পুরুষের কান্না
অঞ্জনা গোড়িয়া
পুরুষের চোখে ও জল আসে। কেউ দেখে আবার কেউ না দেখার ভান করে । দুঃখ আসে । কান্না পায় । কেউ চিৎকার করে কেউ নীরবে কাঁদে। বুক ফাঁটা হাহাকার সবার কানে পৌঁছায় না। নীরবে গুমরে ওঠে হৃদয়।
আমার খুড়তুতো কাকু খুব ভালো মানুষ। ভালো চাকরিও করে। আমাদের সবার জন্য পূজার জামা কাপড় কেনে। সংসারের জন্য ভালো ভালো বাজার ও করে। বাপ-মা মরা কাকু আমার মায়ের কাছেই মানুষ। তাই যত আবদার অভিযোগ সব মায়ের কাছে। মা, যত বার ই বলে এবার একটা বিয়ে কর। কিন্তু বিয়েতে কিছুতেই রাজী নয়।
বলে, তোমরা তো আছো বৌদি, দুমুঠো ভাত দেবে না?
এমন করে বলে যে, মা আর কিছু বলতে পারে না।
বাবা, কিন্তু ভীষণ রেগে যায়। ছেলে বড় হয়েছে। সংসার ধর্ম না করলে পুরুষ মানুষের চলে নাকি?
বহু কষ্টে একপ্রকার জোর করেই বিয়েতে রাজী করানো হলো কাকুকে। ভবিষ্যতের কথা ভেবে। কাকু কিন্তু মাকে বলেই দিল, বিয়ে দিচ্ছো মানেই হাড়ি আলাদা করা যাবে না। আমি কিন্তু তোমার কাছেই খাবো। মা হেসে উড়িয়ে দেয়।
বোকা ছেলে কোথাকার? বিয়ে দিচ্ছি বলে, তোকে আলাদা করব কেন?
তোর বউ যত দিন চায়বে তত দিন তুই থাকিস আমাদের সাথে।
আমি তো আর জোর করে তোকে আটকে রাখতে পারব না। শুনেই কাকুর সে কি রাগ?
জোর করে মানে? আমার ওপর তোমার কোন জোর নেই? কোথাকার কে আসবে? তার কথায় সব? তা হবে না। আমি তোমার হাতের রান্নায় খাবো। সবার আগে তোমার অধিকার।
সবাই হো হো করে হেসে উঠল।
বেশ কিছুদিন পর দেখাশোনা করেই বাপ-মা মরা এক অনাথ মেয়ের সাথেই বিয়ে হল। অবশ্য বেশ ধূমধাম করে। গায়ের রং টা একটু চাপা । কিন্তু মুখটা ভারি মিষ্টি। খুব মজা হলো কাকুর বিয়েতে। কিন্তু কাকুর মুখে তেমন হাসি নেই। নেই কোন উচ্ছ্বাস, আনন্দ। দায়সারা ভাবে বিয়েটা করল।
নতুন কাকিমার মুখে হাসি লেগেই থাকত । কোন দিন ই বুঝতে দেয় নি নিজের যন্ত্রনা কষ্ট। কাকু সেই আগের মতনই দশটা-পাঁচটা ডিউটি করে বাড়ি ফিরত। তারপর আবার ক্লাবে আড্ডা দিয়ে গভীর রাতে ফিরত । কাকুর মুখ দেখতে পেতাম না ।
এক দিন কাকিমার ঘরের সামনে দিয়ে যাচ্ছি । গেটটা হাল্কা ভেজানো । চোখ পড়ল বিছানার দিকে। কাকিমা মাদুর পেতে মেঝেতে শুয়ে আছে।
খাটে একটাই বালিশ রাখা ।
তবে কি কাকিমা রোজ মেঝেতে ঘুমায়? প্রশ্নটা ক্রমশ জটিল হয়ে উঠল। তবু কিছু জানতে চাইলাম না৷। সম্পর্কে কাকিমা। এসব কথা কি আমার মুখে মানায়?
