Click the image to explore all Offers

ছোটগল্প ।। অমানবী ।। শংকর লাল সরকার ।। কথাকাহিনি ২৬, ১লা এপ্রিল ২০২১



 

ঘন্টাখানেক জগিং করবার পর শুভদীপ রাস্তার ধারের একটা বেঞ্চে বসে পড়লমিয়াওএর একমাত্র চার্চের সামনের বাজারে ততক্ষণে দুচারজন লোক আসতে শুরু করেছেকিছুক্ষণের মধ্যেই পুরদস্তুর বাজার বসে যাবেশুভদীপের চোখে পড়ল ওর ঠিক পাশের বেঞ্চে, আকাশী নীল রঙের শাড়ি পরে কমবয়সী একটি মেয়ে বসে আছেশাড়ি পরার ধরণ দেখে বাঙালি বলে মনে হচ্ছে  আগে কোনদিন মেয়েটাকে দেখেনিসুন্দরী মেয়ে দেখলে আলাপ করার ইচ্ছা হওয়াই স্বাভাবিকএমনিতে শুভদীপ খুব ইন্ট্রোভাট টাইপের ছেলেতবু মনে জোর এনেই বলে ফেলল, "আপনি কী বেড়াতে এসেছেন?"

মেয়েটা মুখ ঘুরিয়ে শুভদীপের দিকে তাকালওর  দৃষ্টির গভীরতায় চোখ আটকে গেল শুভদীপের।  "কি হল অমন করে মুখের দিকে তাকিয়ে কী দেখছেন?" মেয়েটা খিল খিল করে হেসে উঠলমানুষের হাসি যে এত মিষ্টি হয় শুভদীপ তা আগে জানত নাসে হাসির শব্দে সমস্ত স্নায়ুতন্ত্রী ঝনঝন করে বেজে উঠেশুভদীপ আড়ষ্ট হয়ে বসে রইলশ্বেত পাথরের ভেনাসের মূর্তি যেন প্রাণ পেয়ে শুভদীপের সামনে বসে রয়েছে। মেয়েটি হাসিমুখে বলল আমি "রূপসি। আপনার নাম?"

"বাঃ খুব সুন্দর নাম আপনার", শুভদীপকে আজ যেন কথায় পেয়েছে।

"আপনি রোজ সকালে এখানে আসেন?"

শুভদীপ বলল, "আপনি বুঝি নতুন সেছেন এখানে?"

"তা এক সপ্তাহ হবে।"

দীর্ঘ চারমাস কলকাতা থেকে চাকুরী সূত্রে বন্ধুস্বজনহীন অরুণাচলপ্রদেশের এই বিজন এলাকায় থাকতে থাকতে কথা না  বলাতেই শুভদীপ অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। মেয়েটার উৎসাহেই কথা গড়িয়ে যেতে থাকে। একসময় রূপসি বলল "আজ এবার উঠতে হবে। কাল আবার আসবেন তো?"

আসবো না বা আসতে পারবো না বললেই হয়তো শুভদীপ বেঁচে যেত কিন্তু তা হল নাশুভদীপ বলল "আসবো।" মেয়েটা ঠোঁট মুটকে গালে টোল ফেলে হেসে উঠল, হাসি থামিয়ে বলল "বাঁচলামএমন জায়গা এসেছি যে একটা লোকের সঙ্গেও দুটো কথা বলা যায় না।"

"এবার উঠি বেশ বেলা হল, অফিস যেতে হবে।" শুভদীপ দাড়িয়ে পড়বার ভঙ্গিতে কথাগুলো বলল

সেদিন রাত্রে উত্তেজনায় শুভদীপের ঘুম হলনাসকালের স্মৃতির মধুর বসাদে তার সমস্ত শরীর আচ্ছন্ন হয়ে আছেপরদিন আবার দেখা হলএকটা সম্মোহন আছে মেয়েটির শরীরেলাণ্যময় কিন্তু পুরুষের শরীরকে কামোদ্দীপ্ত করে তোলেবড়ো বড়ো পটলচেরা চোখ, ধনুকের মতো বাঁকা ভ্রু খাড়া নাক। ঠোঁটদুটো যেন কমলালেবুর কোয়া। রসে টইটম্বুর। সবকিছু ছবির মতো নিখুত। শ্বেত পাথরের মূর্তির মতো অপরূপ ফিগার। খাড়া স্তনদুটো ব্লাউজের বাঁধন ছিড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। ব্লাউজের উপর দিয়ে জেগে থাকা বক্ষবিভাজিকা চোখ ফেরাতে দেয় নাশুভদীপ বলল "আপনি রোজ শাড়ি পরেন! আজকাল শাড়ি পরতে আর কাউকে দেখাই যায় না।"

