরোধিতার মুখে তাকে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এই ব্যাপারে দিদাই তার সবচেয়ে বড় সহযোগী হবেন বলে শুভার বিশ্বাস। মামার বাড়িতে শুভা খুব স্বাচ্ছন্দ বোধ করে। বিশেষ করে দিদিমার সঙ্গে। দিদিমা যেন তার বন্ধু। এছাড়া মামা মামীদের নিয়ে এ বাড়ি ভরাট। দুই মামার দুই ছেলে। একজন শুভার থেকে ছোট আরেকজন বড়। বড়জন চাকুরীর সুবাদে বাইরে বাইরে ঘোরে। ছোটজন স্কুলে পড়ে । শুভা সবসময় তাকে পায়। তার সঙ্গে ভাবও বেশি। তবে তার বেশি সময় কাটে দিদিমার সঙ্গে। সেই অঘটনের পর দিদিমা শুভাকে দিন কতকের জন্য কাছে নিয়ে রাখেন।বোধ হয় বোঝার চেষ্টা করেন ওই ঘটনায় শুভার মনে সেরকম বিপরীত প্রতিক্রিযা হল কিনা। কিন্তু তিনি দেখেন শুভা অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছে। শুভাও জানে যে দিদিমা সংসারে মেয়েরা যে অবহেলিত, নানাভাবে নিপীড়িত তা নিয়ে নানা চিন্তা ভাবনা করেন।
শুভার মনে পরে সে তখন উচ্চমাধ্যমিকে ভালো ফল করে কলেজে ইংরেজি অনার্স নিয়ে ভর্তি হয়। কলেজ বাড়ি থেকে খুব দুরে নয়। বাসে চারপাঁচটা স্টপেজ। বাবা প্রথম প্রথম নিয়ে যেতেন। কলেজে অন্য মেয়েদের একা একা আসতে দেখে কিছুদিন পরেই সে বেঁকে বসে। শুরু হয় বাবার সঙ্গে বিরোধ। সেটাই তার প্রথম যুদ্ধ। সে বাবাকে বলে:
------ এখন থেকে আমি একা একা যাব। সব মেয়েরাইত একা একা যায়। বাবা বলেন
------ সবার সঙ্গে তুলনা করলে চলে না। তোমাকে একা ছাড়ব না। শুভা বাবার কথায় তীব্র আপত্তি করে বলে:
------ এই করে তুমি আমাকে অক্ষম করে রেখেছ। আমি বড় হয়েছি। আমাকে আমার ভাবনা ভাবতে দেও।
কোএডুকেসন কলেজ। রঞ্জুবাবু ভাবেন ছেলেদের পাল্লায় পরে মেয়ে বোধহয় এত উদ্ধত হয়ে উঠেছে। তাছাড়া আগের ঘটনা মনে পরলেই তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন। কিছুটা অধৈর্য হয়ে বলেন:
------ মনে নেই সেই ঘটনা ? সব মেয়ের ক্ষেত্রে কি সেটা ঘটে ? মেয়ে উত্তেজিত হয়ে বলে:
------ সেটার জন্য কি আমি দায়ী ? তোমরাই তার পথ করে দিয়েছ। ভয়ে ভয়ে আমাদের অক্ষম করে তুলেছ। তুমিত সেদিন সঙ্গে ছিলে তাও ওরা সাহস পায় কি করে ? ছেলে দুটো না এলে আমিতো মরতামই তোমাকেও কি করত তা কে জানে। মেয়ের এই স্পর্ধায় রঞ্জুবাবু বিব্রত বোধ করেন। তার ইগোতে লাগে। সে ভাবে তার অক্ষমতার দিকে মেয়ে ইঙ্গিত করছে। শুভা বাবাকে বোঝাবার চেষ্টা করে। কিন্তু বাবা তাকে একা ছাড়তে রাজি হয় না। এই বিরোধের পরিনামে মেয়ে কয়েকদিন কলেজ যাওয়া বন্ধ করে। বেগতিক দেখে শেষ পর্যন্ত বাবা রণে ভঙ্গ দেন।
