ঝাঁকড়া গাছেদের ছায়ায় ঘেরা শীতল স্নিগ্ধতায় মোড়া বামুন কায়েত পরিবেষ্টিত ছায়াপুর গ্রামে মাত্র কয়েকঘর মুসলিম পরিবারের বাস। এরা নিজেরা নিজেদের মতো করেই থাকে। হিন্দু মুসলিম - - উভয়েই মিলেমিশে নিজের নিজের ধর্ম নিয়েই আনন্দে-দুঃখ বেঁচেবর্তে আছে।
আমার গল্প এই গ্রাম বা তার মানুষজনের থেকেও অনেকটা বেশি আকবুলকে নিয়ে। এই গ্রামের ছোট চাষী রহমত মিঞার ছেলে আকবুল গ্রামের হাইস্কুলের ক্লাস নাইনের ছাত্র। পরিবারের প্রথম প্রজন্ম হিসেবে শিক্ষার আলো দেখলেও পড়াশোনায় বেশ ভালো । অঙ্কের স্যার অবীনবাবুতো ওর আব্বাকে বলেছেন "রহমত মিঞা - - - তোমার ছেলে আমাদের স্কুলের গর্ব। ওকে যেন ক্লাস টেনের পরীক্ষার পর তোমার চাষের কাজে লাগিও না। ও অনেক দূর যাবে---অনেক বড়ো হবে ও। দেখো রহমত, তোমার ছেলে তোমার মুখ উজ্জ্বল করবে।"
একথা শুনে লজ্জায় নিচু হয়ে রহমত মিঞা বলেছে"সে আপনেরা যা ভালো মইন্যে করেন গো ম্যাস্টরমশাই। কিন্তুক আমাগো পোলাটারে আপনোদিগেই দেইখতে হবেক। অবিশ্যি খরচের লেগে চিন্তার কারণ নেইকো । ওটুক আমি সামালতে পাইরব। "
সেদিনের পর থেকে রহমত মিঞা ছেলের জন্যে আরও এক পো দুধ বরাদ্দের কথা বলেছে আকবুলের আম্মিজান খালেদাকে"।মিঞা বিবি প্রায়ই আলোচনা করে "বুইঝল্যা আকবুলের আম্মি, অবীন ম্যাস্টর আইজকে আমাগো ব্যাটার ওনেক পশংসা কইরছিল। উ ন্যাকি নেকাপড়ায় ওনেক দূর যাবেক। আকবুলের মাতাটা খুব পরিষ্কার। বুইঝল্যে খালেদা, মুদের ত নেকাপড়া হয় নাইকো, তোবে উয়ার পড়ার লেগ্যে আমো সব কইরবক কিন্তুক তুমার ব্যাটারে বোলো---কুনো পাকামো এই রহমত মেঞা বরদাস্ত কইরব্যে না কো।"
আকবুলের আম্মি তার মিঞার কাছে ছেলের প্রশংসা শুনে একদিকে যেমন খুশিতে উৎফুল্ল হয়ে ওঠে, অন্যদিকে আকবুলের আব্বুর মেজাজের কথায় বুকের ভেতরটা শুকিয়ে কাঠপারা হয়ে যায়। সারা দিনমানের হাড় ভাঙা খাটুনির পর মাইনষটা যখন বেঘোরে ঘুমায়, তখন খালেদা বেগম চুপিচুপি আল্লাহর কীরে দোয়া করে আকবুলের জন্যে আর বলে "আল্লাহ্ - - - - মাইনষটা মুখে রাগ দেখালেও উয়ার ব্যাটা উয়ার জান। দেখো আল্লা, মুর আকবুল য্যান উয়ার আব্বুর মান রাইখতে পারে। আর মুর মিঞার মাতাখান ঠাণ্ডা কইরো আল্লাহ।" বলতে বলতে এক ওয়াক্ত নামাজ পড়ে আকবুলের চাঁদপানা মুখটা মনে করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ে খালেদা।
আর যাকে নিয়ে এই গল্প - - - - আকবুল - - - বড়ো ভালো ছেলে - - - সাতচড়ে রা নেই। আব্বু - আম্মুর কথার নড়চড় করে না। এহেন আকবুল গত কয়েকদিন যাবৎ বেশ মনমরা হয়ে আছে। প্রত্যেক বছরের মতো বেশ ধূমধাম করে এবারও ইস্কুলে স্বরস্বতী পূজো হচ্ছে। আকবুল পূজো কমিটিতে থাকলেও আব্বুর ভয়ে প্রতিমাকে স্পর্শ করে না। ওর আব্বু ভীষণ গোঁড়া - - - বলে"শুন রে আকবুল---ইস্কুলে সব্বার সাতে পূজো কইরছ ভালো কতা। কিন্তুক শুনো বেটা---উ স্বরস্বতী হিঁদুদের ঠাকুর, আর তুমার হিঁদুদের ঠাকুরে হাত দিয়ে কাজ লাই। আল্লাহ গুনাহ করবে। উ তুমি দূর থেক্যাই বিদ্যেটো চেয়ে লিবে - - - তাইতেই হবে। উ ঠাকুরও জানে - - - উ আমাদিগের লয়---বুঝলে বেটা।" আকবুল ওর আব্বুর মুখের ওপর কোনো জবাব দিতে পারে না - - - আর সেজন্যই আব্বুর অবাধ্য না হয়ে প্রতিবছর ঠাকুরের হাজারো দায়িত্ব সামলালেও ফুল হাতে নিয়ে পুষ্পাঞ্জলি দেওয়া ওর হয় না। দূর থেকে হাত জোড় করে চোখ বন্ধ করে পুরোহিত মশাইয়ের বলা মন্ত্র মনে মনে উচ্চারণ করে।
যাই হোক, ক্লাস নাইনে ওঠার পর থেকেই আকবুলের মধ্যে অনেক পরিবর্তন এসে গেছে। আজকাল আব্বুর কথাগুলো মন থেকে মেনে নিতে মন চায় না ওর। বড়ো ইচ্ছে করে মাটির প্রতিমাকে অন্যদের মতো নিজের হাতে সাজাতে। ঠাকুরের কাজে হাত লাগাতে!প্রতি বছর নিষ্ঠাভরে পুরোহিত মশাইয়ের পূজো দেখতে দেখতে নিজের অজান্তেই আকবুল কখন যেন সবটা শিখে নিয়েছে । এসব ভাবতে ভাবতে প্রত্যেক বছরের মতো এবছরও স্কুলের পূজোয় সব কাজ করলেও মনটা ছিল বড়ো আনমনা।
"এই আকবুল, তোর কী হয়েছে রে? কাগজের ফুলগুলো ঠিকঠাক বানাবি তো?"
"কিছু না রে---একটা অন্য কথা ভাবছিলাম।"
"কী কথা, আমাকে বলবিনা?"
"তেমন কিছু নয় রে শুভ।"
আকবুলের বেস্ট ফ্রেন্ড শুভম কিছু একটা বলতে গিয়ে স্যারের গলার আওয়াজ পেয়ে চুপ করে নিজের কাজে মন দেয় আর আকবুলের চোখে তখন এক অন্য স্বপ্নের আভাস। এ স্বপ্নের কথা কীকরে বলবে ও শুভমকে---! শুভম কী বিশ্বাস করবে---প্রতি রাতে মেঘ পশমের ভেলায় চড়ে হংসাসীনা বীণাপাণির ওর স্বপ্নে আগমনের কথা। কিন্তু ও তো বিশ্বাস করে এই স্বপ্নকে। এক অদ্ভূত সুরের মূর্চ্ছনায় ভরে যায় ওর সমগ্র সত্ত্বা। সেই ঝংকারের সুরে সুর মিলিয়ে ওকে কিছু বলে যান দেবী। কিন্তু ঘুম ভেঙ্গে সেকথা মনে না থাকলেও এক অদ্ভূত সুর স্বপ্নের আবেশ সারাক্ষণ জড়িয়ে রাখে ওকে।
পূজোর আগের দিন ওরা বড়ো ব্যস্ত থাকে স্কুলে। স্কুল পরিষ্কার, মণ্ডপসজ্জা, প্রতিমা আনা---শত কাজ ওরা হইহই করে হাতে হাত মিলিয়ে করে। প্রতিবারের মতো এবারও সকলের সাথে প্রতিমা আনতে গিয়ে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাচ্ছিল আকবুল। স্বপ্নের আগমনী দেবী যখন মৃন্ময়ী মূর্তিতে বাস্তবের পৃথিবীতে ধরা দেয় তখন আনন্দে তো চোখ ছলছল করবেই। আকবুলেরও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ওই মৃন্ময়ী দেবীকে স্পর্শ করতে বড়ো ইচ্ছে করলেও এতদিনের সংস্কার আর আব্বুর আদেশ অমান্য করার সাহস হলো না বলেই দূর থেকে দুচোখ ভরে দেবীমূর্ত্তির পবিত্র, স্নিগ্ধ রূপ দুচোখের তারায় মেখে মনটাকে ভরিয়ে নিচ্ছিল আকবুল।
স্কুল থেকে ফিরে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বাড়ির বাইরের দাওয়ায় চুপচাপ বসে থাকতে দেখে ওর আম্মি বলে উঠল "কী হয়েছে জান্? ইস্কুলে কী মারাপিট করেছিস?"
