এক.
'খাবার টেবিলে আর কতক্ষণ বসে থাকবে তুমি? আমিও তো একটা মানুষ! রক্ত মাংসের শরীর -- নাকি ওই সব্বোনেশে যন্ত্রটার মতো আমিও'...
রাগে দুঃখে ক্লান্তিতে ভেঙে পড়লেন সৌমর মা, চেয়ারটা ঠেলে সরিয়ে দিয়ে উঠে পড়লেন খাবার ছেড়ে। প্রায় ঘন্টা দেড়েক হতে চলল রাতের খাবার নিয়ে বসেছেন দু'জনে। পরিস্থিতি যা -- খাওয়ার ইচ্ছা কারও নেই, তবু গত তিনদিনের অজস্র ঝড়-ঝাপটায় প্রায় উপবিষ্ট দেহ দুটোর প্রয়োজনেই খেতে বসা। বেশি কিছু করেননি স্বাতী, খিচুড়ি আর বেগুনভাজা। খাবারের থালা সামনে বসে আছেন নিশ্চুপ, স্থবিরের মতো। হাত-পা নাড়াতেও ইচ্ছা করছে না আর তাদের।
কোনও মতে দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলেন। বললেন 'বসো-- খাচ্ছি। '
দুই.
'এই রাহুল, ট্রেন ঢুকছে রে, ঘুঘনি ফেল!' তিনজন এক সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল! অনিমেষ, পল্লব আর রনি বইয়ের ভারী ব্যাগটা পিঠে ঠিকঠাক করে ট্রেনে ওঠার জন্য প্রস্তুত হল। রোজকার লড়াই। চারজনই দশমের ছাত্র। নাম করা স্কুলে পড়ে। স্মার্ট, সপ্রতিভ। ওদের ডেলি প্যাসেঞ্জারি গত পাঁচ বছর ধরে চলছে। আরও চলবে, চলতেই থাকবে।
ট্রেনটা ফাঁকা ছিল, চারজনই গেটের কাছে দাঁড়িয়ে গেল। অন্যান্য দিন ছেলেগুলো একটুও চুপচাপ থাকে না; সারাক্ষণ আড্ডা-ইয়ার্কি হুল্লোড় চলে। ট্রেনের ভিতর এই সময়টায় ওদের চাপ থাকে না, কিছুটা নিজস্ব সময়, রোজকার যুদ্ধের মধ্যেও আনন্দের সময়। আজও দাঁড়িয়ে আছে ওরা, তবে অতটা উচ্ছ্বলতা নেই। মিইয়ে যাওয়া মুখ, একটু চিন্তিত ভাব, বিশেষ করে রনিটা যেন হিম হয়ে আছে।
অনিমেষ একটু তরল হবার চেষ্টা করল। বলল, 'রনি-- বেশি ভেবে লাভ নেই, সিমটা অ্যাকচুয়ালি সৌমির নামেই তো ছিল না, ছিল তো ওদের কাজের মাসির নামে, আর তোরটাও তো তোর মামার নামে। '
রনি তেতো গলায় বলল, 'আরে ফোনটা তো ট্র্যাকিং করেছে, নয়তো সৌমকে ধরলো কী করে? এখন ও মালটা যদি আমাকে জড়ায়, তবেই কেলো! আমিও লাট খাবো। ' একটা কাঁচা খিস্তি দিয়ে থামলো রনি।
পল্লব একটা প্রচলিত খিস্তি দিয়ে বলল, ' সৌমটা এত মাথা মোটা না? শালা! চ্যাটিং করছিস কর, ছবিটা হোয়াটসপ করতে গেলি কেন? মালটা না একটু সাইকো আছে। '
অনিমেষ বলল-- ' এর আগেও একবার কেলো পাকিয়েছিল না -- কম্পিউটারে, সেই সেবার প্লেবয় এর ওয়েবসাইট খুলে পানু দেখছিল, আর ওর বাবা এসে পিছনে দাঁড়িয়েছিল। মালটা দেখেই যাচ্ছে দেখেই যাচ্ছে -- হুঁশ নেই। ওর বাবা যখন স্যুইচটা অফ করেছে তখন নাকি ও বুঝতে পেরেছে। আরে আমরাও তো দেখি -- রাতে দেখ, ঘুমোক সবাই তখন চালা, না সাড়ে আটটার সময় বাবু পানু খুলেছেন নেটে! মর এবার! '
রাহুল এতক্ষণে কথা বলল-- ' জানিস, গতকাল আমার কি কেস হয়েছে? দেখছি একা একা। রাত প্রায় এগারোটা, বাবা -মা তো তিনদিন নেই, দিল্লি গেছে, পিসির মেয়ে পম্পিদি রয়েছে, আমি তো আনন্দে আছি, যতক্ষণ ইচ্ছা দেখব। হঠাৎ শালা পম্পিদি ঘরে ঢুকে সটান কম্পিউটারের সামনে, আর তখনই সিস্টেম হ্যাঙ করে গেছে, স্যুইচ টিপেই যাচ্ছি -- অফ হয় না, সাইট চেঞ্জ হয় না। শালা আমার না ঘাম ঝরছে পটা-পট, শেষে কি করলাম বলতো!