এরপর থেকে শুভা একা একাই কলেজ যায়। সে ভাবে এটা দরকার ছিল। একটা ভুল চিন্তার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে গেলে অবাধ্য হতে হয়. দিদিমাকে এটা বলায় তিনি খুব কৌতুক বোধ করেন। বলেন:
------ মেয়েদের অধিকার আদায়ে এটাও একটা লড়াই। শুভা এতে যেন খুব আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে। ক্লাসে সে এতদিন ছেলেদের এড়িয়ে চলত। কিন্তু আজকের এই জয়ে তার জড়তা কেটে যায়। আস্তে আস্তে ছেলেদের সান্নিধ্যে সে অনেক সহজ হয়ে ওঠে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বোঝে অনেক ছেলেই মেয়েদের থেকেও ভালো বন্ধু হতে পারে। সে ভাবে এতদিন বাবার তত্ত্বাবধানে সে কুপমন্ডুক হয়ে ছিল। কুপমন্ডুকতা দূর করতে পারলে জীবনটা যে অনেক সহজ সরল হয়ে যায়।
সুমন নির্মল বিমল শুভময় তরুণ সবাই শুভার ভালো বন্ধু। এছাড়াত মেয়েরা আছেই। ক্লাসের কারও সঙ্গেই শুভার সম্পর্ক খারাপ নয়। তাও নির্মলকে যেন একটু আলাদা মনে হয়। দেখতে চোখে পড়ার মত নয়। লম্বায় যতটা ছোঁয়া উচিত ততটা ছুঁতে পারে না। ভিড়ের মধ্যে দিয়ে গলতে অসুবিধা হয়। অবশ্য গায়ের রঙটা ভালই। ফর্সা না হলেও কালো নয়, তামাটে। তার চোখটাই তাকে আকর্ষণ করে। বড় বড় ডেব ডেবে চোখ। চোখে একটা আবেদন আছে। মুখটাও মিষ্টি। দেহের অমিলটাকে যেন পুষিয়ে দেয়। অসুন্দরটাকে সুন্দর করে তোলে। পড়াশুনোয় যে খুব একটা ভালো তা নয়। একটু বান্ডুলে স্বভাবের। যে কোন সমস্যার সন্মুখীন হতে পিছপা নয়। অনেক সময় আগ বাড়িয়ে সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে সমস্যাকে জটিল করে তোলে। কোন ভুল করলে সবার সামনে তা স্বীকার করে নিতে কখনো দ্বিধা করে না। কলেজে ইউনিয়ন গড়তে উৎসাহী। বলে যে একটা আদর্শের ভিত্তিতে সবাইকে জড় হতে হয়, একটা বন্ধনে সবাইকে বাধতে হয়। কলেজের ইউনিয়ন তার একটা প্লাটফর্ম। এই বয়েসে সেটা না করলে মানুষ আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পরে। শুভা ইউনিয়নে জড়িয়ে পড়তে উৎসাহী না হলেও ওর যুক্তিকে অস্বীকার করে না। যেন দিদার কথার প্রতিফলন ঘটে ওর যুক্তিতে। যত দিন যায় তত যেন নির্মলের দিকে আকর্ষণ বাড়ে। সবার আড়ালে সে নির্মলের সঙ্গে একান্তে কথা বলতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। নির্মলেরও তার প্রতি আগ্রহ সে নজর করেছে। তরুণ বন্ধুদের মধ্যে মিচকে। ও ওদের আড়ালে কথা বলার সুযোগ করে দেয়। আবার ওরা একান্তে যখন আলাপে ব্যস্ত থাকে তখন হঠাৎ হাজির হয়ে ওদের `একাকিত্বে` ছেদ ঘটায়। নানারকম চেংরামি শুরু করে। এক এক সময় রাগ হলেও ওর এই সরল ঠাট্টা মজা দুজনেই উপভোগ করে।
