গল্প।। বিষাক্ত দেওয়া-নেওয়া।। সেখ মেহেবুব রহমান ।। কথাকাহিনি ২৬; ১লা এপ্রিল ২০২১;
চলন্ত ট্রেন থেকে হঠাৎ এক অপরিচিত ব্যক্তির ঝাঁপ দিতে যাওয়ার উপক্রম হতেই ট্রেনের মধ্যে হইচই শুরু হয়ে গেল। মানুষটি এতক্ষণ আমার থেকে সামান্য দূরেই বসেছিল। ভাবিনি এমন কিছু করতে পারে। এক মহিলার চিৎকার শুনে ডাইরির পাতা থেকে চোখ তুলতেই দেখি এই কান্ড। মুহূর্তে লেখা থামিয়ে তার দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে হাতটি ধরলাম। আমার সাথে আরও দুজন তাকে টেনে ধরে রইল। মৃত্যুকে কাছ থেকে দেখে সে ভীত না হয়ে বরং আরও হিংস্র রূপ ধারণ করে চিৎকার করতে করতে বাইরের দিকে আরও বেশি ঝুঁকতে থাকল। এক সময় পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছালো আমিও তার সাথে পরে যাওয়ার উপক্রম। প্রচন্ড হাওয়ায় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসতে লাগল। সাথে একের পর এক ইলেকট্রিক খুঁটিগুলি কানের পাশ দিয়ে উড়ন্ত চুলের অগ্রভাগ ছুঁয়ে বেড়িয়ে যেতে রইল। শেষমেশ অন্য যাত্রীদের সহায়তায় মৃত্যুকে একপ্রকার স্পর্শ করে ফিরে এলাম এবং তাকেও বাঁচতে সক্ষম হলাম।
আমি কলকাতা থেকে ফিরছি। চাকরির ইন্টারভিউ দিতে গ্রাম ছাড়িয়ে শহরে এসেছি। এই শহরতলির সাথে আমার সেরকম সখ্যতা নেই। থাকবেই কেন, মাত্র কয়েকবার কিছু পরীক্ষা দেওয়ার জন্যই তো আসা। প্রয়োজনের জিনিস তো সেই বর্ধমানেই পেয়ে যায়। তাই এমুখো হয়নি খুব বেশি। তাছাড়া মানুষ তাকেই মনে রাখে যার থেকে সে কিছু পায়, সবই তো দেয়ানেয়া। এই শহর আমায় বিশেষ কিছুই দিতে পারেনি। আমিও যে সব সময় নিজেকে নিবেদিত করেছি তাও বলা চলে না। আমাদের সম্পর্কটা এখন মুখ চেনা মানুষগুলোর মতন, মুখটা পরিচিত কিন্তু অন্তরটা নয়।
আজকের ইন্টারভিউটা দেওয়ার উ্দেশ্যে বিশেষ ইচ্ছা ছিল না। এমনিতেই কম সিট তারপর আজকাল যেভাবে চাকরির ক্ষেত্রে গোপন দেয়ানেয়া চলছে, ভালো কিছু করেও কোনো আশা না রাখায় ভালো। এসব ঘটনা এখন কবিতার উলঙ্গ রাজার মতন, নগ্ন এই নিয়োগ ব্যবস্থা সবাই দেখেও যেন দেখতে পাই না কিছুই। আমি মধ্যবৃত্ত বাড়ির ছেলে, দেয়ার সামর্থ্য সেরকম নেই, বাধ্য হয়ে পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছি। মুখ চেনা এই ব্যস্ত নগরীকে শুধু নিজের অস্তিত্বর জানান দিয়েই ফিরে যাচ্ছি।
আমার মন খারাপ, কারণটা এই অর্থহীন পরীক্ষার ফল। মাকে মিথ্যা বলেছি। একটু আগেই ফোন করেছিল, কেমন হল জানতে চাইল। ভালো হয়েছে বললাম। সত্যিই ভালো হয়েছে, কিন্তু কি অদ্ভূত ব্যাপার সত্যি হয়েও এটা মিথ্যা! তবে এবারে আমি একা নয়, আমার সাথে এই মহানগরীর মনও বড্ড খারাপ। চারিদিকে রাজনৈতিক উত্তাপ, দলবদলের হাওয়া, অর্থবলে বাহুবলী মানুষের দাপাদাপি, কর্মহীন বেকার মানুষের ফ্যালফ্যালে চাউনি আর শিক্ষিত বেকারের রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে চাকরির দাবিতে সম্মিলিত প্রতিবাদ। কলকাতা এসবের সাথে হয়তো কোনো এক সময় পরিচিত ছিল, কিংবা কখনো হয়নি। যন্ত্রণা বুকে নিয়ে আমারই এগিয়ে যেতে হোঁচট খায়, সেখানে আমাদের গর্বের শহর কলকাতা কিভাবে এগিয়ে চলবে।