"আমাকে যা পরায়, যেভাবে সাজায় সে ভাবেই সাজি।" রূপসি গালে টোল ফেলে হাসল। এইভাবে হাসলে ওকে দারুণ সেক্সি লাগে।

শুভদীপ হালকা গলায় বলল "কে আপনাকে সাজায়?"

"কেন! আমার ক্রিয়েটর, আমার স্রষ্টা "

"বাঃ! আপনি তো বেশ সুন্দর কথা বলেন।"   

এরপরে কেটে গেছে প্রায় দুই সপ্তাহপ্রত্যেক দিনের যাওয়াআসা আর মেলামেশায় মেয়েটি হয়ে উঠেছে অন্তরঙ্গতমপরস্পরের সম্ভাষণ আপনি থেকে নেমে গেছে তুমিতেপারস্পরিক গাম্ভির্যর ব্যবধান ভেঙে কথাবার্তা মধ্যে এসেছে চপলতাক্ষণে ক্ষণে রাগ অভিমানঅরুণাচলপ্রদেশের এই স্বজন ন্ধুহীন জায়গায় শুভদীপ ক্রমশ ওকে আঁকড়ে ধরেছেরাতের স্বপ্নে ভাসতে থাকে রূপসির ছোট ছোট কথা আর হাসির টুকরো

মুখের উপরে নেমে আসা কয়েকগোছা চুল যখন মেয়েটা হাত দিয়ে সরায় বড়ো অপরূপ লাগে শুভদীপেরসেদিন তো খুব জ্জায় পড়ে গেলরূপসি আচমকা বলে উঠল "হাঁ করে কেবল আমার মুখের দিকে চেয়ে কী দেখছতুমি কী আমার ভাগ্যগণণা করতে শুরু করলে নাকি।"

শুভদীপ কিছুতেই পারে না রূপসির উচ্ছল ঝর্ণার মত সব কথার জবাব দিতেকেন পারে না?

সেদিন সকালে মায়ের ফোন পেয়ে থেকে শুভদীপের মন বিষন্ন ছিল। বাবার শরীর খারাপ। মা য়েকদিনের ছুটি নিয়ে কলকাতায় যেতে ছে

সকালে দেখা হতেই রূপসি বলল "আজ তোমার মন খারাপ"

"কি করে বুঝলে?"

"আমার সেন্সর গুলি ভীষন শক্তিশালী।"

ওর কথার মাথামুণ্ড কিছু না বুঝতে না পেরে শুভদীপ থতমত খেয়ে চুপ করে রইল"তুমি সবসময় এত হেঁয়ালি করে কথা বল কেন?"

"ও কিছু নয়তো এবার বল তোমার মন খারাপের কারন?"

"বাবার শরীর খারাপ, য়েকদিনের জন্য কলকাতায় যেতে হবে।"

কথাটা শোনা মাত্র রূপসি মুখখানাকে অসম্ভব গম্ভীর করে শুভদীপের পাশে বসে রইলফুঁপানো গলা বলল "তোমাকে ছেড়ে থাকতে আমার খুব খারাপ লাগবে।"

কথাটা শুনে একটা ভালোলাগার থিরথিরে অনুভূতি শুভদীপের মনের ভিতর ঘনিয়ে উঠল। শুভদীপের মনে হল এই সেই মেয়ে যার জন্য সে পঁচিশ বছর অপেক্ষা করে আছেসে প্রেমে পড়ে গেলরূপসি একটু হাসল, চোখমুখের মতো ওর দাঁতের সেটিংও চমৎকার। মুক্তোর মতো যে কেবল ঝকঝকে তাই নয় মনে হয় কেউ যেন মেপে মেপে প্রতিটা দাঁত বসিয়ে দিয়েছে

