(ভাস সংস্কৃত নাট্যকার। কালিদাসপূর্ববর্তী। ভবদত্ত নিছক কাল্পনিক চরিত্র। মূল ঐতিহাসিক তথ্য হল ভাসের নাটকগুলি বহুদিন পাওয়া যায়নি। গত বিংশ শতকে দক্ষিণভারত থেকে পাওয়া যায়। আবিষ্কৃত হয়।
নাটকগুলি ভাসের কিনা কোনও প্রত্যক্ষ প্রমাণ না থাকলেও নানা ক্রস রেফারেন্স ও যুক্তির উপর ভিত্তি করে কিছু ইতিবাচক তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত যা সংস্কৃতের ছাত্রছাত্রীমাত্রেই ভাসসমস্যারূপে জানেন। আনুমানিক খ্রিস্টিয় দ্বিতীয় শতকে নাট্যকার ভাসকে প্রতিষ্ঠিত করা যায়, বলা বাহুল্য, এ কোনও সিদ্ধান্ত নয়, বহুবিতর্কিত ও কণ্টকিত যুক্তিজাল। এই ভিত্তিকেই আধার করে আমার এ কাহিনীর বিন্যাস ও বিস্তার। একে ব্যক্তিগত কল্পভাষ্য বলা যেতে পারে।)
আচার্য ভাস নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। তিনি কি ঠিক দেখছেন? গগনস্পর্শী অগ্নিশিখা লেলিহান হয়ে গ্রাস করেছে তাঁর সবকিছু। কার অপরিণামদর্শিতায় এমন হল? আচার্য নিজেকে আর সংযত রাখতে পারলেন না। ছুটে গেলেন, কিন্তু প্রবল ধোঁয়ার তাড়নায় বাধা পেলেন। ভবদত্ত কোথায় গেল? সে কি এখনও ঐ জ্বলন্ত কক্ষে.... হা ঈশ্বর!!
বাইরে কোলাহল শোনা গেল। প্রতিবেশীরা নিজেদের রক্ষা করতেই মৃত্পাত্রে পূর্ণ করে জল ঢালতে লাগল। রাত্রি দুই প্রহরে আগুন আয়ত্তে এল, ভস্মসাত্ হয়েছে কক্ষটি। সৌভাগ্যক্রমে গৃহের অন্যত্র অগ্নি তাঁর করাল গ্রাস বিস্তার করতে পারেননি।
"উপত্বাগ্নে দিবেদিবে দোষাবস্তর্ধিয়া বয়ম্ /নমো ভরন্ত এমসি।" ঋগ্বেদের ঋষি কী পরম শ্রদ্ধায় অন্তর উজাড় করে দিয়েছিলেন! আর অগ্নি আজ কেড়ে নিয়েছেন আচার্যের জীবনাধিক সৃজনগুলিকে। না, সৃজনশক্তি হয়তো হারায়নি। কিন্তু তেরোটি দৃশ্যকাব্য সম্পূর্ণরূপে অগ্নিগ্রস্ত হয়েছে। পুড়ে গেছে বিভিন্ন শাস্ত্রগ্রন্থ, বেদের নানা শাখার নানা দুর্লভ পুথি ও মহর্ষি বাল্মীকির রামায়ণ। অন্তর্ঘাত? হতেও পারে।
ভারতবর্ষে এখন বিদেশীদের পদার্পণ ঘটেছে। তারা দুহাতে বিলিয়ে দিচ্ছে তাদের সাংস্কৃতিক গৌরব। আলেকজান্ডার ফিরে গেছেন কবেই। কিন্তু যবনরা থেকে গেছে আনাচে কানাচে। ভাস পরিচিত হয়েছেন তাদের নাট্যকলার সঙ্গে। বিশেষ করে বিয়োগান্তক দৃশ্যকাব্য তাঁকে মোহিত করেছে। ঠিকই। রসিকজন মাত্রেই বোঝেন করুণরসের চেয়ে শক্তিশালী আর বুঝি কিছু নেই।
ভাস মনস্থির করে নিয়েছিলেন। তাঁর মত বিদগ্ধ ও প্রসিদ্ধ মানুষের এই পদক্ষেপ হয়ত সাহিত্যসমাজ মেনে নেবে না। ভারতীয় ঐতিহ্যের পরিপন্থী কিছু কোন্ দিন সমাজসম্মত হয়েছে? তিনি তো আর সমাজসংস্কার করছেন না। ভারতীয় ধারায় একটি বিয়োগান্তক নাট্যকৃতি সৃজন করবেন। শিল্প তো পরীক্ষানির্ভর। নতুন কিছু যদি ভাল হয় তা আদৃত হবেই, হয়ত সে দিন অনাগত কালগর্ভে এখন।