কিছুদিনের মধ্যেই ঘনিষ্টতা বাড়লে শুভা নির্মলকে মামার বাড়ি নিয়ে যায়। দিদার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে। দিদারও ছেলেটিকে ভালো লাগে। বিভিন্ন বিষয় আলোচনা করে দিদাও বোঝে যে ওর মধ্যে কেরিয়ার সর্বস্ব মানুষের বাইরে অন্য একটা মানুষ আছে যা আজ বিরল। আর সেটার জন্যই ওর মধ্যে এত ছটপটানি। শুভাও দিদার আয়্নাতেই নির্মলকে দেখতে চায়। দিদার সঙ্গে আলাপ পরিচয় করে নির্মলও বোঝে সে যে ধরনের মানুষকে খুঁজে বেড়ায় দিদা তাদের একজন। মেয়েদের নিয়ে দিদার সংগঠনের কথা জেনে নির্মল তাকে সহযোগিতা করার প্রতিশ্রুতি দেয়। দিদার বয়স হয়েছে। এখন তেমন দৌড় দৌড়ি করতে পারেন না। এরকম একটি ছেলের সাহায্য পেলে তার ভালো হয়। আর অনেকদিন ধরে ভাবছিলেন মেযেদের সুরক্ষার বলয় গড়ে তুলতে ছেলেদেরও দরকার। নির্মলের মত ছেলেদের সাহায্যে সেটা করা সম্ভব বলে দিদা মনে করেন। তবে তিনি ওদের আপাতত পরীক্ষার কথা ভাবতে বলেন। শুভা বোঝে তার নির্মলের সঙ্গে সম্পর্কে দিদা সবুজ সঙ্কেত দিয়েছে।
সেদিন মামাবাড়ি থেকে ফেরার পথে চায়ের দোকানে নির্মলের সঙ্গে কাটানোয় শুভার বাড়ি ফিরতে দেরী হয়। বাড়ি ফিরে সে আনমনে আজকের দিনটার কথা ভাবে। এটা যেন একটা বিশেষ দিন। সে নিরালায় তার ঘরে বসে এটাকে উপভোগ করতে চায়। তাই মিনু ঘরে এসে সে চা খাবে কিনা জিজ্ঞাসা করলে সে না করে দেয়। বিছানায় উপুর হয়ে শুয়ে ভাবতে থাকে। তার ভাবনায় তখন নির্মল। সে ভাবে দুজন দুজনকে পছন্দ করলেও তা যে ভালবাসায় পরিনত হয়েছে তা কেউ প্রকাশ করেনি। এখন আর সেটা লুকোবার নেই। সেটা প্রকাশ করার সময় এসেছে বলে শুভা মনে করে । সে মনের আনন্দলোকে বিচরণ করতে থাকে। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে বাবা রবাহুতের মত এই আনন্দলোকে প্রবেশ করে পরিবেশটা দুষিত করে তোলে। রঞ্জুবাবু মেয়েকে জিজ্ঞাসা করেন:
------ কিরে এত দেরী হল যে ? সুখস্বপ্ন ভাঙ্গার জন্য এমন একটা অপ্রীতিকর প্রশ্ন করায় শুভা রেগে ওঠে। বলে:
------ সবকিছুর কৈফয়েত চাও কেন ? আমার কি নিজের কিছু থাকতে পারে না ?