গভীর রাতে কখন যে কাকু আসত ?কেউ টেরই পেত না।
বুঝলাম সবই । বলার সাধ্য নেই । আমি যে বাড়ির ছোট সবার ।
রবিবার ছুটির দিনে ও সবার খাওয়া হলে বাড়ি ফিরত কাকু। আড্ডা দিয়ে অনেক বেলায়। নতুন কাকিমা ভাত নিয়ে বসে থাকত । তবে কাকিমার হাতে রান্না খেয়ে, আপত্তি করে নি- খাবো না বলে। খুব সুন্দর রান্না করতো কাকিমা। কাকার পছন্দ মতো রান্না করত। মায়ের কাছ থেকে শুনে শুনে। তাই কাকুর বেশ লাগত খেতে।
কাকু অবশ্য মুখে কিছু বলত না। নিশ্চুপ বাক্য ও প্রশংসার কারণ।
কাকুকে কখনও কাকিমার সাথে গল্প করতে শুনি নি । একসাথে যাওয়া বলতে সেই অষ্টমঙ্গলায় গিয়েছিল মাসির বাড়ি । মাসির বাড়ি থেকেই বিয়ে হয়েছিল।
সবার অনুরোধে একবার ই গিয়েছিল কাকিমার সঙ্গে । তারপর যেই সেই । এনিয়ে নতুন কাকিমার কোন অভিযোগ নেই । বাড়ির সমস্ত কাজ সেরে মেসিনে সেলাই করা, সন্ধ্যে আমাদের নিয়ে পড়াতে বসানো সবই করত একমনে । কখনও কখনও ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকিয়ে থাকে । কেন যে বারবার সময় দেখত কে জানে? স্বামীর জন্য চিন্তা তো হয়। যত রাত ই ফিরুক, কাকিমা না খেয়ে বসে থাকতো।
এক দিন বাথরুমে স্নান করতে গিয়ে তোয়ালে নিয়ে যেতে ভুলে গেল কাকু।
বাথরুম থেকেই চিৎকার, ছুটকি,তোয়ালে টা দিয়ে যা।
আমাকে ছুটকি বলেই ডাকতো।
আমি ইচ্ছে করেই না শোনার ভান করে চলে যায়। কাকিমা, বাধ্য হয়ে তোয়ালে টা নিয়ে বাথরুমের সামনে গেল।
কিছু বলার আগেই কাকু বলল, কই এনেছিস, দে।
কাকিমা হাত টা বাড়িয়ে দিল। গেটটা খোলায় ছিল।
কাকু ভেবেছে, আমি ভেবে ইচ্ছে করেই জলের ফোয়ারাটা খুলে দিল আমার দিকে। আমাকে ভিজিয়ে দিতে।
কাকু বরাবর আমার সঙ্গে মজা করত।
কাকিমা ভিজে স্নান। "এই যা ভিজিয়ে দিলাম তো", বলে ই চেয়ে দেখে, আমি নয়, কাকিমা।
খুব লজ্জায় পড়ে গেল। কাকু হা করে কাকিমার দিকে তাকিয়ে। মুখে কিচ্ছু বলল না।
পরে অবশ্য আমাকে খুব বকে ছিল।
সেদিনের পর থেকে কাকুর একটু পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। আর আগের মতো দেরি করে না।
সেদিন শিবরাত্রি । নতুন কাকিমা ব্রত করেছে । সারা রাত জেগে নির্জলা উপবাস। এ ব্রত নাকি স্বামীর মঙ্গলের জন্য করতে হয়। সংসারের মঙ্গলের জন্য ।সারারাত প্রচন্ড ঝড় জল । বিদ্যুতের আলোয় চমকে উঠলাম । তখন ও কাকু ফেরে নি । মা তো ভীষণ রেগে গেল । রোজ রোজ কি এত কাজ? একদিন তাড়াতাড়ি ফিরতে পারে না? আজ আসুক ,কিছু একটা ব্যবস্থা করতেই হবে ।
গভীর রাতে বাইক চালিয়ে ফিরে এল কাকু । চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ । কাকে যেন খুঁজছিল ? আমি জেগেই ছিলাম । কাছে এসে বললাম ,কাকিমাকে খুঁজছো ? একটু যেন লজ্জা পেল । আরে না না ,তোর মা কোথায় রে ? একটু ডেটল আনতে পারিস । পা টা কেটে গেছে ।
সত্যি ই দেখি গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে । জিজ্ঞাসা করতে বলল , তেমন কিছু নয় । আজ ফেরার সময় একটা গাছ ভেঙে পড়ল গাড়ির সামনে। গাছের ডালটা এসে পড়ল আমার পায়ে। একটুর জন্য বেঁচে ফিরেছি রে । গাড়ির কাঁচ ভেঙে গিয়েছে।
আমি বললাম,তোমার কিচ্ছু হবে না কাকু । কাকিমা যে শিবরাত্রির ব্রত করছে তোমার মঙ্গলের জন্য।
একটু চুপ হয়ে গেল । পায়ে ডেটল দিয়ে ধুয়ে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিলাম । বললাম ,তোমার খাবার ঢাকায় আছে ।