ট্রেনে উঠে দেখি ভিড়ে ভর্তি, এখানেও সিট নেই। বাধ্য হয়ে দরজার সামনে গিয়ে পেপার বিছিয়ে বসলাম। হাওড়া থেকে বর্ধমান কর্ডে দুই ঘণ্টার আশেপাশে কিছু সময় লাগে। গরমের দিনে এই ঘণ্টা দুই ঠাণ্ডা হাওয়া গায়ে মেখে দিনের ব্যর্থ কাহিনীগুলো ডাইরির পাতায় স্থান দেব ভাবলাম। পরিকল্পনা মত ডাইরি, পেন বের করে লিখতে শুরু করলাম। কিন্তু তখনও যে অনেক কিছুই প্রত্যক্ষ করা বাকি ছিল, এক ফোঁটাও আন্দাজ করতে পারিনি।
আমি ট্রেনে ওঠার কিছু পরেই বছর ত্রিশের এক যুবক সাথে দুজন ষাটোর্ধ্ব দম্পতি আমার অদূরে এসে বসে। লেখা তখনও শুরু করিনি, সহজেই আমার চোখ ওনাদের ওপর গিয়ে পড়ল। পোশাক পরিচ্ছদে নিম্ন মধ্যবৃত্তের ছাপ স্পষ্ট। যুবকটি নির্বাক হয়ে বসে আছে। কিন্তু বয়স্ক মানুষ দুজন নিজদের মধ্যে অবিরাম কথা বলে চলেছে। তাদের চোখেমুখে এক অজানা উদ্বেগ দেখতে পেলাম। হঠাৎ আবির্ভূত হওয়া এই ত্রয়ীকে কেন্দ্র করে আমার মনে একরাশ প্রশ্ন এমনই ভেসে এল। কিন্তু কেন? উত্তর ছিল না আমার কাছে। বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে শুধু তাদেরই দেখতে রইলাম। ট্রেনের প্রচন্ড আওয়াজেও বিচ্ছিন্নভাবে তাদের কথা আমার কানে আসছিল। কিন্তু সেগুলো একত্রিত করে বিশেষ কোনো অর্থ বের করতে না পেরে আমি লেখায় মন দিলাম।
ট্রেনের গতির সাথে আমার কলমও বেশ দ্রুত ডাইরির পাতায় মনের ভাব লিখতে রইল। ঠাণ্ডা হাওয়ায় মনোযোগী লেখায় আত্মনিবেশ করতেই এই আকস্মিক ঘটনা। লেখায় মগ্ন থাকায় ঘটনার সূত্রপাত সমন্ধে অবহিত হতে পারিনি। তবে পরে অন্য যাত্রীদের মুখে বিস্তারিত বিবরণ শুনেছি। ডানকুনি ঢোকার আগেই সেই ব্যক্তি অদ্ভূত আচরণ করতে শুরু করে। পাশের যাত্রীদের সাথে দুর্ব্যবহার, মুখে অভ্যব কথা বলতে দেখে অনেকেই অবাক হয়ে পরে। হঠাৎ এইরূপ ব্যাবহারের কারণ! কেউই কিছুই বুঝতে পারেনি।
কিছুপরেই সটান ট্রেনের উন্মুক্ত দরজার সামনে গিয়ে বাইরে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে পাগলের মত চিৎকার করতে শুরু করে। তার এইরূপ আচরণে ষাটোর্ধ বৃদ্ধা জোরপূর্বক টেনে ধরে রাখার চেষ্টা করলেও, পারেননি। সত্যিই অবাক হয় এতো কিছু চলছে কিন্তু সামান্য টের করতে পারলাম না! হয়তো এমনটাই অদৃশ্যের লেখন।
এই ব্যাস্ত জীবনে কে কার খেয়াল রাখে। তার আচরণে বিরক্ত হলেও সাবধান হওয়ার কথা কেউ বলেনি। এমনকি ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধা থামাতে উদ্যত হলেও এগিয়ে আসেনি কেউই। আজকাল মানুষের কাছে এইরূপ ঘটনা বিনোদনের থেকে কম কি! তারা শুধু উপভোগ করতে জানে।