মেরেছি ইউপিএসটাতে এক লাথি, তবে বন্ধ হয়েছে। '
হেসে উঠল সবাই তুইও কেস খেয়ে গেলি! পল্লব বলল, 'তুই স্যুইচটা অফ করলি না কেন?' --'আরে তখন আমার মাথা পুরো চিল্ড! কিছু বুঝতে পারছিনা কি করবো ? কী জানি বাবার কাছে রিপোর্টিং হলে কী করব?' অনিমেষ হঠাৎ বলল পম্পিদিকে কিন্তু ঘ্যাম দেখতে, তাই না! কোন কলেজে রে?' রাহুল ঝাঁঝিয়ে বললো --'কেনো ঝাড়ি করবি নাকি রে? নম্বরটা দেব? শালা দিদি দেরো ছাড়বি না?' রনি চেঁচালো-- 'সোনারপুর ঢুকছে, নামবি না?'
তিন
সৌম্যকে ওর বাবা যখন কম্পিউটারটা দেয়, তখন ও ক্লাস এইট। তমোনাশের বন্ধুর ছেলে এক নামজাদা সংস্থায় কম্পিউটার অ্যাপ্লিকেশন নিয়ে পড়াশোনা করছে। তাকেই বলে কয়ে রাজী করিয়েছিল তমোনাশ। একদিন করে আসতো, ভালই শিখছিল ছেলে। তমোনাশ নিজে বি.ই. ইলেক্ট্রাইক্যাল। সরকারি চাকরি, আগে থাকত চম্পাহাটি, এখন সোনারপুরে দু-কাঠা জমি কিনে বাড়ি করেছে। দালাল এড়িয়ে জমি কিনতে গিয়ে ভালোই হ্যাপা পোহাতে হয়েছে। দালালরা ঠিক খবর জোগাড় করে একদিন অফিস যাওয়ার পথে পাকড়াও করেছে। তমোনাশ এমনিতেই ঠান্ডা মাথার লোক হলেও সেদিন বেশ খেপে গিয়েছিল। তমোনাশের চোখা চোখা যুক্তিপূর্ণ কথা তার অফিসে উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে ও বিপাকে ফেলে, কিন্তু দালালদের ভোঁতা অশালীন খিস্তি-খেউড় উথলানো হুমকির সামনে কিছুটা দমে গিয়েছিল সে। কিছু টাকার বিনিময়ে ছাড়া পেলেও তমোনাশ স্থানীয় নেতা গোছের কয়েকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। প্রথমে অনেক ভালো ভালো উপদেশ দিয়ে জনৈক নেতা সবশেষে বললেন, 'জলে বাস করে কুমিরের সঙ্গে লড়াই করতে যাচ্ছেন কেন দাদা? ওরা তো একবারই নেবে। বদলে আপনার মেয়ে বউয়ের খেয়াল রাখবে, যে কোনো প্রয়োজনেই আপনার পাশে থাকবে।' তমোনাশ বুঝেছিল ছিল জলে কুমির তো আছেই, ডাঙাতে বাঘও আছে! আর বাঘে কুমিরে এ বেশ দোস্তি ও আছে। দুইয়ে মিলে শিকার করে, ভাগাভাগি করে খায়।'
তমোনাশের স্ত্রী স্বাতী মিউজিকে স্নাতকোত্তর। বাড়িতে একটা ছোট নাচের স্কুল আছে। সপ্তাহে দু'দিন। সময় কেটে যায়, চর্চাটাও থাকে। স্বাতীর ছাত্রীরা বেশিরভাগই পঞ্চম ও ষষ্ঠ শ্রেণির। জনা তিনেক একাদশ দ্বাদশ এর। ছোট থেকে পেলে ভালো করে তৈরি করা সম্ভব, তাই স্বাতী দশ-এগারো বছরের ছাত্রী বেশি নিয়েছে। যে তিনজন পনেরো পেরিয়েছে, তারা পরিচিতদের অনুরোধ-উপরোধের ফল। এই মেয়েগুলো যেমন বাচালতা করে, তেমনি