মেয়ের কথায় রঞ্জুবাবু এখন আর অবাক হন না। বেশ কিছুদিন ধরেই মেয়ের পরিবর্তন তিনি লক্ষ্য করছেন।তিনি কথা না বাড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যান। শুভা নিজের ব্যবহারে নিজের ওপর ক্ষুব্ধ হয়। সে ভাবে বাবা এই প্রশ্নত করতেই পারে। এতে তার এভাবে প্রতিক্রিয়া জানানো ঠিক হয়নি। বাবা নিশ্চয়ই আঘাত পেয়েছেন । তার চিন্তার জগত ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়। মিনুকে ডেকে সে এককাপ চা দিতে বলে। শুভার এই অদ্ভুত ব্যবহারে মিনুও অবাক হয়। সে শুভাকে নম্রভাষী বলেই জানে। তার একি ব্যবহার আজ। একান্ত নিজের সুখচারনায় আঘাত লাগলে যে এটা হয় শুভা সেটা কাকে বোঝাবে ? আর সত্যিইতো তার নিজের লুকোন কথা অন্যে বুঝবে কি করে ?
কিছুদিনের মধ্যেই শুভা আর নির্মল একজন আরেকজনের কাছে নিজেদের তুলে ধরে। সুপ্তপ্রেম যেন জেগে ওঠে । আর এই প্রেম উন্মোচিত হতে আরও নিরালা বেছে নিতে হয়। দুজনেই এখনো কলেজে পড়ুয়া। তাদের ভয় কোন কিছুর বাড়াবাড়িতে পড়াশুনার ক্ষতি না হয়। সুতরাং এখন বেশি নিরালা না খোঁজাই ভালো। দুজনে তাই সিদ্ধান্ত নেয় পড়াশুনার কাজটা ভালোভাবে শেষ করার। আর দিদার আশির্বাদ যেখানে আছে সেখানে এই প্রেম ব্যর্থ হবে না বলে দুজনেরই বিশ্বাস। এখনি এ নিয়ে উচ্ছাসে মাততে দুজনেরই আপত্তি। তবে যতই আপত্তি থাক না কেন দুজনে একান্তে হলে প্রতিশ্রুতির বাধন কিছুটা হলেও আলগা হয় আর আলিঙ্গনের বন্ধন কঠিন হয়। এতসব ভাবতে ভাবতে শুভার গন্তব্যস্থল এসে পড়ে।
৪
আজকের ঘটনার পর শুভা স্কুল থেকে বাড়ি ফেরে না। বাড়ি না ফিরে মামার বাড়ি গেলে সে ফোন করে বাড়িতে জানিয়ে দেয়। সন্ধের পর রাত হয়েছে। রঞ্জুবাবু ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। মিনুকে মামার বাড়িতে খবর নিতে বলেন। কিন্তু জানা যায় সেখানেও যায়নি। তিনি তখন স্কুলের প্রধান শিক্ষিকাকে ফোন করেন। তিনি জানান স্কুলের পর সে রোজের মত বেরিয়ে গেছে। একদিন দুদিন যায় মেয়ে আর ফেরে না। সে স্কুলেও যায় না। রঞ্জুবাবু ধরে নেন যে মেয়ে নির্মলের সঙ্গে চলে গেছে। কয়েকদিন পর নির্মলের বাড়িতে খোঁজ করা হয়। খোঁজ পাওয়া যায় না। বরং সেখান থেকে খবর আসে যে নির্মল বাড়ি ফিরছে না। তিনি একে একে দুই করেন। মেয়ে নির্মলকে বিয়ে করে কোথাও বাসা বেধেছে। তিনি পাগলের মত নির্মলের খোঁজ করতে থাকেন। মেয়ে প্রাপ্তবয়স্ক। বিয়ে করে চলে গেলে আইনও কিছু করতে পারে না। সুতরাং পুলিশে খবর দিয়ে কোন লাভ নেই। নিজেদেরই মুখ পুড়বে । রঞ্জুবাবুর অপেক্ষা করা ছাড়া বিশেষ কিছু করার থাকে না।