যাই হোক রুদ্ধশ্বাস মিনিট তিনের লড়াইয়ের পর ট্রেনের ভিতরে নিয়ে আসা গেল। আমার হাতেও কিছুটা আঘাত লেগেছিল, কিন্তু সেসব তোয়াক্কা না করে ব্যাগ থেকে জলের বোতল বেড় করে তার দিকেই বাড়িয়ে দিলাম। বৃদ্ধা তাকে আঁকড়ে ধরে রইলেন বেশ কিছুক্ষণ। ধীরে ধীরে সেও শান্ত হল। আমি জলের বোতল বয়স্কার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, "একটু জল দিয়ে চোখ মুখ ধুয়ে দিন। ওর হাতেও লেগেছে। ওখানেও একটু জল দিন। নাহলে ব্যাথা বাড়বে"।
উনি আমার হাত থেকে জলের বোতল নিয়ে নিজের আঁচল জলে ভিজিয়ে আসতে আসতে তার মুখ মুছিয়ে দিলেন। হাতের ব্যথা লাগা স্থানেও জল দিলেন। এইরূপ স্নেহে যে মা ছাড়া কেউই যত্ন নিতে পারেনা, সেটুকু বোঝার ক্ষমতা আমার হয়েছে। যুবার মুখ থেকে বেশ কয়েকবার ' মা' আওয়াজ আমার ভাবনায় সিলমোহর দিল। লক্ষ্য করলাম মায়ের স্নেহে কিভাবে সে শান্ত হয়ে উঠল। মিনিট পনেরো আগে এই মানুষই নিজের অভব্য আচরণে সকলকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছিল। মুহুর্তের এই পরিবর্তন আকস্মিক লাগল। কিছু বলতে যাব দেখি, সাথে থাকা বৃদ্ধ মানুষটি একরাশ হতাশা নিয়ে বললেন, " বাবা মাকে কষ্ট দিয়ে কি পাচ্ছিস তুই! না নিজে ভালো আছিস, না আমদের থাকতে দিচ্ছিস। মায়ের কষ্ট কি কিছুই বুঝতে পারিস না?"
আমি পাশে দাড়িয়ে থেকে শুনতে রইলাম। এটুকু বুঝতে অসুবিধা হল না, যুবককে সঙ্গে নিয়ে ওর বাবা মা কলকাতা থেকে ফিরছে। কিন্তু এখানে এসেছিল কেন? ওর কি শারীরিক কিছু সমস্যা আছে? যেভাবে ক্ষিপ্র হয়ে উঠেছিল, মানসিক প্রবলেম এর সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কিন্তু একজন বছর ত্রিশের যুবকের মানসিক সমস্যা! অবাক লাগে, যদিও সমস্যাটা বংশানুক্রমিক হতে পারে। ওর বাবাকে দেখে সেরকম মনে হয় না যদিও। মনের মধ্যে হাজারও প্রশ্ন নিয়ে আমি তাদের দিকেই চেয়ে রইলাম।
ছেলের উদ্দেশ্যে বাবার হতাশার বিচ্ছুরণ হতে শুরু করলে এক বছর পঁচিশের মহিলা এসে ধমক দিয়ে বললেন, "দাদাকে এসব বলে কিছু হবে বাবা? ওকে নিয়ে এইভাবেই বাঁচতে হবে। ডাক্তার কি বলল ভুলে গেলে? বেশি কিছু বললে ওর পাগলামি কিন্তু আর হাতের নাগালে থাকবে না। প্লিজ কিছু বলো না"।
'পাগলামি' শব্দটি কানে এল। আমার অনুমান সত্যি হওয়াতে আশঙ্কিত হলাম। সব কিছু জানতে মন আরও ব্যাকুল হয়ে উঠল। কিন্তু কাকে জিঞ্জাসা করি। সকলেই চিন্তিত, মানসিকভাবে ভারাক্রান্ত। প্রশ্ন করে যুবকের বাবা মাকে আর ব্যথিত করতে চাইলাম না। মহিলার থেকেই জানা শ্রেয় মনে হল। কথা শুনে ও যে যুবকের বোন সহজেই অনুমান করেছিলাম। কিন্তু এতক্ষণ ও কোথায় ছিল। যদিও সেকথা জানার ইচ্ছা আমার ছিল না। আমার যন্ত্রণা কাতুর হাতটি সংকোচন প্রসারণ করতে করতে মহিলাকে নম্র ভাবে জিঞ্জাসা করলাম, " কিছু মনে করবেন না, বলছি আপনার দাদা কি মানসিকভাবে অসুস্থ? আসলে ওকে প্রথম দেখায় সেরকম কিছু মনে হয় নি। কিন্তু তারপর যা করল..."