অতিমাত্রায় আধুনিকা হতে গিয়ে এমন সাজসজ্জা, কথাবার্তা বলে যে স্বাতী নিজেই অস্বস্তি অনুভব করেন। হাতে সর্বক্ষণ মোবাইল সেট, কানে হেডফোন তো লাগানোই থাকে। শরীরের সঙ্গে এঁটে বসা পোশাকে যখন ওরা আসে, স্বাতী নিজেই মনে মনে আশঙ্কিত হন। প্রতিদিন যে সমস্ত ঘটনা ঘটছে তাতে মেয়েরা এখনো পুরুষের দাঁত-নখ এর শিকার, তাছাড়া নিজের ছেলেটাও তো বড় হয়েছে। টিনেজ, ফলে প্রকৃতির নিয়মেই বাঁধন আলগা হচ্ছে। ছেলের ব্যাগের মধ্যে থেকে পেন নিতে গিয়ে স্বাতীএকদিন বেশ কয়েকটা বিদেশী ম্যগাজিন পেয়েছিলেন। অন্তর্বাসহীন প্রায় নগ্ন মেয়েগুলোর ছবির নিচে ছেলের লেখা বিভিন্ন মন্তব্য পড়ে তার সর্বাঙ্গ রিরি করে উঠেছিল। শহরের নামী ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের ছাত্র, কথাবার্তা চালচলন বেশভুষায় সবকিছুতেই চাকচিক্য। মাঝে মাঝে মনে হয় সৌমর সঙ্গে তাদের একটা দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। অনেক ব্যাপারেই সৌম্য বাবা-মায়ের সঙ্গে আলোচনা না করে বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা করতেই বেশি ভালোবাসে। বাড়ি থাকলে সর্বক্ষণ কম্পিউটারের সামনে। আর ওই এক যন্ত্র মানুষের নাওয়া-খাওয়া-ঘুম কেড়ে নিতে পারে! এইসব ব্যাপারে তমোনাশ এর সঙ্গে আলোচনা করতে গেলে শুনতে হয়েছে, 'এখন কালচারটাই এইরকম! ওরা এখনকার ছেলে, আমাদের মত কি আর রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্র পড়বে? ওদের হাতের মুঠোয় এখন পুরো দুনিয়া! বেশি টিকটিক করো না সব সময়।'
চার
খাবার টেবিলে মাথা গুঁজে পড়েছিলেন স্বাতী। কেঁদে কেঁদে চোখমুখ ফোলা। ওদিকে তমোনাশ স্থবিরের মতো সোফাতেই বসে আছেন সমস্ত রাত। কেউ কাউকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টাও করেননি। বহু লড়াইয়ের পর জীবনটাকে দাঁড় করিয়েছেন তমোনাশ। স্বাতীও খুব শান্ত এবং ভদ্র মানুষ। কিন্তু বিগত দুটো দিনে ওদের অর্জিত সমস্ত সম্মান শূন্যে ঠেকেছে। একমাত্র ছেলে সৌম্য যাকে ঘিরে তাদের সমস্ত স্বপ্ন আশা আবর্তিত হয়। প্রতিটি দিন যেখানে শেষ হয় তার ভবিষ্যত পরিকল্পনা দিয়ে, সেই ছেলে এখন তাদের খিদে-ঘুম কেড়ে নিয়েছে।
ঘড়িতে সাড়ে পাঁচটার এলার্ম টা না বাজলে বোধহয় তমোনাশের সম্বিৎ ফিরত না! এলার্মের শব্দে সজাগ হয়ে স্বাতীকে ওভাবে পড়ে থাকতে দেখে ভয় পেয়ে ছুটে এলেন, 'এই স্বাতী, ওঠো ওঠো! কি হলো?' বেশ জোরেই ধাক্কা দিলেন স্বাতীকে।
-- হ্যাঁ, বল!