"আম্মু----আমি কী বাচ্চা যে মারপিট করব! আজ ইস্কুলে অনেক কাজ ছিল তো - - - - তাই একটু হাঁপিয়ে গেছি। আর কিছু না।"
"তা বেটা ইস্কুলের কাজ কইরেছ্য ভালো কথা। কিন্তুক ঠাকুর ছোঁও নি তো ব্যাটা - - - - তোমার আব্বু জাইনল্যে রেগে আগুন হই যাবেক। আর তুমি তো জ্যানো - - - উই মাইনষটা রেগে গেলে মাতার ঠিক থাইক্যে না। "
" জানি আম্মু---আর তাই আমি ঠাকুর কোনদিন ছুঁই না"কথাগুলো বলে একটা দীর্ঘশ্বাস নিজের মধ্যে চেপে রেখে আনমনা হয়ে বসে রইল ও ।
আজ ওর পড়াশোনাতেও মন বসছিল না - - - - বীণাপাণির চোখদুটো বড়ো টানছিল ওকে।প্রতিমার মায়াবী চোখ আর স্নিগ্ধ হাসিটা ঠিক যেনো ওর আম্মুর মতোই মমতামাখা। এসব ভাবতে ভাবতে আনমনে খাতায় আঁকিবুঁকি কাটছিল ও। হঠাৎই বাইরে আব্বুর গলা শুনতে পেল"কই গো আকবুলের আম্মি---পানিটা দাও।হ্যাঁ রে ব্যাটা - - - পড়ালেখা ঠিক হইছে ত্য। ওই জায়গায় কিন্তু কুনো ওজর আপত্তি চইলবেক না। বুইঝল্যে বাপজান----তুমাকে ইস্কুলের ম্যাস্টরমশাইদের মান রাইখতে হব্যে। উয়ারা খুব ভালোবাসে তুমাকে। দিল লাগিয়ে পড়ো বাপ।" কথাগুলো বলে আম্মুকে ডাকতে ডাকতে ভেতরে চলে যায় আকবুলের আব্বু।
গ্রামের দিকে রাত একটু তাড়াতাড়িই নিশুতি হয়ে যায়। আকবুলদের ছায়াপুর গ্রামও তার ব্যতিক্রম নয়। রাতে খাওয়া দাওয়ার পর আব্বু আম্মু ঘুমিয়ে পড়লেও নিদ্রাহীন চোখে শুয়ে ছিল ও।। বেশ কিছুক্ষণ বিছানায় এপাশ ওপাশ করে চুপিসারে ঘর থেকে বেরিয়ে নেমে এল নীচের উঠোনে। কুয়াশার চাদরে মোড়া শুক্লা চতুর্থীর চাঁদের ধোঁয়াশার আবছায়া জোছনামাখা নিশুত রাতের সৌন্দর্য্য আগে কখনও দেখেনি আকবুল । আম্মুর কাছে শুনেছে - - - এই সব রাতে জিন, হুর-পরীরা আসমান থেকে নেমে আসে। কিন্তু আকবুলের আজ অন্য কিছু মনে হচ্ছিল। এমন রাতে যদি বীণাপাণি বাগদেবী নেমে আসতেন এই পৃথিবীতে - - - - সেই মুহূর্ত কল্পনা করে এক অজানা রোমাঞ্চে শিহরিত হয়ে উঠছিল ও। এই ধোঁয়াশা ভরা জোছনার রোশনাইতে যদি বীণাপাণির সুর শোনা যেত - - - - সেই সুরের মূর্চ্ছনায় আজ শুধুমাত্র ও একা নয়, ভেসে যেত এ বিশ্বচরাচর - - - - হিন্দু মুসলিম কেউ বাদ যেত না সেই অসামান্য মুহুর্তের হাত থেকে । এসব ভাবতে ভাবতে মাঘ মাসের শীতের চাদর মুড়ি দেওয়া নিশুত রাতের সৌন্দর্য্যের রূপ আকণ্ঠ পান করে ধীর পায়ে নিজের ঘরে চলে গেল আকবুল।।
