গ্রামের নাম সাহাচক। চতু:সীমা বাসিন্দা দের বড় আনন্দ ঘন। চারদিকে নানা নিধি চাষ ।মাঝখানে মানুষের বাস ।গাছ গাছালি পুকুর ডোবা কাঁচা পাকা রাস্তা, বাড়ি বিভিন্ন পোষ্য নিয়ে বলা যায় মনোরম পরিবেশ। পরস্পরের সাথে সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। শিক্ষা দীক্ষা অর্থ নৈতিক অবস্থা গড়পড়তা, চলে যাওয়ার মতো। গ্রামের বেশির ভাগ ই চাষবাসের সঙ্গে যুক্ত, বাকি শহুরে সপ্তান্তে আসা যাওয়া শ্রমিক, কিছু স্বনিযুক্ত ব্যবসায়ী নজরে এলেও চাকরি জীবির সংখ্যা হাতে গোনা। তরুণ এ গ্রামের ই চল্লিশোর্ধ সাধারণ। পেশায় স্বর্ণ কারের মেশিন রিপেয়ারিং এর কাজ করে।
দুই পুত্র সন্তানের জনক। কন্যা সন্তানের খুব শখ। বড়ই মানবিক। মাঝে মধ্যে ই মন টা আবেশ তাবেশ করে। একটা মেয়ে থাকলে ঘর টা আলো হত । ভাই ফোঁটার দিন ছেলে দুটি বোনের অভাব বোধ করতে থাকে। তরুণের মন হান টান করে। এমতাবস্থায় কোন সূত্রে এক অত্যন্ত গরিব পরিবারে এক কন্যা সন্তান প্রসবের খবরও সে পায় ।আর ধরে কে তরুণ কে । হাসপাতাল থেকে ছুটি পাওয়া র পরই তরুণ ঐ কন্যা সন্তানের বাড়িতে যোগাযোগ করে , কন্যা টি কে নিজে দায়িত্বে মানুষ করার প্রস্তাব নিয়ে তার পিতা মাতার কাছে। ঐ দম্পতি র অর্থ নৈতিক অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে নিজ কন্যা সন্তান কে মানুষ করার কথা ভাববার কোন কারণ অস্ত্র হিসেবে তাদের হাতে ছিল না। অগত্যা নিজ কন্যা কে মানুষ করার দায় দায়িত্ব ভার তরুণের হাতে চির তরে সঁপে দিতে দ্বিধা করলো না। তাই চার দিনের কন্যা সন্তান কে মানুষ করার দায়িত্ব লাভ করে তরুণ সমাজে সাড়া জাগালো এবং খুশি র বন্যায় ভেসে গেল। মনটা আনন্দে নেচে উঠলো। যেন হাতে চাঁদ পেল ।
শুরু হল পরিবারের নতুন সদস্য কে নিয়ে উন্মাদনা। পরিবারের সকলে খুব খুশি। তরুণের পরিবারের আর্থিক অবস্থা আহামরি কিছু নয়। সংসার চলে যায় এই পর্যন্ত। বড় ছেলে মাছের ব্যবসা করে। ছোট ছেলে ইংরেজিতে অনার্স নিয়ে এম্ এ পাশ করে বি এড্ নিয়ে আজ ও চাকরি হীন। তথাপি মনটা বড়ই বড়। কন্যা সন্তান কে মানুষ করার দায়িত্ব লাভ করে ঐ পরিবারের সদস্যদের উচ্ছ্বাসের কোন খামতি নেই। চলতে থাকে মেয়ে কে পিতৃস্নেহে যত্ন সহ মানুষ করার প্রক্রিয়া। মেয়ে সকলের একান্ত প্রিয় হয়ে ওঠে।
গ্রামে মাঝেমধ্যে ই পাড়ায় পাড়ায় হনুমানের আনাগোনার অভাব নেই। গাছ গাছালি বেশি থাকার কারণে বন্য গুলি র দৌরাত্ম নজর কাড়ে। মাঝে মধ্যে ই মানুষ কে অতিষ্ঠ করে তোলে।
একদিন বিকেলে নিজেদের মধ্যে হুড়োহুড়ি, লাফালাফি, মারামারি এ ডাল ও ডাল করতে করতে একটি মধ্য বয়সের হনুমান তেঁতুল গাছের শির ডগা হতে একে বারে মাটির উপর আছড়ে পড়ে। হনুমান টি ভয়ঙ্কর ভাবে জখম হয়। ওঠা ও নড়া চড়া করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। ঘটনা চক্রে তরুণের পাড়াতে ই এই ঘটনা ঘটে। এই খবর পেয়ে তরুণ তৎক্ষণাৎ সেই স্থানে আসে। প্রথমে হনুমান টি এবং তার সতীর্থ রা কাউকে কাছে ঘেঁষতে না দিলেও বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে যে যার আস্তানায় গেড়ে বসে। তখন যন্ত্রনা য় কাতরাতে থাকা বন্য টি কে কয়েক জনের সহযোগিতা য় গ্রামের ই এক কোয়াক ডাক্তারের কাছে তরুণ নিয়ে যায়। ডাক্তার বাবু ভালো করে নিরীক্ষা করে সাধ্য মতো চিকিৎসা পরিষেবা দেন।