কাকিমার সকাল হয়ে যাবে বাড়ি ফিরতে ।
কি যেন ভেবে চুপচাপ চলে গেল । খেলো না কিছু ই ।
বাড়ির গেট টা খুলে আবার বেরিয়ে গেল ।
পাশেই শিব মন্দির । সেদিকেই চলে গেল । বুঝলাম কাকিমার খোঁজে।
কখন যে সকাল হয়েছে বুঝতেই পারি নি ।
ঘুম ভাঙতেই চেয়ে দেখি বাড়িতে কেউ নেই । কিছু বোঝার আগেই একটা চাপা কান্নার আওয়াজ কানে এল ।
ঘুম থেকে উঠে দেখি, কাকু ঠাকুর ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আর হাফুস নয়নে কেঁদে চলেছে ।
জানি না কেন এত কাঁদছে ? এভাবে কাঁদতে আগে কোন দিন দেখি নি ।
শুনেছি ,কাকু যখন তিন বছর । কাকুর মা সব মায়া ভুলে চলে গিয়েছিল অন্য একজনের সঙ্গে । টাকা পয়সা গহনা সব নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল বাড়ি থেকে ।
কাকুর বাবা তবু আর বিয়ে করে নি । রাগে অভিমানে মায়ের ওপর থেকে সব টান মুছে ফেলে ছিল। সেদিন থেকেই নারী জাতির প্রতি ঘেন্না বিদ্বেষে বিয়ে করতেই অরাজী ছিল।
মা আর আমি ছাড়া কোন মেয়ের সঙ্গে কথায় বলত না কাকু ।
কাকিমাকে পেয়ে ও ভুলতে পারে নি মায়ের স্মৃতি । আজ কেন এত জল কাকুর চোখে ? তবে কি মাকে মনে পড়েছে? মা বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে এল। জানতে চাইলাম ,কি হয়েছে মা ? কাকিমা কোথায়?
তোর কাকিমা হসপিটালে ভর্তি । ৪৮ ঘন্টা সময় দিয়েছে ডাক্তার । কাকিমার গ্রুপের রক্ত না পেলে আর বাঁচান যাবে না । আর তোর কাকিমার ব্লাডগ্রুপ নেগেটিভ। এই গ্রুপের ব্লাড পাওয়ায় যাচ্ছে না । মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে কাকিমা ।
ডাক্তার বলেছে ,এসব উপোষ ব্রত করা নিষিদ্ধ। শরীরে হিমোগ্লোবিন কম । সেই সঙ্গে গলব্লাডার এর ব্যথাটা বেড়েছে। সব জেনে শুনে এ ব্রত করে নিজের বিপদ ডেকে এনেছে ।
কাল মন্দিরের পূজা শেষ করে বাড়ি ফিরছিল।
রাস্তায় হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে যায়। সেখানেই তোর কাকুর সাথে দেখা। সোজা হসপিটালে ভর্তি করে। অনেক পরীক্ষা করতে হবে। আপাতত রক্ত চায়ই। তার ব্যবস্থা চলছে এখন। কিন্তু নেগেটিভ গ্রুপের খুব পাওয়া খুব মুশকিল। খোঁজ চলছে। কাকু এখুনি বের হবে।
এতক্ষনে বুঝলাম কাকুর কান্নার কারন । ঈশ্বরের কৃপায় জ্ঞান ফিরল কাকিমার । রক্তের সন্ধান ও পাওয়া গেল । কাকিমাকে বাড়িতে আনা হল । কাকু আর আগের মত নেই । টাইমে বাড়ি ফেরা । একসাথে খাওয়া এক সাথে ঘরে যাওয়া সবই করে । কাকুর চোখে মুখে ভালোবাসার ছাপ ফুটে উঠেছে । কাকিমা কিন্তু একই রকম । হাসি খুশি চুপচাপ মিষ্ট ভাষী ।
দেখতে দেখতে একবছর পূর্ণ হলো। সামনের ই বিবাহ বার্ষিকী। কাকু বেশ সাজ সাজ হয়ে বাড়ি ফিরল । হাতে ফুলের স্ট্রিক। অন্য হাতে শাড়ির প্যাকেট। একটু লাজুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে কাকিমার পানে। আমাকে দেখে ই লজ্জা পেল। খুব দুষ্টু হয়েছিস। তাই না? মিষ্টির হাঁড়িটা হাতে দিয়ে বলল,যা বৌদিকে দে। সবাই কে দিতে বলিস।
কেন গো কাকু? আজ এত মিষ্টি । এমন সাজ! কাকিমার জন্য কি আনলে দেখি। কাকু বলল,এখন যা। পরে দেখিস। কথা না বাড়িয়ে ফিরে যাই। কাকিমা এত দিন পর নতুন করে ফিরে পাবে স্বামীকে। বেশ খুশি খুশি মন।
হাতে একটা অ্যালবাম। কাকুর হাতে তুলে দিল । দেখো আমার কিছু ছোটো বেলার ছবি।
অ্যালবাম টা খুলতে খুলতে এক জায়গায় আটকে গেল চোখ। এ যে মায়ের ছবি। কোথায় পেলে এ ছবি?