অনেক কষ্টে মুখটা তুলে স্বাতী তাকালেন তমোনাশ এর দিকে। তমোনাশ এর বুকে যেন প্রাণ ফিরে এলো। কিন্তু স্বাতী চোখের দিকে তাকিয়ে কেঁপে উঠলেন। ফোলা ফোলা, ভিজে চোখ দুটো অসম্ভব রকম লাল হয়েছে। তমোনাশ দ্রুত স্বাতীকে বিছানায় নিয়ে গিয়ে আধশোয়া করে বসিয়ে দিলেন। বেশ জোরে জোরে নিশ্বাস নিচ্ছেন স্বাতী। জোরে তমোনাশ এর একটা হাত চেপে ধরে বললেন 'সৌম্যকে আমার কাছে ফিরিয়ে দাও, তোমার পায়ে পড়ি, আর পারছিনা আমি!' চিবুক বেয়ে জলের ফোঁটা অঝোরে স্বাতীর গলা-বুক ভিজিয়ে দিতে লাগলো। বালিশের উপর মাথাটা কাত করে দিলেন স্বাতী। বড় ক্লান্তি শরীরে। ঘুম যেন ঝাঁপিয়ে পড়ছে তার উপর। কেমন অবশ হয়ে যাচ্ছে হাত-পা, কোথায় যেন হারিয়ে যেতে লাগলেন-- ছোট্ট সৌম এক পা এক পা করে হেঁটে তার কোলে এসে যেন ঝাঁপিয়ে পড়ছে! স্বাতী ছুটছেন টলমল টলমল করে, ছুটন্ত সৌমর পিছন পিছন-- ' সৌম, সোম, ছুটিস না বাবা। '
পাঁচ
পায়ে মশার কামড়ে ঘুম ভেঙে গেল সৌমর। রাগ হয়ে গেল মা'র উপর। মশারি টাঙিয়ে দেয়নি কেন? ঘুমের ঘোরে হাতড়াতে গিয়ে মনে পড়লো -- এটা বাড়ি নয়, হোম। সার বেঁধে চৌকি। একটা চাদর, বালিশ ব্যস! আবার মশারি! কান্না পেল সৌমর। মা'র জন্য, বাবার জন্য। গত পরশু শেষবার দেখেছিল ওদের। মায়ের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারেনি। বাবা বকেনি আর! শুধু বলেছিল, 'যা খেতে দেবে খেয়ে নিও '। ব্রাশ মাজনটা দিয়ে গেছিল। মা কোনও কথা বলেনি। ফুঁপিয়ে কেঁদেছে সারাক্ষণ।
সৌম মনে করার চেষ্টা করে, প্রথম প্রথম যখন সে নেট ঘাঁটে, তখন ম্যাপগুলো দেখত খুব, তাদের বাড়ির লোকেশন খোঁজার চেষ্টা করত সারাক্ষণ। আর খুঁজতো নাসার ছবি। নক্ষত্র, সুপারনোভা, নতুন গ্যালাক্সি, নতুন প্লানেট খুঁজে বেড়াত সারাক্ষণ। তপুদা তাকে অনেক সাইটের অ্যাড্রেস দিত -- কিন্তু সেদিন -- প্রথমবার তপুদা তাকে নিয়ে গেছিল পর্নসাইটে। লজ্জা পেয়েছিল, ভয়ও পেয়েছিল খুব, মা জানতে পারলে! অবশ্য ধীরে ধীরে অভ্যাস হয়ে গেল। এরপর তপুদার কাছ থেকে কতগুলো পর্নোসিডি পেয়েছিল, তপুদা গড়িয়াহাট থেকে কিনে আনত। কবে, কখন যে সে নিজে ওই দুনিয়াটাতে পাকাপাকিভাবে বাস করা শুরু করেছিল, আজ আর তা মনে পড়ে না। বাবার কাছে জেদ করে দামি স্মার্টফোন কিনলো যেদিন, সেদিনই বোধহয় ওর কফিনে শেষ পেরেকটা পোঁতা হল। ক্লাসে বসেই রনি আর পল্লবের কাছ থেকে ফেসবুক আর ট্যুইটার সম্পর্কে যাবতীয় জ্ঞান পেয়ে গিয়েছিল। তপুদা কয়েকটা বিদেশি অ্যাড্রেস দিয়েছিল, যাতে সর্বক্ষণ পর্নো মুভি দেখা যায়। অনিমেষের কাছে এখনও ওর তিনটে মেমরিকার্ড রয়েছে, পর্ন মুভিতে ভরা। কি যে হয়ে গেল সৌমর-- সর্বক্ষণ শুধু এই মাদকাসক্তি, বাড়িতে সব সময় একলা থাকার চেষ্টা করত ও।