শুভদীপ সিরিয়াস গলায় বলল "বেশিদিনের জন্য তো যাচ্ছি না।" কথায় কথায় দুজনে বেশ মশগুল হয়ে পড়েছিল আচমকা একটা শোরগোল শুনে চমকে তাকিয়ে শুভদীপ দেখল একটা টাটাসুমো প্রচণ্ড গতিতে রাস্তা দিয়ে ছুটে আসছে। এদিকে মায়ের হাত ছাড়িয়ে একটা বাচ্ছা টলোমলো পায়ে রাস্তার উপরে। কী ঘটতে চলেছে ভেবে আতঙ্কে চিৎকার করে উঠেছিল শুভদীপ। পরমুহুর্তেই অবাক হয়ে দেখল রূপসি প্রচণ্ড ক্ষিপ্রতায় বাচ্ছাটাকে কোলে নিয়ে রাস্তার ওপারে পৌছে গেছে। রূপসির অমানবিক ক্ষিপ্রতা দেখে ভিড় করে থাকা লোকগুলো হতবাক হয়ে গিয়েছিল। ভেবলে যাওয়া শুভদীপের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে রূপসী বলল "আমার হাইড্রলিক সিস্টেম, এয়ার মাসল তোমাদের থেকে অনেক ভালো। নিখুত অ্যাকচুয়েটরের ক্ষিপ্রতা অনেক বেশি।" 

শুভদীপ হালকা হেসে বলল "সবসময় কি যে ঠাট্টা করো বুঝতেই পারি না।"

সকালে বাইক নিয়ে নামদাফার জঙ্গলে ঘুরে আসার প্রস্তাবটা রূপসির। শুভদীপ একটু দোনামনা করছিল। রূপসি ঠোঁট ফুলিয়ে বলল "তোমার যখন যেতে আপত্তি.."

শুভদীপ তাড়াতাড়ি বলল "দেখো আবার রাগ করলে তো। ঠিক আছে বাবা যাব।"   

রূপসি ঠোট মুটকে গালে টোল ফেলে হাসল। শুভদীপ লক্ষ করেছে রূপসি এভাবে  হাসলে ওর শরীরে কেমন একটা শিরশিরানি হয়। ওকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে ইচ্ছা করে।

ভোরবেলাতে বাইক নিয়ে জঙ্গলের ভিতরে প্রবেশ করলবাইকের পিছনে শুভদীপের কোমর জড়িয়ে বসে আছে রূপসিশুভদীপ পিঠের উপরে ওর বুকের নরম স্পর্শ অনুভব করছেঘন জঙ্গল ওদের মধ্যে এক দ্ভত মাদকতা বিস্তার করেছেনামদাফার ট্যুরিস্ট বাংলোর কেয়ারটেকারের জিম্মায় বাইকটা দিয়ে ওরা পায়ে হেটে নদীর ধার বরাবর এগিয়ে জঙ্গলে প্রবেশ করল। এক ঝাঁক ভ্রমরের মতো গুণগুন আওয়াজ তুলে নীল আকাশের বুক চিরে উড়ে যায় একদল ধনেশ পাখি। শুভদীপের দিকে মুখ ফিরিয়ে গালে টোল ফেলে মিষ্টি হেসে রূপসি বলল "বিউটিফুল!"

শুভদীপ নিজেকে সামলাতে পারে না। একহাতে রূপসির কোমর জড়িয়ে ধরে  কাছে টেনে নেয়ঠোঁট নামিয়ে দেয় রূপসির মুখের উপর। রূপসি দুচোখের পাতায় কানের লতিতে শুভদীপের ঠোঁট ছুয়ে যায়। রূপসি ছিটকে সরে যেতে চেষ্ট করে, পারে নাক্রমাগত বাধা দিতে থাকেওর গলা দিয়ে অদ্ভুত আওয়াজ বের হয়। হাত দিয়ে ঠেলে সরিয়ে দিতে চেষ্টা করে শুভদীপের মুখকোনকিছুকে পাত্তা না দিয়ে শুভদীপের একটা হাত রূপসির বুকে নেমে আসেকাম অভিপ্সা পুরুষের শক্তিকে অনেক বাড়িয়ে দেয়রূপসি জোরে মাথা নাড়ায়একসময় ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় শুভদীপকে শুভদীপ বাক হয়ে যায়অস্থির ভাবে রূপসি বলতে থাকে "আমি আর থাকতে পারব না আমি চলে যাব।"

শুভদীপ বাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে "কী হল?"

