গল্প।। বাতিকগ্ৰস্ত পিসির কবলে ।। পৃথা চট্টোপাধ্যায় ।। কথাকাহিনি ২৬; ১লা এপ্রিল ২০২১;
"শাঁখের করাত"বলে একটি প্রবাদ বাক্য আছে যার মানে 'উভয় সংকট', আমার এই অবস্থা হয়েছে আমারই একমাত্র দাদার বিয়েতে, একদিকে আমার বাতিকগ্ৰস্ত পিসি আর অন্যদিকে আমার মর্ডান গার্লফ্রেন্ড এই দুই ভালোবাসার মানুষ নিয়ে আমার নাস্তানাবুদ হবার গল্প শুনুন তাহলে।
আজ আমার দাদার বিয়ে কিন্তু আমি কাল থেকে শয্যাশায়ী।ছোট ভাই হিসেবে আজ আমার গায়ে হলুদ নিয়ে যাবার কথা ছিল কিন্তু আমার একমাত্র পিসি আমার এই হাল করেছে।পিসি কালকেই ঢুকছে বাড়িতে আর কাল থেকেই বলছে কাশী চলে যাবে, গৃহত্যাগী হয়ে যাবে, এত অনাচার নাকি তার সহ্য হচ্ছে না।আমি এটাই ভাবছি যে এখনও যাচ্ছে না কেন?
দাদার বিয়ে ঠিক হতেই বাবার আমার উপর সর্বপ্রথম দায়িত্ব যে গ্ৰামের বাড়ি থেকে পিসিকে নিয়ে আসতে হবে।আমরা দুই ভাই।আমি ছোটো, বাবা আর মা বর্তমান। বাবার চাকরির সুবাদে আমরা ছোটো থেকে কোয়ার্টার লাইফে মানুষ। দাদুর গ্ৰামের বাড়িতেই পিসি থাকে।আমরাও ব্যস্ততার খাতিরে খুব কম যাতায়াত করি, তবে বেশ মনে আছে ছোটবেলায় স্কুল ছুটি থাকলেই গ্ৰামের বাড়িতে যেতাম।সামার- ভ্যাকেশনে গিয়ে গাছ থেকে আম পেড়ে খেতাম, পুকুরে নামতাম, সারা বিকেল মাঠে খেলা করতাম, হনুমান তাড়াতাম,পাখির বাসায় হাত দিতাম আরও কতকিছু করে দিনগুলো আনন্দের সাথে কেটে যেত।কিন্তু গ্ৰামের মানুষ বলে পিসি চিরকালই ভীষণ বাতিকগ্ৰস্ত।আমার মা দিল্লির মেয়ে,গ্ৰামের এইসব আচার-বিচার অত মানতে পারে না, জানেও না, তাই চিরকালই একটা 'কোল্ড ওয়ার' (cold-war) চলে পিসি আর মায়ের মধ্যে।তাতে অবশ্য বাবার ভূমিকা বিশাল।আমার বাবা হল কনট্রোলার।বলা যেতে পারে 'ইউ-এন' মানে 'united nations' বাংলায় 'রাষ্ট্রপুঞ্জ'।যাতে বিশ্বযুদ্ধ না লাগে তাই দুতরফেই সদ্ভাব বজায় রাখার রোলটা বাবাই করে। নইলে যে কোনো দিন মা ছেড়ে চলে যেত। দুতরফেই ম্যানেজ করার ধৈর্য,সহ্যশক্তি এবং বুদ্ধি ভগবান বাবাকে বোধহয় একটু বেশিই দিয়েছেন।
যাইহোক কথা মতো পিসিকে আনতে গেলাম কিন্তু সেখানে গিয়ে যে এইভাবে তিনদিন আটকে থাকবো, কে জানতো! পিসি যদি আগে থেকেই পাঁজিটা দেখে ডেট আর টাইম ঠিক করে রাখতো তাহলে আমি যেতাম আর নিয়ে চলে আসতাম কিন্তু ওখানে যাবার পর পিসি আটকে দিল।কি-ই না শুভকাজে যাচ্ছে তাই তিনদিন বাদে মানে আইবুড়োভাতের দিনটাই একদম ঠিকঠাক বাড়ি থেকে বেরোনোর জন্য।এদিকে দাদা আর মায়ের তো খুব রাগ হয়েছে। বাবার কিছুই করার নেই, পিসির কথা না মানলে পিসি আবার রাগ করে বিয়ে বাড়িতেই আসবে না।পিসি হল নিঃসন্তান বাল্যবিধবা, পিসি তাই দেশের বাড়িতেই থাকে, জমি-জায়গা-সম্পত্তি সমস্ত কিছু পিসিই দেখাশোনা করে।এই যে তিনদিন আমায় আটকে দিল,আমার অবস্থাটা বুঝতে পারছেন? বাতিকগ্ৰস্থ পিসির সাথে থাকা আর জেলখানায় থাকা একদম এক ব্যাপার।