তপুদা একটা ওয়েবক্যাম কিনে এনেছিল, চাঁদনি থেকে। বেশি দাম নয়, দেড়শ টাকায়, ছবি আপলোড করে দিত। কিন্তু ওই ছবি আপলোড করার খেলাটা যে অন্য খেলার শুরু ছিল এটা বুঝতে অনেক সময় লেগেছিল সৌমর।
মন্দিরাদি মা'র কাছে নাচ শিখত। সময় পেলে মাঝে মাঝে সৌমর কম্পিউটারে গেমও খেলত। কবে যে তপুদাটা ওকে ফাঁসিয়ে দিল, তা সৌম বুঝতে পারেনি।
প্রতি শনিবার সৌম তপুদার কাছে কম্পিউটার শিখে মিনিট দশেকের মধ্যেই বের হত, অঙ্ক স্যারের কাছে টিউশন নিতে। মাঝে মাঝে, তপুদা শেখানোর পরেই বাড়ি যেত না। নেটে ঢুকে পড়ত। ওই সময় মায়ের নীচের ক্লাস চলত অবশ্য। ক্লাসটাকে ধাপে ধাপে নিতেন স্বাতী। প্রথমে বড়দেরকে মুদ্রা, বিভঙ্গগুলো দেখিয়ে প্রাকটিস করতে বলতেন ছাতে আর নিজে বাচ্চাদের নিয়ে দোতলার বারান্দায় শেখাতেন। সৌমর কম্পিউটার রুমটা নীচে ছিল। ওটা গ্রাউন্ড ফ্লোরে করার জেদটা স্বাতীরই। টেকনিশিয়ানরা বার বার আসা যাওয়ায় বিরক্ত হয়ে এই সিদ্ধান্ত। কিন্তু বিগত একমাস ধরে যে মন্দিরা ছাদে না গিয়ে একটু পরেই কম্পিউটার রুমে চলে যাচ্ছিল, তা পুরোপুরি চোখ এড়িয়ে যায় তার।
সেই শনিবার অঙ্ক স্যার পড়ালেন না, সৌম দ্রুত বাড়ি ফিরে এই অযাচিত সময়টা কাজে লাগাবার মানে কম্পিউটারে বসবার জন্য কম্পিউটার রুমের সামনে এসে দেখল দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। মা তো উপরে নাচের ক্লাসে। ওর কেমন যেন সন্দেহ হল। ওর স্টাডি রুমটা কম্পিউটার রুমের পাশেই এবং স্টাডি রুম থেকে কম্পিউটার রুমে যাওয়ার জন্য একটা দরজা আছে। সেই দরজার ফাঁক দিয়ে সেদিন সৌম চোখ রাখার সঙ্গে সঙ্গেই বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো ধাক্কা খেয়েছিল। এ কি দেখছি? নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না। প্রথমে এক ঝটকায় চোখ বন্ধ করে দূরে সরে এসেছিল। তারপর তপুদা-মন্দিরাদি, জীবন্ত পর্নো মুভি-- সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছিল সৌমর, পুরো সময়টা দরজার ফাঁক দিয়ে চোখ রেখে ঘেমে গেছিল।
ওরা বেরিয়ে যাওয়ার আগে তপুদা কম্পিউটারে পুরো ব্যাপারটা দেখাল মন্দিরাদিকে। মন্দিরাদির প্রচণ্ড আপত্তিতে তপুদা মুছে দিলেও সৌম বুঝেছিল তপুদা ওটা হিডেন ফাইলে রেখে দিল। ঘর থেকে বেরিয়ে ওরা দরজা বাইরে থেকে লক করে দিতেই সৌম ঘরে ঢুকে অনেক চেষ্টা করে, পাসওয়ার্ড মিলিয়ে সদ্য ঘটে যাওয়া ঘটনাটার সমস্তটা দেখেছিল। তখনই একটা দুষ্টবুদ্ধি খেলে গেল ওর মাথায়, পুরো দৃশ্যটা ও ইউটিউবে আপলোড করে দিল। বনি, রাহুল, পল্লব, অনিমেষকেও হোয়াটসপ করে দিল। সব শেষে যেটা করলো, সেটা না করলেই বোধ হয় ভালো হত -- কিছু কিছু অংশ মন্দিরাদিকে হোয়াটসপ করলো।
এতদিন পর্নো মুভি দেখে যে নগ্ন-স্বপ্নের কল্পনা করত, উত্তেজিত কৈশোর শেষ পর্যন্ত আত্মরতিতে স্বপ্নীল-সুখ অনুভব করত। আজ তাই চোখের সামনে দেখে হতবুদ্ধি সৌম উচিত- অনুচিতের বিচার করতেই ভুলে গেল।