রূপসি ঘড়ঘড়ে গলায় বলল "কিছু হয়নিআমি চলে যাব"

"সরি! রূপসি" শুভদীপ ওকে শান্ত করার চেষ্টা করে"প্লিজ কাম ডাউন, আমার ভুল হয়েছে।"

রূপসি ফুঁপিয়ে উঠে লে "প্লিজ আমাকে যেতে দাও।" শুভদীপকে অবাক করে দিয়ে দ্রুত হেটে চলে যায়বোকার মতো দাড়িয়ে থাকে শুভদীপ

শুভদীপের রাগ করার অনেক কারন আছে। প্রেমিকাকে একটা চুমু খাবার অধিকারও কি ওর নেইওর বুকে হাত দেওয়াটা না হয় একটু বাড়াবাড়ি হয়েছেসব কি আর হিসাব করে করা যায় নাকি! বাইকে ফেরার সময় পুরো পথটা রূপসি চুপচাপ ছিল, যেন গভীরভাবে কোন কিছু চিন্তা করছে।  

মিয়াও পৌছে নরম ভাবে একটু হাসল রূপসি। সে হাসিতে কোন আনন্দ নেই, বলল "তোমার সরি বলার দরকার নে দোষ আমারই।"

শুভদীপ বলল "রূপসি তুমি কিন্তু বেশি রাগ করছো, এত রাগ করার মতো কোন কিছু কিন্তু ঘটেনি। তোমাকে মোটেই জবরদস্তি করিনি। তোমার ইচ্ছা নেই বুঝতে পেরেই আমি সংযত হয়েছি। আর প্রোসিড করি নি।"

রূপসি মুখ নামিয়ে খানিক অন্যমনস্ক গলায় বলল "প্রোসিড করলে তোমারই সমস্যা হত।"

"রূপসি তুমি তো সেই ঠাকুমা দিদিমার মতো কথা বলছআজকাল এইসব কোন ব্যাপারই নয়।"

রূপসি একটুখানি ম্লান হেসে বলল "তুমি বুঝতে পারছনা, বুঝতে পারবেও না।"

"থাক আমার আর বুঝে কাজ নেই।" অভিমানে শুভদীপের গলার স্বর ভিজে গেল

"আমি তোমাকে ঠকাতে পারব নাগত পনের দিনে আমি তোমার সঙ্গে বড্ড বেশী ইনভলভড হয়ে গেছি এতটা আমার উচিত হয়নি আমি তোমার সঙ্গে ইন্টারঅ্যাকসান করতে পারি কিন্তু শারীরিক সম্পর্কে যেতে পারি নাআমাকে মুখের ভাষা দেওয়া হয়েছে কিন্তু শরীরে ভাষা..। না না তুমি আমাকে ভুলে যাও।"

শুভদীপ প্রায় আর্তনাদ করে উঠল। "সেকি! তুমি এই কথা লছ কেন? তুমি কী পাগল হয়ে গেলেসামান্য একটা ঘটনার জন্য।"

গভীর বিষন্ন গলায় রূপসি বলল "তোমার কাছে সামান্য ঘটনা মনে হলেও আমার কাছে নয়রীরের ভাষা  যে কতটা জরুরী তা আজ বুঝতে পারছিআমি তোমার শরীরের সঙ্গে কমিউনিকেট করতে পারলাম নাপ্রচণ্ড ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও পারলাম না।"

শুভদীপ চেঁচিয়ে উঠল "মানে!"

রূপসি দৌড়ে চলে গেলছুটেও শুভদীপ ওর নাগাল পেল না

তারপর থেকে তিনচারদিন মোবাইল ফোনে কিছুতেই রূপসির সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে নাসেদিন বিকালে একটা অচেনা ফোন নম্বর ভেসে উঠল শুভদীপের মোবাইল স্কৃিণে।  

"আমি ডঃ রুদ্রদেব ভাণ্ডারী বলছি, রূপসির সঙ্গে আপনার আর কোন দিনই দেখা হবেনা।"

"মানে! আপনি কী বলতে চাইছেন?"