অবশেষে তিনদিন পর সেই দিন এলো,আমি মুক্তি পাব পিসির হাত থেকে। পিসি পাঁচখানা পোটলা আমার গাড়িতে তুলে দিল আর গোটা গাড়ির ভিতরে একগাদা গঙ্গাজল ছড়িয়ে দিল।আমারতো রীতিমতো কান্না পাচ্ছিলো কিন্তু কোনোরকমে নিজেকে কনট্রোল করলাম।তারপর গাড়ির গীয়ারে জাস্ট হাত দিয়েছি পিসি একবার আমায় নামালো তারপর বড়ো বড়ো দুটো গঙ্গাজলের মুখ আঁটা বালতি গাড়ির ডিকিতে তুলতে বললো। আমি বললাম---
----"আমাদের বাড়িতে গঙ্গাজল রয়েছে পিসি।"
----"তোর মাকে তো আমি চিনি, তোদের বাড়ি গঙ্গাজল থাকতেই পারে না! তোর মা তো বলে গঙ্গাজল নাকি দূষিত, হরি-হরি এ কথা শোনাও পাপ,দরকার নেই বাবা, আমি আমার একদম সরাসরি গঙ্গা থেকে তোলা গঙ্গাজল নিয়ে যাব, জানিস গঙ্গাজল ছাড়া কোনো শুভকাজ হয় না।"
মাঝরাস্তায় থামালাম গাড়ি কিন্তু পিসি কিছুতেই নামতে দিল না।বলল সাথে নাকি গোপাল আছে তাই যেখানে সেখানে নেমে খাওয়া যাবে না।আমার তো মহা জ্বালা খুব জোরে টয়লেট পেয়েছিল, তাই গাড়িতে তেল ভরার নাম করে টয়লেট আর সিগারেট দুটোই সেরে এলাম।এরপর বাড়ি আসতেই দেখলাম বাড়ির হালচাল সব বদলে গেছে, প্যান্ডেল কমপ্লিট হয়ে গেছে।বাবা আর মা এলো পিসিকে গাড়ি থেকে নামাতে।পিসি বাবাকে বললো গঙ্গাজলটা আগে আগে ছড়াতে তারপর মাকে শুদ্ধ কাপড় কিনা জিজ্ঞেস করে মায়ের হাতে গোপালের মূর্তিখানা দিয়ে চলল দরজার দিকে।আসলে পিসি বাবার থেকে বেশ খানিকটা বড়,মায়ের মতোই, পিসি কাম ঠাকুমাই বেশি আমাদের। তাই পিসিকে খুব মান্যি করে বাবা।
আমি গাড়িটা গ্যারেজে ঢুকিয়ে ঘরে ঢুকলাম।দাদার বিয়ে বলে অফিসে ছুটি নিয়েছি দশদিন, কিন্তু তার মধ্যে তিনদিন বেকার নষ্ট হল, কি আর করা যাবে! দেখলাম দাদা হলুদ পাঞ্জাবি আর সাদা পায়জামা পড়ে হবু বউদির সাথে ভিডিও কলিং করছে, আমিও তাই দেখে সানাইয়ের তালে তালে নাচতে নাচতে ঢুকলাম।কিন্তু পিসি পাথরের মেঝেতে এতো গঙ্গাজল ছড়িয়েছে যে আমি পা স্লিপ খেয়ে আর একটু হলে গঙ্গাযাত্রী হয়ে যাচ্ছিলাম।তবে কোমরে এমন আঘাত পেয়েছি যে সোজা হয়ে আর দাঁড়াতে পারিনি। কাল থেকে শুয়ে আছি।মা,বাবা আর দাদা, মাসি, দিদা, পিসি সকলেই আসছে মাঝে মাঝেই, দেখে যাচ্ছে আর সান্ত্বনা দিচ্ছে।পিসিই অবশ্য সবচেয়ে বেশি সেবা করছে কিন্তু তাতে কি, একবারও দোষ স্বীকার করছে না, পিসির কাছে এটাই নরমাল। গঙ্গাজল ঘরে-দালানে ছড়াতেই হতো, নইলে পিসির গোপাল ঠাকুর ঢুকবেন কি করে?