রামায়ণ-মহাভারতে করুণরসের উপাদান তো ভুরি ভুরি। সেখান থেকেই উপাদান নিয়ে তিনি একের পর এক কালজয়ী সৃষ্টি করেছেন। সে সব বৃথা যাওয়ার নয়। নাট্যকার ভাস যে ব্যতিক্রমী তা সকলেই জানে। প্রতিমা নাটকের অভিনবত্ব তো রসিক সমাজে মুখে মুখে ফেরে। মহাভারতের শোকপর্বের কারুণ্য কি মঞ্চায়িত করা যায়? কিন্তু মৃত্যু পরবর্তী ঘটনাক্রম বড় বেশী সংলাপভিত্তিক হয়ে যাবে না? তার চেয়ে বরং.... চিন্তাস্রোত খেলে যায়। দ্বৈপায়ন হ্রদ। এক মৃত্যুগামী যোদ্ধাকে নিয়মের বাইরে গিয়ে আঘাত করে মেরে ফেলা হচ্ছে। তার শিশুপুত্র ভগ্ন ঊরু আকর্ষণ করে পিতার প্রশস্ত উন্মুক্ত বক্ষদেশে পৌঁছতে চাইছে, পারছে না। ভগ্নঊরু যোদ্ধা নীরবে অশ্রুপাত করছে। পারছে না পুত্রকে শেষবারের মত আঁকড়ে ধরতে.... বড়ই হৃদয়বিদারী ।এই দৃশ্য যদি পরিমিতভাবে শিল্পধর্ম বজায় রেখে মঞ্চে পেশ করা যায় তাহলে ভারতীয় দৃশ্যকাব্য নতুন এক মোড় নেবে। মহাভারত পাবে নতুন মাত্রা। চারণদের মুখে মুখে মহাভারত এখন ভারতব্যাপী বিস্তৃত হয়েছে। এটিই উপযুক্ত সময় তাকে সম্মান প্রদর্শনের।
সেদিনটা আচার্য ভুলবেন কেমন করে? ভাসের নতুন নাট্যকৃতি মঞ্চায়িত হবে, সহৃদয় সামাজিকগণ উৎসাহের সঙ্গে উপস্থিত। মান্য সাহিত্যতাত্ত্বিক পণ্ডিত ও বেত্তা মনীষীরা আপ্যায়িত। একাঙ্ক নাটক। স্বল্প বিস্তারে কোনও কাহিনী নবীন হয়ে উঠবে আবার। যেমন উদয়নকথা ভাসের লেখনীতে নবরূপায়িত হয়েছে। ভাসের সংলাপ ছুরির মত হৃদয়ে বেঁধে। ছবির মত দৃশ্যগুলি দর্শকরা নিবিষ্ট হয়ে দেখতে থাকেন। এরপরেই চারুদত্ত মঞ্চায়িত করার বাসনা আচার্যের। আরেকটি লোককথা জীবন্ত হয়ে উঠবে। একটু বড় হবে রূপকটি। রাত্রি প্রথম প্রহর থেকে আরম্ভ হয়ে তৃতীয় প্রহর পর্যন্ত মঞ্চায়িত হবে। হয়ত ভাসের শ্রেষ্ঠ কীর্তি হয়ে উঠবে চারুদত্ত।
কিন্তু আজ তাল কেটে গেল। প্রবল গোলোযোগে শঙ্কিত হয়ে উঠলেন আচার্য। তাবড় পন্ডিতরা নাটকের শেষদৃশ্যটি সম্পূর্ণ হতেই দিলেন না। একী অনাসৃষ্টি কাণ্ড! এবার না সমাজের উপর দেবতার কোপ নেমে আসে। হা ঈশ্বর! একই করেছেন ভাস! এবার না বাগ্দেবীর অভিসম্পাতে বন্ধ্যা হয়ে পড়ে সমগ্র কাব্যজগত্। মঞ্চে মৃত্যুদৃশ্যের অভিনয় যে শাস্ত্রবিরুদ্ধ ঘোর অনাচার, অমঙ্গলের পদপাত তার ছত্রে ছত্রে। আচার্য ভরত দ্ব্যর্থহীন ভাষায় স্পষ্ট বলে দিয়েছেন, মঞ্চে মৃত্যু, আহার ইত্যাদি প্রদর্শনযোগ্য নয় একেবারেই। এতে নাট্যকলার অধিষ্ঠাত্রী দেবতা কোপাবিষ্ট হবেন ছিঃ ছিঃ, এটি করে ভাসের মত প্রাজ্ঞ মানুষ কোন্ দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চান? নৈরাজ্যের? সমস্ত কলাকুশলী ও নাট্যকারের ঊর্ধ্বতন চতুর্দশ পুরুষকে ভর্তসনা করে, নাট্যকারের মৃত্যুকামনা করতে করতে সকলে প্রস্থান করলেন।