বছর খানেক পর। খবর আসে নির্মল বাড়িতেই আছে । কিন্তু মেয়ে কোথায় ? রঞ্জুবাবু কোন একটা রহস্যের গন্ধ পান। ভাবেন মেয়েও বোধহয় নির্মলের আসল পরিচয় পেয়ে গেছে। তাই হয়তো বেরিয়ে আসার চেষ্টা করলে নির্মল তাকে গুম করে বা কিছু। খুন করেও থাকতে পারে। আজকাল এটা অহরহ ঘটছে। তাঁর সন্দেহ হয় নির্মলকে। আর নির্মল যে বদ ছেলে সে খবরতো তিনি আগেই পেয়েছেন। তিনি তাঁর পরিচিত কয়েকজনকে নিয়ে নির্মলের বাড়িতে চড়াও হন। নির্মল তখন অফিস থেকে ফিরেছে। সে রঞ্জুবাবুদের নিয়ে ঘরে বসে। রঞ্জুবাবু নির্মলকে ধমকে বলেন:
-------- শুভা কোথায় ? নির্মলের উত্তর
------- সেটাতো আপনার জানবার কথা।
------- আমি জানলে এখানে আসব কেন ? বলেন রঞ্জুবাবু
------- সেটা আমি জানব কি করে। উত্তর নির্মলের।
------- দেখো হেয়ালি কর না। বিয়ে করব বলে ওকে নিয়ে গেছ।কোথায় গুম করেছ ? এরপর আমি পুলিশে যেতে বাধ্য হব। রঞ্জুবাবু ভয় দেখান।
------- বিয়ে করিনি, তবে হয়তো করব। ওকে গুম করা হয়নি। জানি ও কোথায় আছে।আপনি যদি ওর সঙ্গে দেখা করতে চান তবে আমার সঙ্গে যেতে পারেন।
রঞ্জুবাবু তখন মেয়েকে পাবার জন্য পাগল। পারলে তখনি যান। কিন্তু নির্মল দুদিন পর রবিবার দিন সময় ঠিক করে । রঞ্জুবাবু রাজি হয়ে ফেরেন।
সামনের রবিবার রঞ্জুবাবু নির্মলের সঙ্গে মেয়েকে আনতে যাবেন। কিন্তু তাঁর ভয় নির্মল তার ক্ষতি না করে। সেই ভয়ে তিনি তার এক বন্ধুর পরামর্শে পুলিশে খবর দিয়ে রাখেন। পুলিশ তাদের অনুসরণ করবে বলে ঠিক হয়। রবিবার তারা কথা অনুযায়ী নির্মলের সঙ্গে রওনা দেয়। দক্ষিন চব্বিশ পরগনার ক্যানিং থেকে কিছুটা দুরে একটা গ্রামে তারা যায়। গ্রাম থেকে দূরে একটা চায়ের দোকানে দুজনে এসে বসে। নির্মল চায়ের দোকানের ছেলেটাকে কি বলে যেন পাঠায়। সে কিছুক্ষণ পরে ফিরে এসে জানায় যে আজ দিদির সঙ্গে দেখা হবে না। রঞ্জুবাবুর সন্দেহ হয়।ভাবেন যে নির্মল তাঁকে তাদের ডেরায় কোথাও নিয়ে মারাত্বক কিছু একটা করার জন্য পরিকল্পনা করছে। উনি যে সন্দেহ করেছেন সেটাই ঠিক। শুভাকে গুম করে হত্যা করেছে হয়তো।এখন রঞ্জুবাবু সেটা ধরে ফেলায় রঞ্জুবাবুকেও সরিয়ে দিতে চায়। ইতিমধ্যে পুলিশের লোক কাছে এসে বসে সব দেখেছে। তারও সন্দেহ হয়। রঞ্জুবাবু তাকে উদ্দেশ্য করে বলেন:
-------- দেখলেনতো আমি যে সম্ভবনার কথা আপনাদের বলেছিলাম তাই হল।আগেই থানায় নালিশ করে রাখা হয়। অঞ্চলের থানাকে জানানো ছিল। তাদের ডেকে এনে নির্মলকে গ্রেপ্তার করিয়ে দেওয়া হয়।
দিন কতক পরে নির্মলকে আদালতে তোলা হয়। নির্মলের পক্ষে উকিল দাঁড়ায়। শুভার বাবাও উপস্থিত। নির্মলের পক্ষে উকিল জামিনের আবেদন করেন। জামিনের বিবেচনা করার আগে বিচারক অভিযুক্ত নির্মলকে প্রশ্ন করেন
-------- শুভা কোথায় আপনি কি কিছু জানেন? নির্মল নির্লিপ্ত গলায় বলে:
--------- যেদিন বাড়ি ফেরেনি সেদিন স্কুল ফেরত আমার সঙ্গে দেখা করবার জন্য শুভা আসছিল। আমি ওর জন্য অপেক্ষা করছি। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর ও আসছে না দেখে আমি যে রাস্তা দিয়ে আসার কথা সেই রাস্তা দিয়ে ওর খোঁজে আসি। কিছু দুরে একটা জটলা দেখতে পাই। লোকমুখে জানতে পারি এক মহিলার ওপর কয়েকজন দুর্বৃত্ত বলাত্কার করে। মহিলা ধর্ষিতা হয়েছেন। এগিয়ে গিয়ে দেখি একটি মেয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। তাকে ঘিরে ভিড়। শুভা তাকে আড়াল করে নিয়ে বসে।। মেয়েটি তখন প্রায় বিবস্ত্র। এক মহিলা ওকে কাপড় পড়িয়ে দেয় । শুভা আমাকে দেখে একটা ট্যাক্সি ডাকতে বলে। ট্যাক্সি এলে মেয়েটিকে নিয়ে ও আমার সঙ্গে দিদির বাড়ি যায়। মেয়েটির বাড়িতে খবর দেওয়া হলে বাড়ির লোক এসে তাকে নিয়ে যায়। শুভাও বেরিয়ে যায়। আমরা জানি যে শুভা বাড়ি গেছে। কিন্তু পরে জানতে পারি যে সে বাড়ি ফেরেনি। আমি হয়রান হয়ে ওকে খুঁজে বেড়াই । পরে সে আমায় জানায় সে আর বাড়ি ফিরবে না। বাবার সঙ্গে আমাকে নিয়ে তার মতবিরোধটা সে আমাকে বিস্তারিত বলে । আর এটাও জানায় যে তাঁর এখন অনেক কাজ। এখন বিয়ে করবে না। পরে আমি তার দিদিমার কাছে জানি সে কোথায় আছে। সেখানেই আমি শুভার বাবাকে নিয়ে যাবার চেষ্টা করি। কিন্তু উনি আমায় বিশ্বাস করেন না বরং পুলিশে ধরিয়ে দেন।
বিচারপতি রঞ্জুবাবুরও সাক্ষ্য নেন। অভিযুক্তের উকিলের বলার সুযোগ এলে তিনি বলেন:
------ মাননীয় বিচারপতি এতক্ষণ যা শুনলেন সেটা সাক্ষীর অনুমান মাত্র। নির্মলবাবু সম্পূর্ণ নির্দোষ।উনি যা বললেন সেটাই সত্যি। সেদিনের একটি মেয়েকে ধর্ষণের ঘটনা থানায় রিপোর্ট করা আছে। পরের দিন কাগজেও তা বেরোয়। তবে থানা কোন ব্যবস্থা নেয়নি। রিপোর্টের একটা কপি আমি পেশ করছি। আপনি যদি অনুমতি দেন তবে আমি পরের দিন শ্রীমতি শুভাকেও মহামান্য আদালতে হাজির করাতে পারি। শুভাদেবী মারা যাননি, কেউ তাকে গুম করেনি। তিনি একজন চাকুরিজীবি সাবালিকা। তার বাবা তার ইচ্ছেকে মর্যাদা দিতে ইচ্ছুক নন। তাই তিনি স্বেচ্ছায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। নির্মলবাবু তাঁর কোন ক্ষতি করেননি। শুভাদেবী নির্মল বাবুর বাগদত্তা স্ত্রী। বিচারপতি পরের দিন শুভাদেবীকে আদালতে হাজির করার অনুমতি দেন । সেদিন জামিন হয় না।