কথা শেষ করতে না দিয়ে শঙ্কিত গলায় তিনি বললেন, "ওর মাথার ঠিক নেই। কন্ডিশন খুবই ক্রিটিক্যাল। হতাশা আর মদের নেশা ওকে শেষ করে দিয়েছে। জানিনা এইভাবে আর কতদিন বাঁচবে। ওর জন্য আপনদের অনেক প্রবলেম হল। আমি ওর হয়ে সরি চাইছি"।
আমি মাথা নেড়ে বললাম, "আরে না না। সরি কেন বলছেন। আপনাদের অসহায়তায় পাশে থাকতে পেরে কৃতঞ্জ । ওকে নিয়ে আপনাদের দুশ্চিন্তা বুঝতে পারছি"।
"অশেষ ধন্যবাদ। আজ আপনারা না থাকলে, হয়তো দাদাই থাকতো না"
"ধন্যবাদ এর প্রয়োজন নেই"
"কিন্তু"
আমি তাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বললাম, "আপনার দাদা কি প্রথম থেকেই মানসিক সমস্যায় ভুগছেন?"
তিনি বললেন, "না না, দাদা এমনিতে ভালো মানুষ। লাস্ট দেড় বছরে ও কেমন যেন হয়ে গেল। আমাদের বাড়িতে কারও মানসিক সমস্যা নেই"।
আমি বললাম, "কিন্তু হঠাৎ করে! ওর সাথে কিছু ঘটেছিল?"
কথা শুনে এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, "হয়েছে তো অনেক কিছুই। ও বলেই হয়তো এখনও বেঁচে আছে। আমি থাকলে অনেক আগেই সুসাইড করে নিতাম"।
চমকে গিয়ে বললাম, "বলছেন কি আপনি! ওকে দেখে তো ভালোমানুষ মনে হচ্ছে। এরকম একজন মানুষের সাথে এত কি খারাপ হল?"
"ঠিকই বলেছেন দাদা খুবই নিরীহ স্বভাবের। তাই ওর সাথেই"
"কাইন্ডলি বলবেন, মানে এরকম কেন হল ওর সাথে"
"কীভাবে বলি বলুন তো। তাছাড়া এসব কথা এত মানুষের সামনে"
আমি ওনার অসহায়তা বুঝতে পারলাম। মনে হল আর কিছু না বলাই ভালো। নিশ্চুপ থেকে সেই যুবার দিকে তাকিয়ে রইলাম। শান্ত হয়ে শুয়ে আছে। ওর মা মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। বাবা পাশে বসে ট্রেনের বাইরের অন্ধকারের দিকে একমনে তাকিয়ে রয়েছে। আশে পাশের যাত্রীদের মধ্যেও এই পরিবার কেন্দ্রিক ব্যস্ততা বা বিরক্তি নেই। যে যার নিজের মত করে যাত্রা অনুভব করছে। আমি স্থির করলাম ডাইরি লেখাটা কমপ্লিট করে নিই। সেইমত প্রস্তুতি নিচ্ছি দেখি, মহিলা আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন। আমি প্রথমে খেয়াল করিনি। আসলে উনি না বলার পর আমার ওনাকে আর বিরক্ত করতে ইচ্ছা হয়নি। কিন্তু তারপরেও এইভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে একটু অবাক লাগল। মনে হল কিছু বলতে চায়। বললাম, "কিছু বলবেন?"