এসে থেকেই পিসি মাঝে মাঝেই আসছে, সেবা করছে আর মুখটা কাঁদো কাঁদো করে অভিযোগের বন্যা বইয়ে দিচ্ছে।কোথায় আমি পিসিকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাবো তা নয়, উল্টে পিসিকে আমায় শান্ত করতে হচ্ছে।আসলে পিসি আমাদের এমনিতে খুব ভালোবাসে, কিন্তু পিসির ওই বাতিকগ্ৰস্থ স্বভাবের জন্যই এতো প্রবলেম।এখন আমি নিজেকে বাবার জায়গায় বসিয়ে রেখেছি, বাবা যেভাবে বুদ্ধি করে দুদিক সামাল দেয়। একবার মা আসছে চোখের জল ফেলছে আর একবার অভিযোগের ডালা নিয়ে পিসি আসছে।শুনুন তাহলে কাল থেকে কি কি নিয়ে কোল্ড ওয়ার চলছে-----
----"কিগো পিসি কি নিয়ে গজগজ করছো? কি হয়েছে?"
----"দেখ্ না আসার পর তোর মাসিকে বললাম আমার গোপালকে তোমাদের যা যা হবে তাই দিও খেতে, ওতো বাচ্চা শিশুর মতো, যা খাই আমি ওকে একটু দিয়ে খাই।তাই বলে তাতান তোর মাসি আমার গোপালকে ডিমসিদ্ধ খেতে দেবে বল! মহাপাপ করলে রে মহাপাপ!"
----"মাসিতো শহরের মানুষ বাইরে থাকে অতকিছু বোঝেনা, তাই দিয়ে ফেলেছে।"
----"হ্যাঁ রে তোর মাসির মেয়েটা ছোটো, আমি ওটাই বলেছিলাম, তোমার মেয়ে যা যা খাবে তাই দিও,ওর মেয়ে ডিমসিদ্ধ খেতে চেয়েছিল, তাই দুটো করে একটা আমার গোপালকে….ছি-ছি-ছি,কী কান্ডরে বাবা, হরি-হরি!"
************************************************
কান্না আমারও পাচ্ছে আমার দাদার বিয়ে আর আমি এভাবে, আমার গালফ্রেন্ড অবশ্য এসেছে, কিন্তু ঘরের মধ্যে পিসিতো তাকে অ্যালাউ করছেনা সবসময়, পিসির কড়া নির্দেশ মেয়ে বন্ধু এসেছে ভালো কথা কিন্তু আমার ঘরে তার আড্ডা মারার দরকার নেই। অগত্যা ফোনটাই ভরসা।কাল বিকেলে এবার মা এল কাঁদতে কাঁদতে, আমি বললাম----
----"কিগো মা কি হলো আবার?"
----"আর বলিস কেন তাতান, খোলামঙ্গলা নিয়ে তোর পিসির সাথে একচোট হল দিদার আর আমার।"
----"কেন!"
----"তোর পিসি আগে বলবে তো বল,খোলামঙ্গলার জন্য উনুন না কি সব লাগে, খড়কুটো-প্যাঁকাটি সব নাকি নিয়ে এসেছিল।আমি আগে জানলে কিছু বলতাম না,দিদার এটা করার কথা ছিল তাই গ্যাস জ্বেলে আমরা কয়েকটা খই ভেজে নিলাম, এখন বলছে হবে না, এই বিয়েটা নাকি নিয়ম মেনে হচ্ছে না।আমি নাকি আচার-বিচার কিছুই জানিনা, দিদা নাকি আমায় কিছুই শেখায়নি, এই নিয়ে দিদার সাথে শুরু হল বিশ্বযুদ্ধ; ভালো লাগে না রে আর।"
----"ছাড়োতো ওসব, পিসি আসলে ভালোই চায় জানো, চায় যে নিয়ম মেনেই হোক,তুমি একটা কাজ করো ছাদে গিয়ে আবার একবার খোলামঙ্গলা না কি একটা বললে করে ফেল।দাদার যদি মঙ্গল হয়।"
----"তাই করি বল, দিদাকে বোঝাই তাহলে, যাতে আমার পাপানের ভালো হবে তাই এখন তোর পিসির কথা মেনেই চলি।"
----"হ্যাঁ মা, তাই করো, দাদার যদি ভালো হয়, সুখী হয় তাইতো আমাদের কাম্য।"
************************************************
আজ সকালে পিসি এল চোখ মুছতে মুছতে আমার কাছে---
----"পিসি তোমার আবার কি হলো?"