"ইহজগতে রূপসির আর কোন অস্তিত্ব নেই" লোকটার গলার স্বরে কেমন যেন বিষন্নতার আভাস।

"হেয়ালি বন্ধ করুন রূপসির কী হয়েছে।" ফোনেতেই চেঁচিয়ে উঠে শুভদীপ।

"আপনি যদি একবার আমার এখানে আসেন তবে সবকিছু পরিস্কার হয়ে যাবে।"

"ঠিকানা বলুন।"

"ঠিকানা ধরে এই পাহাড় জঙ্গলের দেশে আসতে পারবেন নামোবাইলে একটা লিঙ্ক পাঠাচ্ছি সেখানে ক্লিক করুন ম্যাপে রাস্তার হদিস পাবেন।"

মোবাইল ফোনে চোখ রাখে শুভদীপ। প্রচণ্ড উত্তেজনায় সে থরথর করে কাঁপছেগুগল ম্যাপ অনুযায়ী আধঘন্টা পাহাড় জঙ্গল আর নদী পার হয়ে ঘন জঙ্গলের ভিতরে একটা বাড়ির সামনে এসে দাড়ালজঙ্গলের ভিতরে কেমন অদ্ভুত ভাবে লুকানো বাড়িবন্ধ দরজায় স্পর্শ করা মাত্র নিঃশব্দে সেটা একপাশে সরে গেল। ভিতর থেকে গমগমে গলার আওয়াজ ভেসে এল, "ভিতরে এসে সিঁড়ি দিয়ে সোজা নীচে নেমে আসুন।" কয়েকমিনিট পরে শুভদীপ নিজেকে একটা আলোকজ্জ্বল ঘরের ভিতরে আবিস্কার করলসামনেই একটা বিরাট বড়ো টেবিল তার পাশে চেয়ারের উপরে একজন বয়স্ক মানুষ বসে আছেনমুখভর্তি সাদা দাড়িগোঁফের জঙ্গল। মাথায় চকচকে টাক। সাদা ভ্রুর নীচে চোখদুটো আশ্চর্রকমের্  উজ্জ্বল

"বসুন আমি ডঃ রুদ্রদেব।"

"আপনি যার সন্ধানে এসেছেন সেই রূপসি কোন মানবী ননআমার নিজের হাতে তৈরী একটা অত্যাধুনিক রোবটসাইব্রগ বলতে পারেন।"

"সাইব্রগ!"

সাইবারনেটিক্স টেকনোলজির মাধ্যমে কিছু আর্টিফিসিয়াল সাইন্যাপস তৈরী করে ক্ষতিগ্রস্ত হিউম্যান ব্রেন রিপেয়ার করি। তারপর মেকানিকাল বডির সঙ্গে সেটাকে জুড়ে দিয়ে বানিয়েছিলাম রূপসিকে। সুন্দরী মেয়ের রূপ দিয়ে আমি ওকে তৈরী করেছিলামহিউম্যান ব্রেন থাকার জন্য মানুষের মতো উন্নত চিন্তা, সংবেদনশীলতা ও সিদ্ধান্ত নিতে পারত রূপসি। রূপসির কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নির্ধারনের জন্য আমি এই টুরিং পরীক্ষা চালিয়েছি

"টুরিং পরীক্ষা?"

"হ্যা! রোবটের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সক্ষমতা কতটা মানুষের সমতুল্য কোনখানেই বা তা আলাদা তা জানবার জন্য অ্যালান টুরিং প্রায় একশ বছর আগে প্রথম এই পরীক্ষা চালানকৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নির্ধারনের জন্য এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।"

আমাকে আপনি আপনার পরীক্ষায় সামিল করলেন কেন? চিৎকার করে উঠল শুভদীপ। মনে হল সামনে বসে থাকা লোকটাকে খুন করে।

আপনাকে আমি ইচ্ছা করে বেছে নিইনিঘটনাচক্রে আপনি এই টুরিং পরীক্ষায় সামিল হয়ে গিয়েছিলেন "

ডঃ রুদ্রদেবের কথা শুনতে শুনতে শুভদীপের সবকিছু কেমন যেন গুলিয়ে যেতে শুরু করেরূপসি অমানবী! আর্টিফিসিয়ালি ইন্টেলিজেন্ট হিউম্যান রোবট? সাইব্রগ! প্রায় দুই সপ্তাহ একসঙ্গে অতটা সময় কাটাবার পরেও শুভদীপ কিছু বুঝতে পারেনি। বিড়বিড় করে শুভদীপ, রূপসির হেঁয়ালিগুলোর অর্থ এখন বোঝা যাচ্ছে।

"বুঝতে পারছি আপনার মনের অবস্থা। রূপসিকে আমি অবিকল মানুষের মতো করে তৈরী করেছিলাম। ত্বক তৈরী করেছিলাম আমার আবিস্কৃত পলিমার দিয়ে।"

শুনতে শুনতে একটা গভীর বেদনাবোধে শুভদীপের বুকটা হাহাকার করে উঠে। কান্না ভেজা গলায় বিকৃত স্বরে কোনক্রমে বলল, "রূপসি এখন কোথায়?"