আমার থেকে এই প্রশ্নের প্রত্যাশা করেননি, অপ্রস্তুত ছিলেন। নিজেকে সামলে বললেন, "না মানে, আসলে আপনি দাদার জন্য যা করলেন তারপরেও সরাসরি না বলে দিলাম। খারাপ লাগছে"।
আমি মুখে কিঞ্চিৎ হাসি নিয়ে বললাম, "আরে আপনি এসব কি বলছেন। আমি আপনাদের পরিস্থিতি বুঝতে পারছি। আপনি অস্থির হবেন না"।
দেখলাম কথা শুনে একটু স্বস্তি পেলেন। ট্রেনের আওয়াজে আমাদের একটু জোরেই কথা বলতে হচ্ছিল। আমি মহিলার কথা শুনতে পাচ্ছিলাম, তবে নিতান্তই ধীরে। হয়তো এটাই ওনার স্বাভাবিক আওয়াজ। নিজেও সেকথা বোঝেন। তাই হয়তো এবার একটু কাছে এলেন। মনে হল এমন কিছু বলতে চলেছে যেকথা অন্য কেউ শুনলে অসুবিধা হতে পারে। উনি আতঙ্কিত ছিলেন, হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু পাশে আসার পর ওনার মনের মধ্যে এক অজানা ভয় অনুভব করলাম। আমি কৌতূহলী মনে কিছু বলার আগেই বললেন, "এত মানুষের ভিড়ে সব কথা বলতে ভয় হয়। কার মনে কি আছে, কি করে বুঝি বলুন। আপনাকে বিশ্বস্ত মনে হচ্ছে। তাই বলতে ভীত হচ্ছি না"।
আমার অনুমান ভুল ছিল না। আশ্বাস দিয়ে বললাম, "নির্দ্বিধায় বলুন। আমায় বিশ্বাস করতে পারেন"।
উনি বললেন, "ধন্যবাদ। কিন্তু কীভাবে বলি বলুন তো। আসলে দাদা এখনকার জঘন্য রাজনীতির শিকার জানেন"।
সত্যি বলতে, এরকম কোনো কথা প্রত্যাশা করিনি, চমকে উঠে বললাম, "বলছেন কি! ও কি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত? পার্টি পলিটিক্স করে?"
মাথা নেড়ে বললেন, "না না, দাদার পক্ষে নোংরা রাজনীতি করা সম্ভব নয়"।
"তাহলে?"
"ওকে ব্যবহার করা হয়েছে, ওর মেধাকে কাজে লাগানো হয়েছে"
কথা শুনে আতঙ্কিত হয়ে গেলাম। রাজনৈতিক দল গুলির এই অধঃপতন ভাষায় কি ব্যক্ত করা যায়। কিন্তু কীভাবে ওর প্রতি অবিচার করা হয়েছে, সেকথা জানতে চেয়ে বললাম, "একটু যদি পরিষ্কার করে বলেন"।
যথা সম্ভব গলার স্বর নামিয়ে এক নিশ্বাসে বলে চললেন, "হুমম। আসলে আমাদের পারিবারিক অবস্থা ভালো নয়। বাবা এক রাইস মিলে কাজ করত। বেশ কয়েকবছর ওটা বন্ধ হয়ে গেছে। অভাবের সংসারে দাদা নিজে পড়েছে, টিউশন পড়িয়েছে, সংসার টেনেছে। এইভাবেই আমাদের চলে যাচ্ছিল। তারপর ইউনিভার্সিটির পড়া শেষে কিছু একটা চাকরির খোঁজ করতে থাকে দাদা। ও মেধাবী ছিল। খুব দ্রুত বেশ কয়েকটা পরীক্ষায় পাসও করে। কিন্তু ভাইভার ডাক আসেনি সেভাবে। কয়েকটা ডাক পেলেও অদ্ভূত কারণে ওকে বাদ দিয়ে দেয়। পরে জানতে পারে এখন চাকরি পেতে শুধু মেধা নয় অর্থও দরকার"।
উনি হঠাৎ থেমে গেলেন। আমি তীব্র উৎকণ্ঠায় শুনে চলেছি। স্তব্ধ হয়ে যাওয়াতে বললাম, "জল খাবেন?"
"না, গলা এমনিতেই ভিজে রয়েছে"
"আপনারা টাকা দিয়েছিলেন?"
অট্ট হাসি দিয়ে বললেন, "থাকলে তো দেব। কোথায় পাব অত অত টাকা। মিনিমাম পাঁচ লাখ"।
আমি বললাম, "কিন্তু একথা ও জানল কার থেকে?"