----"কী সাংঘাতিক ব্যাপার রে তাতান, তোর মা যা করলো!"
----"কি করলো আবার।আহা বলবে তো কি করেছে?"
----"আর বলিস না তাতান,সকাল থেকে ঘট ডোবানো হবে, কত তোড়জোড় দেখলাম।তারপর গায়ে হলুদের পর তোর মা ঘট ডোবাবে বলে নতুন শাড়ি পড়ল, ও-মাগো-মা! বাথরুমে গিয়ে চান করে ঘটে করে জল নিয়ে চলে এলো বলে কিনা এটাই ঘট ডোবানো, হ্যাঁরে এসব কি কথা, ঘট তো পুকুরে……"
----"ধুর, পিসি, তুমি এমন কথা বল,এখানে পুকুর কোথায় পাবে! এখানে সবাই এমনই করে।"
----"আমি থাকবো না রে এখানে, দিয়ে আসবি চল,এই বিয়ে আমি মানিনা, কি অনাচার এসব! রাম-রাম; বাথরুমে ঘট ডোবানো, বাবার জন্মে এই প্রথম দেখলাম, বেঁচে থাকতে আরও কত কি দেখব রে?"
************************************************
পিসি তো আর জানেনা, সত্যি সুস্থ থাকলে আমি এই ফাঁকেই দিয়ে আসতাম পিসিকে একেবারে কাশীতে, কারণ আমি আর দাদা খুব ভয়ে আছি, পিসি আজকেই এইসব করছে
কাল নতুন বউদি এলে তার সাথে কি নাই কি করবে! আমার দাদাটা আবার বাবার মতো রোল করতে পারে না। তার উপরে দাদাভাই আর বউদিদি একে অপরকে তুইতোকারি করে, ক্লাসমেট ছিল কিনা, বর আর বউ তুইতোকারি করছে শুনে পিসিতো হার্টফেল করবে।
কিন্তু একি আমার কি শনির দশা চলছে; জিনিয়া মানে আমার গালফ্রেন্ড ম্যাসেজ করেছে
----""আমার পক্ষে আর রিলেশন রাখা সম্ভব নয়, তোর পিসি আমাকে যা নয় তাই বলেছে, আই কান্ট টলারেট হার এনিমোর"
যাহ পিসি এটা তুমি কি করলে? কেন জিনিয়াকে ক্ষেপাতে গেলে, ও এমনিতেই পাগল, ওকে মানাতে আমার সারাজীবন লেগে যাবে, এখন মনে হচ্ছে আমার বাবা মহান, গ্ৰেট, অসম্ভব সহ্যশক্তি, যা আমার বিন্দুমাত্র নেই।দাদার বিয়েটা মিস হচ্ছে হোক, আমার বিয়েটা ভেঙে দিওনা ভগবান! আমার হয়েছে "শাঁখের করাত",পিসিকেও মুখের উপর কড়া করে জবাব দিতে পারবো না, পিসিকেও যে বড্ড ভালোবাসি। আপনারা সবাই প্লিজ আমার জন্য প্রার্থনা করুন, আমি যেন পিসি আর জিনিয়া দুজনকে সমানভাবে বজায় রেখে সংসারটা করতে পারি,এতদিনে বুঝছি সংসারে মেয়েরা যদি শক্তির উৎস হয় তবে ছেলেরা হল সহ্যশক্তি।
এই-এই কে- রে বিয়েবাড়িতে সানাইটা বন্ধ করে ব্রেকআপ সঙ্ চালিয়ে দিলি?
ছবিঋণ- ইন্টারনেট ।
---------------------
পৃথা চট্টোপাধ্যায়
ঠিকানা- সিউরী, বীরভূম,