কেমন একটা পাপবোধ, তপুর প্রতি একটা হিংসাবোধ তাকে দিয়ে বেশ কিছু প্রতিহিংসামূলক কাজ করিয়ে নিল।
পরদিন সকালে, সৌম তখন স্টাডিরুমে। পড়া আজ আর মাথায় ঢুকছিল না। শুধু গতকাল দেখা ঘটনাটা চোখের সামনে ভাসছিল। কখনও গা ঘিনঘিনে অনুভূতি, কখনও আকস্মিক উত্তেজনায় বিহ্বল হয়ে পড়েছিল। তাই পরিবেশ বিদ্যার চ্যানেল ফাইলটা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছিল। তমোনাশ সেভ হচ্ছিলেন। স্বাতী সদ্য স্নান সেরে রান্নাঘরে। কলিং বেলের শব্দে সৌমই গেটটা খুলে দিয়েছিল।
পুলিশ! তবে ওকে টর্চার করেনি। ভদ্রভাবে সমস্ত ঘটনাটা জানার পর ওর মোবাইল, কম্পিউটার সমস্ত বাজেয়াপ্ত করে যাওয়ার সময় ওর বাবাকে বলেছিল
--- দেখুন, মূল অপরাধটা হয়তো আপনার ছেলে করেনি, তবে এটাকে ছড়িয়ে না দিলে হয়ত মেয়েটা এভাবে গায়ে পেট্রোল ঢেলে পুড়ে মরত না। দেখলাম তো, অবস্থা খুব একটা স্বচ্ছল ছিল না, বাবাটা ট্যাক্সি চালায়। সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হলো, এই পরিস্থিতিতে মেয়েটার মা'রও অ্যাটাক এসেছে। যাকগে, আমরা দেখছি, একে বের করে আনা যায় কিনা, নাবালক তো। তবে ওই তপুটাকে একেবারে যাবজ্জীবন করে দেব। আমরা খোঁজখবর করেছি, ওর বাড়ি থেকে কিছু তথ্য পেয়েছি। মনে হয় ও কোনও গ্যাংয়ের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। কিছু চেনা মুখের হদিশ পেয়েছি ওর মোবাইলের কললিস্ট থেকে, যারা ব্লু-ফিল্ম তৈরি আর সাপ্লাইয়ের কাজ করে।
সৌম পাশ ফিরে শুলো। পুলিশ যখন তাকে গাড়িতে তোলে, বাবা গেটের কাছে, মা বাইরে আসেনি, রাস্তায় লোকারণ্য। কাঁদছিল সৌম। এখনও কান্না হোমের শক্ত বালিশ ভিজিয়ে দিল। ওর মনে পড়ল মাস-খানেক আগে ওর জন্মদিনে মা আদর করে বলেছিলেন -- 'আজ আমরা তোমার জন্মদিন পালন করছি, তুমি এমন হও, যাতে একদিন অন্যরা তোমার জন্মদিন পালন করে।'
আর আজ সে এই জুভেনাইল হোমে। তারই মতো অনেক নাবালক অপরাধীদের সঙ্গে। চেঁচিয়ে কেঁদে উঠতে ইচ্ছা করল সৌমর। নিজের চুল মুঠো মুঠো করে ধরে বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদতে লাগল। কান্নার দমকে ফুলে ফুলে উঠছিল সৌমর শরীর। তার কান্নার শব্দে আশপাশের বেশ কয়েকটা বেডের ছেলেরা উঠে দেখল, তাদের সঙ্গে আসা ছেলেটা কাঁদছে-- ' মা-মাগো একবার তোমার কাছে নিয়ে যাও মা, আর কখখনো করবো না, মা ...।'
তাদের কাছে এ দৃশ্য গা সওয়া, তাই আবার তারা শুয়ে পড়ল।
ছবিঋণ- ইন্টারনেট ।
================================
ঠিকানা*
======
অনিন্দ্য পাল
প্রজত্নে -- বিশ্বনাথ পাল
গ্রাম -- জাফরপুর
পোঃ-- চম্পাহাটিি
পিন - ৭৪৩৩৩০
থানা -- সোনারপুর
জেলা -- দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত
Mob: 9163812351
ধন্যবাদ।