তরুণের বাড়িতে চলতে থাকলো মানব এবং দানবের সেবা। দ্রুত চিকিৎসা য় সাড়া দিয়ে হনুমান টি সুস্থ হতে থাকলো এবং পরিবারে র একজন হয়ে উঠলো। বন্যেরা বনে সুন্দর এ কথার যেন পরিমার্জন দেখতে পেলাম তরুণের পরিবারে ।
তরুণ তাকে খাইয়ে দেয় ,স্নান করায় এমনকি রাতে তার পাশে না শুলে তরুণের ঘুম আসে না।তরুণের মেয়ে র সাথে হনুমান টি খেলা করে। সত্বর বাড়ির সকলেই তার আপন জন হয়ে ওঠে। মাঝে মাঝে ই তরুণ বিকালের দিকে বেড়াতে নিয়ে যায় সাথে। প্রতিবেশী দের ও একজন হয়ে উঠলো প্রাণীটি। একদিন তো এক মহা বিপদের হাত থেকে রক্ষাই করে দিল এই পোষ্য টি ।খেলতে খেলতে তরুণের মেয়ে টি এক ছুটে পুকুর পাড়ে চলে এসেছে। আনমনা হয়ে পিছন ফিরে জলে পড়তে যায় যায়। মেয়ে টির উপর শ্যেনদৃষ্টি রেখে কুঁদি খেয়ে ছুটে এসে একলাফে হনুমান টি শিশু টিকে কোলে তুলে নিল। জীবন জীবন এর জন্য এই উদাহরণ অজস্র বার পেয়েছি আমরা। আবারও দেখলাম এক মানব কন্যা কে একটি দানব জীবন রক্ষা করলো।
ইতিহাসে আছে সুখ ক্ষণস্থায়ী। তাই হল এখানে ও ।তরুণের আদরের পোষ মানা জীব টির পুরনো ক্ষত চাগান দিল ।ডাক পড়ল ডাক্তার সাহেব এর । ডাক্তার বাবু কয়েক দিন ধরে সাধ্য মতো চিকিৎসা করলেন । কিছু কাজ হল না। চেষ্টা বৃথা হল । তরুণ হারার ছেলে নয় ।খোঁজ খবর নিয়ে প্রাণী চিকিৎসা লয়ে নিয়ে গেল। সেখানে একটা ছোট অপারেশন করা হল ক্ষত নিরাময়ের জন্য। প্রথমে কিছু দিন সুস্থ হয়ে উঠলে ও আবার হনুমান টি যন্ত্রনা য় কাতরাতে থাকে । এবার তরুণ দৈব চিকিৎসা করতে লাগল। পথ্যে কোন কাজ হল না । না শেষ পর্যন্ত এই পোষ মানা একান্ত কাছের হয়ে ওঠা সদস্য চির তরে সকলকে কাঁদিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিল। তরুণ কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। পরিবার এবং প্রতিবেশী বৃন্দ স্বজন বিয়োগের ব্যথায় মুহ্যমান।
মৃতদেহ কাঁধে করে শ্মশানের পাশে এক খালের ধারে নিয়ে যাওয়া হল। তরুণ কাতর হয়ে চোখের জলে তার কবরে শেষ মাটি নিবেদন করে ফুল মালায় সাজিয়ে দিল ।এক সপ্তাহ কেটে গেল। ভারাক্রান্ত মন নিয়ে রীতিমেনে তরুণ ব্রাম্ভন ভোজন ও সাধ্যমতো প্রতিবেশী এবং মান্য জন দের নিয়ে শেষ কৃত্য অনুষ্ঠানে র ব্যাবস্থা করল , যা সমাজে বিরল । দেখতে দেখতে কয়েক বছর কেটে গেল আজ তরুণের পালিত কন্যা যৌবনে পা রেখেছে। গুরুত্ব সহকারে পড়াশোনা করছে । না জানি তাকে পরের বাড়ি পাঠিয়ে তরুণ কেমন করে দিন পাত করবে ।এ হেন হৃদয় বান ও মানবিক তরুণ কে অন্তরে র ভালো বাসা , শ্রদ্ধা ও প্রণাম জানাই ।
-------------
ছবিঋণ- ইন্টারনেট ।
(সাহাচক , আমতা, হাওড়া)