ভয়ে ভয়ে বললেন, "স্থানীয় এক নেতার থেকে। সে নাকি আমাদের ওখানের আরও দুজনকে বেশ কয়েক মাস আগে ওই ভাবেই ঢুকিয়ে ছিল। দাদাকে ওই, ওপর তলার নেতাদের কাছে নিয়ে যায়। তারা অনেক টাকা দাবী করায় ও খুব চিন্তিত হয়ে পড়ে। বেশ কয়েক দিন আমাদের কিছুই জানায়নি। পরে সব বলে। ও টাকা দিতে রাজি ছিল না। আমাদের সব বিক্রি করলেও হয়ত সেই পরিমাণ টাকা উঠবে না"।
উনি আবার একটু থামলেন। কথার গুরুত্ব বুঝতে পারছিলাম। মাঝে মাঝেই আশেপাশে নজর দিচ্ছিলাম, পাছে আমদের এই কথোপকথন কেউ শুনে নেই। না, আমি এত ভীত নয়। কিন্তু এই অসহায় পরিবারের জন্য সাবধানী হতেই হতো। তিনি আবার বলা শুরু করলেন, "ওর চাকরির আশা আমরা সবাই ছেড়ে দিয়েছিলাম। যদিও বেশ কিছুদিন পর, একদল নেতাকর্মী আমাদের বাড়ি আসে। ওরা বলে, দাদা যদি ওদের পার্টির হয়ে কাজ করে তাহলে টাকার অঙ্ক কমতে পারে। ও টিউশন পড়িয়ে আমাদের ওখানে বেশ জনপ্রিয়। বিশেষ করে ছাত্র যুব সমাজের কাছে। ওর মেধা, সৎ ব্যবহার কাজে লাগাতে চেয়েছিল। যদিও দাদা প্রথমেই সেই প্রস্তাব নাকচ করে, ও নিজের সততা বেচতে চায় নি"।
আমি বললাম, "ওর মত মানুষের থেকে এটাই স্বাভাবিক"।
মহিলা কথা সম্মতি জানালেন বটে, কিন্তু সাথে মধ্যবিত্তের অসহায়তার কথা উল্লেখ করে বললেন, "দাদার মত মানুষের থেকে সত্যিই এই ব্যবহার প্রত্যাশিত। কিন্তু তারপরেও ওকে একপ্রকার বাধ্য করি-প্রস্তাব মেনে নিতে। বুঝতেই পারছেন গরীব পরিবার। খেতে পাই না ভালোভাবে। যদি ওর রাজনীতির মাঠে কিছু সময় কাটানো আর অল্প কিছু টাকায় একটা চাকরি জোটে আমাদের দুর্ভোগ কিছুটা কমে"।
আমি ওনার কথার অর্থ বুঝতে পারলাম। কতটা নিরূপায় থাকলে মানুষ এই পথ বেছে নেয়। বললাম, "সবই বুঝতে পারছি। আপনারা আপনাদের জায়গায় সঠিক ছিলেন"।
তিনি বললেন, "অনেক বুঝিয়ে ওকে রাজি করায়। পরে ও নিজেও মন থেকে মেনে নেয়। যত দিন যায় ওকে নেতাগুলো যথেচ্ছ ভাবে ব্যবহার করতে থাকে। ওকে এই এলাকার ইয়াং জেনারেশনের মুখ করে ভোটে লড়ে। জিতেও যায়। কিন্তু..."
"কিন্তু?"
"রাজনীতিতে যা হয় সেটাই হল"
"ওকে চাকরির ব্যবস্থা করে দেয়নি?"
বিষন্ন হয়ে বললেন, "ভোট মিটলে দাদা টাকাও দিয়ে দেয়। কিন্তু যত টাকা কমানোর কথা হয়েছিল, কমায়নি ওরা। আরও অঙ্ক দাবী করে। ও হতাশ হয়ে পড়ে। বাকি টাকা দিতে রাজি হয়নি। যদিও পরে সেই চাওয়াও মেনে নিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, একটু বেশি নিচ্ছে নিক চাকরিটা তো হবে। টাকা জোগাড় করতে বাবা আমাদের সামান্য চাষের জমিটাও বিক্রি করে দেয়। মায়ের কিছু পুরনো গয়না বন্দক রেখেছিলাম। কিন্তু সব শেষ!"
আমি বললাম, " শেষ কেন! আপনার দাদা কোয়ালিফাই করেছিল। টাকাও দিয়েছিলেন। চাকরি তো সুনিশ্চিত হওয়ার কথা"।
তিনি বললেন, " বাস্তবে সেটা হয়নি। মেরিট লিস্ট ওর নাম ছিল। আগের বারও ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে সব উলোট পালোট হয়ে গেল। ওসব লিস্ট টিস্ট কিছুই না ওদের কাছে। সব পাল্টানো যায়। মেধা যে এভাবে পরিবর্তনশীল হয় জানা ছিল না"।
"আপনারা টাকা দিলেন তাও ওর নাম লিস্টে রাখলো না!"