ভবদত্ত। পঁচিশ বছরের তরতাজা নবীন যুবক। অকস্মাৎ কোথা থেকে উদিত হয়ে একেবারে নাড়া বেঁধে বসল। কাব্যকলায় তার বিস্তর আগ্রহ। বিশেষতঃ দৃশ্যকাব্য রচনার শিক্ষণীয় কৃত্কৌশল আয়ত্ত করার জন্য সে বদ্ধপরিকর। ভাস বোঝেন, ভবদত্তের প্রতিভা অলৌকিক নয়। অলৌকিক প্রতিভাসম্পন্ন না হলে এ পথে সিদ্ধি নেই। তবে ছেলেটি বড় ভাল, চালক-চতুর, বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমান। তার অভিনয়প্রতিভা আছে খানিক আর আছে অপূর্বকান্তি হস্তাক্ষর। ভবদত্ত স্বেচ্ছায় ভাসের শ্রেষ্ঠ তেরোটি নাটক সুছাঁদ অক্ষরে নকল করে রাখছে। দ্বাদশটি রূপক লিপিবদ্ধ হয়ে গেছে অল্পদিনেই। এর মধ্যেই একটি পুথি সমাপ্ত। আরেকটি পুথিতে চারুদত্তের অনেকটাই তোলা হয়ে গেছে। চারুদত্ত সমাপ্ত হলে সেটিও অনুকৃত হবে।
ভাসের নাটকগুলির মধ্যে স্বপ্ননাটক প্রসিদ্ধি পেয়েছে। সমালোচকরা ভূয়সী প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছেন তাকে। বাকি গুলি অল্পবিস্তর আক্রান্ত। তবে এবার যা হল তা কল্পনাতীত। রাগে লজ্জ্বায় আর অপমানে ভাসের চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠল। এই বোধহয় বিধিলিপি। ললাটলিখন।
বৈকালিক কিছু কাজকর্ম সেরে সায়াহ্নে গৃহে প্রত্যাবর্তন করে ভাস দেখলেন কী ভয়ানক কাণ্ডটাই না ঘটে গেছে অন্তরালে। পৃথিবীতে মানুষ ই বোধহয় সবথেকে নিকৃষ্টতম জীব। গৃহে প্রাণাধিকপ্রিয় ভবদত্ত পাণ্ডুলিপি অনুকরণের চূড়ান্ত কাজ নিবিষ্টচিত্তে করছিল, ভাস দেখে গেছেন। দিবালোকে কীভাবে ঘটে এই অগ্নিকান্ড। গার্হপত্য অগ্নি গৃহে অন্যত্র প্রজ্জ্বলিত থাকে। সে স্থান তো বিপন্মুক্ত। ভাসের শিরায় - উপশিরায় রক্তপ্রবাহ দ্রুততর হয়। ভবদত্ত কি অগ্নিগ্রস্ত হল? ছেলেটির সঙ্গে প্রবল মায়ার বাঁধনে জড়িয়ে পড়েছেন তিনি। কী অদ্ভুত তত্পরতার সঙ্গে সে অনুকৃতির কাজ সম্পাদন করেছে। সে কি কোনও আভাস পেয়েছিল এই ঘটনার?
অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এল ভবদত্ত। চুপিসাড়ে। গৃহকক্ষে অগ্নির পদসঞ্চার অনুভব করে সে প্রবল শঙ্কিত হয়ে ছুটে গিয়েছিল জলাধারে। গৃহের জলাধার শুষ্ক। দারুণ গ্রীষ্মের দিন। কক্ষে ফিরে এসে ভবদত্ত দেখল দারুণ অগ্নিগ্রাসে সম্পূর্ণ কক্ষ জ্বলছে। সে কিছুক্ষণের জন্য কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিল। পুথি, পুথি কোথায় গেল? সদ্যসমাপ্ত পুথি দুটি হাতে নিয়েই সে ছুটে গিয়েছিল। কোনোমতেই কাছ ছাড়া করেনি। কিন্তু মূল মাতৃকাটি কিঞ্চিত্ বৃহত্, সেটি তো কক্ষেই থেকে গেছে!!
