গল্প ।। পাহাড়ী গোলাপ।। কণা পাল ।। কথাকাহিনি ২৬; ১লা এপ্রিল ২০২১;
0
April 01, 2021
ভোর হয়েছে কিন্তু কুয়াশার আস্তরন ভেদ করে সূর্য এখনো উঁকি দিতে পারেনি। মাথায় মাঙ্কি ক্যাপটা আর গায়ে শীতকালীন ধরাচূড়ো এঁটে গলায় মাফলার চড়িয়ে অভ্যেসমত মর্নিং ওয়াকে বেরোলেন অভেন্দ্র, ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন প্রাক্তন সৈনিক। হিমেল হাওয়ার দাপট আর কুয়াশার প্রতিবন্ধকতাকে অগ্রাহ্য করে পথে নামলেন তিনি। বেশী ভিড় তার কোনকালেই পছন্দ নয়। পাহাড়ের বুকে অভিমানিনী হিমেল বাতাসের ক্রন্দনের শব্দস্রোত শুনতে শুনতে এগিয়ে চললেন সংকীর্ণ পথ ধরে। দূরে পাইন বনের কালো অস্পষ্ট অবয়বটা নজরে পড়ছে। পথটা মোড় ঘুরতেই সেই বাঁকে এসে দাঁড়ালেন। মেঘের সাদা সাদা নৌকা এসে নোঙর ফেলেছে পাহাড়ের মাথায়। ঐ যে নিঃসঙ্গ দাঁড়িয়ে রডোডেনড্রন গাছটায় ফুল ফুটেছে অজস্র। কিছু কুঁড়ি এখনো প্রস্ফুটিত হয়নি। 'পাহাড়ের গোলাপ' গ্রীক ভাষায় এমনটাই আখ্যা দেওয়া হয়েছে। এর সাথেই দেখা করতে আসেন তিনি। শীত থেকে মধ্য গ্রীষ্ম পর্যন্ত ফুলগুলো তারুন্যের আগুন ছড়ায় স্থবির পাহাড়ের বুকে পথের ওপর। মৈত্রীর সঙ্গে প্রথম হৃদয় দেওয়া নেওয়ার সাক্ষীও ঐ গাছটা। যুদ্ধক্ষেত্রে অভেন্দ্র চৌধুরী বাহাদুরির পরিচয় দিলেও সেবার কেমন প্রেম নিবেদনের সময় নার্ভাস হয়ে পড়েছিলেন সেকথা মনে পড়তেই জোরে হেসে উঠলেন। নির্জনপ্রকৃতির কোলে তার হাসি প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরতে লাগলো।
সে শব্দ তাকে বাস্তবে ফেরাল। চোখের কোণে কিছু একটা কর কর করে উঠল। কিসের একটা অব্যক্ত যন্ত্রণা বুক ঠেলে বেরিয়ে আসতে চায়। এগিয়ে গিয়ে আলতো করে গাছটার গা স্পর্শ করলেন। অস্ফুটে বললেন, "মৈত্রীর সাথে শেষ বিচ্ছেদের সেই ভোরটারও তুই সাক্ষী। আমার অস্তিত্ব,আমার প্রেম সবকিছুতেই তুই মিশে আছিস"। কারোর একটা ক্ষীণ পদশব্দে সজাগ হয়ে ওঠে তাঁর ইন্দ্রিয়গুলো। কেউ আসার আগেই ফিরে যাবেন তিনি। 'কাল আবার আসব' কথাগুলো অনুচ্চকন্ঠে হাওয়ার সুরে ভাসিয়ে দিয়ে ফিরে চললেন তিনি।কুয়াশার চাদরে ঢাকা পথে তাঁর অপসৃয়মান দেহখানা অস্পষ্ট হয়ে গেল।
সূর্যের প্রথম আলো মেখে রডোড্রেনড্রনের তলায় এসে দাঁড়ালেন এক প্রৌঢ়া। উজ্জ্বল রঙের ফুলগুলো হাওয়ায় মাথা নেড়ে অভিবাদন জানাচ্ছে। এগিয়ে এলেন তিনি। আঁচলের তলা থেকে লুকোনো এক গুচ্ছ সাদা গোলাপ রাখলেন গাছটার পাশের স্মৃতি ফলকের ওপর... হ্যাঁ শহীদ অভেন্দ্র চৌধুরীর স্মৃতি ফলকের ওপর। ভোর রাতে টহল দিয়ে ফেরার পথে পথ দুর্ঘটনার শিকার হয়ে কুড়ি বছর আগে খাদের অতলে তলিয়ে যান মৈত্রী আর তাঁর বিয়ের মাত্র মাস তিনেক আগে। মৈত্রী আজো প্রতীক্ষা করেন তাঁর ফেরার। ঝড় তুষারপাত উপেক্ষা করে রোজ এখানে আসেন এক অবুঝ মনকে প্রবোধ দিতে। পথের বাঁকে একাকীত্বের চাদর জড়িয়ে রডোডেনড্রন গাছটা নীরবে বিরহীর কত গল্প, কত কথা বলে চলে। সে ভাষা বোঝার ক্ষমতা একমাত্র প্রকৃতিরই আছে।
--------------
ছবিঋণ- ইন্টারনেট ।
Kana paul
Baruipur Madarat Badamtala
24pgs south
Tags