"আর টাকা"
"কেন, আপনারা যাকে টাকা দিয়েছিলেন তার সাথে কথা বলেননি?"
"লাভ নেই কিছু"
"কেন? অতিরিক্ত টাকাও তো দিয়েছিলেন"
তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললেন, "স্বার্থপর লোকগুলো প্ল্যান করে কিছুদিনের মধ্যেই দল পাল্টে অন্য দলে যোগ দেয়। দলই যখন পাল্টে ফেলল আর কিছু করার জায়গা থাকে?"
আমি বিস্মিত হয়ে পড়লাম। ইদানিং এই হওয়ায় দেখতে পাচ্ছি। আগে অবশ্য ছিল কিনা জানিনা। এখন রোজই শোনা যায়। মিডিয়াতে এসব ছাড়া অন্য খবর কি আর টেলিকাস্ট হয়। তবে সত্যি বলতে দলবদলের এইরকম চূড়ান্ত ফলাফল আশা করিনি। টাকার বিনিমযে চাকরি এতো কখনোই সমর্থন যোগ্য নয়। কিন্তু এরপরেও যে মানুষকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করলে, তাকে কিছু ফিরিয়ে দেবে না? এটাও তো একপ্রকার অন্যায়। সহজ ভাষায় বেইমানি। দুর্ভাগ্য এই জনৈক ব্যাক্তিই তার স্বীকার। এরপর আমার কিছু বলার ছিল না। নিশ্চুপ রইলাম। তিনি বললেন, "এরপরেও আমরা তাদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্ঠা করি। প্রথম কদিন তো শুনতেই চাইনি, অস্বীকার করে! পরে বেশ কয়েকবার ডেট দিয়ে আমাদের যেতে বলে। শুরুতে দুদিন ভালো ব্যবহার করলেও, টাকা ফেরতের কথা বলেনি। কিছুদিন পর দাদা নিজেই আবার যায়। ততদিনে ওর আচরণে পরিবর্তন এসে গিয়েছিল। ওদের সামনে মাথা গরম করে দু' চার কথা শুনিয়ে দেয়। ওরা দাদাকে প্রচন্ড মারধর করে"।
"ওকে মেরেছিল!"
"তখন থেকেই ওর মাথার প্রবলেম আরও বেড়ে যায়"
"এটা আরও জঘন্য অপরাধ, আপনারা পুলিশে জানান নি কেন! অন্তত এই ব্যাপারটা পুলিশে বলা উচিত ছিল"
"চেষ্ঠা করেছিলাম"
"পুলিশ কোনো স্টেপ নেই নি?"
দেখলাম গলার স্বর খুব নামিয়ে বললেন, "দল পাল্টালে কি হবে, থানা পুলিশ এখনও ওদের ভয়ে গুটিয়ে থাকে। আমরা থানায় যাবার দুদিন পর ওরা ঠিক খবর পেয়ে যায়। একদিন রাতে, মোটামুটি বারোটার সময় দেখি সব এসে হাজির। শাসিয়ে যায়, যদি ফারদার কিছু করি ওরা দাদাকে প্রাণে মেরে দেবে। সেই ভয়েই গুটিয়ে আছি। সব সময় মনে হয় ওদের লোক আমাদের ফলো করছে"।
আমি বললাম, "ব্যপারটা এতো গভীর আন্দাজ করতে পারিনি। এত বড়ো সমাজে আপনাদের পাশে কেউ দাঁড়ায় নি?"