রঞ্জুবাবু সব শুনে কিংকর্তব্যবিমুড় হযে পড়েন। বোঝেন তিনি বিপথে চালু হয়েছিলেন। নির্মলের প্রতি চুড়ান্ত অবিচার করেছেন। একই সঙ্গে পরের শুনানির দিন তিনি মেয়েকে পাবেন বলে বুক বাধেন। তার জন্য আদালতে তাঁকে হেনস্থা হতে হলেও আপত্তি নেই।তবে অভিযুক্তের উকিলের সঙ্গে একবার কথা বলে তিনি ব্যাপারটা বুঝে নিতে চান। তিনি উকিলকে অনুসরণ করে তাঁর ঘরে যান। উকিলবাবু তাঁকে সাদরে পাশে বসিয়ে জানতে চান তিনি কেন এসেছেন। রঞ্জুবাবু তাকে বলেন
------- সত্যই কি মেয়ে বেঁচে আছে ? সে কোথায় আছে ?
------ সেখানেত আপনাকে দেখাবার জন্য নির্মল সেদিন নিয়ে গিয়েছিল। আমি নির্মলের বন্ধু, একই সঙ্গে কলেজে পরতাম। শুভাও আমার বন্ধু। যদি আপনি মেয়ের কাছে যেতে চান আপনাকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারি । আপনি নিজেও যেতে পারেন। জায়গাটাতো চেনেন। ওখানে গিয়ে খোঁজ করলেই পাবেন। অথবা মামলাটা তুলে নিন নির্মলকে ছাড়িয়ে আনি, ওই আপনাকে নিয়ে যাবে।আর যার কাছে নির্মল খারাপ ছেলে বলে জেনেছেন সেটাও মিথ্যে। আপনাকে আর শুভাকে যারা আক্রমন করেছিল সেই দলেরই ছেলে সে। তার অন্য ধান্দা ছিল। শুভা সেটাও আপনাকে বলতে চেষ্টা করেছিল। আপনি সেটা শোনেননি। শুভা আমাকে সব বলেছে। রঞ্জুবাবু নিজের ভুল বোঝেন। তখন-ই মামলা তুলে নিতে রাজি হন। উকিলবাবু আবেদন করে বিশেষ দিন ঠিক করেন। মামলা তুলে নেওয়া হয়। নির্মল ছাড়া পায়।
নির্মল রঞ্জুবাবুর অনুরোধে তাঁকে আবার ক্যানিং নিয়ে যায় । সেই চায়ের দোকান ছাড়িয়ে পাঁচ কিলোমিটার দুরে দুজনে একটা গ্রামে ঢোকে। সেখানে রঞ্জুবাবু দেখেন তার মেয়েকে ঘিরে পচিশ ত্রিশজন মহিলা বসে আছেন। নির্মল জানায় শুভা মহিলাদের নিয়ে তাদের ওপর নির্যাতনের বিরুদ্ধে সক্রিয় প্রতিরোধের প্রয়োজন কেন তা বোঝাচ্ছে। এখানে গড়ে তুলেছে নারী নির্যাতন বিরোধী সংগঠন। নির্মল রঞ্জুবাবুকে বলেন:
------- যান যদি পারেন মেয়েকে বুঝিয়ে নিয়ে আসুন।রঞ্জুবাবু বলেন
------- না নির্মল, থাক। ও ওর কাজ করুক। আমি ওকে বাধা দেব না। আমি আশির্বাদ করছি তুমি ওকে বিয়ে করে সুখী হও। নির্মল বলে
------- হ্যা আমি অপেক্ষা করব।