অগ্নি আয়ত্তের বাইরে বুঝতে পেরে, এবং বিপদ্ বুঝে ভবদত্ত সদ্যসমাপ্ত পাণ্ডুলিপি বুকে জড়িয়ে গৃহ থেকে নির্গত হল। আর কিছুই রক্ষা করা যাবে না, কিন্তু এই অমুল্যসম্পদ রক্ষা করতে সে বদ্ধপরিকর। বৃহতের জন্য কখনও কখনও কিছু পরিত্যাগ করতে হয়।
অধোমুখে বসে ছিলেন আচার্য। পশ্চাতে পদশব্দ শুনে সচকিত হয়ে ফিরে তাকালেন। ভবদত্ত!!! নিরুদ্ধ উচ্ছ্বাস প্রবল বেগে বহির্গত হয়ে এল। তাকে উদভ্রান্তের মত আলিঙ্গন করলেন আচার্য। "কোথায় ছিলে তুমি পুত্র?"
হঠাত্ সচকিত হলেন ভাস। "তোমার হাতে ও কি?"
ভবদত্ত ম্লান হেসে বলল "বাঁচাতে পেরেছি এটুকুই। অমূল্য আর অননুকরণীয় যা, তাকেই লিপিতে ধরে রেখেছি।"
ভাস সচকিত হয়ে বললেন - - "পুত্র! সাবধান, একথা যেন প্রচার না হয়। তুমি এই মুহূর্তে এই পুথি নিয়ে এদেশ পরিত্যাগ কর। এ স্থান এর জন্য নিরাপদ নয়। আজই জলপথে কৃষ্ণা নদী অতিক্রম করে দূর দক্ষিণে পলায়ন কর। কিন্তু সাবধান, তোমার কাছে এ অমূল্য সম্পদ আছে কেউ যেন না জানতে পারে। আমি দিব্যচক্ষে দেখতে পাচ্ছি, এই নাট্যকৃতিগুলি ভবিষ্যতের আকর। তোমার হাতেই এখন তাদের রক্ষার ভার। জগত্ জানবে ভাসের সৃষ্টি মুছে গেছে। কিন্তু ভাবীকালের গর্ভে তা সুপ্ত থাকবে। আমার আক্ষেপ, যদি পূর্ব থেকেই আরও কিছু অনুকৃতি করিয়ে রাখা যেত, তাহলে হয়ত এমন দিন দেখতে হত না। আমার মন বলছে, ঐ সামান্য পুথি নয়, এর লক্ষ্য আমি। আমার ললাটে বিধাতা যা লিখেছেন তা-ই হবে। কিন্তু এ পুথি আর এখানে নিরাপদ নয়। তুমি শীঘ্র এ স্থান ত্যাগ কর। কল্যাণমস্তু। "
--" কিন্তু গুরুদেব! চারুদত্ত যে অসমাপ্ত থেকে গেল "...
ভাস দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন---" ভাবী কাল এর মূল্যায়ন ও পুনর্নির্মাণ করবে হয়ত। বিদায়।"
ভবিষ্যতের কোনও কবি বলবেন ভাস" জ্বলনমিত্র"। সমালোচনার আগুনে দগ্ধ হয় তাঁর লোকোত্তর প্রতিভা। এর আড়ালে কী দুর্জ্ঞেয় ব্যঞ্জনা কাজ করে তা কে বলতে পারে। ভাসের নাটকগুলিতে অগ্নিকাণ্ডের উল্লেখ বারবার ফিরে আসে। কী নিষ্ঠুর পরিহাসে তা বাস্তবায়িত হয়, হয়ে উঠতে চায় আস্ত একটা ট্রাজেডি। কিন্তু হয় না, সোনা তো আগুনে পুড়ে পুড়েই নিখাদ হয়। "অগ্নে ভদ্রং করিষ্যসি"। "অগ্নিনা রয়িমশ্নবত্ পোষমেব দিবেদিবে"। আঘাত হয়ে যা আসে, তা-ই আগুন হয়ে দিকবিদিক পরিব্যাপ্ত করে।
নষ্টচন্দ্রের রাতে কৃষ্ণার বুক চিরে একটি ক্ষুদ্র জলযান দিগন্তে হারিয়ে যাচ্ছিল। মিশে যাচ্ছিল ভবিষ্যতের গর্ভে। একটি মানুষ পরম মমতায় জড়িয়ে আছে একটি বস্ত্রাবৃত দ্রব্য। সরস্বতীর নির্মল হাস্যের মত তার মধ্যে দ্যুতি বিকিরণ করছিল কিছু পরম ধন, আগুনের পরশমণির মত। বিধাতাও বুঝি সহাস্যে নিরীক্ষণ করছিলেন সবটাই।
----------------------------------------------
ছবিঋণ- ইন্টারনেট
----------
অভিষেক ঘোষ
সহকারী অধ্যাপক
সংস্কৃত বিভাগ, বাগনান কলেজ
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়
Mob and whatsapp : 9432428359