নতুন কিছু নেই।হওয়ার কথাও নয়।ঘরের নড়বড়ে মূল দরজাটা খুললে আওয়াজটা আর্তনাদের মতন শোনায়।মনে হয় সময়ের।তারাও মুক্ত হতে চায়।বেরোতে চায় এই পরিবার,পিছুটানের জ্যামিতি থেকে।ছোটো ছেলে থেকে বড় পুরুষ সব্বাই ওই নড়বড়ে দরজা খুলে বাইরে নোনা ধরা ইঁটের শিরা-উপশিরায় হিসি করে।এ গলিতে রোদ কম ঢুকতো,এখন একদমই ঢোকে না।আশেপাশে তিন দিকে যা সব বড় বড় ফ্ল্যাট বাড়ি গজিয়েছে… ভাড়াটে থাকতো এক বৃদ্ধ।লকডাউনের আগে সেও যে দেশের বাড়িতে সেই যে গেল আর এল না।তার ভাড়াও বাকি।ব্যাটা বেঁচে আছে কিনা কে জানে।ফোন গেলে ফোন কেটে যায়।ঘরের মালিক সাধন বাবুর আলাদা কিছু খারাপ লাগে না।বেশ তো আছেন।ছেলে সারা জীবন ভ্যারেন্ডা ভেজে এই পঞ্চাশ টপকে গুমটি দেওয়াতে সাধনের কি রাগ।নাতি-নাতনিদের সারাক্ষণ খারাপ খারাপ কথা বলতেই থাকে তাদের বাবার সম্বন্ধে।ছেলে সুনির্মলের বিয়ে দেরিতে।সন্তানও দেরিতে,তাও সেটা স্ত্রীর মৃত্যুর বিনিময়ে।এ হেন রোদ না ঢোকা বাড়িতে সাধনবাবুর নাতি-নাতনি শঙ্খ আর শ্রীময়ীর সাথে এক বর্ষার ঝুপুস অন্ধকার নেমে আসা দুপুরে ঢোকে পিয়ালি। পিয়ালি শঙ্খ এবং শ্রীময়ী দু'জনেরই ভালো বন্ধু হলেও সাধনবাবুর সাথে কথা বলতেই তার বেশি ভালো লাগতো। সুনির্মলকেও রাস্তাঘাটে দোকানে দেখা হলে কাকু কাকু সম্বোধন করতো।সুনির্মল মাঝে মাঝে ভাবতো, কি কথা বলবে পিয়ালির সাথে।কিন্তু, পিয়ালি এই অস্বস্তি বুঝতেই দিতো না।মিশে যেত হেলায় গল্পে, কোন চালটা ভালো,সেই চালে জলে ডোবা মোবাইল রেখে কিভাবে মোবাইলটা শুকোলো ইত্যাদি কথার পিঠে কথা বেড়েই যেত।সাধনবাবুর যে অন্ধকার ঘরে নাতি শঙ্খ আর নাতনি শ্রীময়ীরও দম বন্ধ হয়ে যেত সেই ঘরেই অবলীলাক্রমে ঢুকে পড়তো পিয়ালি।পিয়ালির কথা শুনতো বৃদ্ধ সাধন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে। সুনির্মল বাবার মুখের ওপরে বলতে না পারলেও বাসনা বরাবর ছিল বাড়িটাকে প্রোমোটারকে দেওয়া।কিন্তু ওর ভয় ছিল পিয়ালিকে নিয়ে।পিয়ালি যেভাবে পুরোনো বাড়ি পুরোনো গলি পুরোনো পুরোনো ইত্যাদি নিয়ে মাতামাতি করে তাতে ওর ভয় হয়,পিয়ালি বুড়োর মগজ না ধোলাই করে দেয়।পিয়ালি তো কি একটা কাজে এখানে এসেছিল।এটা তো ওর মেসোর বাড়ি। এখনও কেন যে রয়ে গেছে। সুনির্মল প্রমাদ গুণলো।বুঝি ওর শঙ্কাই সত্যি হতে চলেছে।কেননা ঘরে কিছু অদল বদল ঘটে।মূল দরজাটাকে মেরামত করা হয়।একটা দুটো জানলাকে ভেঙে বাড়ানো হয় যাতে করে বেশি আলো খেলে যেতে পারে। ঘরের প্রতি ভালো লাগাটা এমনকি এ প্রজন্মের শঙ্খ আর শ্রীময়ীর মনেও জেগে ওঠে।বাড়িটার সাথে তাদের কেন যেন মনে হতে থাকে সম্ভাবনার অনষঙ্গকে জুড়ে দিতে।সুনির্মলের মেজাজ বিগড়েছে চূড়ান্তভাবে। সে যখন নিদারুণ আশাহত তখনই দোকানে খবর পায় সাধনের মৃত্যুর খবর। বাবার মৃত্যু বয়সজনিত কারণে হওয়ার মধ্যে কোনো কিছু সুনির্মল অস্বাভাবিক না দেখলেও বাবার হাসিমুখে মৃত্যুটাতে সুনির্মল একটু ভ্রুঁ কুঁচকোয়।বাবার এতটা সুখের মৃত্যু হয় কি করে? সব কিছু প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার পর সুনির্মল আবারো বুক বাঁধে বাড়িটা বেচার।লোকজন ঢোকে বাড়িতে প্রোমোটারদের তরফে।পিয়ালি চলে গেছে তাও মাস তিনেক হল।ফোন করেছিল শঙ্খ, শ্রীময়ীকে সাধনের মৃত্যুর পর।যেতে পারেনি বলে তার আফশোস কিছু কম নয়। পাতকো তলা থেকেই ভাঙাটা শুরু করবে বলে তারা স্থির করে। জিনিসপত্র আনে।কাজ শুরু হয়। সুনির্মলদের থাকার অন্যত্র ব্যবস্থা হলেও শঙ্খ আর শ্রীময়ী প্রথম দিন টা কাজ দেখতে আসে।সঙ্গে আসে সুনির্মলও।দোকানে বসিয়ে এসেছে এক পরিচিতকে।হাতে পয়সা এসেছে যা তাই দিয়ে একটা সহকারী রাখবে বলে ঠিক করেছে।সেই লোকটাই দোকানে।লোকটা বিশ্বাসী। পাতকোর গোল দেওয়াল ভেঙে পচা শুকিয়ে যাওয়া জল সরাতে গেলেই একটা ঘরঘর শব্দ হয়। কান-ফাটা শব্দ শুনে প্রোমোটারদের লোকজন এগিয়ে আসে। পাতকোর ওই পচা শুকনো মুখ থেকে সটান সিলিং ছুঁয়েছে একটা ঝর্ণা। এই ঘরে এই নতুন… এই সব?সাধন কি তাহলে এটাই দেখেছিল?শ্রীময়ী পিয়ালিকে ফোন করে বলার আগেই পিয়ালি বলে দেয় ঝর্ণার কথা।পিয়ালি কি তবে জানতো?
ছবিঋণ- ইন্টারনেট ।
প্রতীক মিত্র
12 A, Supti Mitra Sarani, Konnagar,Hooghly
Pin : 712235
Phn: 8902418417