হঠাৎই ভোর রাতে ঘুম থেকে চমকে উঠে বসে পড়ল ও। আজও সেই একই শ্বেতশুভ্রা রূপে হংসবাহনা দেবী ওর স্বপ্নে এসেছিলেন এক অপূর্ব সুরের মূর্চ্ছনার আবেশ নিয়ে ।কিন্তু আজ দেবীর প্রতিটি কথা ওর হৃদয়ে খোদাই হয়ে গেছে। বাকী রাতটুকু সেই সুরের মূর্চ্ছনায় আর সুরেলা কণ্ঠের বাণীর জাদুতে মোহিত হয়েছিল আকবুল। সকালে ঘুম ভাঙতেই ওর ইচ্ছে করছিল এক দৌড়ে স্কুলে গিয়ে বাগদেবীর মূর্তিকে স্বচক্ষে দেখে আসার। কিন্তু আব্বুর কথা মনে হতেই নিজেকে সামলে নিয়ে স্নান সেরে একটু বেলা করে স্কুলে গিয়ে দেখল পুরোহিত মশাই এসে গেছেন - - - - পূজোর কাজও প্রায় সারা। মা স্বরস্বতীর চোখদুটোর দিকে তাকাতেই ওর মনে হল যেন দেবী ওর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছেন। আজ বড়ো ইচ্ছে করছিল হাতে ফুল নিয়ে হংসাসীনা মৃন্ময়ী মূর্তির সামনে হাঁটুমুড়ে জোড়হাতে চোখ বন্ধ করে মন্ত্রোচ্চারণের শেষে মায়ের পায়ে ফুল দিতে। কিন্তু আব্বুর ওই রক্তরাঙা চোখ ওকে এইসময় তাড়া করে বেড়ায়। আজও পারল না ও আব্বুর অবাধ্য হয়ে মনের কথা শুনতে। সবার অলক্ষ্যে কয়েকটা ফুল হাতে নিয়ে এক দৌড়ে বাড়িতে এসে ওর পড়ার ঘরে ঢুকে বিজ্ঞানের বইটা বের করে জোড়হাতে চোখ বন্ধ করে পুরোহিত মশাইয়ের বলা মন্ত্র মনে মনে উচ্চারণ করে ফুলটা বইতে ছুঁইয়ে বইয়ের তাকে সযত্নে রেখে পড়তে বসে গেল ও।
ছেলেকে ঘরে ঢুকতে দেখে খালেদা এসে বলল"ইস্কুল থেইক্যা চল্যে এলে কেন ব্যাটা? কেউ কিছু বইলেছে? ইয়ার লেগ্যেই তুমার বাপ ঠাকুরের কাছকে যেতে না করে বাপজান। আর কক্ষুনো যাইবা না বুঝলা!"
"কেউ কিচ্ছু বলে নি আম্মু! আব্বুর কথা অমান্য করে ঠাকুরকে অঞ্জলি দিতেও পারিনি। তাই বাড়ি এসে নিজের মতো করেই অঞ্জলি দিচ্ছি আম্মু। উনি তো বিদ্যার ঠাকুর- - - -তাহলে সবাই বলে কেন আজ নাকি পড়তে নেই। জানো আম্মু আমি এটা মানি না - - - তাই তো আমি পড়তে বসলাম। আজ আমি সারাদিন পড়ব আম্মু----এটাই আমার অঞ্জলি।"কথাগুলো বলে আকবুল বইয়ের পাতায় মন দিলে ওর আম্মি ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই আকবুল ঊর্ধ্বমুখে সজল চোখে বলতে লাগল" তুমি তো আমার কাছে অঞ্জলি চেয়েছিলে, মা। আব্বুর কথা অমান্য করতে আমি পারলাম না। তুমি কি আমার এই অঞ্জলি নেবে না মা? আসবে তো আজ আমার কাছে? তুমি আমার এই পুষ্পাঞ্জলি গ্রহণ কোরো মা।"
ওদিকে তখন স্কুলের মণ্ডপের অন্তর্যামী দেবী হংসবাহনা বীণাপাণি এই নতুন ধারার অঞ্জলিতে তুষ্ট হয়ে উজ্জ্বল চোখে মিটিমিটি করে হাসতে লাগলেন।
ছবিঋণ- ইন্টারনেট ।