তিনি বললেন,"এসেছিল দাদার কজন ছাত্রের পরিবার থেকে। ওরা তাদের বাড়িতেও থ্রেট দিয়ে আসে। আমার একা হয়ে পড়েছিলাম। গ্রামে বেশ কয়েকমাস থাকিনি। এখন দেড় মাস হল আবার থাকা শুরু করেছি। এখনও ভয় হয়"।
দীর্ঘক্ষণ কথা বলতে ওনার গলার স্বর জড়িয়ে আসছিল। আমি প্রায় শেষ হওয়া জলের বোতল বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, "একটু জল খেয়ে নিন। এখনও অনেক পথ বাকি"।
হাত থেকে জলের বোতল নিয়ে সবটা শেষ করে দিয়ে বললেন, "এসব কথা বলতে এখনও গলা শুকিয়ে আসে। কবে যে সব স্বাভাবিক হবে! ও যদি একটু নর্মাল হয়ে ওঠে আবার নতুন করে শুরু করা যায়। কত বোঝানো হয়। কিছুই রেজাল্ট নেই"।
আমি ওনার দাদার মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, "ঈশ্বরের ওপর ভরসা রাখুন। ডাক্তার দেখাচ্ছেন। সব ঠিক হবে। ওকে আরও বোঝাতে হবে। হয়তো সময় লাগবে। কিন্তু নিশ্চয় ঠিক হবে, দেখবেন"।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, "জানিনা ওর কপালে কি আছে। যদি কোনোদিন সেরে ওঠে বাবা মা র জীবনে সেটাই বড়ো প্রাপ্তি হবে। অগোছালো সংসার একটু গোছানো হবে"।
ইতিমধ্যেই প্রত্যক্ষ করলাম ওনার শারীরিক ক্লান্তি চোখেমুখে ফুটে উঠেছে। সারাদিনের ধকল তারপর এখন এইরূপ প্যানিক হয়ে যাওয়া সব কিছুই যেন মহিলার শরীরের অন্তর্নিহিত শক্তিকে নিগড়ে নিয়েছে। বললাম, "আমার মনে হয় আপনার একটু বিশ্রাম দরকার। মানে, চোখমুখের ছবি কিন্তু সেকথাই বলছে"।
"ঠিকই বলেছেন, আর পারা যাচ্ছে না"
"ভিতরে কি জায়গা পাবেন, সিট ফাঁকা আছে?"
সেদিকে একটু উঁকি দিয়ে দেখে বললেন, "না বুঝলেন। তাছাড়া দাদারা এখানে আছে। আমিও এখানেই বসে পড়ি। ঠাণ্ডা হাওয়াও বেশ আসছে। ভিতরের হাওয়া কিন্তু গরম"।
আমি কথার সম্মতি দিয়ে বললাম, "ভুল বলেন নি। দাঁড়ান, এই পেপারটা বিছিয়ে নিয়ে বসে পড়ুন"।
গতকালের পুরোনো পেপারটা বেড় করে এগিয়ে দিলাম। আমার পাশেই সামান্য একটু জায়গায় কোনোরকমে সেটা বিছিয়ে বসে পড়লেন। বসার পর যদিও উনি আর কোনো কথা বললেন না। শারীরিক মানসিক যন্ত্রণার সাময়িক সমাপ্তি দিতেই নিশ্চুপ হয়ে গভীর অন্ধকারের দিকে চেয়ে রইলেন। ওনার মা বাবা আমদের সামনেই একভাবে বসে আছেন। ইতিমধ্যেই ছেলেকে ওষুধও খাইয়েছেন। হয়তো ওষুধের প্রভাবেই ঘুমিয়ে পড়েছে সে। মায়ের কোলে মাথা দিয়ে বেশ জড়সড় হয়েই রয়েছে। সবই যেন স্বাভাবিক। টেনে লোকজনের কোলাহল আছে, প্লাটফর্মে ট্রেন থামছে, মানুষজন উঠছে সবকিছুই নিজ ছন্দে ঘটে চলেছে। জীবন এটাই এখানে কেউই কারও তোয়াক্কা করে না। এভাবেই প্রবাহিত হয়েছে, আগামীতেও হবে। বর্ধমান ঢুকতে তখনও বেশ দেরি আছে। একাকী বসে থাকার চেয়ে ঘটে যাওয়া দিনের ঘটনাগুলো আবার নতুন করে লিখব স্থির করলাম। সেই মত অদূরেই থাকা পেন আর ডাইরি হাতে নিয়ে লিখতে শুরু করলাম বিষাক্ত দেওয়া-নেওয়ার মর্মান্তিক বাস্তব পরিণতি।
ছবিঋণ- ইন্টারনেট ।
-------------------
লেখক পরিচিতি ঃ
নাম- সেখ মেহেবুব রহমান
গ্রাম- বড়মশাগড়িয়া
ডাকঘর- রসুলপুর
থানা- মেমারী
জেলা- পূর্ব বর্ধমান
রাজ্য- পশ্চিমবঙ্গ
ডাকঘর সংখ্যা- ৭১৩১৫১