এত দিন পর বলার সুযোগ পেল কাকিমা। কাকিমা বলতে শুরু করল----
"আমার মায়ের বান্ধবী ছিল ইনি। তখন খুব ছোট আমি । দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হল মা। বাবা ও ছিল না । তোমার মা খবরটা পেয়ে মাকে দেখতে এসেছিল। মায়ের চিকিৎসার জন্য অনেক অনেক টাকা চায়। কোথা থেকে পাবো আমরা?
তোমার মা, তোমার বাবাকে বারবার বলেছিল, কিছু সাহায্য করতে। কিন্তু রাজী হয় নি৷ তাই বন্ধুর প্রাণ বাঁচাতে নিজের গহনা টাকা সব নিয়ে আসে।
তবু শেষ রক্ষা হয় নি। বাঁচানো যায় নি মাকে। আমাকে একা ফেলে আসতে পারে নি। তোমাদের বাড়ি আনতে চেয়ে ছিল। কিছুতেই তোমার বাবা মেনে নিল না। তোমার বাবা কোন কথায় বিশ্বাস করে নি। ভেবেছে সব ই সাজানো গল্প। আমি তোমার মায়ের ই সন্তান--এই মিথ্যা বদনাম দিয়ে কলঙ্কিত করে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিল। এত বড় অপবাদ তোমার মা মেনে নিতে পারে নি। স্বামীর প্রতি বিশ্বাস টাই নষ্ট হয়ে যায়। তাই নিজে সেলাইয়ের কাজ করে, একটা প্রাইভেট স্কুলে মাস্টারি করে আমাকে নিয়ে থেকে গেল। লুকিয়ে লুকিয়ে তোমার সব খবর নিত। তোমার মা এত টা খারাপ ছিল না। আমাকে মানুষ করতেই সংসার ছাড়তে হলো। আমি মা বলেই ডাকতাম। মা বলে, মানুষের মাঝে দাঁড়িয়ে মানুষের সেবা করায় শ্রেষ্ট কর্ম। কর্ম ই ধর্ম।
মারা যাবার সময় সব কথা জানিয়ে ছিল। তোমার জন্য কত কেঁদেছে। একবার দেখতে চেয়েছিল। তবু এবাড়িতে আর ফিরতে পারে নি। আর অভিমান করে থেকো না মায়ের ওপর। তোমার মায়ের পুরানো আলমারী পরিস্কার করতে গিয়ে একটা ছবি দেখেছিলাম। তোমার সাথে তোমার মায়ের। সেদিন ই বুঝতে পারি "তুমি কে?
আমাদের মা আজো শান্তি পাচ্ছে না। তুমি না ক্ষমা করলে। উনি মারা যাবার পর আমার এক পাতানো মাসির কাছে চলে যাই। সেখান থেকেই বিয়ে হয় আমার। জলের মতো পরিস্কার হয়ে গেল সব।
মায়ের ফোটোর সামনে দাঁড়িয়ে গড়িয়ে পরল অশ্রুকনা। মায়ের ফোটোতে মালা পড়িয়ে প্রণাম করল দুজনে।
মায়ের স্মৃতি গুলো ভেসে ওঠে চোখের সামনে। কাকু নারী জাতির প্রতি সব রাগ নিমেষে বদলে গেল কাকিমার ভালোবাসায়।
ছবিঋণ- ইন্টারনেট ।