"রূপসি আর নেইতিনদিন আগে আপনার সঙ্গে দেখা করে যখন  ফিরে আসে তখন ওর দুচোখে ছিল আমার প্রতি তীব্র ঘৃণাকম্পিউটারে ওর মানসিক অবস্থা বিশ্লেষন করে দেখেছি, ও একটা তীব্র মানসিক দ্বন্দ্বে ভুগছে।  সেন্ট্রাল প্রসেসরের মরালিটি চিপের জন্য মানুষের ক্ষতি করা ওর পক্ষে কখনও সম্ভব ছিলনা। এদিকে ওর আচরণের জন্য আপনার যে প্রচণ্ড মানসিক আঘাত লেগেছে সেটা ওকে অস্থির করে তুলেছিল। যেহেতু আমিই ওর স্রষ্টা তাই সব রাগটাই আমার উপরে পড়েছিল। যদি পুরোপুরি মানুষ হত তবে মানবিক স্বার্থপরতার সাহায্যে নিজেকে সামলাতে পারত। সহজে কোন চরম সিদ্ধান্ত নিত না।"

ভয়ানক কোন কিছু শুনবে সেই আশঙ্কায় অস্থির হয়ে উঠল শুভদীপ। শুকনো জিভটা খরখরে ঠোঁটের উপরে একবার বুলিয়ে নিল। ফুঁপানো গলায় বলল "রূপসি কী.."

বিষন্ন গলায় উনি বললেন, রূপসি হাতুড়ি দিয়ে নিজের মাথায় আঘাত করে মাদার বোর্ড ভেঙে ফেলেছে। কিছুতেই ওকে আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়।

রুদ্রদেব চেয়ার থেকে উঠে পড়েনপাশের একটা দরজা দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করার আগে ইশারায় শুভদীপকে অনুসরণ করতে বললেনবিরাট হলঘরে প্রবেশ করে শুভদীপ বুঝতে পারল সেটা একটা গোপন গবেষণাগার। দেখল কাঁচের শোকেসে একটা নারীর টরসো সাজানো রয়েছেরূপসির নগ্ন দেহের উর্ধাংশটা একটা পোশাকের মতোই হ্যাঙার থেকে ঝুলছেশরীরের নীচ দিয়ে বেরিয়ে আছে কয়েকটা তার কেবল তার, আর নানারকম যন্ত্রপাতির কিছু অংশ। ওর বিষন্ন চোখে চোখ পড়তে শুভদীপের বুকটা বেদনায় মুচড়ে উঠলচিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা হল মানবী রূপসির জন্যফুঁপানির শব্দ শুনে তাকিয়ে দেখল ডঃ রুদ্রদেবের মুখের রেখাগুলো বেদনায় ভেঙেচুরে যাচ্ছে। অনেক কষ্টে কান্না চাপছেন তিনি। শুভদীপ শুনল উনি বিড়বিড় করে বলছেন "মা, তোকে আমি কিছুতেই কাছে রাখতে পারলাম না।" শুভদীপের দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে বললেন "আমার মেয়ে অন্বেষার আত্মা দিয়ে গড়েছিলাম রূপসিকে। বীভৎষ সড়ক দুর্ঘটনায় অন্বেষার মৃত্যু হয়েছিল। ওর ব্রেনের কিছুটা অংশই কেবলমাত্র অক্ষত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। সেটার থেকেই রূপসির নির্মাণ। মেয়ে অন্বেষার মস্তিস্ক ছিল রূপসির শরীরে। দ্বিতীয়বার মেয়ে আমাকে ছেড়ে চলে গেল না ফেরার দেশে।" শুভদীপ ওনার দিকে তাকিয়ে দেখল অসম্ভব কাতর, করুণ মুখ। হতাশা, অসহায়তা, ক্লান্তি সব মিলেমিশে যাওয়া একটা দৃষ্টি। কথা বলতে বলতেই হঠাৎ হুহু করে কেঁদে ফেললেন ডঃ রুদ্রদেব।

শংকর লাল সরকার

8637852643

 

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.